রাবেয়া – ছোট গল্প

রাবেয়া

লেখকঃ রেজাউল করিম আকাশ

 

ঘটনার সুত্রপাত হয়েছিল ঢাকার একটা ছাত্রী হোস্টেল এ। আমার  ফুফু এবং তার এক বান্ধবী রাবেয়া সেই হোটেলেই থাকতেন। রাবেয়া আপুর সাথেই ঘটেছিল সেই মর্মান্তিক ঘটনা।

সাল ২০০৭, আমার ফুফু এবং রাবেয়া আপু তখন মেডিকেল এডমিশন এর প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন এবং ১ সপ্তাহের জন্য তারা সেই ছাত্রী হোস্টেল এ উঠেছিলেন। তাদের উদ্দেশ্যে ছিলো, সেখান থেকেই পড়ে পরীক্ষা’টা দিয়ে আবার গ্রামে চলে আসা তাই ১ সপ্তাহের জন্য দুজন হোস্টেল এ উঠেছিল।

প্রথম দিন সব ঠিকঠাক ই ছিলো, ঘটনা শুরু হয় পরের দিন রাতে। রাত আনুমানিক ১১ টা, ফুফু এবং রাবেয়া আপু পড়ছিলেন। হঠাৎ রাবেয়া আপু টয়লেট গিয়ে পড়ে যায় এবং তার কাপড় ভিজে যায়।

তাই সে ফ্রেশ হয়ে কাপড় গুলো নাড়তে বারান্দায় যায়। বারান্দায় গিয়ে রাবেয়া আপু অনুভব করে, খুবই মিষ্টি একটা গন্ধ ওপর থেকে আসতেছে।

গন্ধ’টা তাকে খুব আকর্ষিত করে তাই সে না বলেই ছাদে চলে যায়। রাত প্রায় সাড়ে ১২ টা বেজে যায় কিন্তু তখনও রাবেয়া আপু আসছিল না দেখে, ফুফু তাকে খুঁজতে বের হয়। খুঁজতে খুঁজতে এক পর্যায়ে ছাদে গিয়ে দেখে, রাবেয়া আপু একমনে নিচের দিকে তাকিয়ে বসে আছে।

দেখে মনে হবে সে ধ্যান করছে। ফুফু পেছন থেকে কয়েক বার ডাকার পরেও সে সাড়া দেয় না। তাই ফুফু কাছে গিয়ে তার গায়ে স্পর্শ করা মাত্রই সে অজ্ঞান হয়ে যায়।

হোস্টেলের বাকিরা মিলে তাকে রুমে নিয়ে আসে, মাথায় পানি দিয়ে তার জ্ঞান ফেরায়। কিছুক্ষণের মধ্যেই সে স্বাভাবিক হয়ে যায় কিন্তু একটু আগে কি হয়েছিল এবং সে ছাদে কি করছিল তা আর মনে করতে পারছিল না।

সবাই ভাবে হয়তো অতিরিক্ত পড়ার কারণে শরীর দুর্বল হয়ে পড়েছে তাই এমন’টা হয়েছে। সেদিন রাত’টা স্বাভাবিক ভাবেই কেটে যায়।

পরের দিন রাতে হঠাৎ ফুফুর ঘুম ভেঙে যায় এবং উনি খেয়াল করেন রাবেয়া আপু ঘরে নেই। খোঁজাখুঁজি করে তাকে আবারও ছাঁদে একই অবস্থায় পাওয়া যায়। কিন্তু এবার আর সে জ্ঞান হারালো না, তাকে ডাক দেওয়া মাত্রই সে মাথা নিচু করে রুমে এসে শুয়ে পড়ে।

পরদিন ফুফু তাকে জিজ্ঞেস করলে রাবেয়া আপু বলে, “তুমি হয়তো স্বপ্ন দেখেছো, আমি কেন এত রাতে ছাঁদে যাবো”। একই ঘটনা তৃতীয় দিন ও ঘটে। কিন্তু এবারও রাবেয়া আপু স্বীকার করে না কেন সে ছাঁদে গিয়েছিল।

বিষয়’টা ফুফুর মনে অদ্ভুত লাগে, তাই তিনি ভাবেন আজকে রাতে তাকে পাহাড়া দেবে। যেই ভাবা সেই কাজ। রাতে ফুফু ঘুমের ভান করে শুয়ে পড়ে এবং খানিকক্ষণ পর দেখতে পায়, রাবেয়া আপু সেদিনও ঘুম থেকে উঠে ছাঁদের দিকে যাচ্ছিল। ফুফুও তার পিছু পিছু যেতে থাকে।

প্রতিদিনের মতো আজকেও, রাবেয়া আপু মাথা নিচু করে বসে পড়ে এবং হঠাৎ কারো সাথে কথা বলতে এবং হাসাহাসি করতে শুরু করে। সেখানে ফুফু এবং রাবেয়া আপু ছাড়া আর কেউ ছিলো না।

ফুফু ভাবে তাকে ভয় দেখানোর জন্যই হয়তো রাবেয়া আপু এমন করছে। তাই ফুফু আরেকটু সামনে গিয়ে তাকে ডাক দেয়।

রাবেয়া আপুকে ডাক দেওয়া মাত্রই ফুফু অনুভব করে, বাতাসের গতিতে অদৃশ্য কোনো জিনিস তার পাশ কাটিয়ে চলে গেছে। ফুফুর চুলগুলো তখনও উড়ছিল। এরই মাঝে রাবেয়া আপু খুব রাগান্বিত ভাবে ফুফুর কাছে আসে এবং ফুফু কে একটা থাপ্পড় দিয়ে বলে, “তুমি এখানে কেনো এসেছো”।

বলেই সে রুমে চলে যায়। ফুফু কিছুটা হতভম্ব হয়ে যায়, কিছুই বুঝতে পারছিলেন না যে এগুলো কি হচ্ছে। হঠাৎ নিচে চেচামেচি শুনে ফুফু দ্রুত নিচে চলে আসে এবং দেখতে পায়, রাবেয়া আপু পাগলের মতো ব্যবহার করছে এবং তার কাপড়চোপড় গোছাচ্ছে।

সে এখনই বাড়িতে চলে যাবে, তাকে  দুজন মিলেও ধরে রাখা যাচ্ছে না। এক পর্যায়ে তাকে বিছানার সাথে বেধে দেয়া হয়।

পুরো রাত এভাবেই ছটফট করে ফজরের আগে সে শান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়ে। ফুফু রাবেয়া আপুর বাড়িতে কল দিয়ে বিষয়’টা আগেই জানিয়ে দিয়েছিল।

রাবেয়া

রাবেয়া আপুর আব্বু পরদিন ই হোস্টেল এ চলে আসে এবং একমাত্র মেয়ের এমন অবস্থা দেখে হকচকিয়ে যান। ফুফু তাকে সবটা বুঝিয়ে বলে আর আংকেল সেদিনই রাবেয়া আপু কে বাড়িতে নিয়ে যায়।

পরবর্তীতে ফুফু কয়েকবার তাদের বাড়ির কল করেছিল কিন্তু তারা আর কল ধরে নি। পরীক্ষাও দিতে আসে নি রাবেয়া আপু। ফুফু একাই পরীক্ষা শেষ করে বাড়িতে ফিরে আসে।

রাবেয়া আপুর গ্রাম খুব বেশি দূরে ছিলো না তাই ফুফু সেদিনই তাকে দেখতে যায়। তাদের বাড়িতে গিয়ে ফুফু অবাক হয়ে যায় কারণ সেদিন রাবেয়া আপুর বিয়ে ছিলো। পুরো বাড়ি বরযাত্রী আর কোলাহলে ভরপুর। রাবেয়া আপুর সাথেও সেদিন তার আর কথা হয় নি।

পরদিন ফুফু আবার তাদের বাড়িতে যায় এবং আন্টি কে জিজ্ঞেস করে, কি হয়েছিল, কেন রাবেয়া কে বিয়ে দিয়ে দিলো। তখন আন্টি বলেন, বাড়িতে আসার পরেও রাবেয়া পাগলামি করছিলো। কিছুতেই তাকে শান্ত করা যাচ্ছিলো না। কোথাও চলে যাওয়ার জন্য সে উঠেপড়ে লেগেছিল।

তাই আমরা একজন হুজুর নিয়ে এসেছিলাম। হুজুর দুইদিন চিকিৎসা করার পর রাবেয়া স্বাভাবিক হয়। হুজুর বলেন, “রাবেয়ার উপর কোনো খারাপ জ্বীনের নজর পড়েছে।

যার সাথে রাবেয়া কয়েকদিন কথাও বলেছে। সেই জ্বীন টাই রাবেয়া কে তার সাথে নিয়ে যেতে চায়। রাবেয়ার শরীর আমি বন্ধ করে দিয়েছি কিন্তু জ্বীন টাকে জব্দ করা যায় নি। সে আবারও রাবেয়ার কাছে আসতে পারে, তাই যতদ্রুত সম্ভব রাবেয়া কে বিয়ে দিয়ে দিন, তাহলেই এই সমস্যার সমাধান হবে”।

এজন্যই আমরা তাড়াহুড়ো করে রাবেয়ার বিয়ে’টা দিয়ে ফেলি। বলেই আন্টি কাঁদতে শুরু করেন। শুনে আমার ফুফুর ও খুব খারাপ লাগে কারণ মেয়েটা এতদূর এসেও পড়াশোনা টা শেষ করতে পারলো না।

একটা ঘটনা তার জীবন টাই পালটে দিলো। ফুফু আর কথা বারায় নি, আন্টি কে শান্তনা দিয়ে বাসায় চলে আসে। ঘটনা’টা এখানে শেষ হলেও পারতো তাহলে আর এতগুলো জীবন নষ্ট হতো না। কারণ বিয়ে করা’টা রাবেয়া আপুর জীবনে আরও বড় অভিশাপ নিয়ে আসে।

ফুফু প্রথম বর্ষের পরীক্ষা দিয়ে বাড়িতে আসে। জানতে পারে, রাবেয়া আপুও তার বাবার বাড়িতে এসেছে।

তার গতকাল কেই একটা ছেলে বাবু হয়েছে। ফুফু খুবই আনন্দের সাথে তাদের বাড়িতে যায়। অনেক দিন পর তাদের দেখে ফুফু আবেগপ্রবণ হয়ে যায়। অনেক আলাপ করে রাবেয়া আপুর সাথে। বাবু’টার বয়স তখন মাত্র ৩ দিন।

দেখতে একদম মায়ের মতো। নাম রেখেছিল জুনাইদ। অঘটন’টা ঘটে জুনাইদ এর ৭ম দিনে। যখন তাকে গোসল করানোর জন্য প্রথম বারের মতো ঘরের বাইরে আনা হয়। জুনাইদ এর নানি মানে রাবেয়া আপুর আম্মু, জুনাইদ’কে বারান্দায় রেখে রান্নাঘরে যান গরম পানি আনার জন্য। গ্রামে রান্নাঘর একটু দূরেই হয়। তাই গরম পানি আনতে তার বড়জোর এক থেকে দেড় মিনিট সময় লেগেছিল।

কিন্তু জুনাইদ এর কাছে এসে উনার চোখ ছানাবড়া হয়ে গিয়েছিল; কারণ জুনাইদ এর সম্পূর্ণ শরীর নীল হয়ে গিয়েছিল এবং তার মুখ দিয়ে ফেনা বের হচ্ছিল। পরক্ষণেই উনি চিৎকার করতে শুরু করেন এবং ঘর থেকে রাবেয়া আপু বেরিয়ে আসেন।

একমাত্র সন্তানের এই অবস্থা দেখে রাবেয়া আপু সেখানেই অজ্ঞান হয়ে যান। মুহুর্তেই মানুষে ভরে যায় রাবেয়া আপুর বাড়ি।

কিছুক্ষণ পরই একজন ডাক্তার এসে জানায়, জুনাইদ এর গায়ে বিন্দুমাত্র রক্ত নেই, তাই রক্তশূন্যতার কারণে সে মারা গেছে। হাহাকার আর কান্নায় ভরে যায় রাবেয়া আপুর বাড়িতে।

সবাই এটাই ভাবে রক্তশূন্যতার কারণে জুনাইদ এর স্বাভাবিক মৃত্যু হয়েছে।  কিন্তু কেউ কখনও চিন্তাও করতে পারে নি এই ঘটনা পিছনে পুরোনো কোনো কারণ ছিলো।

তারপর কেটে যায় আরও কিছু মাস। রাবেয়া আপু আবারও প্রেগন্যান্ট হয়। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত তার বাচ্চা’টা মিসক্যারেজ হয়ে যায়। এভাবে পর পর তার আরও দুইটা বাচ্চা নষ্ট হয়ে যায়।

এবার রাবেয়া আপু খুব ভেঙে পড়ে। ঘর থেকে বের হওয়া, খাওয়াদাওয়া সব বন্ধ করে দেন। তার সংসার এও নেমে আসে অশান্তি। সবমিলিয়ে যেন তিনিও মৃত্যুর কোলে ঢেলে পড়ছিলেন।

শেষমেশ রাবেয়া আপু’কে সিলেটে একটা কবিরাজ এর কাছে নিয়ে যাওয়া হয়। সেই হোস্টেল থেকে শুরু করে এখন পর্যন্ত সমস্ত ঘটনা তাকে খুলে বলা হয়। কবিরাজ সব শুনে সেদিনই আসর বসায়, সেই জ্বীন টার সাথে কথা বলার জন্য।

অনেক’টা সময় অতিবাহিত হওয়ার পর সে হাজির হয়। কবিরাজ তখন তাকে জিজ্ঞেস করে কেন সে রাবেয়া আপুর সাথে এমন করছে, কেন এতগুলো জীবন নষ্ট করেছে, কি চায় সে।

তখন জ্বীন’টা বলে, রাবেয়া আপু তাকে ওয়াদা করেছিল যে সে জ্বীন টাকে বিয়ে করে, তার সাথে চলে যাবে। আর জ্বীনদের কাছে নাকি ওয়াদা জিনিস টা অনেক গুরুত্বপূর্ণ। তারা কখনোই ওয়াদা ভঙ্গ করে না।

রাবেয়া আপু অন্য  কাউকে বিয়ে করায় এবং তার কথার খেলাপ করায় সে খুবই রেগে গেছে। তাই সে প্রতিশোধ নিচ্ছে।

যেভাবেই হোক সে রাবেয়া আপু কে সাথে নিয়ে যাবে নয়তো তার জীবন নরক বানিয়ে ফেলবে। এসব শুনে কবিরাজ তাকে অনেক বোঝানোর চেষ্টা করে যে মানুষের সাথে জ্বীন দের এমন সম্পর্ক সম্ভব না, এটা কখনোই হবে না।

কিন্তু জ্বীন টা কিছুতেই তার কথা থেকে নড়ে না। সে রাবেয়া আপু কে নিয়ে যাবেই। শেষে কবিরাজ তার পালিত জ্বীনের মাধ্যমে সেই জ্বীন টাকে বন্দী করে ফেলে। পরবর্তীতে জ্বীন টাকে কি করা হয়েছিল আর জানা যায় নি।

তবে রাবেয়া আপু তারপর থেকে সুস্থ হতে থাকে। এখন তার একটা তিন বছরের মেয়েও আছে। কিন্তু জুনাইদ এবং বাকি তিনটে সন্তান হারানোর কষ্ট আজও সে ভুলতে পারে নি।

 

 

{ আরো পড়ুন – ভূতের ভয়

 

( রাবেয়া – ছোট গল্পটি আপনাদের কেমন লাগলো তা কমেন্ট করে অবশ্যই জানাবেন।

পরবর্তী গল্প পড়ার আমন্ত্রণ জানালাম। ধন্যবাদ।)

রাবেয়া

” সমাপ্ত”