হোস্টেল ডায়েরী – ছোট গল্প

হোস্টেল ডায়েরী

লেখকঃ তাসফিয়া জামান আফরিন

 

তখন ২০১৮ সাল। আমি ময়মনসিংহে নতুন। উঠেছি হোস্টেলে। আমাদের হোস্টেলটি ছিলো পুরোনো জমিদার বাড়ি। যার বয়স তখন প্রায় ৯৩ বছর। শুরু থেকেই নানান অদ্ভুতুড়ে কাহিনী শুনতে থাকি হোস্টেল নিয়ে আর হোস্টেলের দর্শনরুপের কারণে হোক কিংবা যেকারণেই হোক, সেই কাহিনীগুলো যথেষ্টই বাস্তবিক বলে মনে হয়।

তারপরও সেগুলো আমায় তেমন ভীরু করেনি।

হোস্টেলের ওয়াশরুম ছিলো মূল রুম গুলো থেকে বেশ ক্ষানিকটা দূরে বারান্দার শেষ মাথায়। ভয়ের কারণে সাধারণত সন্ধ্যার পর সেখানে কেউ একা যায় না, একসাথে দু-তিন জন যায়। কিন্তু আমার তেমন ভয় না লাগায় আমি একাই যেতাম।

বেশ কিছুদিন পরের কথা, এক রাতের বেলায় আমি ওয়াশরুমে যাই। কেন যেনো সেদিন হঠাৎ আমার চোখ চলে যায় ভেন্টিলেটরে। সেখানে চোখ পরতেই আমার সমস্ত শরীর শিউরে ওঠে। ভেন্টিলেটরের বাহিরে থাকা একটি গাছের ডালে একটি নারীমূর্তির কালো অবয়ব। কাধ পর্যন্ত নেমে এসেছে তার ঝাঁকড়া চুল।

আমায় সবচেয়ে বেশী ভিতু করেছিলো তার চোখ। আদৌও কি সেগুলো চোখ ছিলো ? ভাবলেশহীন দৃষ্টিতে চেয়ে আছে আমার চোখের দিকে। তার মুখে খেলা করছিলো এক করুণ হাসি! হুট করে এমন একটা অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনায় আমার বুকে ধ্বক করে একটা ধাক্কা লাগে। বহু কষ্টে নিজেকে সামলে রুমে ফিরে যাই।

বেশ ভয় পেলেও নিজের হ্যালুসিনেশন ভেবে নিয়ে ঘটনাটি সবার কাছ থেকে সেদিন চেপে যাই। তারপর আরোও কিছুদিন কেটে যায় ভালোভাবেই। আর তেমন কিছুই চোখে পরেনি।

একদিন আমি কেবল বাইরে থেকে হোস্টেলে এলাম, তার ঠিক পরপরই দেখি আমার রুমমেট তিথি আপু কোথা থেকে এসে হঠাৎ রুমে ঢুকেই জ্ঞান হারিয়ে মাটিতে লুটিয়ে পরে। যখন তার জ্ঞান ফিরে তখন সে ভয়ে অস্থির। সবাই ‘কি হয়েছে?’ জানতে চাইলে তিনি হড়বড় করে যা বললেন, তার অর্থ দাড়ালো, “তিনি বারান্দায় হাঁটছিল এবং তখনই হুট করে দেখে যে দেয়ালে কার যেনো ছায়া পড়ছে।

 হোস্টেল ডায়েরী

কার ছায়া সেটা দেখার জন্য পেছনে তাকাতেই তার রক্ত হিম হয়ে যায়। পেছনে তাকিয়ে দেখে, এক নারীমূর্তীর কালো অবয়ব কোলে একটি ছোট বাচ্চা নিয়ে তার দিকে তাকিয়ে আছে অপলক দৃষ্টিতে!” এরপর তার আর কিছুই মনে নেই।

ঘটনাটি শোনার পর অন্যদের ভাবান্তর হলো কিনা ঠিক বোঝা গেলো না, তবে আমি খুব ভালো করেই সবকিছু বুঝতে পারলাম। সবাই রুম থেকে চলে গেলে তিথি আপু আমাকে জিজ্ঞেস করলেন যে আমি তার কথা বিশ্বাস করেছি কিনা, আমি নির্দ্বিধায় বললাম ‘হ্যাঁ,বিশ্বাস করি’। এতে মনে হলো তিনি বেশ খানিকটা আশ্বস্ত হলেন।

তিথি আপুর সাথে ঘতে যাওয়া ঘটনার ঠিক ২ দিনের মাথায় আমার আরেক রুমমেট রিনি আপু রুমের ভেতরে আমাদের সঙ্গে গল্প করতে করতে হুট করে মৃগী রোগীদের মতোন কাঁপতে শুরু করলেন।

অনেক চেষ্টা-চরিত করার পর তিনি একটু স্বাভাবিক হতেই ঝরঝর করে কেঁদে ফেললেন। কান্নার কারণ জিজ্ঞাসা করাতে তিনি বেশ অনেকক্ষণ চুপ থাকার পর বললেন,”গল্প করার সময় চোখ পেছনের দিকে যেতেই দেখি রুমের এক কোণে পরে থাকা পরিত্যক্ত কাঠের তালাবদ্ধ ক্যাবিনেটের উপর উলটো হয়ে ঝুলছে সেই নারীমূর্তীর কালো অবয়ব। সেখানে আমার চোখ পরতেই সেটি ভীতিপ্রদ হাসি হেসে উধাও হয়ে গেলো”।

তিথি আপু আর রিনি আপু- দুজনেরই দেওয়া বর্ণনা মিলে যাওয়ায় এবার যেন সবার টনক নড়লো।

সবাই বুঝতে পারলো যে আসলেই হয়তো এই অবয়বের অস্তিত্ব রয়েছে। সবাই মিলে সিদ্ধান্ত নিলো হোস্টেল সুপারিনটেনডেন্ট কে বিষয়টা জানিয়ে তাঁর কাছে সাহায্য চাইবে। এ বিষয়ে আমার অসম্মতি থাকলেও সবার ছোট হওয়ায় তা আর প্রকাশ করিনি। অতঃপর বিষয়টি উপর মহলে জানানো হলে আমার ধারণাই সত্য হয়। তাঁরা একদমই পাত্তা দেননা।

সেদিনই সন্ধ্য বেলায় আমি বারান্দায় হাঁটছিলাম। বারান্দাটি শেষ প্রান্তে গিয়ে দু’ভাগে বিভক্ত। বাম পাশে ওয়াশরুম এবং ডান পাশে দু’টি তালাবদ্ধ রুম। বারান্দার সেই দিকটা অনেকটা স্টোররুম হিসেবে ব্যাবহৃত হতো। সেখানেই আমার দৃষ্টি আটকে যায়। পুনরায় মুখোমুখি হই সেই ভয়াবহতার।

সেখানে একটি ভাঙ্গা টেবিলে বসে পা নাচাতে নাচাতে আমার দিকে তার দৃষ্টি নিবদ্ধ করে। এমন ভয়ানক ভাবে কাউকে দেখে আমি প্রায় দৌড়ে রুমে ঢুকে৷ যাই। কাউকে কিছু না বললেও তিথি আপু আমার ভেতরের চঞ্চলতা বুঝতে পেরে আমাকে জেঁকে ধরে বলার জন্য যে কি হয়েছে। আমি তাকে সবকিছু বলে দেই তখন।

তার পরের দিন আমাদের আরেক রুমমেট আদৃতা নিচে ডাইনিং হলে যায় দুপুরে খাবার আনতে। বেশ অনেকটা সময় পেরিয়ে গেলেও সে না ফেরায় আমি আর রিনি আপু যাই ডাইনিং হলে।

সেখানে গিয়ে আমরা দুজনেই অবাক হয়ে আবিষ্কার করি আদৃতা অচেতন হয়ে মেঝেতে লুটিয়ে পরে আছে।  আমরা তাকে ধরাধরি করে উপরে নিয়ে গিয়ে অনেকক্ষণ যাবৎ মাথায়-হাতে-মুখে পানি ঢালা হলেও তার জ্ঞান ফেরে না। অবস্থা বেগতিক দেখে সুপারিনটেনডেন্টের সাহায্যে তাকে হাসপাতালে নেওয়া হয়।

তার প্রায় ৫-৬ ঘন্টা পর তার জ্ঞান ফেরে। আদৃতার সাথে ঠিক কি হয়েছিলো তা আমরা কেউই আজও জানি না। কারণ তার পরদিনই সে হোস্টেল ছেড়ে চলে যায়; এমনকি স্কুল থেকেও বিদায় নিয়ে নেয়। পরবর্তীতে তার সাথে একবার ফোনালাপের সময় সেই ঘটনা সম্পর্কে জানতে চাইলে সে কেবল সেই নারীমূর্তীর ভয়াবহ কালো অবয়বের কথা উল্লেখ করেই থেমে যায়। তারপর আর তার কাছে কিছু জানতে চাওয়া হয়নি।

আদৃতা যেদিন চলে যায় সেদিন রিনি আপুও বাড়িতে গিয়েছিলো। রুমে ছিলাম কেবল আমি আর তিথি আপু। রাতে পড়া শেষ করার পর আমরা দুজন গল্প করতে বসলাম। হঠাৎ লক্ষ্য করলাম, আমাদের রুমের কোণে পরে থাকা সেই কাঠের ক্যাবিনেটটি স্থানচ্যুত! আমরা খুবই অবাক হলাম। কেননা সেটা এতোই ভারী যে আমরা ৬ জন মিলে চেষ্টা করেও সেটাকে নাড়াতে পারিনি। সে রাতে আমরা দুজনেই ভয় পাওয়ায় পাশের রুমে অন্যদের সাথে গিয়ে থেকেছিলাম।

সেই সময়টাতে তিথি আপু,৷ রিনি আপু এবং আমি- এই তিনজনের সাথে বেশ কিছু রোমহর্ষক কাহিনী ঘটছিলো পরপর। খুবই ভয়াবহ আতংকে দিন কাটছিলো আমাদের। সবকিছু নিয়ে ভাবতে ভাবতে আমি বুঝতে পারলাম যে সেই অবয়বটি কেবল আমাদের এই রুমের বাসিন্দারাই দেখতে পাচ্ছি এবং শুধুমাত্র আমাদের সঙ্গেই প্যারানরমাল ঘটনা ঘটছে।

তখন আমার মনে হলো হয়তো এই রুমের সাথে সেই অবয়বটির কোনো সংযোগ রয়েছে যার কারণে সে কেবল আমাদেরকেই তার ভিক্টিম বানাচ্ছে। বিষয়টা আপুদের সাথে শেয়ার করলে তাদের কাছেও যেনো সবকিছু খোলাসা হয়ে ওঠে। আমরা ভেবেচিন্তে সিদ্ধান্ত নেই যে পরদিন কোনো একজন বড় হুজুরকে বিষয়টি জানাবো এবং তাঁর কাছ থেকে পরামর্শ চাইবো।

পরিকল্পনানুসারে পরদিন একজন হুজুরের কাছে গেলেও উনার ব্যস্ততার কারণে আমরা তার দেখা পাইনি। তাছাড়া স্বাভাবিক ভাবেই আমরা সবাই মোটামোটি ছোট থাকায় আমাদের কেউ তেমন পাত্তা দেয়নি। অনেকটা রাগ হয়েই আমরা ফেরত আসি নিজেদের ডেরায়।

সেদিন রাতে আমার সাথে জীবনের সবচেয়ে ভয়ংকর ঘটনাটি ঘটে। কিছুদিন যাবৎ এইসব কাহিনীর দরুণ আমাদের রুমের লাইট রাতের বেলায় জ্বালিয়ে রাখা হতো।

সেই রাতে প্রায় ৩ টার দিকে আচমকা আমার ঘুম ভেঙ্গে যায় কোনো একটা খচখচানি শব্দে। চোখ মেলে আশে পাশে তাকিয়ে দেখেও সেই শব্দের কোনো উৎস খুঁজে পাচ্ছিলাম না। সেসময় চুলে একটু টান পরায় ব্যাথা পেয়ে চুল সরিয়ে নিজের কাছে আনার জন্য টান দেই, ঠিক সেই মুহূর্তেই সম্ভবত এখন পর্যন্ত আমার জীবনের সবচেয়ে জঘন্য দৃশ্যটির তাড়না হয়। ঘাড় ঘুড়িয়ে চেয়ে দেখি, বিছানার পাশে থাকা টেবিলের উপর সেই কুৎসিত কালো অবয়বটি আমার চুলগুলো মুঠিতে নিয়ে কামড়ে কামড়ে খাচ্ছে এবং অনবরত তার মুখ থেকে গড়িয়ে পরা লালচে লালা দিয়ে আমার চুল ক্রমশ আঠালো হয়ে যাচ্ছে।

আমি সেই ঘটনার আকষ্মিকতায় কথা বলার শক্তি পর্যন্ত হারিয়ে ফেলেছিলাম। আজও সেই মুহূর্তটি স্পষ্ট হয়ে আমার চোখের সামনে ভেসে উঠে। এরপর ধীরে ধীরে সেই অবয়বটি আমার আঠালো চুলগুলো নিজের গলায় জড়িয়ে নেয় এবং তার কালচে লাল জিভ বের করে আমার দিকে এগোতে থাকে। এরপর আর আমার সজ্ঞানে থাকার শক্তি ছিলো না।

যখন আমার জ্ঞান ফেরে, তখন পূর্ব আকাশে সূর্যের রক্তিম আভা ভেসে উঠতে শুরু করেছে। হোস্টেলের প্রায় সবাই একত্রে জড়ো আমার পাশে। হুশ ফেরার পর আমি প্রথমেই তাকাই আমার চুলের দিকে। নিজের এতো পছন্দের চুলগুলোকেই অসম্ভব ঘৃণা হচ্ছিলো। কোনো কথা না বলে সবার প্রথমেই আপুদেরকে বলি আমার চুলগুলো যেন কেউ একটু ধুঁইয়ে দেয়।

তখন সবাই বললো যে ইতোমধ্যেই আমার চুল নাকি অনেকবার ধুঁতে হয়েছে। কারণ সেগুলা প্রচন্ড আঠালো হয়ে আমার গলায় পেঁচিয়ে ছিলো। আমার আর তখন বুঝতে বাকি থাকে না যে এটাই সম্ভবত ছিলো এখন পর্যন্ত সেই নারীমূর্তীর নেওয়া সবচেয়ে পৈশাচিক কুপ্রচেষ্টা।

দু’দিন পরের কথা। হোস্টেল সুপারিনটেনডেন্ট আমাকে ডেকে পাঠিয়েছেন। উনার ওখানে গিয়ে দেখি, ম্যাডামের পাশাপাশি হোস্টেলের সবচেয়ে বড় দু’জন আপুও রয়েছেন। ম্যাডাম বললেন যে তিনি এই দু’জন বড় আপুর সাহায্যে আমাদের কিছু নিত্য ব্যবহার্য জিনিসের অংশবিশেষ যোগাড় করেছিলেন।

সেগুলো একজন হুজুরের সাহায্যে পরীক্ষা করানোর পর জানতে পারেন যে, সেই নারীমূর্তীটি আমাদের রুমেই থাকতো অনেকদিন ধরে। হঠাৎ আমরা তার পরিচিত জায়গায় উপস্থিত হওয়ায় আমাদের উপর ক্ষেপে যায় সে। যেহেতু সেই রুমে প্রথম আমিই উঠেছিলাম তাই তার সবচেয়ে বেশি ক্ষোভ আমার উপরই ছিলো। যখন সে বুঝেছে আমরা কোনো একটা বড় পদক্ষেপ নিতে যাচ্ছি, তখনই সেই রাতের সেই দুর্ধর্ষ কাজটি করে চেয়েছিলো সবাইকে দমিয়ে দিতে। আল্লাহর অশেষ রহমতে আমি সেই রাতে জীবিত থাকতে পেরেছিলাম।

এই ঘটনার পর অনেক কিছুই করা হয় এবং এর ভয়াবহতা উপলব্ধি করে তিথি আপুও হোস্টেল ছেড়ে চলে যান ও রিনি আপু অন্য রুমে শিফট হয়ে যান। রয়ে যাই আমি একা। এরপরও প্রায় দু’বছর আমি ঐ রুমে একাই থেকেছি তবে তখন আর কিছুই ঘটেনি। কেন ঘটেনি, তা জানা নেই।

আমি হোস্টেল থেকে চলে আসার পর সেই রুম একেবারেই বন্ধ করে দেওয়া হয়। খোঁজ নিয়ে জানতে পারি, আমি ছেড়ে আসার পরপরই সেই কোনার ক্যাবিনেটটি নিজ থেকেই ভেঙ্গে পরে যায় এবং সেই সাথে ছাদের দেয়াল খসে পরতে শুরু করে। এমনকি সেই রুমের দরজা তালাবদ্ধ থাকলেও সেটি আপনাআপনি খুলে যেতো এবং তালা  খুঁজে পাওয়া যেতো না।

যার কারণে কর্তৃপক্ষ ছাত্রীদের নিরাপত্তার কথা চিন্তা করে বিশেষ বিবেচনায় রুমটি পরিত্যক্ত ঘোষণা করেন।

 

{ আরো পড়ুন – সত্য ঘটনা

 

( হোস্টেল ডায়েরী – ছোট গল্পটি আপনাদের কেমন লাগলো তা কমেন্ট করে অবশ্যই জানাবেন।

পরবর্তী গল্প পড়ার আমন্ত্রণ জানালাম। ধন্যবাদ।)

হোস্টেল ডায়েরী

” সমাপ্ত”