কনিষ্ঠা আঙুল – ছোট গল্প

কনিষ্ঠা আঙুল

লেখকঃ মারিয়া ইসলাম

 

আমার ঘর থেকে একদম সোজা দেখা যায় ছেলেটার ঘর। সারাদিন ই কি যেন করে। কানে একটা হেডফোন, সামনে ল্যাপটপ, সাথে ধোঁয়া ওঠা একটা কাপ। সে কাপে কফিও থাকতে পারে, আবার চা’ও।

৬-৭ মাস হবে ময়মনসিংহ এসেছি। ঘর থেকে বের হতে পছন্দ করি না আমি। কিছুটা ইন্ট্রোভার্ট স্বভাবের মেয়ে বলা যায়। সবার সাথে সহজে মিশতে পারি না, সবকিছুতেই আনইজি লাগে। তবে এ ছেলেটাকে শুরু থেকেই মনযোগ সহ দেখি। বেশ ভালো লাগে ওনাকে দেখতে। আমার রুমমেট তমা একদিন বিষয়টা খেয়াল করে আমাকে বেশ ক্ষ্যাপায়। আমি শুধু ঠোঁট কামড়ে হেসে যাচ্ছিলাম। বিষয়টা বেশ অস্বস্তিকর ছিলো।

আমি কিন্তু ওই ঘরটার দিকে তাকানো বন্ধ করতাম না। আমার প্রাত্যহিক রুটিন হয়ে দাড়িয়েছিলো ওই জানলার খোঁজ খবর নেয়া। তমা খুব ভালো মেয়ে। সেদিন আমার অস্বস্তি বুঝতে পেরে আমাকে আর ঘাটায় নি। কিন্তু খেয়াল করতাম মাঝে মাঝে সেও উঁকি দিতো সেই ঘরটায়। আমি বিষয়টাকে তেমন গুরুত্ব দেই নি৷ তমা প্র্যাক্টিসিং মুসলিমাহ,বেশ কঠোর ধার্মিক স্বভাবের। দুষ্টুমিগুলো যেমন লিমিট রেখে করে, নিজেকেও সবদিক থেকে সেইফ রাখার চেষ্টা করে। কোন ছেলের প্রতি এভাবে আকৃষ্ট হওয়ার মেয়ে সে না- এতোদিন এটুকু বেশ ভালো বুঝেছিলাম আমি।

একদিন রাতের বেলায় প্রচন্ড রকমের গরম লাগছিল। আমার রুমে শুধু তমা আর আমি ই থাকতাম। গরমে দুজনেই হাসফাঁস করছিলাম। আমার বেডসাইডের জানালাটা খুলে তাকালাম সেই ঘরটার দিকে। এখনো ছেলেটা কি যেন করছে ল্যাপটপে। পাশ থেকেই তমা বলে ওঠে,

– অনামিকা,তুমি কি দেখো ওইখানে?

আমি চমকে উঠলাম! চশমা চোখে দিয়েও আমি কম দেখি জানি, কিন্তু তমার চোখ তো একদম পরিষ্কার! আমি ছোট্ট করে জবাব দিলাম,

– কেন?

– না মানে, আমি তো প্রথমে ভাবতাম হয়তো কাওকে পছন্দ করেছো; এ জন্য জানালা দিয়ে তাকিয়ে থেকে কাওকে দেখো। কিন্তু ওখানে তো কেও ই নেই!

কপাল আপনা-আপনিই কুঁচকে উঠলো আমার। হঠাৎ করেই এ বিষয় নিয়ে আর কথা বলতে ইচ্ছে করছিলো না আমার। তাই প্রসঙ্গ পাল্টাতে চা বানিয়ে আনার বাহানা দিয়ে রান্নাঘরে চলে যাই। সেদিনের পর তমা রোজ আমাকে দু’আ পড়ে রুকইয়াহ করে দিতো। সে আমাকে শেখাতো, জানাতো ইসলাম সম্পর্কে। আমারও বেশ ভালো লাগতো জানতে। একদিন তমার মামা অসুস্থ হওয়ায় জরুরী তাকে বাড়ি যেতে হয়। রুমে তখন আমি একা। এমনিতেও আমি ভয় ডর কম পাই। মাঝে বেশ অনেকদিন আমি ছেলেটাকে দেখতে পাই নি। এ বিষয়টাও আমি গুরুত্ব দেই নি। ভেবেছিলাম হয়তো কোথাও গেছে বেড়াতে। অথবা যাই হোক আবেগকে প্রশ্রয় দেয়ার মেয়ে আমি না।

পুরো ঘরটা কেমন নিরবতায় থমথম করছে। ঘরির কাটাগুলোও রাত ১২.৩০ ছুঁয়েছে। বায়োলজির প্র্যাক্টিক্যাল করতে করতে সময় কখন পেরিয়ে গেছে, খেয়ালই করি নি। লোড শেডিং হওয়াতে হুশ এলো এবার। গরম লাগার জন্য আবার জানালা টা খুলে দেই। অভ্যাসমতো আজও সামনের ঘরটায় তাকাই। দেখলাম, আজ ছেলেটা একদম জানালার কাছে দাড়িয়ে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। যেন সে জানতো আমি জানালা খুলবো, আর তাই আমার অপেক্ষাতেই আছে। খেয়াল করলাম বেশ স্নিগ্ধ তার চেহারা, মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি, অনেকটা লম্বা হবে। আজ এতো মাস পর প্রথম ছেলেটার চেহারা দেখলাম।

কতক্ষণ তাকিয়ে ছিলাম জানিনা। হঠাৎ দেখি ছেলেটা নেই। চোখ থেকে চশমা খুলে মুছে আবারও চোখে চশমা লাগালাম। কিন্তু এখনো তাকে দেখতে পারছি না। এই প্রথম বিষয়টা খুব অদ্ভুত লাগলো। এই মাত্রই এখানে ছিলো, গেলো কই!

মুখ দিয়ে “চ” আওয়াজ করতেই ঘাড়ে কারো স্পর্শ টের পেলাম। এ ঘরে আমি ব্যতীত কেও নেই। আমি নতুন নতুন ৫ ওয়াক্ত নামায শুরু করেছি কিন্তু রুকইয়াহ পারি না। হঠাৎ করেই খুব ভয় লাগা শুরু করলো। পাশের রুমে ফায়জা আপু ছিলো। পিছন না ফিরেই তাকে ডাকতে চাচ্ছিলাম। কিন্তু মুখ দিয়ে টু শব্দও বের হচ্ছে না আমার। হঠাৎই ঘাড়ে থাকা ঠান্ডা হাতের স্পর্শ আমার আমার গলা জড়িয়ে ধরে। কানে আসে ভরাট এক কন্ঠস্বর,

– অনামিকা তুমি ভীষণ সুন্দর! তোমার ডান হাতের কনিষ্ঠা আঙুলটাও  কি সুন্দর,নরম, সতেজ!

কনিষ্ঠা আঙুল

আচমকা এমন  কথা শুনে আমার গলা-ঠোঁট সব শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে। আমি একটা শব্দও উচ্চারণ করতে পারছিলাম না। গলায় রাখা হাতটাতে ধরে পিছন তাকাতেই আরো একদফা আৎকে উঠি৷ এ তো সেই ছেলেটা যাকে মাত্রই ওই জানালার সামনে দেখলাম!

খেয়াল করলাম সে আমার হাতের আঙুলগুলো তার হাতের আঙুল দিয়ে স্লাইড করছে। কনিষ্ঠা আঙুলে গিয়ে সেটা তার মুখের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। চিৎকার দিয়ে মাটিতে পড়ে যাই। অবশ হয়ে আসে শরীর। আমার সামনে চিবিয়ে চিবিয়ে সে আমার আঙুল টা খাচ্ছে। যন্ত্রণায় আমি চিৎকার করছি। অথচ কেও আসছে না। হঠাৎ দেখলাম ছেলেটা একটা ভয়ঙ্কর আকৃতিতে পরিবর্তন হয়ে গেছে।

এরপরদিন নিজেকে হাসপাতালে পাই। জ্ঞান ফিরতেই আগে আমার আঙুলের দিকে তাকাই। কনিষ্ঠা আঙুলটা নেই আমার হাতে। তমা এসে জড়িয়ে ধরে আমাকে।

– তুমি এক ভয়ানক জ্বিনের কবলে পড়েছো। ভয় পেয়ো না, তোমার রুকইয়াহ করানোর ব্যবস্থা করেছি। তুমি যখন সবসময়ই জানালা দিয়ে তাকিয়ে থাকতে- আমি খেয়াল করতাম। পরে খোঁজ নিয়ে জানতে পারলাম ওই বাসাটায় আগে কয়েকটা দুষ্টু ছেলে মেয়ে থাকতো, ওরা রিচুয়াল করতো। আরো অনেক ভয়ানক কাজ করতো। সেদিনই আমি এবিষয়ে জানলাম, তবে তোমাকে জানাই নি, জানলে তুমি ভয় পাবে এই ভেবেই জানাই নি। যেদিন ভাবলাম জানাবো, সেদিন আমার বাসায় যেতে হলো।পাশের রুমের আপুকে কল দিয়ে তোমার রুমে যেতে বলার পরই শুনি তোমার এ অবস্থা। আল্লাহ হেফাজত করেছেন তোমাকে। আলহামদুলিল্লাহ।

আমি মুচকি হেসে জিজ্ঞেস করলাম, “তুমি কখন এসেছো?”

সে বললো তখনই নাকি তার আব্বু আর বড় ভাইকে সঙ্গে নিয়ে বের হয়েছিলো। কৃতজ্ঞতায় মাথা নুয়ে আসছিলো। কিন্তু আমার ইন্ট্রোভার্ট স্বভাব তার প্রতি সবটুকু কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে দেয় নি।

এরপর বেশ অনেকবার ওই ছেলে রূপি জ্বীনকে আমি দেখেছি। কিন্তু সে আমার কোন ক্ষতি করতে পারেনি। সবসময় সেল্ফ রুকইয়াহ করতাম। এবং একসময় রাক্বীর কাছে যেয়ে রুকইয়াহ করি। এরপর থেকে আর কোনদিনই ওই বদ জ্বীনকে দেখিনি আর। আলহামদুলিল্লাহ।

মাঝে কেটে গেছে ১৪ টি বছর। এখনো মাঝে মাঝে আমার কনিষ্ঠা আঙুলের দিকে তাকালে প্রথমবারের মতোই ভয়ে কুঁকড়ে যাই আমি।

 

 

{ আরো পড়ুন – সত্য ঘটনা

 

( কনিষ্ঠা আঙুল – ছোট গল্পটি আপনাদের কেমন লাগলো তা কমেন্ট করে অবশ্যই জানাবেন।

পরবর্তী গল্প পড়ার আমন্ত্রণ জানালাম। ধন্যবাদ।)

কনিষ্ঠা আঙুল

” সমাপ্ত”