২ ডিসেম্বর – ছোট গল্প

২ ডিসেম্বর

লেখকঃ সিফাত হাসান

 

আমি ও আমার বন্ধু সিফাত দুজনেই খুব ভ্রমণপিপাসু ব্যাক্তি। দেশের বিভিন্ন জেলা শহরগুলো ঘুরে ঘুরে দেখা আমাদের শখ্। এরকমই একবার ২০২২ সালে আমরা ঠিক করেছিলাম ময়মনসিংহ ঘুরবো। শীতকাল ঘুরার আদর্শ সময়। দিনক্ষণ আগে থেকে ঠিক করা ছিলো, ২ ডিসেম্বর। আমরা সেদিন দুপুরের দিকে ঢাকা থেকে রওনা দেই। আমরা নতুন আরো একটা শহর দেখবো ভাবতেই একটা অন্যরকম ভালোলাগা কাজ করছিলো।

যারা ভ্রমণপ্রিয় মানুষ তারা বিষয়টা আরো বুঝতে পারবেন। আর বিশেষ করে আমাদের বেড়ে ওঠা এই ইট পাথরের যান্ত্রিক শহর ঢাকাতেই। তাই ঢাকার বাহিরে নতুন কোথাও ঘুরতে যাওয়াটায় আমাদের বিশেষ ভালোলাগা কাজ করে।

সেদিন ঢাকা থেকে ময়মনসিংহ পৌঁছুতে আমাদের প্রায় বিকাল হয়ে যায়। তাই আমরা সেখানের একটা হোটেলে রুম বুক করে ফ্রেশ হয়ে বেরিয়ে পড়ি৷ আমরা কাছেই কোথাও যাওয়ার কথা ভাবি। আর শেষমেশ একটা রিক্সা ঠিক করে জয়নুল আবেদিন পার্কের দিকে যাই। সময়টা মাগরিবের আজানের কিছু পূর্বে, সূর্য তখন পশ্চিম আকাশে। শুক্রবার, ছুটির দিন থাকায় পার্কেও প্রচন্ড ভীড়। মানুষের ভীড়ে শীতের ঠান্ডাটা খুব একটা পাওয়া যাচ্ছিলো না সেখানে।

আমরা সিদ্ধান্ত নেই নদীর ওপারে যাবো, ওপারে ভীড় কম, এপারের তুলনায় মানুষ নেই বললেই চলে। কথামতো নৌকায় করে ওপারে যাই। তারপর নৌকা থেকে নেমে দুজন দুটো সিগারেট জ্বালিয়ে গল্প করতে করতে হাটতে থাকি। আশেপাশে গ্রাম, আমরা নদীর উপরের পাড় ধরেই  হাটতে থাকি।

ততক্ষণে সন্ধ্যা শেষে আঁধার নেমে এসেছে। আশেপাশে ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক, জোনাকির আলো, ওপারের রেস্টুরেন্টে বাজানো সাউন্ড বক্সে ও মানুষের কোলাহলের মৃদু শব্দ – সবে মিলে ভালোই লাগছিল কানে। শীতকাল হওয়ায় নদীর বাতাস ও হালকা কুয়াশায় বেশ ঠান্ডা ঠান্ডা অনুভূত হচ্ছিলো আমাদের। সেসময় চিন্তা করি নির্জন অপরিচিত স্থানে এমন সন্ধ্যার পর আর সামনে আগানো আর ঠিক হবেনা, ঘাটে ফিরে যাবো। সিফাতকে বললাম,

– চল ফিরি, সামনে যাওয়া আর ঠিক হবেনা।

– এতদূর এসে আবার একই পথে ফেরার প্রয়োজন নেই। সামনে একটা নৌকা দেখা যাচ্ছে। চল ওটায় করে যাই।

তারপর আমরা নদীর নিচের পাড়ে নেমে আসি। নৌকায় দেখলাম আমাদের বয়সি একটা ছেলে বসে ছিলো বৈঠা হাতে। পরনে সাদা টি-শার্ট, কালো প্যান্ট। ওইপাড়ে যাবে কিনা জিগ্যেস করতে বললো যাবে। নৌকায় ওঠার পূ্র্বে আমি আরেকটা সিগারেট ধরাই। যেহেতু আর আশেপাশে আমরা দুজন ছাড়া কেউ ছিলোনা তাই আমরা নৌকায় ওঠার পরপরই ছেলেটা নৌকা বাইতে শুরু করে। নৌকার মাঝখানের পাটাতনে ছেলেটার দিকে ফিরে আমরা দুজন বসি।

একটা ব্যাপার তখন খেয়াল করেছিলাম, নৌকায় ওঠার পরপরই  চারপাশে কেমন যেনো একটা স্থবিরতা দেখা দেয় হঠা; ওপারের শব্দগুলা শুনা যাচ্ছিলোনা, শোনা যাচ্ছিলোনা মানুষের সেই মৃদু কোলাহল। শুধুই ছলাত ছলাত বৈঠা বাওয়ার শব্দটাই কানে আসছিলো আমার। নৌকায় ঠান্ডার প্রকোপটাও হঠাৎ বেড়ে গিয়েছিলো। সবকিছু তখন স্বাভাবিকভাবেই নিচ্ছিলাম। কিছুক্ষণ চলার পর  সিফাত উৎসুক হয়ে তাকে তার নাম জিগ্যেস করলে ছেলেটা নাম জানায়। এরপর সিফাত আবার বললো,

– আপনাকে দেখে মনে হয়না মাঝি।

পড়ালেখা করে কিনা জিজ্ঞেস করাতে ছেলেটা জানালো সে পড়ালেখা করতো। কিন্তু এখন করেনা। কেনো জিগ্যেস করলে বললো,

– আপনাদের একটা ছোটো ঘটনা বলি? তবে শর্ত আমার নাম কাউকে বলা যাবেনা। যদি বলেন আপনাদের ক্ষতি হবে।

আমরা সাতপাঁচ না ভেবে শুনতে রাজি হয়ে যাই। ভাবলাম আমাদের প্রশ্ন এড়াতে চায়।

– গত বছর ২ ডিসেম্বর, ঠিক এই দিনে এই ঘাটে একটা ছেলে হঠাৎ নৌকা থেকে মাঝ নদীতে পড়ে যায় । ঠিক মাগরিবের পর। সারারাত ডুবুরি দিয়ে খোঁজাখুঁজি করার পর সকালের দিকে তার লাশ পাওয়া যায়। জানা যায় ছেলেটার মাথা নদীর তলদেশে কাদায় আটকে ছিলো আর পা উপরের দিকে। পাড়ে ওঠানোর পর লাশের পকেটে পাওয়া ফোন (যা সচল ছিল) চেক করে শেষ কলে একটা মেয়েকে পাওয়া যায়। সেই মেয়েটা পরবর্তীতে তার লাশ শনাক্তের জন্য এসেছিলো। সে সহ সবাই জানে ছেলেটা দূর্ঘটনাবশত পড়ে মারা গেছে। কিন্তু ছেলেটা..

এই বলে কিছুক্ষণ চুপ থাকলো সে। তার কথা শুনতে শুনতে মনে হচ্ছিলো চারপাশের ঠান্ডাটা আরো বেড়ে গেছে ততক্ষণে। সিগারেটে টান দিতে দিতে জিগ্যেস করলাম,

– তারপর?

এরপর নীরবতা ভেঙ্গে বলে ওঠে,

– কিন্তু ছেলেটা আত্ব হন ন করে।

আমি স্বভাবিকভাবে প্রশ্ন করি,

– আপনি জানলেন কি করে যে সেটা আত্মহত্যা?

তিনি কিছু সেকেন্ড চুপ থেকে আমার দিকে  চোখগুলো একদৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো,

– কারণ ছেলেটা আমিই।

হালকা আলোয় বুঝা যাচ্ছিলো কথাগুলো বলার সময় তার অপলক চোখগুলো কেমন বড় বড় হয়ে ছিল। কথাটা শোনার পর ফাজলামো ভেবে আমি আর সিফাত একে অপরের দিকে তাকালাম। সিফাত যে ছেলেটার কথা সিরিয়াসলি নিয়েছে, সেটা ওর চেহারা দেখে বুঝলাম। তবে আমি একটু মুচকি হাসলাম।

তার ঠিক পরমুহূর্তেই আমরা ছেলেটার দিকে তাকাতেই দেখলাম, সে নৌকায় নেই। আশেপাশে খুঁজতে যেয়ে চোখ পড়ে নদীর একটু দূরে, বালুতে। সেখানে সেই ছেলেটা হেঁটে হেঁটে বড় দূর্বাঘাসগুলার মধ্যে দিয়ে চলে যাচ্ছে কোথাও। চোখের পলকেই মিলিয়ে গেলেন তিনি। আমরা আবার খেয়াল করলাম, আমাদের নৌকা নদীর পাড়েই এতক্ষণ বাধা ছিলো একটা বাঁশের খুঁটির সাথে। অথচ আমি দেখেছিলাম, সেই ছেলের সাথে কথা বলতে বলতে প্রায় মাঝ নদীতে এসে পড়েছিলো আমাদের নৌকা। সিফাতকে জিগ্যেস করলাম,

– আমি যা দেখছি, তুইও কি তা দেখছিস?

– হ্যাঁ।

ভাবছিলাম একসাথে দুজনের ভুল কিভাবে হতে পারে! আমার শরীরে রক্তের একটা হিমশীতল স্রোত বয়ে গেলো তখন। মনে হচ্ছিলো হৃদপিন্ড রক্তশূণ্য হয়ে গেছে কিছুক্ষণের জন্য। ঠান্ডার মাঝেও প্রচন্ড ঘামতে থাকি আমি। আমরা দুজন ততক্ষণে কোনো কথা না বলে নৌকা থেকে নেমে দোআ পড়া শুরু করে দিয়েছি। এরপর হঠাৎ হাতের সিগারেটের দিকে লক্ষ্য করলে দেখতে পাই, যতটুক খেয়ে নৌকায় ওঠেছিলাম ঠিক ততটুকুই অবশিষ্ট আছে, ওপারের কোলাহলও কানে আসতে থাকে ততক্ষণে।

তারপর আমরা নদীর নিচের পাড় ধরেই দ্রুত হেটে ঘাটের দিকে যেতে যেতে অন্য আরেকটা নৌকা পেয়ে যাই। ভয়ে ভয়ে সেটা দিয়েই এপারে ফিরে আসি। ও পরে হোটেলে। পুরো রাস্তাটায় আমরা কোন কথা বলিনি। শুধু ভাবছিলাম কি হয়েছে আমাদের সাথে।

পরদিন আমরা ঢাকায় ফিরে আসি। এরপর আর আমাদের ময়মনসিংহ যাওয়া হয়নি। আর আমাদের জানাও হয়নি যে সেখানে আদৌ এমন কেউ মারা গেছিলেন কি-না। আমাদের মনে সেই ঘটনাটা নিয়ে এখনো প্রশ্ন জাগে, আমরা দুজন একটা ছেলেকে নৌকা বাইতে দেখলাম, আমরা মাঝ নদীতেও গেলাম, তাও হঠাৎ চোখের পলকে আমরা কীভাবে আবারো তীরে ফিরে গেছিলাম ? সব যেনো রহস্যই থেকে গেলো। ২ই ডিসেম্বরের রহস্য।

 

{ আরো পড়ুন – আ লেডি পেইন্টার

 

( ২ ডিসেম্বর – ছোট গল্পটি আপনাদের কেমন লাগলো তা কমেন্ট করে অবশ্যই জানাবেন।

পরবর্তী গল্প পড়ার আমন্ত্রণ জানালাম। ধন্যবাদ।)

 

 

২ ডিসেম্বর

” সমাপ্ত”