পাঁচ তলা – ছোট গল্প

পাঁচ তলা

লেখকঃ মারিয়া আক্তার মাতিন

 

ঘটনাটি যার সাথে ঘটে, তিনি সম্পর্কে আমার একজন আঙ্কেল। এই আঙ্কেল তখন পরিবারসহ ঢাকায় ৭ তলা একটা ভবনের ৫ন তলায় থাকতেন। আর এই ৫ম তলায়ই ঘটে কিছু অস্বাভাবিক ঘটনা। আসুন জেনে নেওয়া যাক সেই ঘটনাবলী সম্পর্কে।

একদিন আংকেলের কাজ করতে করতে অনেক রাত হয়ে যায়।  আংকেল ঘড়িতে সময় দেখলেন রাত ৩ টা বাজে।তখন তিনি ঘুমানোর প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন।

হঠাৎ তিনি বারান্দায় কিছু ভাঙার আওয়াজ শুনতে পেলেন। তিনি ভাবলেন উনার বারান্দায় তো অনেকগুলো টব আছে, তাহলে কি টব ভাঙল? আর এত রাতে কেই বা টব ভাঙবে?

আংকেল খুবই ভীতু মানুষ ছিলেন। তিনি তখন ভয় পেতে লাগলেন। একবার ভাবছেন চোর এসেছে আরেকবার ভাবছেন অন্যকিছু। তিনি সাহস করে বারান্দায় আর যেতে পারছেন না।

তিনি তখন বারান্দার দরজার একদম কাছে এসে দাঁড়ালেন আর কান পেতে রাখলেন আরও কিছু ভাঙে কিনা। তখনই তিনি শুনতে পান বারান্দায় একচোট টব ভাঙার আওয়াজ। বারান্দায় শো শো বাতাস বইছে যেন বাইরে না বারান্দায় ঘূর্ণিঝড় হচ্ছে। তিনি তো ভয়ে শেষ। শরীর ঘেমে একাকার। তিনি তখন নিশ্চিত হলেন বারান্দায় চোর নয় অন্যকিছু এসেছে।

কারণ ৫ তলা বেয়ে তার উপর বারান্দার গ্রিল ভেদ করে চোর কীভাবে আসবে! তিনি একবার ভাবলেন আন্টিকে ডাকবেন। তারপরে আবার কী ভেবে যেন আর ডাকলেন না।তিনি সেখানেই দাঁড়িয়ে রইলেন।

বেশ কিছুক্ষণ পর বারান্দায় ভাঙার আওয়াজটা বন্ধ হয়েছে সাথে বাতাসের প্রবাহও। তিনি তখন মনে সাহস সঞ্চয় করে বারান্দার দরজা খুলে বারান্দায় গেলেন। কিন্তু কী আশ্চর্য! বারান্দায় কিছুই ভাঙেনি। টবগুলো তিনি যেভাবে সাজিয়েছিলেন ঠিক সেভাবেই রয়েছে। একটা টবও ভাঙেনি। বারান্দা একদম পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন। অথচ তিনি স্পষ্ট শুনেছিলেন ভাঙার আওয়াজ সাথে শো শো বাতাসের প্রবাহ। তিনি আর এক মিনিটও বারান্দায় দাঁড়ালেন না, সাথে সাথে রুমে এসে বারান্দার দরজা লাগিয়ে দিলেন।

আংকেলের তখন প্রচুর পানির পিপাসা পায় তাই তিনি ডাইনিং রুমে যান পানি পান করতে। পানি পান করে তিনি যখন নিজের রুমে যাচ্ছিলেন তখনই দেখলেন ড্রয়িং রুমের দরজাটা আপনাআপনি ভিতর থেকে লক হয়ে গেছে। সেই সাথে শুরু হয়েছে জিনিস ভাঙার আওয়াজ যে আওয়াজটা তিনি বারান্দায় শুনেছিলেন। আবারও শো শো বাতাস বইছে।

তিনি এবার তাড়াতাড়ি করে আন্টিকে ডাকলেন, উনার মা-বাবাকে ডাকলেন। তারাও উঠে এই আওয়াজটা শুনতে পেলেন। তারা প্রত্যেকেই খুব ভয় পেলেন। তখন আংকেলের মা বললেন।

পাঁচ তলা

সবাই তাড়াতাড়ি আয়তুল কুরসী পড় আর দোয়া দুরুদ পড়তে থাক। তা নাহলে বড় ধরণের কোনো বিপদ হতে পারে।”

তখন সবাই আয়তুল কুরসী আর দোয়া দুরুদ পড়তে লাগল। এর কিছুক্ষণ পরই ভাঙার আওয়াজ আর বাতাসের প্রবাহ বন্ধ হয়ে গেল। ড্রয়িং রুমের দরজাও আপনাআপনি খুলে গেল। সবাই একসাথে রুমের ভিতর ঢুকল। কিন্তু নাহ, রুমের ভিতর কিছুই এলোমেলো হয়নি। সবকিছুই ঠিকঠাক আছে। সেই রাতটা সবাই নির্ঘুম কাটাল।

কিছুদিন পর আংকেলের এক আত্মীয় অসুস্থ হয়ে যায়। তাই সবাই তাকে দেখতে গাজীপুর যায়। কেবল বাসায় আংকেল থেকে যায় কারণ উনার খুব কাজের ঝামেলা ছিল। এখন, আংকেলতো অনেক ভীতু, তিনি একা একা কীভাবে এই বাসায় থাকবেন তাই ভাবছিলেন। উনার স্ত্রী, মা-বাবা ফিরবেন দুইদিন পর।

এই দুইদিন তিনি কীভাবে একা একা বাসায় থাকবেন তা নিয়ে খুব চিন্তিত ছিলেন। তখন উনার মাথায় এলো উনার কয়েকজন বন্ধুকে এই বাসায় থাকতে বললে কেমন হয়! মাত্র দুইদিনেরই তো ব্যাপার!

তাই তিনি উনার কয়েকজন ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের বললেন দুইদিন যেন উনার বাসায় থাকে। উনার বন্ধুরা রাজি হলো।

সেদিন রাতেই আংকেলের চারজন বন্ধু আংকেলের বাসায় এসে পড়লো। রাতের খাওয়াদাওয়া শেষ করে সবাই ঘুমাতে গেল। তখন উনার একজন বন্ধু ওয়াশরুমে যায়। কিন্তু ওয়াশরুমের দরজা ভিতর থেকে লক করা ছিল এবং ঝরণা থেকে পানি পড়ার আওয়াজ আসছিল। আংকেলের বন্ধু ভাবলেন এত রাতে কে গোসল করে! তিনি রুমে গিয়ে দেখলেন আংকেল সহ বাকিরা সবাই শুয়ে পড়েছে। তাহলে ওয়াশরুমে কে?

তিনি আবারও ওয়াশরুমে গেলেন এবং এইবার দেখলেন ওয়াশরুমের দরজা খোলা। তিনি ভয়ে ভয়ে ওয়াশরুমে ঢুকলেন। তিনি যখন ওয়াশরুমের দরজা লাগালেন তখনই ঝরণা থেকে পানি পড়তে শুরু হলো।

এটা দেখে তিনি তাড়াতাড়ি করে দরজা খুললেন সাথে সাথে পানি পড়াও বন্ধ হয়ে গেল। আবার যখন তিনি দরজা লাগালেন তখন আবার পানি পড়তে শুরু হলো। তিনি এবার ভয়ে দরজা খুলে এক দৌড়ে রুমে গিয়ে আংকেলকে ডাকতে লাগলেন। আংকেলসহ তখন বাকিরা উঠে জিজ্ঞেস করে কী হয়েছে।

তিনি তখন ঘটনাটা খুলে বললেন। আংকেল সব বুঝতে পেরে যায় কিন্তু তিনি উনার বন্ধুদের এই ব্যাপারে কিছুই বললেন না কারণ তখনতো তারা ভয় পেয়ে চলে যাবে। তাই তিনি উনার বন্ধুকে বললেন,

আরে এইসব কিছু না। এটা আসলে ওয়াশরুমের ঝরণার একটু সমস্যা হয়েছে বুঝলি। দেখি কাল পরশু ঠিক করব।

তিনি আরও কিছু বলে ব্যাপারটাকে ধামাচাপা দেন। এভাবে দুইদিন কেটে যায়। উনার বন্ধুরা বিদায় নেয়। উনার পরিবারের লোকেরাও এসে পড়েন। কিন্তু আংকেলের মনে তখন হাজারও প্রশ্ন।

প্রায় প্রায়ই এসব কী ঘটছে উনার বাসায়, কেন ঘটছে এসব কিছুর উত্তর উনাকে জানতে হবে। তিনি বাসার বাড়িওয়ালাকে এই ব্যাপারে জিজ্ঞেস করেন কিন্তু বাড়িওয়ালা সঠিক কিছু বলতে পারলেন না।

বাসার অন্য তালার ভাড়াটিয়াদের জিজ্ঞেস করলেন তাদের বাসায় এমন কিছু ঘটে নাকি তারাও না করে যে এমন কিছু ঘটেনি। তাহলে আংকেলের ফ্ল্যাটেই এসব ঘটছে। কিন্তু কেন ঘটছে! তখন তিনি ভাবলেন এই পাড়ার কোনো লোকদের জিজ্ঞেস করলে হয়তো তিনি কিছু তথ্য পেতে পারেন। তিনি বাইরে কিছু লোকদের জিজ্ঞেস করলেন তন্মধ্যে একজন বললেন,

আপনি এই বাসার কয় তালায় থাকেন?

জ্বি,পাঁচ তলায়।

কতদিন হলো এই বাসায় এসেছেন?

এইতো এই মাস শেষ হলে ছয় মাস হবে।

বাহ!আপনি তো অনেকদিন টিকে গেছেন এই বাসায়।এই পাঁচতলায় কোনো ভাড়াটিয়া দুই মাসের বেশি থাকতে পারে না।সেই জায়গায় আপনি ছয় মাস ধরে আছেন।কীভাবে আছেন এই বাসায়?”

আপনি একটু ক্লিয়ার করে বলুন তো আসল কাহিনীটা।”

তাহলে শুনুন,এই বাসাটা যে জায়গায় করা হয়েছে এটা পূর্বে হিন্দুদের শ্মশান ছিল। এই বাসার বাড়িওয়ালা সেই শ্মশানের জায়গাতেই এই সাত তলা বাসা করে। এই শ্মশানে নাকি খারাপ জ্বীন বসবাস করত। বাসা করার পর জ্বীনেরা তাদের থাকার জায়গা হিসেবে এই বাসার পাঁচতলাকে বেছে নেয়।

এই বাসার বাড়িওয়ালা বাসা করার পর কোনো মিলাদও পড়ায়নি। আর সব ভাড়াটিয়াদের কাছ থেকেও এই বিষয়টা গোপন করে গেছে। এরপর থেকে এই বাসার পাঁচতলায় কেউ দুই মাসের বেশি থাকতে পারে না। আর আগে আমরাও সন্ধ্যাবেলায় দেখতাম একটা সাদা কাপড় কোথা থেকে উড়ে এসে পাঁচতলার বারান্দায় এসে অদৃশ্য হয়ে যেত। তাই আপনাকে বলছি যত তাড়াতাড়ি সম্ভব এই বাসা ত্যাগ করুন।”

এটা শুনে আমার আংকেল প্রচুর ভয় পেয়ে যায় এবং ওই মাসেই বাসা ছেড়ে নতুন বাসা ভাড়া নেয়। তারপর থেকে আংকেল আর এরকম কোনো সমস্যার মুখোমুখি হননি।

 

{ আরো পড়ুন – বহুরূপী

 

( পাঁচ তলা – ছোট গল্পটি আপনাদের কেমন লাগলো তা কমেন্ট করে অবশ্যই জানাবেন।

পরবর্তী গল্প পড়ার আমন্ত্রণ জানালাম। ধন্যবাদ।)

পাঁচ তলা

” সমাপ্ত”