সে আসে – ভয়ঙ্কর এক আত্মার কাহিনী

পর্ব০১

সে আসে-

আমার বিয়ের রাতে আমার বর একটা তাবিজ গিফট দিলো। আমি অবাক হয়ে বললাম, ‘এটা কি?’

আমার বর সাজু খানিকটা লজ্জা পেয়েই বললো, ‘তাবিজ।’

‘সেটা তো বুঝতেই পারছি‌। কিন্তু এটা কেন?’

‘সময় আসুক। বুঝবা।’

আমার ভীষণ রাগ লাগলো। বান্ধবীদের কাছে এতো এতো গল্প শুনেছি বিয়ের রাতের, তাদের বর হিরার আংটি, রুপার নেকলেস, এসব কিছু উপহার দেয়, আর আমি কিনা পেয়েছি তাবিজ। তাও খুব দামি কোন তাবিজ না, সস্তা টিনের কালো সুতা পরানো তাবিজ। সুতাটাও ছোট। ওটা গলায় দেয়া যাবে না, হাতে বাঁধতে হবে।

রাগে সে রাতে আমার ঘুম আসলো না। সাজু খানিকক্ষণ মিষ্টি মিষ্টি কথা বলে আমাকে কাছে টানবার চেষ্টা করছিলো, কিন্তু নেগেটিভ রেসপন্স দেখে শেষমেষ ভোঁসভোঁস করে নাক ডাকতে লাগলো। আর আমার উঠলো রাগ। নিজের উপর, নিজের কপালের ওপর। কেন যে এই ছেলেটার প্রেমে পড়তে গেলাম! কেন যে বাবা-মার অমতে একে বিয়ে করতে গেলাম!

আমার বাবা-মা বিয়েতে অমত করলেও বিয়ের অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন। কন্যাদানের ব্যাপার-স্যাপার সব সুন্দর মতোই সমাধা করেছেন। যাওয়ার আগে মা আমাকে ধরে অনেক কান্নাকাটি করেছেন। কাঁদতে কাঁদতে বলেছেন, ‘এতো আদরে বড় হয়েছিস তুই, এরকম গরীব ঘরে গিয়ে থাকবি কেমনে?’

আমিও কাঁদতে কাঁদতে মাকে জড়িয়ে ধরে বলেছি, ‘আমি থাকতে পারবো মা। তুমি শুধু দোয়া করো।’

বড় মুখ করে একথা বলে এলেও ওদের বাড়ি এসে বেশ ধাক্কা খেয়েছি। সাজুদের বাসা আমি আগে দেখিনি। বাসাটা মোটামুটি বড়, কিন্তু আগের আমলের। সাজুর দাদার যখন কিছু টাকা-পয়সা ছিলো, তখন তিনি জমি কিনে বাসাটি করেন। কিন্তু বাসাটা করার পরপরই তাদের অবস্থা পড়ে যায়। অনেকে বলে, এই বাসা করতে গিয়েই ধার-দেনা করে অভাবে পড়ে ওদের পরিবার। অতো টাকা পয়সা না থাকলেও কেন ধার-দেনা করে সাজুর দাদু বাসাটা করতে গেলেন, তা কেও জানে না।

এই বিরাট বাসায় মাত্র চার রুমে মানুষ থাকে, আর অন্য রুমগুলো পুরোপুরি খালি। দোতলার এক রুমে থাকে সাজুর বাবা-মা, উনাদের রুমটাই সবচেয়ে ছোট। অথচ তারা আগে সবচেয়ে বড় রুমটা নিয়েই থাকতেন। তাদের যা আসবাবপত্র সব সাজু আর তার বোনের রুমে পাস করে দিয়েছেন ওরা বড় হওয়ার পর, তাই তাদের আর বড় রুম লাগবে না বলে এই ছোট রুমে উঠে এসেছেন। সত্যি বলতে, সাজুদের বাড়িতে সবচেয়ে বেশি আমার ভালো লেগেছিলো ওর বাবা-মাকেই।

কি ভীষণ অমায়িক দুজন মানুষ, তাদের সাথে সারাজীবন এমন বড় বাড়িতে কেন, কুঁড়েঘরেও থাকা যায়।

এরপরের রুমটা মেঘার। মেঘা, সাজুর ছোট বোন। অনার্স ফাইনাল ইয়ারে এখন। ওর জন্য ছেলে খোঁজা হচ্ছে, ভালো ছেলে পেলেই বিয়ে দেওয়া হবে। মেঘা আমার সাথে খুবই ভালো ব্যবহার করলো, কিন্তু আমার কেন যেন মনে হলো, ও আমাকে পছন্দ করে না।

এরপর প্যাসেজের শেষ রুমটা সাজুর। বলতে একটু লজ্জা লাগছে, এখন থেকে রুমটা আমারও। একটা ছেলের সাথে একই রুমে থাকতে হবে এখন থেকে, ভাবতেই কেমন একটা লজ্জা-লজ্জা ভাব আমার মনটাকে রাঙিয়ে দিচ্ছে বারবার।

আর দোতলার আমাদের উল্টোপাশের সবচেয়ে বড় রুমটা সাজুর ফুফুর। তিনি আর তার মেয়ে এখানে থাকেন। ফুফুটি বিধবা, মেয়ের ছোট বয়সেই তার স্বামী মারা গিয়েছিলেন। এরপর থেকেই তিনি এখানে থাকেন। তার মেয়েটার বয়স মেঘার মতোই‌। মা আর মেয়ে- দু’জনের একজনও আমাকে পছন্দ করেনি। এখানে আসার পর থেকেই তাদের কথায় আর আচরণে বারবার এ কথাই আমাকে বুঝিয়ে দিয়েছেন। যেমন ঘরে ঢোকার সাথে সাথেই ফুফু বললেন, ‘ওমা , বউ কই?’

আসমা, মানে ফুফুর মেয়েটি বললো, ‘এই তো বউ, মা।’

ফুফু হেসে কুটিকুটি হয়ে বললেন, ‘তা এর রুপেরই এতো গল্প শুনলাম। কি আজব! সুন্দরী কি আজকাল সব মেয়েকেই বলে রে?’

আসমা বললো, ‘ভাইয়ার পছন্দ মা, বোঝো না। তার তো ভালো জিনিস আর ভালো লাগে না।’

আমি অবাক হয়ে গেলাম ওনাদের কথা শুনে। এমন কথা কেউ বলতে পারে, কখনো ভাবতেও পারিনি।

যাই হোক, রাতে সাজুর কাছ থেকে অমন তাবিজ গিফট পেয়ে আরেকটা ধাক্কা খেলাম। তখন বারবার বাবা-মার কথা মনে হচ্ছিলো। মনে হচ্ছিলো, তারা ঠিকই বলেছেন, আমি এ বাড়িতে থাকতে পারবো না। এদের মানসিককতার সাথে আমার মানসিকতা হয়তো যাবে না।

আমি ঘুমিয়ে পড়েছিলাম‌। ঘুম ভাঙলো মাঝরাতে। কেন ঘুম ভাঙলো, বুঝতে পারছিলাম না।

পুরো বাড়ি অন্ধকার। কিছু দেখা যায় না। কিছুক্ষণ শুয়ে থাকতেই চোখে অন্ধকার সয়ে এলো। এখন একটু একটু দেখতে পারছি। আমি সাজুকে ডাকলাম, ‘এ্যাই, শুনছো। এ্যাই।’

সাজু হুমহুম কেমন একটা আওয়াজ করে আবার ঘুমিয়ে পড়লো।

আমি আবার ওর গা ধরে ঝাঁকি দিলাম, ‘এই সাজু এই। উঠো।’

সাজু ধরমর করে উঠে বললো, ‘কি? কি হয়েছে?’

আমি বললাম, ‘আমার খুব টয়লেট পেয়েছে। একটু টয়লেটে নিয়ে চলো।’

সাজু আমার হাত ধরে টয়লেটে নিয়ে চললো। ওদের বাড়িটা একটু পুরনো আমলের তো, অ্যাটাচড বাথরুম বলে কিছু নেই। বারান্দার শেষমাথায় টয়লেট। সাজু বারান্দার লাইট জ্বালিয়ে আমাকে বারান্দার শেষমাথায় নিয়ে গিয়ে বললো, ‘তুমি ভেতরে যাও। আমি বাইরে দাঁড়াচ্ছি।’

আমি টয়লেট সেরে বের হলাম। দেখি, বারান্দা অন্ধকার। সাজু নেই। ওদের বাড়ির আশেপাশে তেমন বাড়ি বা ল্যাম্পপোস্টও নেই যে বারান্দাটায় একটু আলো আসবে‌। আজকে রাতে বুঝি অমাবস্যা, চাঁদও নেই। বারান্দায় থিকথিকে অন্ধকার। আমি বাড়ির দেওয়াল হাতড়ে একটু একটু করে আমাদের রুমের দিকে যেতে থাকলাম। রুমের সামনে এসে একটু সাবধানে দরজা খুলে দেখে নিলাম, আমাদের রুম কিনা। অন্য কারো রুমে ঢুকে পড়লে কেলেংকারি হবে। হ্যাঁ, আমাদেরই রুম। সাজু ঘুমিয়ে আছে। ঘুমের ঘোরে আমাকে রেখেই চলে এসেছে, আমার বাথরুম থেকে বের হওয়ার জন্য অপেক্ষা করেনি।

আমি রুমে ঢুকতে যাচ্ছি, এসময়ই কেমন শব্দ হলো। পিছনে তাকিয়ে দেখি, একটা বাচ্চা দাঁড়িয়ে আছে।

বাচ্চাই তো ওটা। দশ বারো বছরের ছেলের মতো, বারান্দার একদম শেষমাথায়। কিন্তু এমন কেন বাচ্চাটা? কারো শরীর অতো শুকনা হয়? যেন কংকালের ওপর চামড়া পরে আছে কেউ, বুকের পাঁজর সব দেখা যাচ্ছে।

অন্ধকার চোখে সয়ে আসায় দেখতে পেয়েছি বাচ্চাটাকে, কিন্তু বাচ্চাটার সেই শুকনো অবস্থা দেখে অবাক হইনি। অবাক হয়েছি অন্য জিনিস দেখে। অবাক না, ভয় পেয়েছি আসলে। ভীষণ ভয়।

সেই অন্ধকার বারান্দার শেষমাথায় দাঁড়িয়ে যে বাচ্চাটা আমার দিকে তাকিয়ে আছে, তার চোখ লাল। অসম্ভব, টকটকে লাল। একদম রক্তের মতো।

সে আসে

আমি চিৎকার করে উঠলাম। আমার চিৎকার শুনে সাজু দৌড়ে এলো। বললো, ‘কি হয়েছে?’

বাচ্চাটা নেই ততক্ষণে।

আমি সাজুকে বললাম, কি দেখেছি।

সাজুর মুখটা চুপসে গেল ভয়ে। আমাকে বললো, ‘তাড়াতাড়ি এসে শুয়ে পড়ো। রাত অনেক হয়েছে।’

আমি বিছানায় এসে শুলাম। সাজু লাইট নিভাতে গেলেই আমি বললাম, ‘আজ লাইটটা জ্বালানো থাক, প্লিজ।’

সাজু দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো, ‘আচ্ছা।’ বলে লাইট না নিভিয়ে বিছানায় এসে শুয়ে পড়লো। আমি ভাবলাম ওর দিকে ফিরে ওর বুকে একটু মাথা রাখে জিজ্ঞেস করবো কি হলো ওটা, ওটা কি ছিলো, কিন্তু ততক্ষণে সে নাকডাকা শুরু করেছে।

আর তখনই কারেন্টটা চলে গেল। আমার মুখটা ছিলো জানালার দিকে। আমি সভয়ে দেখলাম, একটা বাচ্চা ছেলে সেই দোতলার জানলার ওপাশ থেকে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। তার চোখদুটো টকটকে লাল।

আমি চোখ বন্ধ করে মনে মনে বললাম, ‘তুমি সত্যি না। তুমি সত্যি না। তুমি, আমার মনের কল্পনা।’বলেই চোখ খুললাম। দেখলাম, বাচ্চাটা জানালায় নেই। সে আমার বিছানার কাছে। একদম আমার মুখোমুখি।

 

{ আরো পড়ুন – ভূতের গল্প

 

পর্ব- ০২

মেঘা আমাকে দেখে চিৎকার করে উঠলো, ‘ভাবি, এ কি হয়েছে আপনার?’

মেঘার চিৎকার করাই স্বাভাবিক। সারারাত ঘুমাইনি। চোখ টকটকে লাল। মুখটাও মলিন, আলুথালু বেশ। এ অবস্থাতেই রান্নাঘরে ঢুকেছি‌। কালকে রাতের নতুন চকচকে বউকে আজ সকালে এই অবস্থায় দেখলে আমি নিজেই চিৎকার করে উঠতাম।

আমি বললাম, ‘ভয় পেয়েছি মেঘা। খুব ভয় পেয়েছি।’

মেঘা আমাকে হাত ধরে বসালো। জিজ্ঞেস করলো, ‘চা খাবেন?’

আমি মাথা নাড়লাম‌। মেঘা চা বানালো। খুব সুন্দর চা। খেলেই মনটা প্রশান্তিতে ভরে ওঠে‌।

মেঘা এরপর জিজ্ঞেস করলো, ‘বলেন তো, কি হয়েছে কালকে?’

আমি কালকে রাতের ঘটনা বললাম‌। এক বাচ্চাকে দেখেছি। বাচ্চার চোখ দুটো টকটকে লাল।

মেঘার মুখ শুকিয়ে গেলো। যেমন ওর ভাইয়ের শুকিয়েছিলো কাল রাতে। আমাকে বললো, ‘ও কিছু না ভাবি। নতুন বাড়ি দেখে দুঃস্বপ্ন দেখেছো।’

আমি বুঝলাম, মেঘা কিছু লুকোচ্ছে। আমি একফোঁটা দুঃস্বপ্ন দেখিনি। সব হয়েছে আমার চোখের সামনে।

এসময়ই ফুফু ঢুকলেন রান্নাঘরে। আমায় দেখেই বললেন, ‘বাব্বাহ। এতো সকাল সকাল ভাঙলো ঘুম? আমি তো ভাবলাম সকাল দশটার আগে উঠবে না।’

মেঘা ওর ফুফুর দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বেরিয়ে গেল। আমি বললাম, ‘না ফুফু, সকাল সকালই ঘুমটা ভেঙে গেল। মাথা ধরেছে বলে চা খেতে এলাম। আপনার ঘুম ভালো হয়েছে তো?’

ফুফু বললেন, ‘না গো। একদমই ভালো হয়নি। কেবল সাজুর কথা মনে হচ্ছিলো। কি ভালো ছেলেটা, কি মেধাবী! কিন্তু জীবনে পাওয়ার মতো কিছু পেলো না।’

আমি বললাম, ‘ফুফু, যারা জীবনে পাওয়ার চাইতে বেশি পেয়েও আফসোস করতে থাকে, তাদের জীবনের হতাশা যায় না কখনো।’

ফুফু হা করে আমার দিকে তাকিয়ে থাকলেন। বুঝতে পারেননি আমি এমন একটা কথা বলবো‌। আমি তাকে রান্নাঘরে একলা রেখে চলে এলাম বাইরে। ঠিক করলাম, ফুফুর কথা এখন থেকে আর না ধরে ছাড়বো না। তার একটু শিক্ষার দরকার আছে।

বাইরে আসতেই মায়ের সাথে দেখা। মাও এই সকালেই উঠেছিলেন‌। আমার চিবুক ধরে বললেন, ‘কি ব্যাপার মা? এতো শুকনো কেন মুখটা?’

আমার একবার মনে হলো মাকেও সব বলে দেই মেঘার মতো। কিন্তু, মা যদি আমাকে পাগল ভাবেন? হতেই পারে, নতুন বউ বিয়ের পরদিনই এমন সব কথা বললে মানুষ পাগল ঠাওড়াবে। না বলাই ভালো।

মা আবার জিজ্ঞেস করলেন, ‘কি হয়েছে মা? কিছু বলবা?’

আমি বললাম, ‘না মা। এমনি সকাল সকাল ঘুম ভাঙলো।’

দুপুরে খাওয়ার পর মেঘা আমাকে ওদের বাড়িটা ঘুরে দেখাতে নিয়ে গেল। বাড়িটা বিশাল না হলেও অনেকগুলো রুম বাড়িতে। আমরা কেবল ওপরতলার রুমগুলোতে থাকি। নিচের তলার রুমগুলো সব ফাঁকা।

আমরা সবগুলো রুমেই ঢুকলাম‌। সবগুলো রুমের মেঝে খোঁড়া, বড় বড় গর্ত। আমি মেঘাকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘এমন করে কে খুড়লো?’

মেঘা বললো, ‘সবগুলো আমার দাদার খোঁড়া।’

‘কেন খুড়েছিলেন উনি এগুলো?’

‘কে জানে?’ বলেই মেঘা মুচকি হাসলো।

আমি বললাম, ‘তুমি তো জানো।’

মেঘা মুচকি হাসলো আবার। ওর হাসিটা খুব সুন্দর, কথা ভুলিয়ে দেয়। ছেলে হলে ওর হাসি দেখে সব ভুলে যেতাম‌। মেয়ে বলেই ভুললাম না। গতকাল রাতের কথা বারবার খোঁচা দিতে লাগলো আমার মনটাকে‌।

আমি বললাম, ‘মেঘা, আমাদের বাসার আশেপাশে কোন বাড়িতে শুকনো-লিকলিকে নয়-দশবছরের ছেলে আছে?’

মেঘার হাসি থেমে গেছে। সে কেবল বললো, ‘না।’

‘নিশ্চয়ই কেউ আছে। শুধু আছে যে তাই নয়, সে প্রতিরাতে আমাদের এ বাড়িতে ঘুরে বেড়ায়।’

মেঘা তাকিয়ে রইলো। কিছু বললো না।

আমি বললাম, ‘কতোদিন ধরে তুমি ঐ ছেলেটাকে দেখতা, বলতো?’

মেঘা বললো, ‘এমন কাউকেই আমি দেখি নাই ভাবি। আপনিও দেখেন নাই। শুধু স্বপ্ন দেখেছেন।’

‘এইজন্যই কি তোমার ভাই আমাকে তাবিজ গিফট করেছে?’

‘ভাইয়াটার মাথায় বুদ্ধিশুদ্ধি কম। ও কি করতে কি করে ঠিক নাই।’

মেঘার সাথে আর কথা জমলো না। সে উপরে উঠে গেল। আমি ঘুরে ঘুরে রুমগুলো দেখতে লাগলাম। একদম কোণার রুমটা দেখে বের হয়েছি, উপরে উঠবো, সেসময়েই মনে হলো পাশের রুমের দরজার ফাঁক দিয়ে কেউ তাকিয়ে আছে আমার দিকে।

নিঝুম দুপুরবেলা। আশেপাশে কেউ নেই, নীরব নিস্তব্ধ চারিদিক। এর মাঝেই এমন এক অনুভূতি। আমার সারা শরীর শিরশির করে উঠলো। আমি ডাকলাম, ‘কে?’

কেউ সারা দিলো না।

কিন্তু তখনও আমার মনে হচ্ছে, কেউ এক দৃষ্টিতে দেখছে আমাকে।

আমি আর থাকতে পারলাম না। সোজা দৌড়ে চলে গেলাম দোতলায়।

বিকালে সাজু আসলো। ওর আজকে ছুটি, কিন্তু অফিসে খুবই জরুরি এক কাজ পড়ে গেছিলো বলে যেতে হয়েছিলো। সাজু আসবার সময় আমার জন্য একটা শাড়ি নিয়ে এসেছে। লাল পাড়ের কালো রংয়ের শাড়ি।

সাজু কাঁচুমচু  হয়ে বললো, ‘বেশি ভালো দেখে শাড়ি কিনতে পারিনি। অল্প কিছু টাকা জমিয়েছিলাম, তা দিয়েই কিনলাম এটা। প্লিজ, কিছু মনে করো না।’

আমার চোখে তখন টলমলে পানি। বললাম, ‘এর চাইতে সুন্দর গিফট আর কখনো পাইনি।’ সত্যিই বলেছিলাম, আমার মনের কথা।

সাজু হেসে বললো, ‘মিথ্যা বলছো, জানি। তবুও ধন্যবাদ।’ ওর মুখের লাজুক ভাবটা চলে গেছে ততক্ষনে।

রাতে খাবার পর আমরা ছাদে গেলাম। ওদের বাড়ির সবচেয়ে সুন্দর জায়গা হলো ছাদটা। অনেক বড়, আশেপাশে তেমন বাড়ি না থাকায় আকাশ পুরোটাই দেখা যায়। সাজু আর আমি চা হাতে দাঁড়িয়ে ছিলাম। মেঘা আসলো সেসময়।

মেঘা সাজুকে বললো, ‘তোদের রোমান্টিক মুড নষ্ট করতে চলে এলাম।’

সাজু হেসে বললো, ‘কিস্যু করতে পারলি না। আমরা এমনিই নিচে যাচ্ছিলাম। তুই আসায় ভালো হলো, চায়ের কাপগুলা নিয়ে চল।’

মেঘা বললো, ‘তোদের জিনিস তোরা টান। আমি এখন আকাশ দেখবো।’

আমি সাজুকে বললাম, ‘চায়ের কাপ আমি নিবো।তুমি নিচে চলে যাও। আমি মেঘার সাথে গল্প করি কিছুক্ষণ।’

সাজু নিচে চলে গেল। মেঘা বললো, ‘ভাবি আপনিও চলে যেতেন নিচে‌। আমার জন্য দাঁড়ালেন শুধু শুধু।’

‘নাহ ঠিক আছে। তোমার সাথে একটু গল্প করি।’

বলে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলাম। মেঘাও কিছু বলছে না। আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে।

কিছুক্ষণ পর, কিছু একটা বলা লাগে বলেই বললাম, ‘তোমার ফুফু তো আমাকে পছন্দ করেন না, তাই না?’

মেঘা হেসে ফেললো, ‘ফুফু এমনই। মুখের ওপর কথা বলে দেন। কিন্তু তার মনটা খুব ভালো। আপনাকে বিয়েতে যে গয়নাগুলো দেয়া হয়েছিলো না, সব কিন্তু ফুফুর দেয়া। তার শ্বশুরবাড়ি থেকে পাওয়া অনেক গয়নাই আপনাকে দিয়ে দিয়েছেন।’

এটা জানতাম না। ফুফুর প্রতি নরম হয়ে এলো মনটা। তাকে কথা শুনিয়েছি বলে খারাপও লাগছিলো।

মেঘা বললো, ‘চলুন যাই এখন। রাত বাড়ছে, শিশির পড়া শুরু হয়েছে। ঠান্ডা লাগবে এরপর।’

বলে পাশ ফিরতেই হঠাৎ দাঁড়িয়ে গেল মেঘা। আমি তার পাশ দিয়ে উঁকি দিলাম। গতকালকে রাতের দেখা সে ছেলেটা দাঁড়িয়ে আছে। অন্ধকার ছাদে, কেবল তারার আলোয় আমরা ছেলেটাকে দেখতে পারছি‌। আমরা, মানেও মেঘাও দেখতে পেয়েছে। নইলে এমন থমকে যেত না সে।

হঠাৎই ছেলেটা দৌড়াতে শুরু করলো। ভীষণ জোরে দৌড়ে আসতে লাগলো আমাদের দিকে। আমরা পাশ ফিরেছিলাম সিঁড়ির দরজায় যাওয়ার জন্য, কিন্তু ততক্ষণে দেরি হয়ে গেছে।

অনেক দেরি।

 

 

{ আরো পড়ুন – লাল_ডাইরী – এক অতৃপ্ত আত্মার রহস্য উন্মোচন

 

সে আসে

শেষ পর্ব

আমার জ্ঞান ফিরতেই দেখি সবাই আমার দিকে ঝুঁকে আছে। সবার মুখে দুশ্চিন্তা। মেঘার চোখে পানি।

মেঘা বললো, ‘আপনি অমন করলেন কেন ভাবি?’

কি করেছি? কিছুই তো করিনি। কেবল কাল রাতে সেই ছেলেটা যখন দৌড়ে আসছিলো, তখন ওর আর মেঘার মাঝে দাঁড়িয়ে গিয়েছিলাম। এরপর আর কিছু মনে নেই।

মা জিজ্ঞেস করলেন, ‘কি হয়েছিলো?’

আমার বলার শক্তি নেই। মেঘাই সব বললো।

সব শুনে সবার মুখ কালো হয়ে গেল। ফিসফাস-গুজগাজ শুরু হলো। আমার কেন যেন অস্বস্তি লাগছিলো। কি বলছে ওরা? কাকে নিয়ে বলছে?

মা কি যেন চিন্তা করছিলেন। তারপর বাবা আর সাজু দুজনকে নিয়েই বাইরে গেলেন। তাদের কিছু কিছু কথা আমার কানে আসতে লাগলো- ‘তুই ওটা পরতে দিস নি কেন ওকে…’ , ‘পরতে দিয়েছিলাম, ও পরেনি…’

বাকি কথা শুনতে পেলাম না। এর মাঝেই মেঘা আমার দিকে ঝুঁকে বললো, ‘আপনি আমাকে বাঁচানোর জন্য ওরকম করে আমার সামনে দাঁড়িয়েছিলেন, না ভাবি?’

আমি কিছু বললাম না। মেঘা বললো, ‘আপনাকে চিনতে আমার ভুল হয়েছিলো। আপনাকে আমি অহংকারী ভাবতাম‌। আপনি আমাকে ক্ষমা করে দিবেন।’

আমি হেসে বললাম, ‘ধুর বোকা। নতুন কেউ পরিবারে আসলে তার সাথে মানিয়ে নিতে একটু সময় লাগেই। আস্তে আস্তে সব ঠিক হয়ে যায়। আমি কিছু মনে করিনি।’

এর মাঝেই মা রুমে ঢুকে বললেন, ‘মা, তুমি আজ তোমার বাবার বাড়ি চলে যাও। এ ক’টা দিন বাবার বাড়িতেই থাকো। ওখানে থাকলে তোমার মনটাও একটু শান্ত হবে।’

আমি বললাম, ‘আমার মন তো শান্তই মা। আমি যা দেখেছি, সব সত্যি…’

মা বললেন, ‘ওসব নিয়ে আমি আর কথা বলবো না। সাজু তোমায় নামিয়ে দিয়ে আসবে। তোমার বাবা-মার আপত্তি না থাকলে কাল থেকে কিছুদিন সাজুও থাকবে তোমাদের বাড়িতে‌।’

‘না, বাবা-মার কেন আপত্তি থাকবে?’

‘তাহলে তো ভালোই। একটা কাজও করো সাথে। এই তাবিজটা সাথে বেঁধে রাখো। কেন বাঁধছো, কি বাঁধছো এসব প্রশ্নের উত্তর আমি তোমায় পরে দিবো। আপাতত ভেবে রাখো, এটা আমাদের পরিবারের ঐতিহ্য। তাবিজটা কিন্তু ভুলেও কখনো খুলবে না, ঠিক আছে?’

বলেই মা তাবিজটা আমার হাতে বেঁধে দিলেন। আমার বিয়ের রাতের সেই তাবিজটা।

আমাকে বাড়ি নামিয়ে দিয়ে আসতে আসতে সাজু বললো, ‘ঐ তাবিজটা পরে থাকলে আর কোনো সমস্যাই হবে না। আমরা সবাই পরি। আমাদের কিন্তু কোন সমস্যা হয় না।’

আমি বললাম, ‘তাবিজ পরার আগে হতো?’

সাজু আমার দিকে তাকিয়ে থাকলো কিছুক্ষণ, তারপর বললো, ‘দিয়া, আমি স্যরি আমার আগেই তোমাকে সব জানানো উচিৎ ছিলো‌। দাদু যখন মারা যান, তার কিছুদিন পর একদিন রাতের বেলাতে আমি প্রথম আমাদের বারান্দায় ঐ ছেলেটাকে দেখেছিলাম। সেই শুরু। এরপর থেকে প্রায় সবাই ঐ ছেলেটাকে দেখতে পেয়েছে, বেশ কয়েকবার। এরপর আমরা এক হুজুরকে দেখাই। তিনি কয়েকটা তাবিজ দেন। ঐ তাবিজগুলা পরার পর থেকেই আমাদের আর কোনো সমস্যা হয় নাই।’

‘তাহলে তো তাবিজের অনেক গুণ।’

সাজু হতাশ গলায় বললো, ‘তোমার কাছে ব্যাপারটা হাসির লাগছে, বুঝেছি‌। কিন্তু এটা সত্যি। তাবিজটা পরার পর থেকেই ওই জিনিসটা আর আমাদের কাছে আসে নাই। তাবিজটা থাকলে ফুপাকেও মরতে হতো না।’

আমি অবাক হয়ে বললাম, ‘কি বলো? ফুপা কি তোমাদের বাড়িতেই মারা যান?’

‘হ্যাঁ। দাদা মারা যাবার পর থেকে ফুপা আমাদের বাসাতেই থাকতেন। আমাদের সবার মতো ফুপাও ঐ ছেলেটাকে দেখেছিলেন। এক শুক্রবার, আমরা সবাই এক দাওয়াতে গেছিলাম। ফুপা ছিলেন বাসায় একা। রাতে বাসায় ফিরে সবাই দেখলাম ফুপা মারা গেছেন। মুখে প্রচন্ড আতংকের ছাপ। ফুপার হার্টের সমস্যা ছিলো, হয়তো কিছু দেখে ভয় পেয়েছিলেন। হার্ট অ্যাটাক। কেউ জানলো না কি দেখে ভয় পেয়েছিলেন, তবে ঐ ছেলেটার যে হাত ছিলো, তা নিশ্চিত।’

‘এরপর থেকেই তোমরা তাবিজ পরা শুরু করলে?’

‘হু। আর কোনো সমস্যা হয়নি।’

সাজু আমাকে বাসায় নামিয়ে দিয়ে গেল। আমার চিরচেনা বাড়ি। মাত্র তিনদিন পরই বাড়ি এলাম, অথচ মনে হচ্ছে কতো জনম জনম বাড়িটা থেকে দূরে আছি।

বাবা-মা কাউকেই আমার শ্বশুরবাড়ির ভূতুড়ে ব্যাপার জানালাম না। শুধু বললাম, বেড়াতে এসেছি। তাদের জামাইও আসবে কালকে। সপ্তাহখানেক থাকবো। আব্বু-আম্মু তাতেই খুশি।

বিকেলে স্নিগ্ধা এলো। স্নিগ্ধা, আমার পাড়াতো বান্ধবী। ওর সাথে এটা ওটা গল্পের পর আমার শ্বশুরবাড়ি থেকে দেওয়া গহনাগুলো দেখালাম। স্নিগ্ধা অবাক হয়ে বললো, ‘এগুলো তো একদম অ্যান্টিক।’

বললাম, ‘হ্যাঁ। আমার ফুফু-শাশুড়িকে তার শ্বশুরবাড়ি থেকে দিয়েছে, ত্রিশ-চল্লিশ বছরের পুরনো তো হবেই।’

স্নিগ্ধা বললো, ‘না রে গাধা, এগুলো কম করেও দেড়শো বছরের পুরনো। পিওর গোল্ড।’

‘সে কি!’

‘হ্যাঁ। আমি নতুন একটা শর্টফিল্ম বানাচ্ছি বাংলায় গয়নার বিবর্তন নিয়ে, সেটার জন্য রিসার্চ করতে হয়েছে। এইরকম নকশার গয়না দেখেছি তখন। সেসময় কিন্তু ইংরেজ আমল। এদেশে জমিদারদের দাপট ছিলো তখন। জমিদারদের বউ-মেয়েরা এসব নকশার গয়না পরতো।’

‘ওরে বাবা। আচ্ছা, হতেই তো পারে, ফুফু-শাশুড়ির শ্বশুরবাড়ির লোকজন জমিদার বংশের মানুষ। জেনারেশন টু জেনারেশন এই গয়না পাস করছে তারা‌।’

‘হাইলি আনলাইকলি। এসব গয়না এখনো টিকলে ওসব ব্যাংকের ভল্টে রাখার কথা, বউ-মেয়েদের গলায় দেবার কথা না। যাই হোক, তোর ফুফু-শাশুড়ির সাথে কথা বলতে হবে এ বিষয়ে।’

রাতে স্নিগ্ধা চলে গেল। আমার গয়নার ছবি নিয়ে গেছে সে, আরো কিছু তত্ত্ব-তালাশ করবে ওগুলো দেখে। আমি আবার পুরনো দিনের মতো একা নিজের রুমে শুলাম। রাত্রি এগারোটা পার হতেই সাজুর ফোন এলো- ‘ম্যাডাম, ঘুমান নাই?’

‘উহু। একা শুতে কেমন খারাপ লাগছে।’

‘ওরে বাবা। টুরু লাভ।’

‘হ। তোমার জন্য না। তোমার বাড়ির জন্য।’

আমরা ফিসফিস করে কথা বলা শুরু করলাম। বিয়ের আগে যেমন বলতাম। একসময় ভুলেও গেলাম আমাদের বিয়ে হয়েছে। বিয়ের আগের প্রেমিক-প্রেমিকার মতো গল্প শুরু করলাম আমরা।

গল্প থামলো শেষরাতে‌। আমি একটু পানি খেতে উঠলাম। পানি ডাইনিংরুমের টেবিলের ওপর। সেখানে একটা ডিম লাইট জ্বলছে। ওটার আবছা নীলচে আলোয় দেখা যাচ্ছে চারপাশ।

আমি পানি খেয়ে ফিরে আসছি, ঘরের কোণায় আমার চোখ গেলো। কে যেন দাঁড়ানো ওখানে। ঐদিকটা অন্ধকার, তাই ভালো মতো দেখা যায় না একদম।

আমি একটু এগিয়ে গেলাম দেখার জন্য। দেখলাম- একটা দশ বছরের ছেলে। অসম্ভব শুকনো। চোখদুটো টকটকে লাল। আমার শ্বশুরবাড়িতে দেখা সেই ছেলেটা। ও তাকিয়ে আছে আমার দিকে, একদৃষ্টিতে।

আমি চিৎকার করে উঠলাম। আমার চিৎকারে বাবা-মা দৌড়ে এলো। মা বললো, ‘কি হয়েছে?’

আমি কিছু বলতে পারছিলাম না। প্রচন্ড ভয়ে আমার হাত-পা জমে আসছিলো। বাবা-মা আমার অবস্থা দেখে ভয় পেলেন। বাবা বললেন, ‘মনে হয় খারাপ স্বপ্ন দেখেছে। ওকে নিয়ে একটু শোওতো, যাও।’

আমার ইচ্ছা করছিলো ‘না’ বলি। বলি যে, বাবাকে আমি একা শুতে দিবো না। বাবার বিপদ হতে পারে। অথবা আমার সাথে থাকলে মায়েরও বিপদ হতে পারে। উনাদের জানিয়ে দেই, একটা ভয়ংকর কিছু আমার পিছু পিছু এই বাড়িতে চলে এসেছে। আমার তাবিজ দিয়েও কোনো লাভ হচ্ছে না।

কিন্তু আমি কিছুই বলতে পারলাম না। স্বার্থপর হয়ে গেলাম। মাকে আমার সাথে শুতে নিয়ে আসলাম। একা একটা রুমে থাকতে হবে, এ কথাটা আমি ভাবতেও পারছিলাম না।

মা আমার সাথে শুয়ে কিছুক্ষণ গল্প করার চেষ্টা করলেন, কিন্তু আমার মুড ছিলো না। শেষে মা ঘুমিয়ে গেলেন। মায়ের নাকডাকা শুরু হতেই, আমি ছেলেটাকে দেখলাম ‌‌। আমার বিছানার সামনে দাঁড়িয়েছে। একদম আমার মুখোমুখি।

আমি আর থাকতে পারলাম না। চিৎকার করে উঠলাম, ‘কে তুই? কেন এমন করছিস আমার সাথে?’

ছেলেটা উত্তর দিলো না। একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো আমার দিকে। তার রক্তলাল চোখদুটো আমায় দেখছে। তার দৃষ্টিটা কেমন যেন করুণ।

আমি চমকালাম‌। এমন করুণ দৃষ্টি আমি আর কারো দেখিনি। রক্তলাল চোখদুটোতে কি যেন চাপা দুঃখ লুকিয়ে আছে‌। আগে খেয়াল করিনি আমি। আমি ছেলেটাকে দেখতে লাগলাম। ছেলেটা যেমন আমাকে দেখতে লাগলো।

ফজরের আজান দিলো। মা ঘুম ভেঙ্গে চিৎকার করে উঠলো, ‘ওটা কি?’

আমি বললাম, ‘কোনটা?’

মা বললেন, ‘মনে হলো, এখানে একটা বাচ্চা ছেলেকে দেখলাম। আমাকে দেখেই ছেলেটা উধাও হয়ে গেল।’

আমি হাই তুলে বললাম, ‘স্বপ্ন দেখেছো। স্বপ্নে মানুষ কতো উল্টোপাল্টা জিনিসই তো দেখে।’

আমি সাজুদের বাড়িতে বসে আছে। আমার সাথে আছে সাজুর পুরো পরিবার আর আমার বাবা-মা। আর আছে স্নিগ্ধা।

স্নিগ্ধা বললো, ‘গল্প ছোট করি‌। এ বাড়িতে যত ঘটনা ঘটছে, সবগুলোর রহস্য আমি উদঘাটন করেছি। এরজন্য যদিও আমাকে অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে, সেসবের ডিটেইলস বর্ণনায় আমি যাচ্ছি না‌। তাহলে অনেক কথা বাড়ানো লাগবে। আমি শুধু মেইন ঘটনাটা বলি। এই ঘটনা শুনেই বুঝবা, আমার ডিটেক্টিভ স্কিল কতো হাই। এরপর থেকে সবাই আমাকে মহিলা শার্লক হোমস ডাকা শুরু করবা।’

সাজু চায়ের কাপে শব্দ করে চুমুক দিয়ে বললো, ‘মহিলা।’

স্নিগ্ধা বললো, ‘দেখেন সাজু ভাই, আমি খুব সিরিয়াস একটা বিষয় নিয়ে আলোচনা করছি। এর মধ্যে এমন ফাজলামি ভালো লাগে না‌। যাই হোক, মেইন ঘটনাটা বলি। অনেকদিন আগে আমাদের এই বাংলায় অদ্ভুত এক প্রথার প্রচলন ছিলো। এই প্রথার কথা হয়তো অনেকেই শুনেছেন। সেখানে ধনী জমিদাররা তাদের সকল ধনসম্পদ একটা গোপন ঘরে রেখে দিতো। সেই সম্পদ পাহারা দেবার জন্য তারা পাহারাদারেরও ব্যবস্থা করতো।

তারা করতো কি, খুব গরীব ঘরের একটা ছোট বাচ্চাকে বাবা-মার কাছ থেকে কিনে নিয়ে আসতো‌। এরপর তাকে অনেক ভালো খাবার-দাবার খাইয়ে সুন্দর পোষাক পরিয়ে ঐ গোপন ঘরে রেখে দিতো‌। বাচ্চাটা সুন্দর পোষাক পরে, মজার খাবার-দাবার খেয়ে খুশি মনে শান্তির এক ঘুম দিতো। সেই ঘুমটাই হতো তার কাল। তাকে ঘুমন্ত অবস্থায় ঐ ঘরে রেখে ঘরের দরজা বন্ধ করে দেয়া হতো। বাচ্চাটা ঘুম থেকে জেগে উঠে দেখতো সে একা, আর কেউ নেই ঘরে‌।

সে কান্নাকাটি শুরু করতো। কেঁদে কেঁদে মা-বাবাকে ডাকতো। ঘরের দরজা ধাক্কাতো। কিন্তু তার কান্না শোনার জন্য কেউ তখন থাকতো না। তারপর ধীরে ধীরে ক্ষুধায় তৃষ্ণায় ধুঁকে বাচ্চাটা একদিন মারা যেত। শয়তান জমিদারগুলা ভাবতো, এই বাচ্চার আত্মাই তাদের ধনসম্পদ আগলে রাখবে।

বাচ্চাটাকে বলা হতো যক। আমাদের বাংলায় একটা বাগধারা আছে না, যকের ধন বলে। বাগধারাটার অর্থ কৃপণের ধনসম্পদ। বাগধারাটা এসেছে এই যকের ঘটনাগুলো থেকেই। কারণ কৃপণ যকের মতোই তার ধনসম্পদ আগলে রাখে।

আপনাদের এই বাড়ির নিচেও এ অঞ্চলের জমিদারদের সেরকম লুকানো ধনসম্পদের একটা ঘর ছিলো। সাজু ভাইয়ের দাদা কোনোভাবে তার খোঁজ পেয়েছিলেন। এরপরই তিনি সমস্ত সঞ্চয় দিয়ে এই জমিটা কিনে এর উপর বাড়ি তৈরি করেন। দোতলায় সবাইকে রেখে নিচতলায় তিনি গুপ্তধন খোঁজার কাজ শুরু করেন। কিন্তু কথাটা তিনি কাউকে জানালেন না। কারণ সবাই তাকে পাগল ভাবতে পারে। সবাইকে বলা হল, বাড়ির মেঝে মেরামত করে মোজাইক করা হবে। ব্যাপারটাকে কেউ আর তাই তেমন গুরুত্ব দিলো না।

একমাত্র তার আদরের নাতনি মেঘাকে এ ব্যাপারটা তিনি জানান। মেঘা তখন ছোট, ব্যাপারটা সেভাবে বুঝতে পারেনি‌। বড় হয়ে সে ভাবে গুপ্তধন খোঁজার কথাটা দাদার মশকরা ছিলো, তাই কাউকে সে ব্যাপারটা বলেনি। আমার যখন দিয়ার গহনার সেটগুলো দেখে সন্দেহ হচ্ছিলো, আমি আপনাদের সবার সাথে কথা বলি। মেঘা তখন ব্যাপারটা আমাকে জানায়‌। আমিও দুয়ে দুয়ে চার মিলিয়ে ফেলি।

এখন কথা হলো, দাদা কি সেই গুপ্তধনের খোঁজ পেয়েছিলেন? সেটা আমরা জানি না। খুব সম্ভবত তিনি খোঁজ পাননি। কারণ তার মৃত্যুর সময় যকের দেখা পাওয়া গেলো না‌। যকের আগমন ঘটলো আরো অনেক পরে।’

আমার শ্বশুর-আব্বা বললেন, ‘তাহলে কি অন্য কেউ গুপ্তধনের সন্ধান পেয়েছিলো?’

স্নিগ্ধা মুচকি হাসলো। এরপর ফুফুর দিকে তাকিয়ে বললো, ‘আপনি তো জানেন। বলেন তো, আপনার হাজব্যান্ড গুপ্তধনের খোঁজ কিভাবে পেলো? এ জিনিসটা আমি এখনো ঠিক বুঝতে পারিনি।’

ফুফু বিস্ফোরিত চোখে তাকালেন । সবগুলো মুখ একসাথে ফিরলো তার দিকে। ফুফু কোনোরকম ঢোক গিলে বললো, ‘আমি…জানি না…’

স্নিগ্ধা হাসিমুখে বললো, ‘আপনি সবই জানেন। আমার থিওরি হলো, আপনার বর দাদার এভাবে বাড়ির ফ্লোর খোঁড়া দেখে কিছু একটা আন্দাজ করেছিলেন। তিনি স্থানীয় মানুষ, এই এলাকা নিয়ে স্থানীয় মিথ তো তিনি শুনেই থাকবেন। আমার মতো দুয়ে দুয়ে চার মিলাতে তারও কোনো সমস্যা হলো না। দাদা মারা যাবার পর এ বাড়িতে থেকে তিনি গুপ্তধনের সন্ধান শুরু করলেন। স্থানীয় মিথগুলো এক্ষেত্রে তাকে সাহায্য করলো। একসময় তিনি সফল হলেন।

গুপ্তধনের খোঁজ পেলেন। সেই গুপ্তধনের কিছু অংশ তুলে তিনি নিজের কাছে নিয়ে যান। সেসময়ই যকের আগমন ঘটলো। যক তার আগলে রাখা ধনসম্পদগুলো ফিরে পাবার জন্য আপনাদের দেখা দিতে লাগলো।

এখন একটা কথা বলি। একটা বাচ্চাকে ধনসম্পদের সাথে আটকে রাখা হয়েছিলো বলেই তার আত্মা সবসময় ধনসম্পদগুলো হেফাজত করবে- এমন কথা আমি বিশ্বাস করি না। নিশ্চয়ই এখানে প্রাচীন কোনো কালোজাদুর ব্যাপার-স্যাপার ছিলো। বাচ্চাটাকে আটকে রাখার আগে সেই কালোজাদু মোতাবেক রিচ্যুয়াল করা হয়েছিলো। এতে করেই বাচ্চাটা চিরদিন আটকে যায় ঐ ধনসম্পদের সাথে। জানি, আমাদের আধুনিক সমাজে এসব কথা বিশ্বাসযোগ্য নয়। কিন্তু বিপুলা এ পৃথিবীর কতটুকু বা জানি আমরা, তাই না?

যাই হোক, বাচ্চাটা বেশি আসতেন ফুফার কাছে। শেষমেষ এক রাতে বাড়িতে একা থাকার সময় তিনি ভয়ে মারাই গেলেন। যেহেতু তার হার্টের সমস্যা ছিলো, এক্ষেত্রে আমরা যক বাচ্চাটাকে তেমন দোষও দিতে পারি না। উনি মারা যাবার পরপরই আপনারা তাবিজ পরা শুরু করলেন। যকের আগমন বন্ধ হয়ে গেল‌। আসলে ব্যাপারটা তেমন না,এখানে তাবিজের কোনো কেরামতি নাই‌। ফুফু, ফুপা মারা যাবার পরপরই তার নিয়ে আসা গুপ্তধনগুলো আগের জায়গায় রেখে আসেন। তাই যকের আগমনেরও প্রয়োজন ফুরিয়ে যায়‌।

এখন কথা হলো, যক আবার কেন দেখা দিচ্ছে? এর উত্তর হলো, ফুফু আবার যকের ধন বের করে এনেছেন। এবং সেটা উপহার দিয়েছেন দিয়াকে।’

ফুফু চিৎকার করে উঠলো, ‘মিথ্যা কথা। ওগুলো আমার শ্বশুরবাড়ির গহনা।’

স্নিগ্ধা বললো, ‘আপনি কি ভেবেছেন, সব খোঁজ-খবর না নিয়ে আমি এমনি এমনি আপনার বিরুদ্ধে এতো বড় অভিযোগ আনছি? আপনার শ্বশুরবাড়ি থেকে বিয়ের পর একটা সোনার চেইন বাদে আপনি কিছু পাননি। কিন্তু সবার সাথে গপ মেরে বেড়াতেন, আপনার শ্বশুড়বাড়ি থেকে আপনাকে এত্তো এত্তো জিনিস দেয়া হয়েছে। তাই দিয়াকে যখন আপনি গহনাগুলো উপহার দেন, কেউ সন্দেহ করেনি।’

শ্বশুর-আব্বা বললেন, ‘কিন্তু ও এমন কাজ কেন করবে?’

স্নিগ্ধা বললো, ‘বলছি। আপনি কি জানেন, ফুফু তার মেয়ে আসমার সাথে সাজু ভাইয়ের বিয়ে দিতে চাচ্ছিলেন।’

বাবা বললেন, ‘হ্যাঁ, জানি। ও বলেছিলো ঐ কথা।’

স্নিগ্ধা বললো, ‘সেটাই তার মোটিভ। সাজু ভাইয়ের সাথে আসমার বিয়ে দেয়ার ইচ্ছাটা কেবল নিষ্পাপ ইচ্ছাই ছিলো না। এই পুরো বাড়ির দখল তিনি নিতে চাচ্ছিলেন মেয়েকে দিয়ে। যাই হোক, তার পরিকল্পনা সফল হলো না। সাজু ভাই দিয়াকে বিয়ে করে ফেললেন। আর তার সব রাগ গিয়ে পড়লো দিয়ার ওপর। তিনি দিয়াকে শাস্তি দেয়ার ব্যবস্থা করলেন। যকের ধনের অভিশাপের কথা তার জানা। তিনি সেই যকের ধন নিয়ে এসে দিয়াকে উপহার দিলেন।

তার হিসাব ঠিকই ছিলো। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন, দিয়া হয় ফুপার মতো মারা যাবে নয়তো পাগল হয়ে যাবে‌। আর এর পেছনে যে তার হাত আছে, কেউ ধরতে পারবে না।’

সবাই ফুপুর দিকে তাকালো। তিনি নীরবে কাঁদছেন। বাবা হতভম্ব হয়ে গেছেন। তার নিজের বোন যে এমন একটা কাজ করবে, তিনি ভাবতেও পারেননি। তিনি কেবল শান্ত স্বরে বললেন, ‘তোমার জন্য এতোকিছু করলাম, আর তুমি তার এই প্রতিদান দিলে? যাও, চলে যাও আমার সামনে থেকে। আজ থেকে তোমার মুখ আমি আর দেখতে চাই না।’

ফুপু চিৎকার করে কাঁদতে লাগলেন। স্নিগ্ধা তাকে থামিয়ে বললো, ‘কার কি শাস্তি হবে, সেটা পরে দেখা যাবে। আগে আমরা আসল কাজটা করি। যকের সম্পদ যকের কাছেই ফিরিয়ে দেই।’

আমরা নিচতলায় নামলাম। ফুফুই আমাদের নিয়ে চললেন। নিচতলার কোণার রুমে যেখানে মাটি খোঁড়া, সেখানে একটু মাটি কোদাল দিয়ে সরালেন তিনি। একটা আংটা বেরোলো। সেই আংটা ধরে টান দিতেই একটা ছোট পাথরের গর্ত মতো খুলে গেল মেঝেতে। গর্তের মুখ থেকে একটা সিঁড়ি চলে গেছে নিচে। সিঁড়িটা খুব সরু।

আমরা সিঁড়ি বেয়ে এক এক করে নিচে নামলাম। প্রথমে নেমেছিলো সাজু। সে নিচে নেমেই তার মোবাইলের ফ্ল্যাশ অন করলো। সেই ফ্ল্যাশের আলোয় আমাদের চোখ ঝলসে গেল। চারপাশে কেবল রাশি রাশি সোনার গহনা আর সোনার মুদ্রা। আমরা চারপাশ দেখতে লাগলাম ফ্ল্যাশ মেরে। ছোট্ট একটা ঘর। এই ঘরেই জমিদার তার সমস্ত ধনসম্পদ লুকিয়ে রেখেছিলেন।

ঘরের মাঝে এক খালি জায়গা। সেখানে একটা ছোট্ট বাচ্চার কংকাল। আমরা কংকালটা ভালো মতো দেখতে যাবো, তার আগেই পাশ থেকে কিছু একটা নড়ে উঠলো। আমরা সেদিকে আলো ফেললাম। দেখলাম সেই বাচ্চাটাকে, যাকে আমি এই তিনরাত ধরে দেখছি। অন্য সময় হলে সবাই ভয়েই পালিয়ে যেত এখান থেকে‌। কিন্তু আজ, সবার খুব করুণা হচ্ছে বাচ্চাটার জন্য। বাচ্চাটার মুখটা মায়াভরা, চোখটা করুন। যেন কত বছরের কত দুঃখ বয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছে বাচ্চাটা।

আমার খুব ইচ্ছা করছিলো বাচ্চাটাকে জড়িয়ে ধরি। তাকে বলি, আজ থেকে তুই আমাদের সাথে থাকবি। পৃথিবী এখন অনেক বদলে গেছে। এখানে এখন আর কেউ বাচ্চাদের কষ্ট দেয় না। সামান্য কটা টাকার জন্য বাচ্চাদের খুন করেনা।

কিন্তু আমি পারিনি। কারণ আমি জানি, পৃথিবীর কিছুই বদলায়নি। এখনো সব আগের মতোই আছে। এসব আর বদলাবে না কখনো।

আমরা ঘরটা আগের মতো পাথর চাপা দিয়ে আসি। শেষসময়ে, পাথরের ফাঁক দিয়ে আমি বাচ্চাটার মুখ দেখেছিলাম। মনে হচ্ছিলো, এক টুকরো হাসি ঝুলে আছে সেই মুখটি থেকে। এরপরই অদৃশ্য হয়ে গেল হাসিটা।

আমি আর তাকে দেখিনি কোনোদিন।

 

 

লেখা- সোয়েব বাশার

 

( সে আসে – ভয়ঙ্কর এক আত্মার গল্পটি আপনাদের কেমন লাগলো তা কমেন্ট করে অবশ্যই জানাবেন।

পরবর্তী গল্প পড়ার আমন্ত্রণ জানালাম। ধন্যবাদ।)

” সমাপ্ত”