কেউ না – ছোট গল্প

কেউ না

লেখক: ইসমত আরা তন্নি।

 

থার্ড ইয়ার ফাইনাল পরীক্ষার এক মাস আগে আমার রুমমেট হল ছেড়ে  মেডিকেলের কাছেই প্রথমবারের মতো ভাড়া বাসায় উঠেছিলো। এখান থেকে কলেজে আসতে সমস্যা হলেও পরিবারের সাথে থাকার সুবিধার্থে এছাড়া আর উপায় ছিলো না। আমিও মাঝে মাঝে সময় পেলেই তার বাসায় চলে যেতাম। বাসাটা ভাটিকেশর গোরস্তানের কাছেই। বাসার ছাঁদটাও বেশ খোলামেলা ছিলো। ফল ফুলে গাছপালা দিয়ে সাজানো গোছানো যেন ছোট্ট একটি ছাঁদবাগান।

মাঝে মাঝে একাই সেই ছাঁদে গিয়ে বসে থাকতাম। সেখানে কিছুক্ষন বসে থাকলে কোন কারন ছাড়াই মনমরা হয়ে যেতাম আবার এই মলিন অনুভূতিটা কাটিয়ে সেখান থেকে চলে আসতেও মন চাইতো না।

বাগান বিলাস, চন্দ্রমল্লিকা, জুঁই, থানকুনি, ওষধি পাতা, গোলাপ সবকিছুর সম্মিলিত এক অদ্ভূত ঘ্রানে মনে হতো আমি কোন এক বিষন্নতার নেশায় ডুবে আছি। এমনই এক বিকেলে ছাঁদ বসে চন্দ্র মল্লিকা ফুলে হাত বোলাচ্ছিলাম; সেসময় হঠাৎ আমার মাথাটা ঘুরে উঠলো। মনে হলো ভূমিকম্প হয়ে গেলো এক মুহুর্তে। আমি ছাঁদের দরজার দিকে তাড়াতাড়ি এগিয়ে যেতে চাইলেই আমার খোলা চুলে শক্ত কিছুর টান পড়লো।

পিছন ফিরে চাইতেই দেখি চন্দ্র মল্লিকা গাছের ডালে শক্ত করে আমার চুল গিঁট বেঁধে আছে। যেন এইমাত্র  দুষ্টুমি করে কেউ গিঁট দিয়ে গেছে। আমি বেশ অবাক হলাম আবার সাথে ভয়ও পেলাম।

এত বেশি বাতাসও নেই যে চুল উড়ে গিয়ে গাছে প্যাঁচ লাগবে। চুলের গিঁট ছাড়াতে গিয়েও পারছিলাম না দেখে বিরক্ত হয়ে জোরে টান দিতেই চুল ছিড়ে চলে আসলো। আমি সাথে সাথে ছাদ থেকে দৌড়ে বের হলাম আর এক গোছা চুল চন্দ্রমল্লিকা গাছেই ঝুলে রইল।

রুমে এসে বান্ধবী কে সব বলতেই ও একরকম হেসে উড়িয়ে দিলো। ভাবলো আমারই মনের ভুল সবটা। কিন্তু আমি মেনে নিতে পারছিলাম না। ঠিক করলাম এখনই হলে চলে যাবো। আর এ বাসায় আসা ঠিক হবে না।

বিকেলের মধ্যেই নাস্তা করে হলে চলে আসলাম। রাতে টেবিলে বসে পড়ছিলাম। জানালা দিয়ে হালকা হালকা বাতাস আসছিলো। বাতাসের সাথে স্নিগ্ধ ঘ্রাণ আসতেই আমার শরীর ঝাঁকুনি দিয়ে উঠলো। মনে হলো সেই ছাদে বসে আছি এখনও। সেই একই ঘ্রাণ। কেমন একটা ঘোরের মধ্যে আছি মনে হচ্ছে। ফোনের রিং এর আওয়াজে ঘোর কেটে গেলো। সেই বান্ধবীর নাম্বার। রিসিভ করলাম,

– হ্যালো? কিরে কল দিলি যে!

ওপাশে তখনও নিরবতা। বাতাসের শো শো আওয়াজ ভেসে আসছে।

– হ্যালো? কি রে? কি হলো তর?

এইবার থমথমে গলায় সে উত্তর দিলো,

– কাল বিকেলে বাসায় আসিস।

বলেই ফোন কেটে দিলো। অবাক লাগলো ওর ভয়েস শুনে। মোহনা তো এভাবে কথা বলে না! নিশ্চয়ই বাসায় কিছু ঘটেছে।

পরদিন বিকেলের দিকে রওনা হলাম ওদের বাসায়। গিয়ে দেখি তালা ঝুলছে দরজায়। মেজাজটা খারাপ হলো। ওকে কল দিলাম। ধরছে না। হঠাৎ শুনি ছাঁদের দরজায় জোরে জোরে আওয়াজ হচ্ছে। তার মানে ওরা ছাঁদেই আছে। আমি ছাঁদে গিয়ে কাউকে খুঁজে পেলাম না। উল্টো ভয়ংকর আওয়াজে ছাদের দরজা টা বন্ধ হয়ে গেলো। ব্যাস! সাথে সাথে আমি দৌড়ে দরজা ধাক্কা দিতে লাগলাম। খোলার নাম নেই। মোহনাকে কল দিচ্ছি বার বার। ধরছেনা। চতুর্থ বার রিং হতেই ধরলো। আমি রাগী গলায় বলে উঠললাম,

– ফাজলামি করতেসিস আমার সাথে? কল দিয়ে আনালি আর এখন ছাদে এনে দরজা বন্ধ করলি!

আমার কথা শুনে ও যেন আকাশ থেকে পড়লো। সাথে সাথে বললো,

-কি বলিস? আমি তোকে কল দিইনি তো। আর আমরা সকালেই বাড়িতে আসছি। তোকে কেন কল দিবো?

আমি বুঝতে পারছি না এখন কি বলবো। কান্না কান্না কন্ঠে বললাম,

– তোর নাম্বার থেকে কাল কল দিয়ে আমাকে তর ভয়েসে কেউ আসতে বলসে। আমি আসছি। এখন আমাকে ছাদে কেউ আটকে রাখসে। আমি এখন কি করবো বল?অনেক ভয়  লাগছে। প্লিজ কিছু কর।

বলতে বলতে ব্যালেন্স ফুরিয়ে ফোন কেটে যায়। সন্ধ্যাও ঘনিয়ে আসছে। আমি দরজা ধাক্কা দিতে দিতে ওখানেই ক্লান্ত হয়ে বসে পড়লাম। এবার ঠান্ডা একটা বাতাস আমাকে ছুঁয়ে গেলো। এতক্ষণে বুঝতে বাকি নেই অশরীরী কিছুর পাল্লায় পড়েছি। পালানোর পথও নেই। কাঁপা কাঁপা গলায় জিজ্ঞেস করলাম,

– কে আপনি?

বাতাসে গম্ভীর গলায় ভেসে আসলো,

– কেউ না

অশরীরী উত্তর শুনে ভয়ে নিঃশ্বাস আটকে আসার উপক্রম হলো। আবারও আওয়াজ ভেসে আসলো,

-ভয় পেও না। কোন ক্ষতি করবো না।৷ সামনে হাত বাড়াও।

আমি বুঝতে পারছি না আসলেই হাত বাড়াবো কিনা। যদি হাত টান দিয়ে ছাঁদ থেকেই ফেলে দেয়! আরও অনেক কিছু ভাবতে ভাবতে হাত বাড়িয়ে দিলাম। ঠিক তখনই এক গোছা চুল জড়ানো দুটো চন্দ্র মল্লিকা ফুল আমার হাতে এসে পড়লো। ভীষন অবাক হলাম। এটা তো আমারই চুল সেদিন গাছের ডালে ছিঁড়ে রয়ে গেছিলো। হঠাৎ আমার পিছনে ছাদের দরজাটা শব্দ করে খুলে গেলো। দেখি কেয়ার টেকার রাগী চোখে চেয়ে আছে। আমাকে দেখেই বলতে লাগলো,

– সেই কখন থাইকা আপনার বান্ধবী আমারে কল দিতাসে আপনি নাকি ছাদে আটকা পড়সেন এখন তো আইসা দেখি দরজা ছাদের ভিতর থাইকা লাগায়া বইসা আছেন!

আমি আর কোন ভাষা খুঁজে পেলাম না। জানি কিছু বলে লাভ নেই। চুপচাপ হলে চলে গেলাম। হাতের মুঠোয় আমার চুল জড়ানো সেই চন্দ্র মল্লিকা ফুল দুটো। আসার পথে ফুল গুলোর দিকে চেয়ে  মনে মনে বললাম,

– কে আপনি?

আবারও মনে হলো দূর থেকে কেউ গম্ভীর স্বরে উত্তর দিলো,

– কেউ না।

 

 

{ আরো পড়ুন – সত্য ঘটনা

 

( কেউ না – ছোট গল্পটি আপনাদের কেমন লাগলো তা কমেন্ট করে অবশ্যই জানাবেন।

পরবর্তী গল্প পড়ার আমন্ত্রণ জানালাম। ধন্যবাদ।)

কেউ না

” সমাপ্ত”