জমিদার বাড়ির রহস্য – ভয়ানক এক অভিজ্ঞতা

জমিদার বাড়ির রহস্য –

 

বাড়িটাকে যতটা ভেবেছিলাম তারচেয়ে বেশি ভয়ানক দেখতে লাগছে। আমরা চারজন বাড়িটায় প্রবেশ করার জন্য সবরকম প্রস্তুতি সেরে ফেলেছি।

চারজনের হাতে চারটা ওয়াকিটকি। প্রত্যেকের মাথায় লাইট ও ক্যামেরা লাগানো। শীতের তীব্রতা অনেক বেশি। “ভুতের বাড়ি” নামক এই বাড়িতে আমরা আজকে রাতটা অবস্থান করবো।

এর আগে আরো এরকম বেশ কয়েকটা বাড়িতে থাকার অভিজ্ঞতা পার করেছি আমরা চারজন।

যার ফলে ভয় কাজ করছে না তেমন। ওহ হে আমাদের পরিচয়টাই ত দেওয়া হলো না।

আমি ইফতেখার, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করছি। রাফি, অনিক আর টিটু, আমরা সবাই ছোটবেলার বন্ধু।  স্কুল কলেজ সব এক ই ছিল।  তবে উচ্চশিক্ষার কারণে আমরা সবাই ভিন্ন ভিন্ন শহরে অবস্থান করছি৷ টিটু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আর বাকী দুইজন প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করছে।

ছোটবেলা থেকেই আমাদের চারজনের ভুত-প্রেতের প্রতি আগ্রহ ছিল প্রবল ।

এগুলোর অস্তিত্ব আবিস্কার করা যেন আমাদের নেশার মতো ছিল৷  সেই সুবাদে কলেজে থাকা অবস্থয় বেশ কয়েকটা ভূতুরে বাড়িতে রাত কাটিয়েছি চারজন একসাথে ।

কোনোটায় অস্তিত্ব পেয়েছি কোনোটায় পাইনি। এবার শীতের ছুটিতে সবাই বাড়িতে এসেছি ।

গত পরশু বিকেলে হঠাৎ ই অনিক আমাদের সবাইকে ডাকে আর পাশের গ্রামের একটা ভূতুরে বাড়িতে রাত কাটানোর প্রস্তাব জানায়। রাফি শুরুতে হালকা দ্বিমত পোশন করলেও পরে আমাদের জোরাজোরিতে রাজি হয়ে যায়।

খোজ খবর নিয়ে জানতে পারলাম সেই বাড়িটা নাকি প্রায় শত বছরের পুরোনো।

অনিকের থেকে শুনলাম, লোকমুখে শুনা যায় জমিদার উপেন্দ্রনাথ সাজাপ্রাপ্ত আসামী দের এই বাড়ির নিচতলার বিভিন্ন কক্ষে জ্যান্ত কবর দিয়ে পাকা ইমারত তৈরী করে দিতেন।

বেশ কয়েক বছর এভাবে চলার পর জমিদারের একমাত্র মেয়ে এবং তার স্ত্রী এই বাড়িতে গলায় দড়ি দিয়ে আত্নহত্যা করে। এর পর থেকে নাকি এই বাড়ি ভূতুরে বাড়ি নামে পরিচিত।

মাঝেমধ্যেই নাকি মাঝরাতে এই বাড়ি থেকে কান্নার আওয়াজ পাওয়া যায়। স্থানীয়রা এই বাড়িকে নাকি অভিশপ্ত বাড়ি হিসেবেও চিনেন।

এখন সময় রাত ১১.৫৬, কিভাবে কিভাবে যেন জীবন থেকে আরেকটা বছর পার হয়ে গেল, টের ই পেলাম না।

হে ঠিক ধরেছেন একটু পরে আমার জন্মদিন। কিন্তু এরা হয়ত ভুলে গিয়েছে। যাই হোক এসব ছাইপাশ ভেবে কোন লাভ নেই। যে মিশনে এসেছি তা নিয়ে ভাবা যাক।

বাড়িটার ভিতরে ঢুকা মাত্রই সত্যিই যে কেও অবাক হয়ে যাওয়ার কথা। কত্ত বড় ডাইনিং। ডুপ্লেক্স সিস্টেম।

সিনেমাতে জমিদার বাড়ি যেমন দেখতে ঠিক অনেকটক ঐরকম। সত্যিই জমিদার উপেন্দ্রনাথের রুচি আছে বলতে হবে। প্রত্যেকটা জায়গায় ধুলোর মহা আস্তরণ পড়ে আছে।

আমাদের উপস্থিতিতে ভেতরে থাকা দুই একটা পাখি কিছুটা পাখা ঝাপটালো। পায়রা  হবে হয়তবা৷ যাইহোক কেওই সেই দিকে তেমন ভ্রুক্ষেপ করলাম না।

আমাদের টার্গেট হলো প্রথমে একটা আগুন জ্বালানো। বাইরে থেকে কিছু লাকরি নিয়ে এসেছিলাম।

মাঝখানে আগুন জ্বলছে আর আমরা চারজন চারপাশে বসে আছি। আগুনের আলোয় পুরো ঘরটা আলোকিত হয়ে গিয়েছে। মাথা থেকে ক্যামেরা আর লাইট টা খুলে রাখলাম৷

জমিদার বাড়ির রহস্য

ক্যামেরা সব সময়ের জন্য চালু আছে। যেন একটা কিছুও রেকর্ড হওয়া বাদ  না যায়।  কে জানে যে কোন মুহূর্তে অশরীরী কিছু একটা সামনে চলে আসল।

ক্যামেরা চালু থাকলে তা রেকর্ড হওয়ার সম্ভাবনা থাকবে৷ চারজন বসে বেশ আড্ডা দিচ্ছি। আমার আর রাফির সিগারেটের অভ্যাস না থাকলেও বাকী দুইজন বেশ প্রফেশনাল।

ওরা সগারেটের ধোয়া ওরাচ্ছে প্রানপণে। কারো মনেই তেমন ভয় লক্ষ করছি না।

হঠাৎ করেই উপর থেকে একটা কবুতর আগুনে এসে পড়ল। কিছুক্ষণের জন্য চমকে উঠেছি সবাই। আগুনটা প্রায় নিভে যাওয়ার উপক্রম হচ্ছে । টিটু একটা লাঠি দিয়ে কবুতরটাকে আগুন থেকে সরিয়ে দেওয়ার সাথে সাথে পাখিটা পাখা ঝাপটে উড়ে গেল৷

বুঝতে আর বাকি রইল না এখানে সত্যি সত্যিই কিছু একটা আছে। মনের ভিতরে অল্প একটু ভয় কাজ করছে লোক লজ্জার ভয়ে ওদের কিছু বলতেও পারছি না। তবে সবার মনেই বেশ কিছুটা খুশির জাগরণ হয়েছে । আমরা যে উদ্দেশ্যে এসেছি সেটা হয়ত সফল হবে। বহুদিন পর অদৃশ্য কিছুর সাথে মোকাবেলা হবে।

ভাবতেই গায়ে শিহরণ জাগছে। আগুন জ্বলছে আর আমরা আড্ডায় মশগুল আছি।

হঠাৎ উপরতলা  থেকে কান্নার আওয়াজ আসছে। সামান্য ভয় কাজ করছে তবে অতটাও না। ঠিক করলাম দুইজন নিচে থাকবো আর দুইজন উপরে যাবো।

আমি সবাইকে স্পষ্ট করে বলে দিলাম সবাই যেন যেকোন অবস্থায় ওয়াকিটকি চালু রাখে আর রেসপন্স করে। আমি আর টিটু উপরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম।

যাওয়ার সময় অনিক আর রাফির সাথে বুক মিলিয়ে গেলাম। সিরি দিয়ে উপরে উঠছি। বেশ উত্তেজনা কাজ করছে।  যত উপরের দিকে যাচ্ছি কান্নার শব্দের তীব্রতা তত বাড়ছে।

দুতলায় উঠার পর দেখলাম ডান বাম দুদিক থেকেই আওয়াজটা আসছে বলে মনে হচ্ছে।

টিটু বলল ও বাম দিকে যাবে আর আমি যেন ডান দিকে যাই। আমি একমত না থাকলেও দুজন একই সাথে থাকার কথা বললে ভাববে হয়ত আমি ভয় পাচ্ছি তাই আর বলিনি।

আমার সত্যিই একটু ভয় ভয় লাগছে। আমি ধীরে ধীরে এগুচ্ছি। বাড়িটা কেমন যেন প্যাচানো, মনে হচ্ছে একই জায়গায় বার বার ঘুরপাক খাচ্ছি৷ কান্নার শব্দ টা থামছেই না।

কান্নার শব্দে কষ্টের চেয়ে ভয়াবহতা স্পষ্ট৷ ওয়াকিটকি তে একে অপরের সাথে যোগাযোগ করছি অনবরত৷ হঠাৎ লক্ষ করলাম অনিক আর রাফির আওয়াজ শুনা যাচ্ছে না।

কানেকশন লস হলো নাকি কোন বিপদ হলো বুঝতে পারছি না। টিটু আর আমি ওয়াকিটকি তে আলোচনা করছি কি করা যায়।

আরেকটু এগিয়ে যেতেই হঠাৎ টিটুর চিৎকার শুনতে পেলাম। দৌড়ে গিয়ে দেখলাম টিটুর রক্তমাখা শার্ট টা পরে আছে। আশে পাশে যেন রক্তের বন্যা বয়ে গিয়েছে।

আশে পাশের রুম গুলোতে খুঁজতে লাগলাম কিন্তু কোথাও টিটুর খোজ পেলাম না।

সবচেয়ে প্রিয় বন্ধুগুলোর একটাকে বোধহয় হাড়িয়ে ফেললাম চিরতরে। বুক ফেটে কান্না আসছে।

চিৎকার করতে করতে দৌড়ে নিচের ফ্লোরে এলাম। নিচে এসে আরেকজনের কান্নার আওয়াজ শুনতে পাচ্ছি।

হে, আর কেও না রাফি হাও মাও করে কান্না করছে। অনিকের কোন খোজ নেই। কিন্তু রাফি আর অনিকের ত এখানেই থাকার কথা ছিল।

জমিদার বাড়ির রহস্য

রাফি কে জিজ্ঞেস করলাম, “অনিক কোথায়?”

রাফি বলতে লাগল ” আমরা দুইজন তোদের সাথে কমিউনিকেট করছিলাম, হঠাৎ দরজার কাছে দেখলাম একটা পায়রা নিচে পড়ে ছট ফট করছে।

আমি আগুনের পার থেকে উঠে পায়রা টা দেখতে গেলাম। যেই মুহূর্তে পায়রাটার কাছে গিয়েছি তখনই পায়রা টা উড়ে চলে গেল। পিছনে তাকিয়ে দেখি অনিক উধাও হয়ে গিয়েছে।

বেশ কিছুক্ষণ খোঁজাখুজি করেও অনিকের লাল টকটকে গরম রক্তমাখা টি-শার্ট টা ছাড়া আর কিছুই পেলাম না। তোদের সাথে কমিউনিকেট করতে যাবো তখনই দেখি তোদের কোন রেসপন্স নেই। কানেকশন লস। অনিক কি বেচে আছে নাকি তাও বলতে পারছি না।”

রাফি আমাকে জিজ্ঞেস করল ” টিটু কোথায়?” আমি বললাম “অনিকের সাথে যা ঘটেছে, টিটুর সাথে তাই ঘটেছে ”

আমি আর রাফি দুইজন ই বন্ধু হারানোর শোকে চিৎকার করে কান্না করছি। ভাবলাম বাইরে থেকে মানুষের সাহায্য চাইবো তাই দড়জা খুলতে যাবো তখন দেখি দড়জা টাও খুলছে না।

এতটা নিরুপায় আর অসহায় জীবনে কখনো হইনি। আচ্ছা আমরা দুইজন কি বেচে ফিরতে পারবো এখান থেকে.?

আজ জীবনের মায়া ত্যাগ করা ছাড়া আর কোন উপায় দেখছি না। আর এ জীবন থেকেও বা কি হবে তাই ভাবছিলাম। টিটু আর অনিকের বাবা মা কে গিয়ে কি জবাব দিবো আমরা দুইজন।

ওদের মৃ*ত্যুর জন্য সবাই আমাদেরই দায়ী করবে। সবার কথা দূরে থাক আমি নিজেকে নিজে কোন দিন ও ক্ষমা করতে পারবো না। দুইজন মিলে সিদ্ধান্ত নিলাম টিটু আর অনিক কে পুরো বাড়ি খুজবো। হয় সবাই ফিরে যাবো না হয় কেও ই না।

হঠাৎ করেই রাফির মাঝে অস্বাভাবিক আচরণ লক্ষ করছি। কথা বার্তা স্বাভাবিক না। ওর আওয়াজটাও কেমন যেন পরিবর্তন হয়ে গিয়েছে। আমি জিজ্ঞেস করলাম।

রাফি কি হয়েছে তোর।

রাফি আর বেশিক্ষণ বাচবে না। আমি তোর বন্ধুকে হ*ত্যা করবো। রক্ত খাবো তোর বন্ধুর ঠিক যেভাবে তোর বাকি দুই বন্ধুরটা খেয়েছি।

আহ! তাজা রক্তের কি স্বাদ আর ঘ্রাণ তা ভাষায় প্রকাশ করা যায় না।

আমার আর বুঝার বাকি রইল না রাফির শরীরে কিছু একটা ভর করেছে। আরো বুঝতে পারলাম সেই টিটু আর অনিক কে হ*ত্যা করে ওদের রক্ত খেয়েছে।

হয়ত রাফিকে শেষ করে আমার রক্তও খাবে। আমার চোখ থেকে অঝোরে পানি ঝড়ছে। ঠিক কি করবো বুঝে উঠতে পারছি না।

হেল্প হেল্প বলে চিৎকার করে কান্না করছি। আর চাইছি যেন কেও এসে অন্তত আমাদের দুজনকে বাঁচিয়ে নেয়। মৃত্যু হয়ত খুব কাছাকাছি। এমন পরিনতির জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিলাম না।

এসবই ভাবছিলাম। রাফি নিজের হাতে কামড় দিছে রক্ত খাবে বলে। অশরীরী টা কে আক্রমণ করার ইচ্ছে জাগছে খুব।

উপায় নেই আক্রমণ করার। তাই অসহায়ের মতো দাড়িয়ে দেখছি। আর ভয় ও আতঙ্কে কান্না করছি।

হঠাৎই লক্ষ করলাম পুরো বাড়িতে লাইট জ্বলে উঠেছে। বেলুন ফাটার শব্দ পেলাম।

বেশ কয়েকজনের সমস্বরে আওয়াজ আমার কানে ভেসে আসছে “হ্যাপি বার্থডে, হ্যাপি বার্থডে টু ইউ, হ্যাপি বার্থডে টু ইউ ডিয়ার ইফতেখার, হ্যাপি বার্থডে ফ্রম গোস্ট স্কোয়াড”

খেয়াল করলাম উপরতলা থেকে সিড়ি দিয়ে টিটু আর অনিক নামছে আর হাততালি দিতে দিতে আমাকে উইশ করছে।

সেই সাথে আমার সামনে থেকে রাফি ওদের সাথে তাল মিলাচ্ছে। এরপর সামনে আসল আমাদের আরো দুই বন্ধু সাজিদ আর তওহিদ। ওদের দুইজেনর হাতে জন্মদিনের কেক। মনে হচ্ছে আমি আকাশ থেকে পড়লাম।  আমি বোকার মতো তাকিয়ে আছি ওদের দিকে আর ওরা আমাকে দেখে হাসছে।

হাসব না কাদবো তাও বুঝতে পারছি না। টিটু আমার দিকে তাকিয়ে বলছে “বার্থডে সারপ্রাইজ কেমন দিলাম বন্ধু?”

আমি দৌড়ে গিয়ে জরিয়ে ধরলাম ওদের। আমার চোখ থেকে তখনো পানি ঝড়ছে। আমি বলতে লাগলাম

আমি ত মনে করেছি তোদের বোধহয় হাড়িয়ে ফেললাম। তোরা না থাকলে কিভাবে বাচতাম আমি? ”

যাইহোক এ ঘটনার জন্য এরপর অনেক বকেছি ওদের। জন্মদিনের কেক কাটলাম ওদের সাথে।

এরপর ওদের থেকে সব ঘটনা শুনলাম। যেসব ভৌতিক কথা এই বাড়ি সম্পর্কে শুনেছিলাম সবই নাকি ওদের বানানো ছিল আমাকে সারপ্রাইজ দিবে বলে।

সাজিদ আর তওহিদ আগে থেকেই বাড়িতে লুকিয়েছিল। দিনের বেলা এসে সব সাজিয়ে গিয়েছিল। সাসপেন্সে ভরপুর একটা রাত ছিল। শেষরাতের দিকে সবাই ঠিক যখন বাড়ি থেকে বের হয়ে আসবো তখনই উপরতলা থেকে অন্যরকম আওয়াজের একটা মহিলা কন্ঠে ভয়ংকর কান্নার আওয়াজ পেলাম।

আমি অবাক হইনি মোটেও ভাবলাম এটাও হয়ত ওদের প্ল্যান। কিন্তু ওদের চোখে মুখে অবাক হওয়ার ছাপ স্পষ্ট।

আমি এই আওয়াজ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলে ওরা সবাই বলল এই আওয়াজ সম্পর্কে ওরা কিছু জানে না। বাড়িটার গেইটে এসে দাড়িয়ে আছি আমরা। ভোর ৪ টা বাজে।

ফজরের আজান হয়নি এখনো। ভোরের আলো ফুটবে কিছুক্ষণ পরেই। রাফি আর টিটু খুব বেশি আগ্রহ দেখাচ্ছে এই আওয়াজের রহস্য খুজে বের করার জন্য।

অনিক বলল ” এমনিতেও এই বাড়িতে খুব বেশি রুম নেই। ঘুরে দেখতে বেশিক্ষণ লাগবে না। যাওয়া যায়।” রাফির কথা শুনে আমি অবাক হয়ে গেলাম৷ আমি যখন উপরতলায় উঠেছিলাম অনেক রুম দেখেছি সেখানে আর এরকম প্যাচানো বাড়ি আমি এর আগে কখনো দেখিনি। এই কথা বলতেই ওরা সবই চমকে গেল।

ওরা নাকি গতকাল এসে ভালো করে এই বাড়ি দেখে গিয়েছে আর এমন কিছু লক্ষ করিনি। আমি আরো যা দেখেছিলাম ওদের বললাম।

উপড়তলার কর্ণারের একটা রুমের সামনে ইংরেজি তে লেখা ছিল।   “You will be lost in the ocean of time if you try to find the secret of this house” ।

আর সম্ভবত আন্য কোন একটা ভাষায় কিছু বাক্য লিখা ছিল। জানতে চাইলাম এই লেখাগুলো ওরা লেখেছিল কিনা।

ওরা এক বাক্যে না বলে দিল। ওরা নাকি দিনের বেলায় এমন কিছু দেখেনি। আমি আমার মোবাইলে ওটার ছবি তুলে রেখেছিলাম। দেখালাম ওদের রাফি ইংরেজি কথাটার বাংলা ট্রান্সলেট করল।

যদি এই বাড়ি রহস্য খুজার চেষ্টা করো তবে তুমি সময়ের মহাসাগরে হারিয়ে যাবে। ” ভাবছিলাম কেমন ধরণের বাক্য এটি।

কি বুঝাতে চাচ্ছে তাও বুঝতে পারছি না। অন্য ভাষার লেখাগুলো বুঝতে পারলে হয়ত জানা যেত কিছু। ওরা তিনজন বাড়িটার কর্নারের ঐ রুমটার ওখানে আবার যেতে চায়।

আর সাজিদ আর তৌহিদ কোনমতেই রহস্য ভেদ করতে রাজি নয়। ওরা এ বাড়িতে আর থাকতে চায় না।

একটু আগে কি মানষিক প্রেশারটাই না গেল আমার উপর। রহস্য টা ভেদ করতে ইচ্ছে করছে খুব। হয়ত টাইম লুপ বা এরকম কিছু হতে পারে।

কিন্তু কান্নার শব্দের রহস্যটা ত অশরীরী কিছু একটা হবে হয়তবা। ওদের বারণ করা সত্বেও শুনছে না৷ আমি চলে গেলেও দিনের আলো ফুটলে ওরা তিনজন আবার বাড়ির ভিতর ঢুকবে।

রহস্য ভেদ করার নেশা পেয়ে বসেছে ওদের। আমিও রহস্য ভেদ করার সুযোগ হাতছাড়া করি কি করে। যোগ দিলাম ওদের সাথে। ততক্ষণে আওয়াজ টা হাওয়ায় মিলিয়ে গিয়েছে।

আমরা চারজন আস্তে আস্তে বাড়ির ভিতর প্রবেশ করছি। রাত ফুরিয়ে গেছে তাই ভয় কাজ করছে না তেমন।  অশরীরীরা দিনের বেলায় শক্তি হারিয়ে ফেলে বোধহয় তাই হয়ত ভয় কাজ করছে না।

 

দড়জা দিয়ে প্রবেশের সাথে সাথেই মহিলা কন্ঠের কান্নার আওয়াজ টা বন্ধ হয়ে গেল।

ঘরের বিভিন্ন জায়গা দিয়ে ভোরের আলো ভিতরে প্রবেশ করছে। কিছুটা আলোকিত দেখাচ্ছে ঘরটা। আমরা উপরতলায় উঠা শুরু করলাম। উপরতলায় উঠে আমি বেশ অবাক হচ্ছি।

বাড়িটা রাতের মতো আর প্যাঁচনো লাগছেনা। মাত্র কয়েকটা রুম সারিবদ্ধ ভাবে দেখা যাচ্ছে। ভাবলাম কর্ণারের রুমটার কাছে যাই যেখানে ঐ লেখাগুলো ছিল।

যেই ভাবা সেই কাজ।  গেলাম সেখানে।  তবে রাতের মতো আর কিছুই দেখতে পেলাম না। দেয়ালটা একদম পরিস্কার কোনরকম কিছু লেখা নেই দেয়ালে ।

আমাদের বুঝতে আর বাকি রইল না যে এই বাড়িতে যদি কিছু অদ্ভুত বা অ*শরীরী থাকে তবে সেটা রাতে ছাড়া দেখা যায় না। রহস্য সমাধান করার নেশা যেন আমাদের পেয়ে বসেছিল।

আমরা তখন ঐ বাড়ি থেকে চলে আসি। সিদ্ধান্ত নেই যে আজ রাতে আবার আসবো। রহস্য খুজে বের করেই ছাড়বো। তার আগে গ্রামবাসীদের থেকে ভালো করে এই বাড়ি সম্পর্কে খোজ নিতে হবে। আমরা তাই করি।

সারাদিন পুরো গ্রামে ঘুরে ঘুরে এই বাড়িটা সম্পর্কে খোঁজ নেই। অনেক কিছু জানতে পারি বাড়িটা সম্পর্কে। এটা সত্যিকার অর্থেই ইংরেজ আমলে এক বিশাল জমিদার বাড়ি ছিল।

এখানকার জমিদার ছিল উপেন্দ্রনাথ যিনি বেশ ক্ষমতাধর ছিলেন। উনি বিয়ে করেছিলেন ইংরেজ প্রভাবশালী পরিবারের এক মেয়েকে। শোনা যায় এই জমিদারের আয়ত্তে নাকি অনেক ভুত আত্না ছিল৷

আরো অনেক তথ্য জানলাম এই জমিদার এবং বাড়িটা সম্বন্ধে। আরো জানতে পারি যে বাড়িটাতে একটা গোপন কক্ষ আছে যার রহস্য জমিদার তার স্ত্রী কে পর্যন্ত জানায়নি।

সবকিছু ঠিক ঠাক ই ছিল। শোনা যায় হঠাৎ কোন একদিন জমিদার হারিয়ে যায়। প্রাসাদ থেকে উধাও হওয়ার কিছুক্ষণ আগে পর্যন্ত তাকে সুস্থ সবল দেখা গিয়েছিল।

কেও কেও বলেছেন জমিদার তার গোপন কক্ষে গিয়ে আর ফিরেন নি আবার কেও কেও বলেন জমিদারের আয়ত্তে থাকা অ*শরীরী রা তাকে নিয়ে গেছে কোন এক জায়গায়।

এর মধ্যে আমার মোবাইল থেকে অন্য ভাষায় যে লেখাটা ছিল তা নিয়ে একটু ঘাটাঘাটি করে বুঝলাম ঐটা জাপানিজ ভাষা। যার বাংলা অনুবাদটা ছিল

” সময়ের জগতে স্বাগতম। সময় সর্বদা আপন গতিতেই চলে। সময়ের আবর্তন সম্ভব নয় তবে নিজের আবর্তন সময়ের সাপেক্ষে সম্ভব”

আজ রাতে ঐ বাড়িটায় পা ফেললে হয়ত রহস্যের জট কিছুটা খুলবে। এসব বাক্যের অর্থগুলোও বুঝতে পারবো আমরা।

যাইহোক আমরা আজ রাতে আবার অভিযানে যাচ্ছি রহস্য ভেদের উদ্দেশ্যে। আশা করছি খালি হাতে ফিরবো না।

তখন সময় রাত ১১ টা৷ আমরা বাড়িটায় ঢুকতে শুরু করলাম। প্রত্যেকের মাথায় ক্যামেরা আর টর্চ লাগানো আবার হাতেও একটা করে টর্চ আছে।

জমিদার বাড়ির রহস্য

আমার ভয় লাগছে বেশ। আগের দিনের মতো একই রকম প্যাচানো রুমগুলো। বেশ কিছুক্ষণ খোঁজার পর কর্ণারের ঐ রুমটা খুজে পেলাম। দেয়ালে লেখাগুলো ঠিক প্রথম রাতের মতোই আছে।

আমরা রুমটায় ঢুকতে যাবো তখনই লক্ষ করলাম রুমের দড়জা আটকানো। সম্ভবত আগেকার যুগে যেসব পদ্ধতিতে সিন্দুক লাগানো থাকতো সেই পদ্ধতি তে লাগানো৷

এনালগ পদ্ধতিতে ৪ সংখ্যার একটা কোড না দিলে অথবা নির্দিষ্ট চাবি ছাড়া এই দড়জা হয়ত খুলবে না।

দড়জা ভাঙতে চেষ্টার কমতি রাখিনি কিন্তু কাজ হয়নি। কিছুটা হতাশা আসছে মনে। এই দড়জা খুলতে পারলেই হয়ত অনেক রহস্য ভেদ করা যেত।

কিন্তু এই দড়জা ভাঙা অসম্ভব সেটাও বুঝতে পেরেছিলাম। হঠাৎ ঐ মহিলার আওয়াজ কানে ভেসে আসল।

হে, শুধু আমি না বাকি তিনজনও শুনতে পাচ্ছে। ভয় লাগছে কিছুটা। এগুতে থাকলাম ঐ আওয়াজের দিকে।

কিন্তু ঠিক বুঝে উঠতে পারছি না কোথা থেকে আসছে। একে একে সবগুলো রুম খোঁজা শেষ। কোথাও খুঁজে পেলাম না।  আওয়াজ টা অনবরত কানে আসছেই।

নিচের। ওর কিছু রুম দেখা বাকি ছিল। ঐগুলোর দিকে পা বারালাম। এবার কান্নার আওয়াজটা তীব্র হচ্ছে।

কি ভয়ং*কর কান্নার আওয়াজ ছিল তা বলে বুঝানো যাবে না। বামপাশের কর্নারে একটা ছোট রুম দেখতে পেলাম। সম্ভবত কিচেন ছিল। তার পাশের রুমটায় প্রবেশ করতেই চমকে উঠলাম সবাই। আওয়াজ টা এই রুম থেকেই বের হচ্ছে।

টর্চ টা রুমে পরতেই এাকটা কালো কুচকুচে বিড়াল দেখতে পেলাম। ওর চোখ দেখে মনে হচ্ছে এই বুঝি আক্রমন করে বসবে। কান্নার আওয়াজ সহ্য করতে পারছি না আমরা।

রুমটার ভিতরে ঢুকে ভালো করে সব দেখবো তার উপায়টাও হচ্ছে না। আমার হার্টবিট যেন ক্রমশই বেড়ে চলেছে।

সহ্য করতে না পেরে রুম থেকে বেড়িয়ে এলাম আমরা। কিছুক্ষণ পর কান্নার আওয়াজ টা থামল। আমরা খুব সাবধানে রুমটায় প্রবেশ করলাম। বিড়ালটা তখনও রুমের ভিতরেই আছে।

বিড়ালটা সম্ভবত একটা বইয়ের উপর বসে আছে। পুরো ঘর মাকর্সার জালে ছেয়ে আছে। ঘরের সবগুলো জিনিসপত্রেই ধুলোর মহা আস্তরন পরে আছে।

একটা লাঠি নিয়ে বিড়ালটাকে বাইরে বের করে দেই। বইটা হাতে নিয়ে দেখলাম বইটা বেশ মোটা৷ দেখেই বোঝা যাচ্ছে উনিশ শতকের বই। বইয়ের উপরের ধুলো সরালাম।

বইয়ের নাম দেখে অবাক না হয়ে পারলাম না। বইটার কভার পেইজে লেখা ” SECRET KEY”।

কাল বিলম্ব না করে বইটা খুললাম। খেয়াল করলাম বইটা খুলতেই পুরো বাড়ি জুরে কম্পন শুরু হলো। যেন ভূমিকম্প হচ্ছে। আবারও সেই মহিলা কন্ঠ ভেসে আসল কানে।

তবে এবার আর কান্না নয় অট্টহাসি হাসছে। যেন মুক্তির হাসি। তবে কাওকে দেখা যাচ্ছে না। এমন অদৃশ্য বিদঘুটে হাসির মুখোমুখি হলাম জীবনে এই প্রথমবারের মতো ।

টিটু জিজ্ঞেস করল “কে?”

হাসি থামিয়ে উত্তর দিল ” আমি জমিদার উপেন্দ্রনাথের প্রধান চাকরানী লতা রাণী। আমি ৭০ বছরেরও বেশি সময় ধরে এই বইয়ের ভিতর বন্দি ছিলাম। তোমরা আমাকে মুক্ত করলে আজ। ”

আমাদের মধ্যে রাফি একটু ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করল ” আপনাকে কে আর কেন এই বইয়ের ভিতর বন্দী করেছিল? ”

অদৃশ্য মহিলাটা বলা শুরু করল-

” তবে শুনো বলছি তোমাদের, জমিদার উপেন্দ্রনাথ বেশ ক্ষমতাধর, শিক্ষিত ও জ্ঞানী ছিলেন। যার কারণে ইংরেজ শাসকদের সাথে তার সম্পর্ক বেশ ভালো ছিল।

প্রতি সপ্তাহেই বড় বড় সাহেবরা জমিদারদের সাথে দেখা করতে আসত। তবে ঠিক কি জন্য আসত তা জানত না কেওই।

আমি কাজ করতে করতে কোন একদিন তাদের মিটিংয়ের কিছু কথাবার্তা শুনে ফেলি। আমি জানতে পেরে যাই যে পুরো বাংলার সংস্কৃতি আর ঐতিহ্যকে বাতিল করে পাশ্চাত্য সংস্কৃতির প্রসার কিভাবে ঘটানো যায় তার মূল পরিকল্পনা গুলো হয় এই বাড়িতে।

এ জন্যই সাহেবরা এখানে এতো বেশি আসেন৷ তাছাড়া এ কাজ বাস্তবায়নের জন্য জমিদার তাদেরকে তার আয়ত্তে থাকা অদৃশ্য শক্তি দিয়েও তাদের সাহায্য করেন৷

আমি এসব কিছু জেনে গেছি তা জমিদার জেনে যায়। লোকমুখে যেন এই কথাগুলো না ছড়িয়ে যায় সেইজন্য তিনি প্রথমে আমাকে হ*ত্যা করেন তারপর তার অদৃশ্য শক্তিগুলোর সাহায্যে আমার আত্নাকে একটি চাবি সমেত এই বইয়ের ভিতর বন্দী করে রাখেন।

এরপর থেকে আমি বন্দী। এর আগে আরো কয়েকজন এই বই খুলার চেষ্টা করেছে তবে যারা চেষ্টা করেছে সবাই পাগল হয়ে গিয়েছে। ”

কথাগুলো শুনছিলাম আর অবাক হচ্ছিলাম। তবে চাবির কথা শুনে মনে কিছুটা প্রশান্তি জেগেছিল।   ঐরুমটার চাবি হবে হয়তবা৷ এরপর আমি সময় কেন্দ্রিক দেয়ালে লেখা ঐ বাক্যগুলো সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলে তিনি উত্তরে বললেন-

“জমিদার উপেন্দ্রনাথ বিলেত থেকে পড়াশুনা করেছিলেন। শুনেছি উনি অতীতে বা ভবিষ্যতে যাওয়া নিয়ে গবেষণা করতেন অনেক। তার গবেষণা কক্ষে প্রবেশ নিষিদ্ধ ছিল।

তাই কেও কিছু বলতে পারত না এ সম্বন্ধে । দুতলায় কর্ণারের কক্ষটা ছিল তার ঐ গবেষণা কক্ষ। তাছাড়া এ বাড়ির যে গোপন কক্ষের কথা বলা হয় তার রহস্যও নাকি ঐ রুমেই আছে। দুইজন ইংরেজ বিজ্ঞানী অনুমতি ছাড়া গবেষণা কক্ষে ঢুকে পরেছিল।

এরপর জমিদার ঐ দুইজনকে তৎক্ষনাৎ হ*ত্যা করেছিলেন। এ নিয়ে ইংরেজ শাসকরাও কিছু বলার সাহস পাইনি । কারণ জমিদারের কাছে অশরীরী রা ছিল তা সবাই ই জানত। ”

এবার উনি থামলেন। আর কোন সারা শব্দ পাইনি তার। বইটা আরেকটু খুললাম।  হে কিছু পাতা খোদাই করে চাবিটা সুন্দর করে রাখা আছে।  আমরা চাবিটা নিয়ে উপরে যেতে লাগলাম ঐ কর্নারের রুম অর্থাৎ গবেষণা কক্ষ খোলার উদ্দেশ্যে।

এই চাবিটাই ঐ কক্ষের চাবি কি না এ ব্যাপারে আমরা কেওই নিশ্চিত নই।

 

লেখায়ঃখালিদ_সাইফুল্লাহ

 

 

{ আরো পড়ুন – মধ্য রাতের ট্রেন 

( জমিদার বাড়ির রহস্য গল্পটি আপনাদের কেমন লাগলো তা কমেন্ট করে অবশ্যই জানাবেন। পরবর্তী পর্বের জন্য আমাদের সাথেই থাকুন । ধন্যবাদ।)