জ্বীন যাত্রা – ছোট গল্প

জ্বীন যাত্রা

লেখকঃ  শাওরিন শাওন এনি

 

২০১৭ সালে আমার বিয়ে হয়। বিয়ের পর নতুন জীবনে সব স্বাভাবিক  ও সুন্দরভাবেই যাচ্ছিলো। তবে লোকে বলে, বেশি খুশি বেশিদিন থাকেনা। হলোও তাই।

একদিন মাগরিব এর ওয়াক্ত এর সময় আমি আমার হাজব্যান্ড’কে বলি যেনো তিনি নামাজ থেকে ফেরার পথে আমার জন্য পুরি আর চা নিয়ে আসেন। আমিও নামায পড়ে  অপেক্ষায় থাকবো; এরপর দুজন খাবো। কথামতো উনিও নিয়ে আসেন। উল্লেখ্য, পুরিগুলো বেশ ফুলকো থাকায় উনি প্যাকেট আলতোভাবে না লাগিয়ে এনে সেভাবেই রেখে দেন, যেনো সেগুলো চুপসে না যায়। এরপর দুজনে নাস্তা করার পর উনি বাইরে চলে যান।

হঠাৎ আমার বেশ গরম ও অস্বস্তি লাগতে শুরু করলো। কেনো যেনো মনে হচ্ছিলো সেই ভাজা খাবারগুলো খাওয়ার জন্য এমন হচ্ছিলো। নিজেকে শান্ত রাখতে চেষ্টা করেও ব্যার্থ হলাম; অস্থিরতা যেনো ক্রমান্বয়ে বাড়ছিলো আমার। একপর্যায়ে আমি উনাকে ফোন করে বলি যেনো তিনি দ্রুত বাসায় ফিরেন।

উনি ফেরার পর গল্প করে সময় কাটাতে চেষ্টা করলাম যেনো ভেতরকার যন্ত্রণা ভুলে থাকি। তবে না। আমার অস্থিরতা ও অসুস্থতা এমনভাবে বাড়তে থাকে যে একপর্যায়ে আমি জ্ঞান হারাই।

আমার শাশুড়ি আমায় শুশ্রূষা করতে থাকেন। বাসায় ডাক্তার আনা হয়। তিনি পরিক্ষা করে দেখেন আমার প্রেশার ঠিক আছে কি না। ঠিকই ছিলো। তবে অজানা কারণে আমার মুখ সহ পুরো শরীর একদম লাল বর্ণ ধারণ করতে শুরু করে। উল্লেখ্য, সেই ডাক্তার কিছুটা ধার্মিক ধরণের ছিলেন।

তখন তিনি একটা গ্লাস আনতে বলেন। এরপর সেটায় ফুঁ দিয়ে ঐ পানি আমায় খাওয়ান ও শরীরে ছিটিয়ে দেন। এরপর আমি ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হতে শুরু করলে ডাক্তার চাচা বলেন, আমার অন্য সমস্যা আছে, আমাকে যেনো দ্রুত বড় হুজুর দেখানো হয়। তারপর তিনি চলে যান।

তারপরদিন একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি হওয়ার পর একজন হুজুর আনা হয় বাসায় ও তারপর আমি আবারো সুস্থ হই। এরপর থেকে আমি যখন খেয়াল করি, আমি তেলে ভাজা বিশেষ কিছু খাবার খেতে পারতাম না, তখন থেকে ওসব খাবার বন্ধ করে দেই। বলে রাখা ভালো, বিশেষ সেই খাবারগুলো খাওয়ার পর আমি অসুস্থ তথা জ্ঞান হারালে মাথায় পানি ঢাললেও হুশ ফিরতোনা, বরং হুজুর তথা ধর্মীয় পদ্ধতি প্রয়োগ করতে হতো।

এরপর একদিন… সেদিন সাধারণ দিনের মতোই নিজের ঘরে ঘুমিয়ে ছিলাম আমি। হঠাৎ খেয়াল করলাম কেউ আমার মুখ চেপে ধরলো, আমি হাত ও শরীর ও নাড়াতে পারছিলাম না।

যেনো আমি শরীরের উপর পাথর মতো ভারি কিছুর ভর অনুভব করতে পারছিলাম। এরপর আমি এবিউজ এর স্বীকার হই উক্ত অদৃশ্য বস্তটির দ্বারা। মুক্ত হয়েই চিৎকার দিয়ে জ্ঞান হারাই আমি।

 

{ আরো পড়ুন – আবারো রবিবার!! – ছোট গল্প

 

পরিবারের মানুষজন আমার চিৎকার শুনে ঘরে এসে আমাকে পরে থাকতে দেখে প্রাথমিক চিকিৎসা ও পানি ঢেলে স্বাভাবিক করে। এরপর সবাইকে বিষয়টা জানাই আমি। তারাও চিন্তিত হয়ে পড়েন। তারা শুরু করেন হুজুর ও কবিরাজ খোঁজ করা। অনেকের শরণাপন্ন হই। তবে কেনো যেনো লাভ হচ্ছিলোনা খুব একটা।

দিনের বেলা ঘুমালেই যেনো এসব সমস্যার সম্মুখীন হতাম। অবশ্য রাতের বেলা, আমার স্বামী সাথে থাকার সময় কখনোই এরকম হতোনা।

এভাবে চলে গেলো পুরো এক বছর। একবছরে শত চেষ্টা করেও নিজের থেকে ছাড়াতে পারছিলাম না এই খারাপ জ্বীনটাকে। তারপর আমি প্রেগন্যান্ট হই। অপ্রত্যাশিতভাবে আমার বাচ্চাটা আর দুনিয়ার আলো দেখে না। পাশাপাশি অশরীরি’র নোংরামো কিছুতেই বন্ধ হচ্ছিলোনা। বরং আমি একা ঘরে থাকলেই আমার ঘারে, কোমরে সুড়সুড়ি দিতো, গালে স্পর্শ করতো। কিছুদিন পর আমি আবার প্রেগন্যান্ট হই।

ভাগ্যের কি নির্মম পরিহাস, এবারও আমার মিসক্যারেজ হয়। মানসিকভাবে প্রচন্ড ভেঙে পড়ি আমি ও আমার স্বামী দুজনেই। আল্লাহ্‌’র কাছে কান্নাকাটি করতে থাকি।

২০২০ সালে শেষ অব্দি আমি একটা পুত্রসন্তান লাভ করি, আলহামদুলিল্লাহ্‌। ঘটনা অবশ্য এখানেই শেষ নয়। ছেলের জন্মের ১ বছর অব্দি ঐ জ্বীন কিংবা অশরীরী কোনো সমস্যা না করলেও তারপর আবারো শুরু হয় তার উৎপাত।

দেখা যাচ্ছে, দুপুরে যোহরের নামাজ পড়ে ঘুমালে আসরের নামাজের জন্য আবারো গোসল করতে হতো। আমি পুরোপুরি বিরক্ত হয়ে যাই সবকিছুর উপর। উল্লেখ্য, এবারে এদের ডিস্টার্বের ধরণ পরিবর্তিত হয়েছে। আগেরবারের মতো স্বজ্ঞানে এবিউজ না করলেও এবার আমার স্বপ্নের মধ্যে এধরণের সমস্যা করতে থাকে। এবং তারপর আমার ঘুম ভেঙে গেলে পুরো শরীরেই ব্যাথা অনুভব করি, শরীর ভারি লাগে।

এরপর শুরু হয় আমার ফেমিনিন সাইকেলে’র সমস্যা – যা আগে কখনোই ছিলোনা। ডাক্তার দেখিয়েও লাভ হয়নি। এদিকে দিনে দু-তিনবার গোসল করতে করতে আমি জ্বর – ঠান্ডায় অসুস্থ।

সব মিলিয়ে আমি আবারো ভেঙে পড়ি। আমার পরিবার এ সময়টায় আমায় অনেক হুজুর দেখাচ্ছিলেন, তবে কাজ হচ্ছিলোনা। জ্বীন সম্পর্কেও কিছু জানতে পারছিলাম না। উল্লেখ্য, হুজুর কিংবা কবিরাজ দেখানোর সময়ে আবার অন্যরকম সমস্যা হতো। যেমন আমি কোনো কবিরাজ এর কাছে যাওয়ার নাম নিলেই হয় আমি অসুস্থ হয়ে যেতাম, নয়তো ঐ কবিরাজ অসুস্থ হয়ে যেতো। যাকে বলে, কাজে বাধা পড়া।

তারপর আমার এক বান্ধুবি একজনের সন্ধান দেয়, যিনি নাকি জ্বীন পালন করেন এবং তাদের দ্বারা মানুষের উপকার করেন। আমি অবশ্য উনাকে আগে থেকেই চিনতাম, তবে জানতাম না উনি এসব ব্যাপারে পারদর্শী।

উনার সাথে যোগাযোগ করা হলে আমি উনাকে ঘটনার বিশ্লেষণ করার আগে উনি নিজেই কিভাবে যেনো সব বলে দেন। আমি নতুনভাবে জানতে পারি, আমার সাথে একটা না, বরং দুইটা জ্বীন আছে, যারা দৈত্য জ্বীন। উনি আরো বলেন, জ্বীন আগুনের তৈরি হওয়ায় তারা আমার আশেপাশে থাকলে আমার শরীর গরম থাকতো, হাত-পা জ্বালাপোড়া করতো। এরা আমায় এবিউজ করার কারণেই নাকি আমার গর্ভাশয় পুরে গেছে ও ফেমিনিন সাইকেলে সমস্যা হতো। লোকটা আমায় আরো জানান, এই জ্বীন দ্বয়ই আমার আগের দুটো বাচ্চাকে নষ্ট করেছে।

সবকিছু জানার পর উনাকে অনুরোধ করলাম যেনো যেভাবেই হোক আমাকে এসব থেকে মুক্তি দিতে। উনি আমাকে খাওয়ার জন্য কিছু ওষুধ দিলেন আর গোসলের জন্য কিছু ওষুধ দিলেন। তিনি আরো জানান, এই দুটো কাজেও যদি এরা আমায় না ছাড়ে তখন তিনি তাদের বন্দি করবেন। পাশাপাশি তিনি এও জানান, আমি তাদের স্বপ্নে দেখতে পারি, তবে তারা আমার কাছে আসতে পারবেনা ও ওষুধগুলো দিয়ে গোসল করলেও তারা অনেক বাধা দিবে।

আমি উনার দেয়া বিশেষ ওষুধগুলো খাওয়ার পর থেকে উনার কথামতো স্বপ্নে দেখতে লাগলাম দুটো অবয়ব’কে, যারা শুধু দূরে দাঁড়িয়েই থাকতো, আমার কাছে আসতে পারতোনা। আর উনার দেয়া ওষুধগুলো দিয়ে গোসল করার সময় খেয়াল করতাম আমি গোসলে ঢুকলেই নানা সমস্যা হতে থাকতো।

যেমন বাথরুমের দরজা বাইরে থেকে জোড়ে জোড়ে নক করতেই থাকতো; অথচ ঘরে কিন্তু কেউ নেই! নক শুনে দরজা খুলেও কাউকে দেখতাম না। আবার ছেলে নিয়ে ঘুমিয়ে থাকা অবস্থায় একবার শুনি পুরুষ কন্ঠে কেউ যেনো বললো, “বেরিয়ে যা!” আমি সাথে সাথে জেগে যাই। জেগে দেখি সব স্বাভাবিক। ভাবতে থাকি মনের ভুল। কিছুক্ষণ পর আবারো কিছু একটা শব্দ শুনতে পেলে আমি ছেলেকে নিয়ে দ্রুত রুম থেকে বেরিয়ে যাই।

দীর্ঘদিন এভাবে চলতে চলতে কেমন অভ্যস্ত হয়ে গেছি সবকিছুর সাথে। এখন আর ভীষণ ভয়ঙ্কর ব্যাপারগুলোর সাথেও খুব একটা ভয় কাজ করেনা।

সবশেষে হাজবেন্ডকে বলার পর আমাকে আবারো ৭ দিনের ওষুধ এনে দেয়। এবার বলে দেয়া হয়, শুরুর তিন দিন আমাকে অনেক বেশি বিরক্ত করবে। হয়েছেও তাই। এরপর আরো ভয়ঙ্কর ব্যাপার ঘটলো যিনি আমায় ওষুধ দিয়েছিলেন, তার সাথে। অশরীরী যেয়ে মোচর দিয়ে তার হাত ভেঙে আসে। উনি আবার নিজ ও নিজের পোষা জ্বীনের সহায়তায় কিছুটা সুস্থ হয়। এরপর ৭ দিন শেষে আমিও সুস্থ হয়ে যাই।

এখনও মাঝে মাঝে ঐ জ্বীন দুটো আমার স্বপ্নে আসলেও কিছু করতে পারেনা। আমি এদের থেকে এখন সম্পূর্ণ মুক্ত। আমার ফেমিনিন সাইকেল এর সমস্যা ও পেট ব্যাথা’ও পুরোপুরি ভালো হয়ে গেছে।

শেষ হয় অশরীরী’দের সাথে আমার যাত্রা।

 

 

( জ্বীন যাত্রা – ছোট গল্পটি আপনাদের কেমন লাগলো তা কমেন্ট করে অবশ্যই জানাবেন।

পরবর্তী গল্প পড়ার আমন্ত্রণ জানালাম। ধন্যবাদ।)

 

 

জ্বীন যাত্রা

” সমাপ্ত”