মুকুন্দপুরের অভিশপ্ত পিশাচ (পরবর্তী পর্ব )

পঞ্চম পর্ব

মুকুন্দপুরের অভিশপ্ত পিশাচ-

এবারে তারকানন্দ মনোহর বাবুর দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন “এই রাজবাড়ী সম্বন্ধে আমাকে কিছু বলতে পারবে? এর কথা শুলে মনে হচ্ছে ওই রাজবাড়ীর সাথে ওই ওই অশরীরীর কোন একটা যোগসূত্র আছে এবারে মনে মনোহর বাবু হাতজোড় করে বললেন ” ক্ষমা করবেন বাবাঠাকুর ওই রাজবাড়ী সম্বন্ধে গ্রামের কেউ কিছুই জানে না। আমরা ঠাকুরদার মুখেও ওই রাজবাড়ী কোন ইতিহাস জানতে পারিনি আমরা। এখন ওই রাজবাড়িটি কে যেমন দেখেছি আমার ঠাকুরদার ঠাকুরদাও তেমন অবস্থায় দেখেছেন। সুতরাং ওই রাজবাড়ির ইতিহাস গ্রামের সকলেরই অজানা। শুধু পূর্ব পুরুষের মুখ থেকে জানতে পেরেছিলাম ওটা একটা রাজবাড়ী তাই ওটাকে সবাই রাজবাড়ী বলেই জানে”।

হঠাৎ একটা খুব দরকারি কোন কথা মনে পড়ে যাবার মত চমকে উঠে তারকানন্দ। মনোহর বাবুকে বেশ উত্তেজিত স্বরে জিজ্ঞাসা করলেন ” তুমি আমাকে বলেছিলে যে খননের সময় একটি ঘটি জাতীয় পাত্র তুমি পেয়েছিলে। সম্ভবত সেটা খোলার পর থেকেই এই ভয়ানক উপদ্রব শুরু হয়েছে। সেই জিনিসটা আমি এখনই দেখতে চাই ।মনোহর বাবু হাতজোড় করে বললেন ” আমাকে ক্ষমা করবেন বাবাঠাকুর। এই সব ঝামেলার মধ্যে আমি সেই বস্তুটির কথা একেবারেই ভুলে গিয়েছিলাম।

আপনি একটু বসুন আমি এখনই সেটা এনে দিচ্ছি “।এই বলে তিনি দ্রুত পায়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন। মিনিটখানেকের মধ্যেই হাতে সেই মূর্তিটিকে নিয়ে ফিরে এলেন। এবং সেটা তারক আনন্দের হাতে দিলেন। তিনি হাতে নিয়ে সেটি ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে দেখতে লাগলেন। জিনিসটি সাধারণ ঘটি জাতীয় হলেও এর রং অনেকটাই আলাদা। তখনও ঘটির একদম নিচে মাটি শক্ত হয়ে বসে আছে। এবং সেই মাটির সাথে ধাতুর তৈরি কিছু একটা আটকে আছে। তিনি মনোহর বাবুকে নির্দেশ দিলেন একটি পাত্রে জল নিয়ে আসতে, মনোহর বাবু একটি পাত্রে জল নিয়ে এসে তান্ত্রিক কে দিলেন।

তখন তিনি সেই জল দিয়ে ধীরে ধীরে ভিতরের শক্ত মাটি পরিষ্কার করতে লাগলেন। বেশ কিছুক্ষন চেষ্টার পর ভেতর থেকে একটি ধাতুর তৈরি মূর্তি বেরিয়ে এলো। সেই মূর্তিটিকে হাতে নিয়ে তারকা আনন্দ চমকে উঠলেন, তার মুখে কালো ছায়া নেমে এলো। তিনি নিজের মনেই বলে উঠলেন ” আশ্চর্য ব্যাপার, কিন্তু এটা কি করে সম্ভব ?। তারপরে তিনি মূর্তিটির দিকে তাকিয়ে রইলেন। এবারে মনোহর বাবু এবং রাধারমন বাবু দুজনেই জিজ্ঞাসা করলেন ” মূর্তিটি কিসের বাবাঠাকুর, আর ওটি দেখে আপনি এত চিন্তিতই বা হয়ে গেলেন কেন “?.।

তারকানন্দ এবার তাদের দিকে তাকিয়ে বললেন ” এই মূর্তি কোন সাধারন মূর্তি নয়, এটি একটি বহু প্রাচীন অশুভ শক্তির মূর্তি। সবচেয়ে আশ্চর্যের কথা হলো বর্তমান সময়ের কোন তান্ত্রিক ও কাপালিক এই অশুভ শক্তির আরাধনা করে না। কারণ এই অশুভ শক্তি জাগ্রত করার প্রক্রিয়া খুবই কঠিন সাধনার দ্বারা সম্পন্ন হয়।

যেসব তন্ত্রসাধক এই অশুভ শক্তির আরাধনা করে তাদের আত্মাও ওই অশুভশক্তির বশীভূত হয়ে যায়। অর্থাৎ সেই তন্ত্রসাধকের মৃত্যুর পর তাদের আত্মাও ওই অশুভ শক্তির দাসে পরিণত হয়। আমাদের মানব জাতির জন্য সে তখন ভয়ানক অভিশাপ এ পরিণত হয়। তখন সেই আত্মাকে প্রতিরোধ করা খুব কঠিন হয়ে পড়ে ।তাকে প্রতিরোধ করা এক কথায় অসাধ্য পড়ে । তবেআমাদের পৃথিবীতে যেমন অশুভ শক্তি আছে তেমনি শুভ শক্তিও আছে।

এই অশুভ শক্তির বিনাশ একমাত্র শক্তি দ্বারাই সম্ভব। তখন শুভ শক্তির মাধ্যমে আত্মা কে বশীভূত করে এই মূর্তির মধ্যে বন্দী করে কোন মন্তপুত পাত্রে আবদ্ধ করে রাখলেই ওই আত্মাকে প্রতিরোধ করা সম্ভব।

আমি নিশ্চিত এই পাত্রের ভিতর ওই মূর্তির সাথে তেমনি এক আত্মা বন্দি অবস্থায় ছিল। খননের সময় ওই আত্মা মুক্তি পেয়ে এই গ্রামে তার হত্যালীলা চালিয়ে যাচ্ছে “। এ পর্যন্ত বলে তারকানন্দ চুপ করলেন। এবারে রাধারমন বাবু বললেন ” কিন্তু এই অশুভ আত্মা কে প্রতিহত করার কোন না কোন রাস্তা তো আছে “?।

তারকানন্দ বললেন ” হ্যাঁ আছে, কিন্তু তার জন্য সেই আত্মার পরিচয় আগে জানতে হবে। তার সাথে জানতে হবে তার তন্ত্রসাধনার ক্ষমতা কতটা। তার মৃত্যুর কারণ, এবং সবচেয়ে বেশি জরুরী তার সাথে যুক্ত সেই অভিশাপ এর সম্বন্ধে জানা। এই সব তথ্য জানার পরেই সেই অশুভ শক্তিকে আটকানোর একটা রাস্তা পাওয়া যাবে।

এই সময় তারকানন্দর দৃষ্টি পরলো ঘটিটির গায়ে লেখা খুদে খুদে অক্ষর গুলির উপর। তিনি চোখদুটি সংকুচিত করে করে লেখা গুলি দেখতে লাগলেন। কিন্তু ঘরের অল্প আলোতে সেই লেখা পড়তে তার অসুবিধা হচ্ছিল।

তিনি তখন টেবিলের লন্ঠন টিকে কাছে নিয়ে এসে লেখাগুলো পড়ার জন্য মনোনিবেশ করলেন। মিনিট কয়েক পড়ার পর যখন তিনি মুখ তুললেন তখন তার মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে। ঠোঁটের কোণে একটা হাসির রেখা ফুটে উঠেছে। এমন পরিবর্তনে ঘরে থাকা বাকি তিনজন জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তার দিকে তাকালো। এবারে তাদের উদ্দেশ্যে তারকানন্দ বললেন ” “তোমরা নিশ্চয়ই কৌতুহল হচ্ছে যে ঘটিটির গায়ে যে লেখা টি আছে সেটা কি ভাষা? এবং সেই লেখাটির বিষয়বস্তু “?। মনোহর বাবু,রাধারমন বাবু ,ও শম্ভুচরণ তিনজনেই হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়লেন।

এবারে তারকা আনন্দ তাদের উদ্দেশ্যে বলতে শুরু করলেন ” প্রথমেই ওই ভাষার সম্বন্ধে বলি। যে ভাষায় ঘটিটির গায়ে লেখা আছে ওই ভাষাটি কোন সাধারণ ভাষা নয়।

ওই ভাষাটি হল প্রাচীন তিব্বতী ভাষা। বর্তমানে ওই ভাষা তিব্বতীরা ব্যবহার করে না। তবে কিছু কিছু তিব্বতি লামা এখনো এই ভাষার ব্যবহার করে। এই ভাষাটি মূলত তন্ত্র সাধনার সাংকেতিক ভাষা হিসাবে ব্যবহার করা হতো। আমি এই ভাষা জানতে পেরেছি আমার গুরুদেবের কাছ থেকে।

জানতে চাও ঘটির গায়ে খোদাই করা লেখাটির অর্থ কি “? তিনজনেই এক বাক্যে হ্যাঁ বলল।

তখন তারকানন্দ বললেন ” লেখাটির সারমর্ম এরকম ‘এই অশরীরী কে প্রতিহত করার উপায় রাজবাড়ীর পশ্চিম দিকের একটি ঘরের গোপন কক্ষে রাখা আছে’ একটা ব্যাপারে আমি নিশ্চিত, এই অশরীরীর তাণ্ডব থেকে মুক্তির জন্য তৎকালীন লোকেরা কোন একটি তিব্বতি তান্ত্রিকের শরণাপন্ন হয়েছিল।

সেই তান্ত্রিক এই আত্মাকে তার উপাস্য অশুভ শক্তির প্রতীক এই মূর্তির সাথে বন্দি করে রাখে। এবং ভবিষ্যতে যদি কোনভাবে ওই আত্মার মুক্তি পায় তবে তাকে প্রতিহত করার উপায় ও ওই পাথরের গায়ে খোদাই করে রেখেছে। তবে একটা ব্যাপারে নিশ্চিত হলাম, রাজবাড়ির সেই ঘরে এমন কিছু জিনিস রাখা আছে, যা এই গ্রামের হত্যালীলা বন্ধ করতে পারে।

ঠিক আছে আজকে রাত হয়ে গেছে আজকে আর কিছু করা সম্ভব নয়। কাল সকালে গ্রামের কয়েকজন কে সঙ্গে নিয়ে রাজবাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দেওয়া যাবে। এরপর শম্ভুচরণ এর উদ্দেশ্যে বললেন “তুমি নিশ্চিন্তে বাড়ি চলে যাও, সেই অশরীরী এখন আর গ্রামে প্রবেশ করতে পারবেনা। শম্ভুচরণ তাকে প্রণাম করে বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দিল।

পরের দিন সকালে মনোহর বাবু এবং রাধারমন বাবু গ্রামের জনা কয়েক শক্ত সামর্থ্য লোক কে সঙ্গে নিয়ে রাজবাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দিলেন। সবার আগে চলতে লাগলেন তারকানন্দ। গ্রামের সীমানা পেরিয়ে জঙ্গলের পথে পা দেওয়ার পূর্বে তারকানন্দ সবাইকে দাঁড় করিয়ে নিজের ঝোলা থেকে একটা পাত্র বের করে তার থেকে কিছুটা মন্ত্রপূতঃ জল বের করে সবার মাথায় ছিটিয়ে দিলেন। তারপর বললেন ” দেখো যদিও এখন দিনের বেলা সূর্যের আলোয় সেই অশরীরী আমাদের কোন ক্ষতি করতে পারবে না। তবুও সাবধানের মার নেই।

কারন আমি এখনো তাঁর ক্ষমতা সম্বন্ধে অজানা, সুতরাং কারো যাতে বিন্দুমাত্র ক্ষতি না হয় তাই এই ব্যবস্থা গ্রহণ করা “। এই বলে তিনি জঙ্গলের মধ্যে প্রবেশ করে রাজবাড়ির উদ্দেশ্যে চলতে লাগলেন। মনোহর বাবু এবং রাধারমন বাবুর সাথে বাকি সবাই পিছনে পিছনে চলতে লাগলো। বেশ কিছুক্ষণ চলার পর জঙ্গলের মধ্যে ভাঙ্গাচোরা রাজবাড়ীটি চোখে পড়ল। আরো খানিকটা এগোনোর পর সবাই ভাঙ্গা রাজবাড়ির সামনে পৌঁছালো।

বিশাল বাড়িটা এখন ভাঙাচোরা ইটের ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়ে আছে। পেছনের দিকের দু একটি ঘর ছাড়া বাকি প্রায় সবটাই কবেই ভেঙ্গে গেছে। চারপাশ এখন জঙ্গল আর আগাছায় ভর্তি। কত বছর যে মানুষের পা এখানে পড়েনি তার কোন হিসাব নেই। পথ বলতে কিছুই নেই আগাছার জঙ্গল কেটে রাস্তা করে নিতে হচ্ছে। তারকানন্দ বাকি লোকেদের আগাছার জঙ্গল কেটে পথ পরিষ্কার করার নির্দেশ দিলেন। সাথে এও বললেন দিনের বেলায় সেই অশরীরীর ভয় না থাকলেও এসব জায়গায় সাপ খোপ থাকা সম্ভাবনা আছে। সুতরাং সবাই যেন সাবধানে কাজ করে।

সকলের কাছেই আগাছা পরিষ্কারের সরঞ্জাম ছিল তাই সবাই পরিষ্কারের কাজে লেগে পড়ল। মনে হয় বাবু নিজে দাঁড়িয়ে থেকে তাদের কাজ তদারকি করতে লাগলেন। প্রায় ঘণ্টা দুয়েকের চেষ্টায় মোটামুটি কাজ সম্পন্ন হলো। তারকানন্দের সাবধান বাণী মিথ্যা ছিল না ।কারণ এই ঘর পরিষ্কারের কাজে তিনটি বিষধর সাপ মারতে হয়েছে। পরিষ্কার করা পথ দিয়ে সবাই ভিতরে ঢুকলো। কত বছরের পুরনো বাড়ি ভিতরে তাই পুরনো ইটের স্তুপ ছাড়া বেশি কিছুই অবশিষ্ট ছিল না। সেই স্তুপের উপর দিয়ে সাবধানে পা ফেলে সবাই এগিয়ে চলল। সেই সময় তারকানন্দ সবাইকে থামতে বললেন। তারপর যেখানে দাঁড়িয়ে ছিলেন সেখান থেকে আন্দাজ করে পশ্চিম দিক বরাবর চলতে লাগলেন।

কিছুক্ষণ আসার পর ঘটিতে নির্দেশিত ঘরের জায়গায় এসে দাঁড়ালেন। চারপাশটা নিজেও ভালো করে দেখতে লাগলেন এবং সঙ্গে থাকা বাকি লোকেদের নির্দেশ দিলেন তন্ন তন্ন করে সব দিকটা দেখতে। সবাই আলাদা আলাদা হয়ে ভালোভাবে দেখতে লাগলো। কিন্তু ঘন্টা দুয়েকের তন্ন তন্ন করে খোঁজার পরেও কোন সূত্র কারো নজরে পড়লো না।

এই জন্য সকলেই বেশ একটু হতাশ হলো। এরপর আরো ঘন্টাখানেক খোঁজার পরও যখন কেউ কিছু দেখতে পেলোনা তখন সকলেই ফিরে যাবার সিদ্ধান্ত নিল। সেই সময় হঠাৎই একজনের দৃষ্টি পরলো ঘরের একদম পিছনের দিকে ইটের স্তুপ এর আড়ালে লোহার পাতের মত কি একটা জিনিস একটুখানি বেরিয়ে আছে। সে বাকি সকলকে ডেকে জিনিসটা দেখালো। তারকানন্দ তখন সকলকে নির্দেশ দিল সেখানের ইটের স্তুপ তাড়াতাড়ি সরানোর জন্য।

সকলে সেই কাজে লেগে পড়ল। বেশ কিছুটা সময় সেগুলো হাতাহাতি করে করে সরানোর পর সেখানের ভাঙ্গা ইটের স্তুপ পরিষ্কার করে ফেলল। তারকানন্দ দেখলেন সেখানে হাত দুয়েক চওড়া চৌকো আকৃতির একটা লোহার পাত রাখা আছে। এবং এও বোঝা যাচ্ছে ওই লোহার পাতের নিচেই কোন গুপ্ত কক্ষে যাবার রাস্তা লুকিয়ে আছে। তিনি তখন পাশের দুই জন শাবলধারি লোককে নির্দেশ দিলেন শাবল দিয়ে লোহার পাতটি তোলার জন্য।

নির্দেশ পেয়েই তারা দুজনে কাজে লেগে পড়ল ।বেশিক্ষণ লাগলো না পাতটি তুলতে। পাতটি তোলার পর দেখা গেল একটা সংকীর্ণ লোহার সিড়ি নিচের দিকে নেমে গেছে। নিচে ঘুটঘুটে অন্ধকারে কিছু দেখা যাচ্ছে না। তারকানন্দ একজনকে একটা মশাল তৈরি করার জন্য বললেন। মশাল তৈরি হবার পর তিনি নিচে নামার জন্য প্রস্তুত হলেন। মনোহর বাবু সঙ্গে কাউকে নিয়ে যাবার জন্য অনুরোধ করলেন।

তখন তারকানন্দ বললেন ” নিচে কি আছে সেই সম্বন্ধে আমাদের কারও কোন ধারণা নেই। তবে একটা জিনিস স্পষ্ট, সেটা হলো এই গ্রামে মৃত্যু-যজ্ঞ চালানো সেই বিভীষিকার মূল চাবিকাঠি এই নিচেই কোথাও আছে। তাই সেখানে আমাকে একাই যেতে হবে। কারণ আমার গাত্র বন্ধন থাকলে কেউ আমার কোন ক্ষতি করতে পারবে না। যত বড় বিপদই হোক আমি ঠিক ফিরে আসতে পারবো।

কিন্তু আমার সাথে যে থাকবে সে যদি ভয় পায় তাহলে সে ভয়ানক বিপদে পড়তে পারে। এমনকি তার প্রাণ সংশয়ও হতে পারে। তখন আমিও কিছু করতে পারবো না। তোমরা এখানে অপেক্ষা করো আমি না আসা পর্যন্ত “। এই বলে তিনি মশাল হাতে নিয়ে গাত্রবন্ধন করে মনে মনে মা কামাখ্যার নাম স্মরণ করে নিচে নেমে গেলেন। উপরে রাধারমন বাবু এবং মনোহর বাবু সহ বাকি সকলে উদ্বিগ্ন মনে তার জন্য অপেক্ষা করতে লাগল।

তারকানন্দ কতটা নিচে নেমেছে সেই সম্বন্ধে উপরের কারো কোন ধারণা নেই। কারণ তিনি নিচে নামার পর মশালের বিন্দুমাত্র আলো উপর থেকে দেখা যাচ্ছে না। প্রথমে উপর থেকে নিচে টা যেমন ঘুটঘুটে অন্ধকার লাগছিল এখনো ঠিক তেমনি অন্ধকার লাগছে। সকলেই বেশ উদ্বিগ্ন মনে চিন্তা মগ্ন হয়ে তারকানন্দের জন্য অপেক্ষা করতে লাগলো।

বেশ অনেকটা সময় কেটে যাবার পরেও যখন তারকানন্দ উপরে উঠে এলো না তখন উপরের সকলেই মনে মনে প্রমাদ গুনতে লাগলো। সেই সময় আচমকাই নিচের ঘর থেকে একটু আলো উপর দিকে উঠতে দেখে সকলেই উল্লসিত হয়ে উঠলো। তারপর ধীরে ধীরে সেই লোহার সিঁড়ি দিয়ে তারকানন্দ উপরে উঠে আসতে লাগলো। তার হাতে একটা ছোট লোহার বাক্স মত কি একটা ধরা রয়েছে। হয়তো ওই বাক্সেই রয়েছে সব প্রশ্নের উত্তর সব সমস্যার সমাধান।

 

ষষ্ঠ পর্ব

তারকানন্দ উপরে আসার পর তার মুখটা বেশ চিন্তিত লাগল। তিনি উপরে উঠে সকলের উদ্দেশ্যে বললেন ” আমরা যে উদ্দেশ্যে এখানে এসেছিলাম সেই উদ্দেশ্য সফল হয়েছে। কিন্তু এখানেই শেষ নয় ,সামনে আমাদের এক কঠিন সমস্যার মুখোমুখি হতে হবে। আর সেই সমস্যার মোকাবিলা করার জন্য সকলের সহায়তার প্রয়োজন পড়বে।

আর আমাদের সবার লড়াইটা হবে ওই অশরীরীরবিরুদ্ধে। লড়াই যতই কঠিন হোক মনে শুধু একটাই কথা রেখো অশুভশক্তি যতই শক্তিশালী হোক, সেটা কখনোই শুভশক্তির থেকে বেশি নয়। আমি সেই অশরীরীর দুর্বলতম জায়গার সন্ধান পেয়েছি। আর সেটা এই বাক্সের ভিতরে এক পুরনো পুঁতি তে লেখা আছে এখন সবাই যে যার বাড়ি ফিরে চলো। এরপর কি করতে হবে আমি ঠিক সময় বলে দেব। এই বলে সবাইকে সঙ্গে নিয়ে তারকা আনন্দ গ্রামের দিকে রওনা দিলেন।

বাড়ি ফিরে এসে তারকানন্দ, মনোহর বাবু এবং রাধারমন বাবুকে বললেন ” আমি এখন কিছুটা সময় একা থাকতে চাই। তোমাদের মনে যে কৌতূহল ও প্রশ্ন আছে যথাসময়ে সেটার নিভৃতি হয়ে যাবে “। এই বলে তিনি সাথে থাকা বাক্সটি সঙ্গে নিয়ে পাশের একটি ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিলেন।

এই অবসরে মনোহর বাবু এবং রাধারমন বাবু গ্রামের লোকেদের সাথে দেখা করে তাদের সাথে কথা বললেন। তাদের অভয় দিলেন। গ্রামবাসীরাও যেন অনেকদিন পর একটু স্বাভাবিক হয়েছে।

যেন আগের সেই স্বাভাবিক ছন্দ ফিরে এসেছে গ্রামে।

হয়তো তাদের মনেও একটা দৃঢ় বিশ্বাস রয়েছে যে এই তান্তিক তাদের এই ভয়ানক বিপদ থেকে খুব তাড়াতাড়ি উদ্ধার করবে। অনেকদিন পরে গ্রামবাসীদের এই স্বাভাবিক ছন্দ দেখে মনোহর বাবু যারপরনাই আনন্দিত হলেন।

তিনি রাধারমন বাবুকে সাথে নিয়ে গ্রামের চারপাশটা একটু ঘুরতে লাগলেন। ঘুরতে ঘুরতে তার মনে হলো অনেকদিন যেন এ গ্রামের আলো বাতাসের মধ্যে একটা অপবিত্রর ছোঁয়া, ছিল কিন্তু আজকে নির্মল বাতাস আর স্নিগ্ধ আলোর মধ্যে কোনো অপবিত্রর ছোঁয়া নেই। বেশ অনেকটা সময় ঘোরাঘুরির পর মনোহরা বাবু যখন বাড়ি পৌঁছাল তখন দুপুর গড়িয়ে পড়েছে।

বাড়ি ঢুকে দেখলেন তারকানন্দ সদ্য স্নান সেরে মাথা মুছছেন। মনোহর বাবুদের দেখে তারকানন্দ বললেন ” তোমরা তাড়াতাড়ি স্নান করে নাও,মা আমার খাবার নিয়ে বসে আছে”।

দুপুরে খাওয়া দাওয়ার পর তিনজনে বৈঠকখানায় জমিয়ে বসলেন। তারপর তারকানন্দ তাদের দিকে তাকিয়ে একটু মুচকি হেসে বললেন ” তোমাদের নিশ্চয়ই কৌতুহল হচ্ছে যে ওই বাক্সের মধ্যে কি আছে? এবং আমি এতক্ষণ ঘরের মধ্যে থেকে কি জানতে পেরেছি।

তাই তো? দুজনেই হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়লেন তখন তারকা নন্দ এক আশ্চর্য কাহিনী বলতে শুরু করলেন ” আমি ওই ঘরের মধ্যে থেকে যে বাক্স টা পেয়েছি সেই বাক্সের মধ্যে ছিল একটা পাঁচশো বছরের পুরানো পুঁতি। আর সেই পুঁতি তে লেখা আছে এই অশরীরীর আবির্ভাব। তাহলে মন দিয়ে শোনো। এই বলে তিনি বলতে আরম্ভ করলেন।

” ওই বাড়িটি যদিও রাজবাড়ী নামে পরিচিত। কিন্তু এই কাহিনীর সূত্রপাত যে সময় সেই সময় এই বাড়ির নাম রাজবাড়ী থাকলেও বাড়ির লোকেরা আদৌ রাজা ছিল না।

তবুও পূর্বপুরুষের ছত্রছায়ায় থেকে সেই রাজপরিবারের সম্মানটুকু তখনও অক্ষুন্ন ছিল। এখন যেখানে এই মুকুন্দপুর গ্রামটা আছে তখন সেখানে আরও বড় গ্রাম ছিল এখন চারপাশে যে অনেকটা অঞ্চল বনভূমি জঙ্গল মাঠ পড়ে আছে তখন এইসবটুকু এলাকাজুড়েই একটা গ্রাম ছিল।এই বাড়ির কর্তার নাম ছিল চন্দ্রকান্ত রায় বর্মন, তার দুই ছেলে একজনের নাম দেবকান্ত অন্যজনের নাম রুদ্রকান্ত। দেবকান্ত তার প্রথম স্ত্রীর সন্তান।

আর রুদ্রকান্ত হলো তার দ্বিতীয় স্ত্রীর সন্তান। তার প্রথম স্ত্রী গত হওয়ায় তিনি আরেকটি বিবাহ করেন। তার বড় ছেলে দেবকান্ত নামেও যেমন কাজেও তেমনই। মানুষের পাশে থাকা তাদের বিপদে আপদে সাহায্য করা এক কথায় বলতে গেলে বাবার উপযুক্ত সন্তান। কিন্তু তার ছোট ছেলে রুদ্রকান্ত ঠিক তার বিপরীত। সবসময় উৎশৃংখল জীবনযাপন করত।

এছাড়া অল্পবয়সেই নানারকম নেশায় আসক্ত হওয়া। কারনে অকারনে গ্রামের লোকের সঙ্গে ঝগড়া মারামারি করা এইসব করেই তার দিন চলে যেত। যাই হোক এভাবেই খারাপ ভালো সব নিয়ে চন্দ্রকান্ত রায় বর্মন এর দিন চলে যাচ্ছিল। তার মনে সর্বদা এই চিন্তায় ছিল যে ছোট ছেলে যেমনি হোক, বড় ছেলে তার মনের মতো। সুতরাং এই বিশাল জমিদারির উত্তরাধিকারী নিয়ে সে একদম চিন্তিত ছিল না।

শুধু মাঝে মাঝে তার স্ত্রীর সাথে ঝগড়া হতো। কারণ তার স্ত্রী চাইত জমিদারের উত্তরাধিকারী হিসেবে তার ছেলে রুদ্রকান্ত হোক। কিন্তু চন্দ্রকান্ত রায় বর্মন রুদ্রকে ভালোভাবেই চেনে, তাই স্ত্রীকে স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছে যে রুদ্রকান্ত যদি নিজেকে শোধরাতে না পারে, তাহলে তাকে এই জমিদারি থেকে বহিষ্কার করে গোটা জমিদারিটাই দেবকান্তর হাতে সঁপে দেবে। এ কথায় জমিদার গিন্নি মুখে কিছু না বললেও ভিতরে ভিতরে যে দেবকান্তর প্রতি আক্রোশে ফেটে পড়ে সেটা তার মুখ দেখলেই বোঝা যেত। আশ্চর্যের কথা হল দেবকান্ত এসবই জানে। কিন্তু তাও সে নিজের সৎ মা এবং সৎ ভাইকে নিজের আপন মা ভাইয়ের মত সম্মান করতো, ভালোবাসতো।

গ্রামেরই এক শিব মন্দিরের পূজা করত রামরত্ন আচার্য। তারা বংশানুক্রমে এই মন্দিরের সেবায়েত ছিলেন। তারও একটি মাত্র ছেলে ছিল, কিন্তু সেই ছেলে বাবার মতো পূজারী না হয় জমিদার বাড়ির কাছারিতে চাষাবাদের ফসলের দেখাশোনার কাজ করতো। তার পূজা-অর্চনার দিকে বিন্দুমাত্র আগ্রহ ছিল না।

সেজন্য রামরত্নের মনে সর্বদাই একটা আশঙ্কা ছিল। যে তার অবর্তমানে শিবমন্দিরের দায়িত্ব কে নেবে তাই নিয়ে। কিন্তু প্রকৃতির এক অদ্ভুত নিয়ম আছে। যে, কাউকে কোনো দিকে অপূর্ণ রাখলে অন্যদিকে সেটা পূরণ করে দেয়। তেমনই ঘটনা রামরত্নের জীবনেও ঘটেছিল। তিনি ছেলের বিয়ে দেন এক সম্ভ্রান্ত ব্রাহ্মণ পরিবারে।

বৌমা রূপে গুণে অতুলনীয়া নামটিও বেশ “মোহিনী”। মোহিনীর সাংসারিক সব গুন তো ছিলই। তার সাথে আরও একজন ছিল, সেই গুনের জন্যই বৃদ্ধ রামরত্নের এতদিনের চিন্তা মাথা থেকে নেমে গিয়েছিল। আর তা ছিল পরম শিব ভক্তি। সকাল সন্ধ্যা শিবের পূজা করা ছিল তার নিত্যকর্ম। তার বাড়ি থেকে মন্দির যাবার পথে একটা ছোট জঙ্গল পড়ে।

তাই সন্ধ্যার সময় মোহিনী সর্বদাই একজনকে সঙ্গে করে নিয়ে যায় ।তার রূপ এবং গুণের খ্যাতি গ্রাম ময় রটে যেতে বেশি দেরি হয়নি। আর রামরত্ন আচার্যও এমন বৌমা পেয়ে নিজেকে সৌভাগ্যবান মনে করেন।।।

এদিকে জমিদারবাড়িতে নতুন এক অশান্তির সৃষ্টি হয়েছে। রুদ্রকান্তর ব্যবহারে প্রত্যেকদিনই বাড়িতে নতুন নতুন ঝামেলার সৃষ্টি হতো। চন্দ্রদেব বর্মন এতদিন সবকিছু সহ্য করলেও। এই নতুন ঘটনাটা তিনি একেবারেই সহ্য করতে পারলেন না।

ঘটনাটি হল ” আজ সকালে এই রাজবাড়ীরই এক গোমস্তা চন্দ্রদেব বর্মন কে বলে তিনি ছোট কুমারকে রাত্রি এগারোটা নাগাদ চুপিসারে বাড়ি থেকে জঙ্গলের দিকে যেতে দেখেছি। তখন সন্দেহ হওয়ায় ছোট কুমারের পিছন পিছন নিঃশব্দে তাকে অনুসরণ করতে শুরু করলাম।

এভাবে প্রায় আধ ঘন্টা চলার পর জঙ্গলের প্রায় মাঝামাঝি একটা জায়গায় এসে উপস্থিত হলাম। আর তখনই আশ্চর্য হয়ে দেখলাম পাশেই একটি ঝোপের আড়ালে একটা কুটির মত আছে। আর তার ভেতর থেকে অল্প আলো দেখা যাচ্ছে। সেখানে পৌঁছে আমি একটা মোটা গাছের আড়ালে দাঁড়িয়ে নিঃশব্দে সেই দিকে তাকিয়ে রইলাম। তখন ছোটকুমার সাবধানে এদিক-ওদিক তাকিয়ে একটু ইতস্তত করে সেই কুটিরে প্রবেশ করলো।

আমিও নিঃশব্দে সাবধানে পা টিপে টিপে ঘরের দরজার কাছে গিয়ে একটু আড়াল হয়ে দাঁড়ালাম। দরজা বন্ধ থাকলেও পাশে একটা ফাঁক দিয়ে চোখ রাখলে ভিতরের দৃশ্য দেখা যায়। আমি মিনিট কয়েক অপেক্ষা করার পর সেই ফাঁক দিয়ে ভিতরে চোখ রাখলাম। আর চোখ রাখতেই আমি ভয়ে সিউড়ে উঠলাম। দেখলাম ভিতরে একজন ভীষণ দর্শন কাপালিকের সামনে ছোটকুমার বসে আছে ।কিন্তু সেই মুহূর্তে ছোটকুমার রুপ সম্পূর্ণ অন্যরকম ।

তার পরনে তখন কোন কাপড় নেই। সে সম্পূর্ণ নগ্ন হয়ে বসে আছে। আর তার সারা শরীরে কি সব আঁকিবুকি কাটা আছে। আর সেই বীভৎস দর্শন কাপালিক তার মাথায় হাত দিয়ে বিড়বিড় করে কি যেন বলে যাচ্ছে। এভাবে অনেকটা সময় কাটার পর কাপালিক সেই প্রক্রিয়াটি শেষ করে ছোট কুমারকে ইশারায় কি একটা বললো। তখন দেখলাম ছোটকুমার উঠে দাঁড়িয়ে ঘরের কোণের দিকে গিয়ে সেখান থেকে একটা পাত্র ডানা বাধা দাঁড়কাক নিয়ে এলো। তারপর একটা ধারালো ছুরি দিয়ে সেই দাঁড়কাকের মুন্ডুটা তার ধর থেকে বিচ্ছিন্ন করে দিল।

তারপর একটি পাত্রে দার কাকের শরীরের সব রক্ত সংগ্রহ করে পাত্রটি কাপালিকের সামনে রাখলো। আর তারপর সেই দাঁড়কাকের ধর এবং মুন্ডু টিকে একটি বিশেষ আকৃতিতে পাশেই একটি উঁচু মাটির টিবিতে রেখে দিল। তারপর সেই ধারালো ছুরি দিয়ে ছোটকুমার তার নিজের হাতের আঙ্গুল কেটে সেই একই পাত্রে রক্তটা রাখল। অর্থাৎ সেই দাঁড়কাকের রক্তের সাথে নিজের রক্ত মিশিয়ে দিল। তারপর দেখলাম সেই কাপালিক কি একটা দুর্বোধ্য মন্ত্র উচ্চারণ করছে। আর সেই মন্ত্র শুনে ছোটকুমারও সেই মন্ত্র উচ্চারণ করছে।

আর উচ্চারণের সাথে সাথে সেই পাত্রের রক্ত ওই মৃত দাঁড়কাকের শরীরে ছিটিয়ে দিচ্ছে। এই প্রক্রিয়াটা প্রায় দুই ঘণ্টা চলল। দু’ঘণ্টা পর সবকিছু সমাপ্ত হবার পর দুজনেই শান্ত হয়ে বসল। তারপর সেই কাপালিক সেই রক্তের পাত্র থেকে কিছুটা রক্ত ছোট কুমারের মাথায় দিয়ে বলল ” আজকের মত কার্য সম্পন্ন হলো, সামনের অমাবস্যায় পূর্ণাহুতি দিয়ে অশুভ শক্তির কাছে নিজেকে সমর্পণ করলেই তুই সাধনায় সিদ্ধিলাভ করবি। তখন তোর মনের সব ইচ্ছা এমনিতেই পূরণ হয়ে যাবে। তুই হবি অসীম ক্ষমতার অধিকারী। যা আজকে বাড়ি ফিরে যা “।

এই পর্যন্ত বলে সেই গোমস্তা একটু চুপ করে থেকে আবার বলল ” এরপর আমি সেখানে আর থাকার সাহস পাইনি। আমি দ্রুত এই রাজবাড়ীতে ফিরে আসি। তারপর দরজার দিকে তাকিয়ে অপেক্ষা করতে থাকি। প্রায় আধঘন্টা পর দেখলাম ছোটকুমার নিঃশব্দে সিংহদ্বার দিয়ে প্রবেশ করলো।আমি আশ্চর্য হয়ে দেখলাম দারোয়ান তাকে বিনাবাক্যে দরজা খুলে দিল ” ।

এই পর্যন্ত বলে গোমস্তা চুপ করলো। তখন চন্দ্ররায় বর্মন এর রাগ সপ্তশিখায় পৌঁছেছে। তিনি তখনই পাইক দের নির্দেশ দিলেন রুদ্রকান্ত যেখানেই থাকুক এখনই তাকে ধরেএনে যেন তার সামনে হাজির করা হয়। নির্দেশ পেয়ে পাইকডরা তখনই ছুটলো। এদিকে তিনি আরো দুজন পাইক দিয়ে দারোয়ানকে ডেকে পাঠালেন। দারোয়ান এসে কাঁপা কাঁপা হাতে হাত জোড় করে দাঁড়ালে চন্দ্র রায় বর্মণ তাকে জিজ্ঞাসা করলেন ” রুদ্রকান্ত মাঝরাতে বেরিয়ে ভোররাতে বাড়িতে ফেরে, এই কথাটা তুমি আমাকে বলোনি কেন “?।

তখন দারোয়ান আমতা আমতা করে বলল ” ছোটকুমার এই কথাটা আমাকে কাউকে বলতে বারণ করেছে। আর এও বলেছে যে আমি যদি এই কথাটা কারো কাছে বলি তাহলে আমাকে প্রাণে মেরে ফেলবে। তাই আমি ভয়ে এই কথা কাউকে বলতে পারিনি “।

এ কথা বলে সে ঝর ঝর করে কাঁদতে লাগল। তখন চন্দ্র রায় বর্মন আবারও তাকে প্রশ্ন করল ” রুদ্র কতদিন থেকে এ কাজ শুরু করেছে ?। তখন দারোয়ান কান্না থামিয়ে একটু ভেবে উত্তর দিল তা প্রায় সাত-আট মাস হবে। তখন চন্দ্ররায় বর্মন দারোয়ানকে কি একটা বলার জন্য মুখ খুলতে যাচ্ছিলেন কিন্তু তখনই রুদ্রকান্ত এসে যাওয়াতে সেই কথাটা অসম্পূর্ণই হয়ে রইল।

এবারে রুদ্রকান্ত রাগান্বিত গলায় তার পিতা কে বলল ” এই সকালে আমাকে এভাবে বল পূর্বক নিয়ে আসার কারণটা জানতে পারি কি ?।

তখন চন্দ্ররায় বর্মন তাকে বলল ” তোমার অনেক অন্যায় আমি সহ্য করেছি । তোমার অনেক ভুল সন্তান স্নেহে ক্ষমা করে দিয়েছি। কিন্তু।এই কাপালিক, তন্ত্র, এসব আমি কিছুতেই মেনে নেব না। কারণ এগুলো হচ্ছে সর্বনাশের লক্ষণ। এগুলি যে বাড়িতে প্রবেশ করে সেই বাড়ি অপবিত্র হয়ে যায়। তাই এই তন্ত্র-সাধনা তোমাকে বন্ধ করতে হবে, নতুবা তোমাকে চরম শাস্তি ভোগ করতে হবে। তখন রুদ্রকান্ত চোখ লাল করে পিতার দিকে তাকিয়ে বলল ” টানা আট মাস আমি যে কঠিন সাধনা করে এসেছি সেই সাধনায় সিদ্ধি লাভের সময় প্রায় উপস্থিত। আর এই সময় আপনি আমাকে সাধনা করতে নিষেধ করছেন .। তবে শুনুন এ সাধনা আমি কিছুতেই বন্ধ করবো না।

আর যারা আমাকে সাধনায় বাধা দেবে তাদের চরম সর্বনাশ হবে। আর একটা কথা সাধকের কাছে সব থেকে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হলো তার সাধনা। তার থেকে বেশি গুরুত্বপূর্ণ কেউ না।  আমি আপনাকে শেষবারের মত অনুরোধ করছি আমার সাধনার পথে বাধা সৃষ্টি করবেনা।

 

সপ্তম পর্ব

এই বলে সে দ্রুত পায়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।

এদিকে আচার্যের পুত্রবধূ মোহিনীর যে গ্রাম জোড়া খ্যাতি ছড়িয়ে পড়েছিল সেই কথা রুদ্রকান্তেরও কানে এসে পৌঁছেছিল। তাই সে একদিন দিন সকালে মোহিনীর মন্দিরে যাওয়ার রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে মোহিনীর জন্য অপেক্ষা করতে থাকে। উদ্দেশ্য তাকে একবার নিজের চোখে দেখার। সেদিন মোহিনীর রূপ যৌবন দেখে তার শরীরে বিদ্যুতের চমক খেলে গেল।

তার মনে পাশবিক প্রবৃত্তি জেগে উঠলো। ব্যাকুল হয়ে উঠলো তার মন শুধু মাত্র একবার ওই শরীর ভোগ করার জন্য । সেজন্য সে প্রত্যেকদিন সন্ধ্যার সময় শিব মন্দির যাওয়ার পথে জঙ্গলের পাশে দাঁড়িয়ে থাকে। কিন্তু মোহিনী কোনদিনই একা যায় না। সর্বদাই তার সাথে কেউ না কেউ থাকে। কিন্তু তবুও রুদ্রকান্ত অপেক্ষায় থাকে একটা সুযোগের আশায়।

হঠাৎই একদিন সে সুযোগ পেয়ে গেল। মোহিনীর সাথে যে থাকে তার নাম হলো ননীবালা। সে সম্পর্কে মোহিনীর ননদ হয়। তো সেদিন ননীবালা পাশের গ্রামে তার মাসির বাড়ি গিয়েছিল। যদিও কথা ছিল বিকালের মধ্যে চলে আসবে, কিন্তু সন্ধ্যার মধ্যেও যখন সে বাড়ি ফিরল না, তখন মোহিনী ব্যস্ত হয়ে একাই শিবমন্দির যাবার জন্য উদ্যত হল।

তখন তার শ্বশুরমশাই বললেন ” শিব মন্দির যাওয়ার পথটা কিছুটা জঙ্গলের মধ্যে পড়ে তাই যেকোনো একজনকে সঙ্গে নিয়ে যেতে। কিন্তু সাথে যাবার মতো তেমন কাউকে না পেয়ে মোহিনী একাই শিব মন্দিরের দিকে রওনা দিল। যাবার সময় শশুরকে বলল ” আপনি অযথা চিন্তা করবেন না, আমি এই রাস্তা দিয়ে রোজ দুবেলা যাতায়াত করি।

সুতরাং আমার কোন অসুবিধা হবে না, আমি পূজা করে এখনই ফিরে আসব। আর এরই মধ্যে যদি ননীবালা ফিরে আসে তাহলে তাকে মন্দিরে পাঠিয়ে দেবেন “। এই বলে সে চলে গেল।

গ্রামের রাস্তা ছাড়িয়ে জঙ্গলের পথে কিছুটা চলার পরই হঠাৎ তার মনে হল কেউ যেন তাকে অনুসরণ করছে। সে বারকয়েক এদিক ওদিক তাকিয়ে কাউকে না দেখতে পেয়ে সেটাকে নিজের মনের ভুল মনে করে দ্রুত পা চালাতে লাগল। এদিকে তখন রুদ্রকান্ত গাছের আড়ালে থেকে নিঃশব্দে মোহিনী কে অনুসরণ করতে লাগলো।

কিছুটা এগুনোর পর জঙ্গলের একটা অপেক্ষাকৃত নির্জন স্থানে আসতেই হঠাৎ সামনে এসে তার পথ আগলে দাঁড়ালো। কিছু বুঝে ওঠার আগেই তার মুখটা চেপে ধরে জঙ্গলের মধ্যে টেনে নিয়ে যেতে লাগল। শত চেষ্টা করেও মোহিনী সেই শক্ত হাতের বন্ধন থেকে নিজেকে মুক্ত করতে পারল না। জঙ্গলের মধ্যে রুদ্রকান্ত যখন নিজের কামক্ষুধা নিবৃত্তি করে উঠে দাঁড়িয়ে প্রস্থানের জন্য উদ্যত হল। তখন মহিনী ছাড়া পেয়ে উঠে দাঁড়িয়ে বলতে লাগলো ” আজ আমার যে সর্বনাশ তুই করলি এই পাপের শাস্তি তোকে ভোগ করতে হবে। একজন সতী নারীর সতীত্ব নষ্ট করার পাপ তোকে সারা জীবন বয়ে বেড়াতে হবে।

এমনকি মৃত্যুর পরেও তুই রেহাই পাবে না। যুগ যুগ ধরে তুই অতৃপ্ত হয়ে ঘুরে বেড়াবি। আমার মন এখন যেমন তীব্র দহনে জ্বলছে তার থেকেও হাজারগুণ বেশি দহনে তুই জ্বলবি। তুই যেখানেই যাবি সেটাই অপবিত্র হবে। তোর শরীর থেকে সব সময় শব দেহ দাহ করার মত কটু গন্ধ নির্গত হবে। আমি যদি মনে প্রাণে সারা জীবন ভগবানের সেবা করে থাকি। তাহলে তোকে যে সব অভিশাপ দিলাম সেগুলো ফলবেই ” । এই বলে মোহিনী অঝোরে কাঁদতে লাগল।

রুদ্রকান্ত প্রথমে মনে করেছিল সে নিজের কাম ক্ষুধা নিবৃত্তি করে চলে যাবে। কিন্তু মোহিনীর এইসব কথা শুনে তার মনে ভীষণ রাগ হলো। তখন সে ভীষন ক্রোধে পাশেই পড়ে থাকা একটা বিরাট পাথর তুলে মোহিনীর উপর নিক্ষেপ করল। একটা মৃদু আর্তনাদ করে মোহিনী মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ল। তখন রুদ্রকান্ত চারপাশটা ভালো করে দেখে সাবধানে বাড়ির দিকে ফিরে চলল। কিন্তু বিধিবাম ! তার এত সাবধানতা সত্ত্বেও কিন্তু একজন তার পাপ কাজের সাক্ষী হয়ে রইল।

সে হলো ননীবালা। মাসির বাড়ি থেকে বাড়ি ফিরে যখন সে জানতে পারল তার বউদিদি একাই মন্দিরে গেছে তখনই সে তাড়াতাড়ি মন্দিরের দিকে যেতে লাগল। কিন্তু তাকে বেশি দূর যেতে হলো না । মন্দিরের পথে কিছুটা এসে জঙ্গলের মধ্যে এই দৃশ্য দেখে সে ভয়ে কাঠ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। তারপর এক বুক ফাটা আর্তনাদ করে সে বাড়ীর দিকে দৌড়াতে লাগল।

ননীবালা ছুটি বাড়িতে এসে কাঁদতে কাঁদতে আচার্যকে সব কথা খুলে বললো। আচার্য তাড়াতাড়ি গ্রামের আরো কয়েকজন লোককে সঙ্গে নিয়ে জঙ্গলের কাছে এসে দেখল সেই বীভৎস দৃশ্য। মোহিনী একটি ঝোপের মধ্যে মৃত অবস্থায় পড়ে আছে তার মাথাটা থেতলানো। এই দৃশ্য দেখে উত্তেজিত লোকেরা প্রচন্ড আক্রোশে রাজবাড়িতে গেল রুদ্রকান্তের খোঁজে।

গ্রামের লোকেরা তার দুর্ব্যবহারের জন্য এমনিতেই তাকে দেখতে পারত না, আর আজকের ঘটনায় তারা মনস্থির করে নিল যে তাদের কি করনীয়। তারা রাজবাড়ীতে গিয়ে রুদ্রকান্ত কে বেঁধে জঙ্গলের দিকে নিয়ে চলল। চন্দ্ররায় বর্মন সব কথা শুনে তাদের আর বাধা দিলো না। তখন সবাই তাকে জঙ্গলে নিয়ে গিয়ে একটা গাছে বেঁধে জীবন্ত অবস্থায় তার গায়ে আগুন লাগিয়ে সবাই গ্রামের দিকে ফিরে এল। আসার সময় তাদের কানে এলো এক অপার্থিব আর্তনাদ। সেইদিন রাতেই সবাই মহিনীর দেহ দাহ করে যে যার বাড়ি ফিরে এলো ।

গ্রামের লোকেরা সবাই রুদ্রকান্তর উপর অসন্তুষ্ট ছিল । তাই তার পরিণতিতে সবাই স্বস্তি পেল। কিন্তু সবার অলক্ষ্যে যে একটি ভয়ঙ্কর আতঙ্কের বীজ এই গ্রামের মধ্যে বোনা হলো কেউ ঘুনাক্ষরেও সে কথা জানতে পারল না। রুদ্রকান্ত কে জীবন্ত অগ্নিদগ্ধ করে যখন সবাই গ্রামে ফিরে এলো তখন তার শরীরে তখনো একটু প্রাণ ছিল।

সেই সময়ে তার কাছে উপস্থিত হল সেই কাপালিক। তার প্রিয় শিষ্যের এই পরিণতি দেখে সে অত্যন্ত ক্রোধিত হলো। আর যেদিন রুদ্রকান্তকে অগ্নিদগ্ধ করা হলো সেদিনই ছিল সেই অমাবস্যা যে অমাবস্যায় তার সিদ্ধিলাভ নিশ্চিত ছিল। তাই কাপালিক তখন তাড়াতাড়ি বাকি ক্রিয়া সম্পন্ন করার কাজে লেগে পরলো। সে জীবিত থাকতেই তাকে কাজ সম্পন্ন করতে হবে। তাই সে সেখানেই বসে বাকি ক্রিয়ার কাজ শুরু করে দিল ।

ঘন্টা দুয়েক সব ক্রিয়া সম্পন্ন করে যখন সিদ্ধিলাভের মুহূর্ত উপস্থিত হল ঠিক তখনই রুদ্রকান্ত শেষ মৃত্যু যন্ত্রণায় কুঁকড়ে উঠল। তখন কাপালিক তাড়াতাড়ি নিজের শরীর কেটে কয়েক ফোটা রক্ত বের করে সেই রক্তে সাধনার ক্রিয়া মন্ত্র দ্বারা আবদ্ধ করে রুদ্রকান্তর কপালে সেই রক্তের তিলক এঁকে দিলো। আর ঠিক তখনই শেষ নিঃশ্বাস তার শরীর থেকে বেরিয়ে গেল ।

কাপালিক তখন এক পৈশাচিক হাসি হেসে গ্রামের লোকের উদ্দেশ্যে মনে মনে বলে উঠল। তোমরা রুদ্র কে হত্যা করে যে কত বড় ভুল করেছো তার প্রমান দুদিন পর থেকেই টের পাবে ।অচিরেই এই গ্রাম শ্মশানে পরিণত হবে। ঘরে ঘরে চলবে মৃত্যু লীলা সেই মৃত্যু থেকে কেউ রেহাই পাবে না। আর হলোও ঠিক তাই।

দুদিন পরেই গ্রামে শুরু হলো এক ভয়ানক উপদ্রব। প্রত্যেকদিন এক একটি পরিবারের সবাইকে কেউ যেন নৃশংসভাবে হত্যা করে যাচ্ছে। অন্ধকারে অনেকেই দেখলো এক ভয়ানক বীভৎস মূর্তি প্রচন্ড আক্রোশে গ্রামের চারপাশে ঘুরে বেড়াচ্ছে। ভয়ে সকলে সন্ধ্যার আগে দরজা বন্ধ করে ঘরের ভিতরে বসে থাকতে লাগল। কিন্তু তাও শেষ রক্ষা হল না। সেই অশরীরী ঘরের ছাদ ভেঙ্গে ভিতরে ঢুকে সবাইকে হত্যা করতে লাগলো। এইভাবে প্রত্যেক দিন প্রায় পনেরো কুড়ি জন মানুষকে সে হত্যা করতে লাগল।

গ্রামে হাহাকার শুরু হয়ে গেল। গ্রামের লোকের এইরকম পরিণতি দেখে বড়কুমার দেবকান্ত স্থির থাকতে পারল না। সে তখন বাবা মায়ের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে এর সমাধান খোঁজার উদ্দেশ্যে বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়ল।

কিন্তু তখনকার দিনে আর এখনকার মত এত ঘনঘন লোকালয় ছিলনা। এক গ্রাম থেকে অন্য গ্রামে যেতে হলে কয়েক মাইল পথ অতিক্রম করতে হতো। তাই একটা লোকালয় কোনো দুর্যোগ হলে অন্য লোকালয়ের লোক তা জানতেই পারতো না। যাইহোক এদিকে দেবকান্ত দিনের পর দিন হন্য হয়ে ঘোরার পর একদিন কাশীর কাছে এক তান্ত্রিকের আশ্রমে গিয়ে হাজির হলো। তবে তান্ত্রিকটি ছিল এক বৌদ্ধ লামা।

সে তিব্বতে বহুকাল তন্ত্র সাধনা করে সম্প্রতি কাশীতে এসেছিল। উদ্দেশ্য ছিল বাকি জীবনটা এখানে কাটানোর। তিনি দেবকান্তর মুখে সব কথা শুনে তারপর দিন পর দিনই তার সাথে তাদের গ্রামের উদ্দেশ্যে রওনা দিলেন তারপর অনেক কষ্ট করে কয়েকদিনের পথ চলার পর তারা গ্রামে প্রবেশ করল।

যাওয়া থেকে এখনো পর্যন্ত প্রায় এক মাস অতিক্রম হয়ে গেছে। কিন্তু গ্রামে প্রবেশ করেই সে থমকে দাঁড়াল। কোথায় এসে পড়েছে সে ! কোথায় তার গ্রাম। এখন যেদিকেই চোখ যায় সেদিকেই মৃতদেহ ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে আছে । সব দিকে শেয়াল কুকুর আর শকুনের ছড়াছড়ি। এত বড় গ্রামে জীবিত মানুষ বলতে দুজন তারা তার বাবা আর তার সৎ মা। সে সেখানে বসেই মাথায় হাত দিয়ে কাঁদতে লাগল।

তার সাথে যে তান্ত্রিক এসেছিল সে কোন সাধারণ তান্ত্রিক ছিল না তন্ত্র সাধনায় সে এক উচ্চমার্গের সাধক। গ্রামে পা দিয়েই সে বুঝতে পারল এই মৃত্যুলীলা কোন শ্রেণীর অশরীরীর কাজ। আরো কিছুক্ষণ চোখ বন্ধ করে অনুভব করার পর সে গোটা ব্যাপারটা বুঝতে পারল তখন সন্ধ্যা হতে আর কিছুক্ষণ বাকি আছে তাই সে দেরি না করে কাজে লেগে পড়ল। প্রথমে প্রাথমিক সব প্রক্রিয়া সম্পন্ন করার পর সে সেখানেই একটি যজ্ঞস্থল তৈরি করল।

সবকিছু প্রস্তুতি সম্পন্ন করার পর তার ঝোলা থেকে তিনটি জিনিস বের করল। সেগুলো হলো একটি ঘটি, একটি বিশেষ ধাতুনির্মিত চেন, আর একটি পিতলের মূর্তি, রুদ্রকান্তের আরাধ্যা সেই অশুভ শক্তির প্রতীক। সব প্রস্তুতি সম্পন্ন করে সে সেই অশরীরীর আসার জন্য অপেক্ষা করতে লাগলো। অন্ধকার একটু ঘন হতেই সেই অশরীরীর আবির্ভাব হলো। এদিকে তান্ত্রিক প্রস্তুতই ছিলেন। তাকে দেখেই সে মন্ত্রোচ্চারণ শুরু করল।

সেই মন্ত্রের তীব্রতা এতটাই যে প্রত্যেকবার মন্ত্রটা উচ্চারণের সাথে সাথে সেই অশরীরী কে যেন কোন এক অজানা শক্তি সেই ঘটীটির দিকে যেতে বাধ্য করল। এভাবে প্রত্যেকবার মন্ত্র উচ্চারণের সাথে সাথে সেই অশরীরী আরো কাছে আসতে লাগল। তারপর একসময় সে সুক্ষ থেকে সুক্ষতর হতে হতে ঘটীর ভিতরে প্রবেশ করল। তান্ত্রিক তখন এক মুঠো মুঠো মাটি সেই ঘটীর মধ্যে দিয়ে, একটা ঢাকনা দিয়ে ঘটির মুখটা বন্ধ করে একটা বিশেষ মন্ত্র উচ্চারণ করতে করতে ঘটীটা বেঁধে দিল।

তারপর সেখানেই মাটির মধ্যে কয়েক হাত গভীরে একটা গর্ত করে সেটা সেখানে পুতে দিয়ে সে রাজবাড়ীর দিকে চলতে লাগলেন। সেখানে সারারাত জেগে থেকে সব ঘটনার বিবরণ একটা হরিণের চামড়ার মধ্যে আবদ্ধ করে পরদিন সকালে সেখান থেকে প্রস্থান করলেন। এতক্ষণ একটানা এই ঘটনাটা বলে এবার তারকানন্দ একটু চুপ করলেন।

 

শেষ পর্ব

তারকানন্দ তখন আবার বলতে আরম্ভ করলেন। এতক্ষণ তোমরা যা যা শুনলে সবই পুঁথিতে লেখা ছিল। সবকিছু জেনে এটা বোঝা যাচ্ছে যে সেই অশরীরী তন্ত্র সাধনায় যথেষ্ট পারদর্শী ছিল। আর তার মৃত্যুর পূর্ব মুহূর্তে সেই কাপালিক তার শরীরে এক অসীম ক্ষমতা প্রদান করেছিল। সুতরাং সেই অশরীরী নিঃসন্দেহে প্রচুর ক্ষমতার অধিকারী। আর তাকে প্রতিহত করা কোনো সহজ কাজ নয়।

যেহেতু সে তন্ত্র ক্ষমতায় যথেষ্ট পারদর্শী তাই তাকে প্রতিহত করতে হলে আমাদের তন্ত্রের কোন প্রক্রিয়া প্রয়োগ না করে বুদ্ধি দিয়ে তাকে প্রতিহত করতে হবে। আর এই সময় একটা বিশেষ সুবিধা আমি পেয়েছি।।।

তার আগে তোমাদের একটা কথা বলি, ভগবান বোধহয় আমাদের উপরে সহায় হয়ে আছেন তাই এই মুহূর্তেই একটি বিশেষ ক্ষণ আমাদের সামনে উপস্থিত হয়েছে। আমি তন্ত্রমতে সেই ক্ষনের ব্যাপারে জানতে পেরেছি। সেটি হল ” আর তিনদিন পর পূর্ণচন্দ্র গ্রহণ আর সেই ক্ষণই হবে ওই অশরীরী কে দুর্বল করার চরম মূহূর্ত। সেই রাতই আমাদের কাছে একমাত্র সময়। আমরা যদি বিফল হই তাহলে আর কোন আশার আলো থাকবে না।

তখন এই গ্রামতো শ্মশানে পরিণত হবেই। তার সাথে আশপাশের গ্রামেরও কেউ জীবিত থাকবে না। সেই অশরীরী সবকিছু ধ্বংস করে দেবে। মনোহর বাবু আশ্চর্য হয়ে প্রশ্ন করলেন “বাবাঠাকুর পূর্ণচন্দ্র গ্রহণের দিন আপনি যদি সেই অশরীরী কে প্রতিহত করতে ব্যর্থ হন তাহলে কেন তাকে আর প্রতিহত করা সম্ভব নয়? আর সেই দিনটির গুরুত্বই বা কতটা?। তখন তারকানন্দ আরো গম্ভীর হয়ে বলতে আরম্ভ করলেন ” কিছু কিছু বিশেষ গ্রহণযোগ্য দিন থাকে যেটা শুভ শক্তি এবং অশুভ শক্তি উভয়পক্ষেরই বিশেষ দিন। আর পূর্ণচন্দ্র গ্রহনের সময় ত্রিলোকের সমস্ত অশরীরীর আসুরিক ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়।

তাই এই বিশেষ দিনে তাদের প্রতিহত করা সম্ভব নয়। কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার হলো এই পুঁতিতে ওই অশরীরীর সম্পর্কে একটি বিশেষ নির্দেশ আছে। সেটা হল ওই অশরীরী অভিশাপগ্রস্ত হবার কারণে সে অশুভশক্তির জগত থেকে পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন। তাই এই পূর্ণচন্দ্র গ্রহণ এ যেখানে সকল অশুভ শক্তির ক্ষমতা বৃদ্ধি পায় সেখানে এই অশরীরী তাদের জগৎ থেকে বিচ্ছিন্ন হবার কারণে তার ক্ষমতা হ্রাস পাবে। আর ওই দিনই তাকে প্রতিহত করার কাজ অনেকটাই সহজ হবে।

আর যদি কোনো কারণে ওই দিন আমি ওই অশরীরীকে প্রতিহত করতে ব্যর্থ হই। তাহলে তাকে আটকানো প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়বে। কারণ ওই বিশেষ তিথির পূর্ণচন্দ্র গ্রহণ টি কুড়ি বছরে একবারই হয়। সুতরাং বুঝতেই পারছ ওই দিনটি আমাদের কাছে কতটা গুরুত্বপূর্ণ “।

এই বলে তিনি চুপ করলেন। এবারে মনোহর বাবু হাতজোড় করে বললেন ” বাবাঠাকুর আপনিই আমাদের একমাত্র ভরসা, এই সুন্দর গ্রামটিকে শ্মশানে পরিণত হওয়া থেকে আপনিই রক্ষা করতে পারেন “।

এই বলে তিনি অশ্রুসিক্ত চোখে তার দিকে তাকিয়ে রইলেন। একথার কোন প্রতুত্তর না দিয়ে কিছুক্ষণ চুপ করে মাথা নিচু করে বসে রইলেন তারপর মাথা না তুলেই তারকানন্দ ধীরে ধীরে বললেন ” সেই অশরীরীও জীবিত থাকা অবস্থায় তন্ত্র সাধনা করেছিলো, সেই হিসেবে তন্ত্রের বহু গূঢ় বিদ্যা তার করায়ত্ত। সুতরাং তাকে তন্ত্রের সাহায্যে আটকানো প্রায় অসম্ভব। পূর্ণচন্দ্র গ্রহণের দিন তার অশুভ ক্ষমতা কিছুটা হ্রাস পাবে মাত্র। কিন্তু তার তন্ত্র বিদ্যা তার মধ্যে বর্তমান থাকবে।

তাই আমি তন্ত্রের সাহায্যে কিছু করতে উদ্যত হলে সেটা সে আগে থেকেই বুঝতে পেরে যাবে। তখন সে ক্ষমতা কমার কারণে হয়তো আমার কোন ক্ষতি করতে সাহস পাবেনা। কিন্তু পালিয়ে গিয়ে নিজেকে রক্ষা করতে পারবে। তাহলে সেদিন তাকে আর প্রতিহত করা যাবে না। আর ওই দিন সে রক্ষা পেলে আগামী কুড়ি বছর তাকে আর কোনোভাবেই আটকানো সম্ভব হবে না। তখন সে আরো নিষ্ঠুর আর নির্মমভাবে মানুষ হত্যা করবে। তাই ওইদিন তাকে প্রতিহত করতে হলে তার উপর কোন তন্ত্র প্রক্রিয়া প্রয়োগ করা যাবেনা। বুদ্ধির দ্বারা তাকে এমন এক অবস্থায় এনে ফেলতে হবে যে অবস্থায় তাকে প্রতিহত করা অনেকটাই সোজা হবে। ।তেমনি একটা রাস্তা আমাকে ভাবতে হবে” ।

এই বলে তিনি উঠে দাঁড়িয়ে ফিরে ধীরে বৈঠকখানায় পায়চারি করতে লাগলেন আর ভ্রু-কুঞ্চিত করে গভীর চিন্তামগ্ন হলেন। এইরকমভাবে অনেকটা সময় কাটার পর তিনি বেশ উত্তেজিত হয়ে আবার চেয়ারে এসে বসে পড়লেন। তার চোখ-মুখ তখন উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে, তিনি তখন একটু উত্তেজিত হয়েই মনোহর বাবুকে বলতে লাগলেন ” বুদ্ধির দ্বারা সেই অশরীরীকে প্রতিহত করার একটা রাস্তা আমি পেয়েছি “।

একথা শুনে মনোহর বাবু এবং রাধারমন বাবু দুজনেরই মুখে আশার আলো ফুটে উঠল। তখন তারকানন্দ আবার বলতে লাগলেন ” আমি এখন সব কিছু বলবো না, শুধু ঠিক ঠিক সময়ে কি কি করনীয় আমি সেটা বলে দেবো। এবারে আমাকে একটা কথা বল ” এই গ্রামে এমন কোন মৃতশিল্পী আছে যে তিন দিনের মধ্যে একটা চার ফুটের শিবমূর্তি তৈরি করে দিতে পারবে “?. তখন মনোহর বাবু একটু ভেবে নিয়ে বলল ” হ্যাঁ আছে, গ্রামের পূর্ব দিকে কয়েক ঘরে মৃতশিল্পী আছে ,,তাদের অনুরোধ করলে গ্রামের ভালোর জন্য তারা তিন দিনের মধ্যে চার ফুটের শিবমূর্তি তৈরি করে দিতে পারবে “।

তারকানন্দ বললেন ” খুব ভালো, তাহলে দেরী না করে এখনই তাদের কাছে গিয়ে শিবমূর্তি তৈরীর কথা বলে এসো। আর বলবে যেন অবশ্যই তিন দিনের মধ্যে মূর্তি তৈরি করে দেয় “।

তখন মনোহর বাবু রাধারমন বাবুকে সঙ্গে করে নিয়ে মৃৎশিল্পীদের উদ্দেশ্যে বেরোবার জন্য দরজার কাছে পৌঁছতেই পেছন থেকে তারকা নন্দ বলে উঠলো ” আরও একটা বিশেষ কথা মৃৎশিল্পীদের বলবে,,, তখন মনোহর বাবু এবং রাধারমন বাবু পিছনে ফিরে আশ্চর্য হয়ে জিজ্ঞাসা করল,, কি বিশেষ কথা??।

তখন তারকানন্দ ধীর পায়ে তাদের কাছে এসে বললেন “” মূর্তিটির গায়ের রঙ যেন কুচকুচে কালো হয়,, আর তার মুখমন্ডল যেন ভয়ংকর-দর্শন হয়””। একথায় দুজনেই প্রচন্ড আশ্চর্য হয়ে কিছুক্ষণ তারকানন্দের মুখের দিকে তাকিয়ে রইল।

তারপর কাঁপা কাঁপা গলায় বললো ” বাবাঠাকুর আপনি আপনি স্বয়ং কাল! কাল! “” এই পর্যন্ত বলে তার গলা কেঁপে উঠলো। তখন তারকানন্দ তার মুখের কথাটা কেড়ে নিয়ে বললেন “” হ্যাঁ ঠিকই বুঝেছ আমি মহাদেবের সবচেয়ে ভয়ংকর অবতার কালভৈরবের মূর্তি তৈরি করার জন্য নির্দেশ দিচ্ছি।

কারণ পৃথিবী সৃষ্টির আদি থেকে এখনো পর্যন্ত তন্ত্রের সবচেয়ে ভয়ঙ্কর এবং ক্ষমতাশালী রুপ হিসাবে কালভৈরব কে মানা হয়। এখনও একটি বিশেষ সম্প্রদায়ের অঘোরী তান্ত্রিক আছে, যারা এই পার্থিব সকল ধ্যানজ্ঞান বিসর্জন দিয়ে কোন এক দুর্গম স্থানে কালভৈরবের আরাধনা করে চলেছে।

কালভৈরবের আরাধনা করা যতটা কঠিন ততটাই কষ্টসাধ্য। আমি নিজেও সেই সাধনার প্রক্রিয়া। বীজ মন্ত্র। মূর্তিতে প্রাণ প্রতিষ্ঠা প্রক্রিয়া। আমার গুরুদেবের কাছ থেকে শিখেছি ।এখন আমার সৌভাগ্য হয়েছে সেই শিক্ষাকে কাজে লাগানোর। তিনদিন পর পূর্ণচন্দ্র গ্রহণের বিশেষ তিথি। সেইদিন আমি ওই মূর্তিতে প্রাণ প্রতিষ্ঠা করব। তার জন্য আজ থেকেই আমাকে বিশেষভাবে সাধনার মধ্যে দিয়ে নিজেকে উপযুক্ত তৈরি করতে হবে।

আজ সন্ধ্যায় এক বিশেষ পূজার পর আমি সেই সাধনা শুরু করব। আর তার জন্য আমাকে কিছু নিয়ম মেনে চলতে হবে,, এই তিন দিন আমার পোশাক পরিধেয়,, আমার খাওয়া দাওয়া,, এসবই করতে হবে বিশেষ শৃংখলার মধ্যে “” । তখন মনোহর বাবু হাতজোড় করে বললেন “” বাবাঠাকুর আপনার খাওয়া-দাওয়ার ব্যাপারে যদি একটু বলে দেন, তাহলে সেগুলোর আগে থেকে ব্যবস্থা করে রাখতাম ” । তখন তারকানন্দ তার কাঁধে হাত রেখে বললেন ” ব্যস্ত হয়ো না,, আমার খাবার নিয়ে তোমাকে কোনো চিন্তা করতে হবেনা,, আর সেসব খাবারও এমন কিছু দুষ্প্রাপ্য নয় যে তোমাকে আগে থেকে সেগুলি জোগাড় করতে হবে,,

একথার প্রত্যুত্তরে মনোহর বাবু তার দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন।। তখন তারকানন্দ মৃদু হেসে তাকে বললেন ” আমি এই তিনদিন যে সাধনা করব সেই সাধনারত অবস্থায় আমার খাবার হবে মানুষের উচ্ছিষ্ট ভোজ্যবস্তু, অর্থাৎ তোমাদের খাবার পর তোমাদের এঁটোকাটা আর উচ্ছিষ্ট যেসব খাবার পড়ে থাকবে সেটাই হবে আমার খাদ্য। আর আমার পোশাক হবে শুধু এক টুকরো কাপড় বা নেংটি। যেটা শুধু আমার নিম্নাঙ্গের লজ্জা নিবারণ করবে। সেটুকু ছাড়া আমার বাকি সারাশরীর অনাবৃত থাকবে “।

একথা শুনে মনোহর বাবু অত্যন্ত কুণ্ঠিত হয়ে বললেন ” কিন্তু বাবা ঠাকুর আপনি এত বড় পুণ্যাত্মা মানুষ,, আপনি যদি আমাদের উচ্ছিষ্ট খান তাহলে যে আমাদের নরকেও জায়গা হবে না “।।

একথা শুনে তারকানন্দ বললেন ” তুমি নিজের মন ছোট করোনা,, কারণ তুমি যেটা করছ সেটা আমার নির্দেশে করছ,, সুতরাং এটা কোন পাপ কাজ নয়। বরং মানব কল্যাণে এবং তন্ত্রের সাহায্যার্থে তুমি পুণ্যের কাজেই করছো। আর তোমাকে আমার আর আর একটা গুরুত্বপূর্ণ কথা বলার আছে। কিন্তু সেই কথাটা বলার আগে আমি তোমাকে একটা প্রশ্ন করতে চাই “”। মনোহর বাবু হাতজোড় করে বললেন ” বলুন বাবাঠাকুর আপনি কি জানতে চান “।

তখন তারকানন্দ বললেন ” আমি যে প্রশ্নটা করছি এর উত্তরটা তুমি তোমার হৃদয়ের অন্তস্থল থেকে দেবে,, প্রশ্নটা হলো ”’ এই গ্রামের মানুষের সুখের জন্য যদি তোমার জীবনের অনেক বড় আত্মত্যাগের প্রয়োজন হয় তুমি কি সেটা দিতে পারবে “??। এই বলে তিনি ভাষা ভাষা চোখে মনোহর বাবুর দিকে তাকিয়ে রইলেন।

তখন মনোহর বাবু হাতজোর করে আবার বলতে লাগলেন “” বাবাঠাকুর আমার কোনো সন্তান নেই,, কিন্তু তার জন্য আমি বা আমার স্ত্রী কোনদিন আক্ষেপ করিনি। কেন জানেন ? কারণ এই গ্রামের প্রত্যেক মানুষকে আমরা সন্তানের ন্যয় স্নেহ করি। সুখ দুঃখে সবসময় পাশে থাকার চেষ্টা করি। সবাই যাতে সুখী হয় সর্বদাই সেই চেষ্টা করি,, এই গ্রামের প্রত্যেকটা মানুষ আমার সন্তানতুল্য তাই এদের সুখের জন্য যদি আমার প্রাণও উৎসর্গ করতে হয় তাও আমি হাসিমুখে সেটা উৎসর্গ করতে রাজি আছি। আপনি শুধু নিঃসংকোচে বলুন আমাকে কি করতে হবে “”।

এই বলে তিনি আবার মাথা নিচু করলেন,,,। তখন তারকানন্দ স্নেহ পূর্বক তার কাঁধে হাত রেখে বললেন ” তোমার মত মানুষেরা পৃথিবীতে আছে বলে পৃথিবীটা এখনো পাপের আঁধারে ডুবে যায়নি,,,। শোনো এই গ্রামের মানুষের রক্ষা করার ভার আমি তোমার ওপর দেবো।। গতকাল আমি গ্রামবন্ধন করেছিলাম,, আর সেই বন্ধনীর ক্ষমতা চারদিন অটুট থাকে। অর্থাৎ পূর্ণচন্দ্র গ্রহণের দিন এই গ্রাম বন্ধন থেকে মুক্ত হবে।

আর এই চারদিন সেই অশরীরী কোন মানুষকে হত্যা করতে পারেনি বলে সেইদিন সে মরিয়া হয়ে সেই চেষ্টাই করবে,,, তখন তুমি তার সামনে যাবে,,, বাকি কার্য ভগবান নিজেই করবেন। আমি চাইনা এই অশরীরি আবারো কোনদিন পৃথিবীর বুকে ফিরে আসুক।। আমি একে চিরতরে এই পৃথিবীর বুক থেকে মুছে দিতে চাই ” । এই বলে তিনি মনোহর বাবুকে বিদায় দিলেন।। এদিকে মনোহর বাবুও তারকানন্দের কথা মতো সব কাজ সম্পন্ন করে ফিরে এলেন।

দেখতে দেখতে তিনদিন পেরিয়ে সেই বিশেষ দিনটি উপস্থিত হলো। এই তিনদিন তারকানন্দ একটা ঘরের মধ্যেই থাকতেন।। বাইরে বেরোতেন না। তার পরনে শুধুমাত্র একটা ছোট কাপড় তার লজ্জা নিবারণ করছিল। আর তার খাদ্য ছিলো মনোহর বাবুদের পাতের ভুক্তাবশেষ।।

এই দিন সকালের দিকে শিব মন্দিরের কাছেই একটা জায়গা পরিষ্কার করে কালভৈরবের মূর্তি প্রতিষ্ঠা করলেন। সারাদিন তারকানন্দ নানান উপাচারে পূজা করার পর,, সন্ধ্যার কিছুটা পূর্বে সকল গ্রামবাসীদের বিদায় দিয়ে শুধু মনোহর বাবুকে সঙ্গে রেখে দিলেন।। তারপর মনোহর বাবুকে সঙ্গে নিয়ে পূজা স্থলের কিছুটা অংশ বাদ দিয়ে বাকি গ্রামটা বন্ধন করার কাজ সম্পন্ন করলেন।। তারপর পুজোর সমস্ত উপকরণ সরিয়ে দিয়ে কালভৈরবের মূর্তিটা একটা কাপড় দিয়ে ঢেকে দিলেন।। তারপর জঙ্গলের দিকের কিছুটা অংশ বাদ দিয়ে বাকি অংশটা মন্ত্র দ্বারা বন্ধন করে দিলেন।

তারপর অন্ধকার একটু ঘন হবার পর তারকানন্দ মনোহর বাবুকে যা যা করণীয় ভালো করে বুঝিয়ে দেবার পর শুধু একটাই কথা বললেন “” ভগবানের উপর বিশ্বাস রাখো,, আর মনে মনে তাকে ডাকো। সেই অশরীরী তোমার কোন ক্ষতি করতে পারবেনা। এই বলে তিনি মনোহর বাবুকে কালভৈরবের মূর্তিটি আড়াল করে দাঁড় করিয়ে কিছুটা দূরে খননের জায়গায় এসে একটা মাটির ঢিপির আড়ালে লুকিয়ে বসে রইলেন।।

এভাবে অনেকটা সময় কাটার পর রাত প্রায় সোয়া বারোটা নাগাদ জঙ্গলের দিক থেকে একটা প্রচণ্ড বাতাস এই দিকে এগিয়ে আসতে লাগলো। মনোহর বাবু একমনে ভগবানের নাম স্মরণ করতে লাগলেন। মনোহর বাবু দেখলেন জঙ্গলের ভিতর থেকে তারই দিকে এগিয়ে আসছে এক গাঢ় অন্ধকারের অবয়ব।

সেটা দেখে তিনি বিচলিত না হয়ে আরো কাছে আসার জন্য অপেক্ষা করতে লাগলেন। সেই অশরীরী যে অংশটা বন্ধন করা ছিলো না সেই অংশটা অতিক্রম করতেই তারকানন্দ তাড়াতাড়ি গিয়ে সেই অংশটা বন্ধ করে দিয়ে তার ফেরার রাস্তা বন্ধ করে দিলেন। ওদিকে মনোহর বাবুও তৈরীই ছিলেন। সেই অশরীরী তার কাঙ্খিত সীমার মধ্যে আসতেই তিনি তাড়াতাড়ি পিছন ফিরে কালভৈরবের মূর্তির কাপড়ের আবরণটা সরিয়ে দিয়েই তাড়াতাড়ি বন্ধনের গন্ডির বাইরে বেরিয়ে এলেন।

এই আচমকা ঘটনায় সেই অশরীরি এক মুহূর্তের জন্য হতভম্ব হয়ে গেলেও পরমুহুর্তেই তাড়াতাড়ি পিছন ফিরে পালাবার চেষ্টা করলো। কিন্তু কোথায় পালাবে ততক্ষণে তারকানন্দ সেই ফাঁকা অংশটা বন্ধন দিয়ে দিয়েছে। তাই দেখে সে প্রচন্ড আক্রোশে ফেটে পড়তে লাগলো। এরপর মনোহর বাবু এবং তারকানন্দ দুজনেই আশ্চর্য হয়ে দেখলেন , কালভৈরবের চোখ থেকে এক নীলাভ আলো বেরিয়ে এসেই ওই অসরীরীর শরীরের উপর পড়ছে। আর সেই অশরীরী প্রচণ্ড যন্ত্রণায় আর্তনাদ করছে । এরপর ধীরে ধীরে সেই অশরীরী মিলিয়ে যেতে লাগল।

মিলিয়ে যাওয়ার সময় তারকানন্দ এবং মনোহর বাবু দেখলেন একটা আবছা মানুষের অবয়ব সেখান থেকে ফুটে উঠেছে।। সেই অবয়বটা জোড়হাতে কালভৈরবের মূর্তিকে প্রণাম রত অবস্থায় আস্তে আস্তে মিলিয়ে গেল।তারকানন্দ এবং মনোহর বাবু দুজনেই বুঝলেন যে সেই মূর্তিটা সেই অভিশপ্ত রুদ্রাকান্তের।তখন আনন্দে মনোহর বাবুর দুই চোখ দিয়ে অনবরত জল পড়তে লাগল।। তিনি তারকাদের পা ধরে কাঁদতে লাগলেন।

তখন তারকানন্দ তাকে উপরে তুলে তার কাঁধে হাত রেখে বলল “” আজকে পৃথিবী থেকে যে একটা ভয়ঙ্কর পাপ নিশ্চিহ্ন হল, এই কাজে কিন্তু তোমার অবদানই সবচেয়ে বেশি।। আমিতো শুধু আমার করনীয় তোমাকে বুঝিয়ে দিয়েছি।। তুমি তোমার সাহস দিয়ে তাকে প্রতিহত করেছ।।

ঠিক আছে এখনো অনেক রাত বাকি আছে। এখন বাড়ি ফিরে চলো “। এই বলে তারা দুজনে বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দিল।। ঘন্টা কয়েক তারকানন্দ মনোহর বাবুর বাড়িতে কাটিয়ে ভোর হবার আগের মুহূর্তে তিনজনে বেরিয়ে পড়লেন।। গ্রামের সীমানার কাছে পৌঁছে তারকানন্দ তাদের কাছ থেকে বিদায় নিলেন।। মনোহর বাবু এবং রাধারমন বাবু অশ্রুসিক্ত চোখে তাকে বিদায় দিয়ে যখন গ্রামের দিকে পা বাড়ালেন তখনই সূর্যের প্রথম কিরণ পৃথিবীর বুকে পড়তে আরম্ভ করেছে।। অনেকদিন পর এই প্রথম সূর্যোদয় যেন এক শান্তির বার্তা নিয়ে মুকুন্দপুর গ্রামে ছড়িয়ে পড়তে লাগলো।

 

 

(মুকুন্দপুরের অভিশপ্ত পিশাচ গল্পটি আপনাদের কেমন লাগলো তা কমেন্ট করে অবশ্যই জানাবেন।

পরবর্তী গল্প পড়ার আমন্ত্রণ জানালাম। ধন্যবাদ।)

সমাপ্ত”