অপঘাত – ছোট গল্প

অপঘাত

লেখকঃ আরিফ শেখ

 

আমাদের এলাকার ঠিক মধ্যখান দিয়ে চলে গেছে জয়দেবপুর টু কমলাপুর স্টেশনের সূদৈর্ঘ্য রেলরুট।সেই শৈশব থেকেই এই রেলরুট ঘিরে জড়িয়ে আছে হাজারো রকমের ভয়ানক অভিজ্ঞতা।

প্রথমবার মাত্র ৫ বছর বয়সেই সরাসরি চোখের সামনে রেলগাড়ির নিচে মানুষ কাটা পড়তে দেখেছি।

এরপরে রেলেকাটা কত লা শ যে দেখেছি, তা হিসেবের বাইরে। তখন থেকেই রেলেকাটা লা শ একবারে কাছ থেকে খুটিয়ে-খুটিয়ে দেখার একরকম বাজে সাইকো টাইপ কিউরিসিটি কাজ করত।

কিন্তু একবার এই রেলেকাটা লা শ নিয়েই ঘটে গেছে আমার জীবনের সবচেয়ে ভয়ানক রকমের একটা ঘটনা।

সময়টা ২০১৮ সালের ডিসেম্বরের শীতকাল। বন্ধুদের সাথে চট্টগ্রাম থেকে ৩ দিনের ট্যুর শেষ করে বাসায় ফিরছিলাম। গাড়ি থেকে নেমে রেললাইন দিয়ে হেটে বাসায় যাচ্ছিলাম। আশেপাশে কোনো জনমানবের চিহ্ন নেই।

একেবারে শুনশান নিরবতা। আমার হাতে মোবাইলের ফ্লাশ লাইট জ্বালানো। শুরু থেকেই কেমন যেনো একটা গাঁ ছমছম ভাব হচ্ছিল।

যা অন্যসময় কখনোই হয়নি। ভাবটা কাটানোর জন্য গান শোনা শুরু করলাম। ৭-৮ মিনিটের রাস্তা, প্রায় বাসার সামনে চলে এসেছি। আমাদের বাসা দেখা যাচ্ছে। হঠাৎ করে একটা গোঙ্গানির শব্দ কানে আসলো।

আমি শব্দ শুনে থমকে দাড়ালাম। আশেপাশে লাইট দিয়ে দেখার চেষ্টা করলাম। রেললাইনের পাশ দিয়ে একটু ঢালু এবং জঙ্গলের মতো। ভালো করে লাইট মারতেই দেখলাম আমার একটু সামনে মানুষের কাটা দুইটা পা এবং একটি হাত রেললাইনে পড়ে আছে।

গোঙ্গানির শব্দটা তখনও আছে। বুঝতে পারলাম লোকটা বেঁচে আছে। হাতের ডানপাশে জঙ্গলে লাইট মেরে দেখার চেষ্টা করলাম। দেখি একটা পুরুষ মানুষের প্রায় অর্ধেক হয়ে যাওয়া দেহ। উরুর উপর থেকে কেটে গেছে।

শুধু একটি হাত অক্ষত আছে। সাহায্যের জন্য আশেপাশে কোনো মানুষ আছে কিনা দেখার চেষ্টা করলাম, কেউই নেই। আমি একাই সাহস করে লোকটার কাছে গেলাম। লোকটা খুব জোরে-জোরে শ্বাস নিচ্ছিল। বুঝতে পারলাম হয়তো শেষ সময় পার করছেন তিনি।

লোকটা তার হাতটা একটু উঁচু করলেন। মনে হচ্ছে আমাকে ডাকছে। আমি একবারেই উনার কাছে চলে গেলাম।

সে কিছু বলতে চাচ্ছিল, কিন্তু পারছিলো না। আমি জিজ্ঞেস করলাম, ভাই আপনার বাসা কই? সে আস্থে-আস্থে ঠোট নাড়ল। আমি কিছুই বুঝলাম না। আমি বললাম, ভাই একটু অপেক্ষা করেন দেখি কোনো গাড়ি পাই কিনা, আমি মানুষ ডাকি। লোকটি তার হাত দিয়ে আমার প্যান্ট খামছে ধরলো।

আমি একটু ঘাবড়ে গেলাম। তারপরও লোকটাকে জিজ্ঞেস করলাম, ভাই কিছু বলবেন?

লোকটা ঠোট নাড়িয়ে অনেক কিছু বলছে, কিন্তু আমি কিছুই বুঝতে পারছিলাম না। আমি স্থির করলাম দৌড়িয়ে বাসায় যাই, মানুষ ডেকে নিয়ে আসি। কিন্তু লোকটা এবার আমার পা আরো জোড়ে আকড়ে ধরলেন তার হাত দিয়ে।

আমি এবার পুরোপুরিই ভয় পেলাম। আমি বললাম, ভাই পাঁ ছাড়েন, আমি লোক নিয়ে আসি।

সে না ভঙ্গিতে মাথা ঝুকাল। তারপর সে আমার দিকে কেমন একটা দৃষ্টিতে তাকাল। খেয়াল করলাম, আমি ভীষণ ঘামছি।লোকটার চোখগুলোও ভয়ানক লাগছিল। আমি তার হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করলাম।

তারপর সে আমার চোখের দিকে তাকিয়ে এক অদ্ভুত মুচকি হাসি দিলেন এবং ক্রমাগত হাসতে লাগলেন। আমি প্রচন্ড রকমের ভয় পেলাম এবং হেচকাটানে পাঁ ছাড়িয়ে জোড়ে দৌড় দিলাম।

আর আম্মুকে  জোড়ে-জোড়ো ডাকতে লাগলাম। এরপর বাসার গেটের সামনে আম্মুকে দেখে সাথে-সাথে জ্ঞান হারালাম।

চোখ খুলে দেখি সকাল। আম্মুর কোলে আমার মাথা। আম্মু কান্না করছেন। আশেপাশে আব্বু, কাকা আরো অনেকেই। আম্মু জিজ্ঞেস করল, কি হয়েছে বাবা?

চোখ বন্ধ করে মনে করলাম সবকিছু। আর তাদের রাতের সবকিছু খুলে বললাম। সবাই অবাক হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে রইল। কাকা বললেন, কী বলিস এইসব? বললাম, হ্যাঁ, লোকটা আমার পাঁ খামচে ধরছিল। কাকা বললেন, লোকটার বর্ননা দে তো!

আমি সবকিছু বললাম। কাকা উত্তর দিলেন, ভুল দেখছস তুই, এই কয়দিনে তুই এলাকায় কোনো ট্রেনে কাটার ঘটনা শুনেছিস, সেখান থেকেই কল্পনা আসছে তোর। আমি বললাম, না, চট্রগ্রাম যাওয়ার পর এলাকার কারো সাথেই আমার যোগাযোগ হয় নাই।

আর আমি ভুল দেখি নাই। আমার সব মনে আছে। তারপর কাকা যা বলল, আমি এইটা শোনার জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিলাম না।

কাকা বললেন, এই লোকটা আরও তিনদিন আগেই মারা গেছেন। যেদিন তোরা ট্যুরে গেলি এর পরের দিনই। বিকেলের দিকেও মানুষজন লোকটাকে রেললাইনে বসে থাকতে দেখেছিলো। সন্ধ্যার দিকে লোকটা ট্রেনের নিচে পড়ে মারা যান।

অবশ্য কেউ নিশ্চিতভাবে বলতে পারেন না এইটা এক্সিডেন্ট নাকি আ ত্মহ ত্যা। তবে লোকটাকে হাসপাতালে নেওয়া হয়েছিলো এবং হাসপাতালে নেয়ার একঘন্টা পর মারা যান।

 

 

{ আরো পড়ুন – পাঁচ তলা

 

( অপঘাত – ছোট গল্পটি আপনাদের কেমন লাগলো তা কমেন্ট করে অবশ্যই জানাবেন।

পরবর্তী গল্প পড়ার আমন্ত্রণ জানালাম। ধন্যবাদ।)

অপঘাত

” সমাপ্ত”