বিস্ময়ভিলা – ছোট গল্প

বিস্ময়ভিলা

লেখক: নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক

 

আমরা ৪ জন সদস্যের পরিবার চট্টগ্রাম থাকি। আমি, আমার হাজবেন্ড আর পিঠাপিঠি ২সন্তান। ২০২০ সালের নভেম্বর মাসে কোল জুড়ে আমার মেয়ে দুনিয়াতে আসে। এর পরের মাসেই নতুন ঘরে উঠি। যেহেতু আমরা ছোট পরিবার, তাই অতো বড় বাসার ঠিক প্রয়োজন ছিলনা। সব মিলিয়ে ১ বেড, ড্রয়িং, ডাইনিং নিয়ে নতুন বাসা। বাসাটা ছিল ছাঁদের পাশে।

বাচ্চাদের ছোট কাপড় ধুয়ে ইজিলি শুকানো যাবে। তাছাড়া বড় ছেলে তখন ২ পূর্ণ হয়; ও খেলতে পারবে ভেবে ওই বাসায় উঠলাম। বাসার মালিক ছিলেন শিক্ষিকা।

১।

যেদিন ওই বাসাটায় উঠলাম, ঠিক সেদিন থেকেই আমার ১০৪ ডিগ্রি জ্বর। ৩ দিনেও জ্বর নামে না। সাপোসিটার, নাপা কোন কাজই করছিলো না। এন্টিবায়োটিক খাওয়ার পর জ্বর কমে। সেবার জ্বরের পর মেজাজ খুব খিটখিটে হয়ে যায়। এন্টিবায়োটিক খেলে এমন হয়; তাই মনে করলাম। বাসায় উঠার পর বাড়ির মালিক ঘন ঘন আসতেন।

উঠার আগে ও পরে উনি আমাদের বলে দিলেন যেনো দক্ষিণে ড্রয়িং রুমে থাকি, ওখানে আরাম। বেডরুম যেটা ওটা উত্তর, ওখানে গরম, থাকার দরকার নাই। তবে শীতকাল থাকায় আমরা উনার উপদেশ অমান্য করে উত্তর রুমেই থাকি।

উত্তর দিকের রুমটার একটা অদ্ভুত বৈশিষ্ঠ লক্ষ করলাম। ওই রুমে যখনই ঘুমাতাম, খুব গভীর ঘুম হতো। যেনো আমি চোখ মেলতেই পারতাম না। এক বিকালে ভাত খেয়ে শুয়েছি। হঠাত আমি গভীর ঘুমে ছেয়ে গেলাম। দরজায় বাড়িয়ালী এসে কড়া নেড়েছে প্রায় এক ঘন্টা মতো। এরপর একসময় চোখ খুলে কোন রকম ওড়না মাথায় দিয়ে দরজা খুলি। খুলে দেখি বাড়িওয়ালী সামনে।  উনি জিগাস করলো, তুমি কই ছিল্‌ এক ঘন্টা আমি দাঁড়িয়ে। আমি তখনও স্থির হয়ে দাঁড়াতে পারছিলাম না। বললাম, এই তো শুয়েছিলাম।

এবার তিনি কোন কিছু না বলে ঘরে ঢুকে যান। আমাকে জিজ্ঞেস করেন, তুমি ওই রুমে ঘুমাও? ওখানে কেনো ঘুমাও, দক্ষিণ রুমে ঘুমাবা।

এই ব্যাপারটা তেমন পাত্তা না দিলেও এ ঘটনার পর আমি আরো অদ্ভুত কিছু ঘটনার সম্মুখ হতে থাকি। প্রথমে মনের ভুল ভেবেছিলাম; ধারণা ছিল, হয়তো একা থাকি বলেই এসব অনুভব করছি। তবে পরে বুঝতে পারি কোন সমস্যা এখানে আছে।

২।

আমার ছেলেটা সারাদিন কাঁদতো। একদম সারাদিন মুখে কিছুই বলতো না। আমার মেজাজ ও খিটখিটে থাকতো। ওকে খুব বকা দেয়া শুরু করি। হঠাৎ করে দেখা যেতো ও ভয় পেয়ে দৌড়ে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরতো। এরপর আমরা দক্ষিণের রুমে থাকা শুরু করি। সে সময়টায় আবার আগের রুমটায় আমার ছেলে-মেয়েকে খেলতে দিতাম, তারা একসাথে খেলতো। তবে খেলতে খেলতে হঠাৎ’ই তারা কেন যেনো কান্না শুরু করে দিতো।

আরো ৬/৭ মাস অতিবাহিত হওয়ার পর এসব আরো বাড়তে থাকে। যেমন, এক দুপুরে আনুমানিক ৩ টার দিকে ছাঁদে কাপড় আনতে যাই। শুরুতে কিছু না দেখলেও ফিরে আসার সময় ঘুরে দেখি আমার সামনে পানি ট্যাংকের উপর বিশাল আকৃতির এক দাঁড়কাক বসে আছে। কি ক্ষিপ্ত-ভয়ানক তার চাহনি! ওই অবস্থায় জোড়ে চিৎকার মত করে আয়তুল কুরসি পড়তে পড়তে ফিরে আসি।

তখন থেকে আমি ৩ বেলা কোরআন পড়া শুরু করি। বাচ্চাদের একা রাখতে ভয় লাগতো। ছেলে কোন না কোন ভাবে ব্যথা পেতো। একবার এত জোড়ে ফ্লোরে পরে গেলো, ওর চোখের নীচ কালো জখম হয়ে গেল। সকাল সন্ধ্যা দুআ পরে ফু দিতাম। ছেলের পর আমার ৬/৭মাসের মেয়ে ব্যথা পেতে শুরু করলো। কখনো বিছানা থেকে পরে যাচ্ছে তো কখনো দাঁড়ানো থেকে পরে যাচ্ছে। হাজবেন্ড যেখানে ঝগড়া করতো না, সেখানে আমাদের প্রায় প্রতিদিন ঝগড়া।

ওই বাসায় থাকাকালিন স্বামী-স্ত্রী’র স্বভাবিক যে সম্পর্ক, সেটাও ঠিক মতো ছিল না। হাজবেন্ডকে এই অদ্ভুত বিষয়গুলো জানালেও তিনি এ কথা গুলো বিশ্বাসই করতেন না। বলতেন, মনের ভুল তোমার।

এরপর এক বিকালে চোখ লেগে কখন ঘুমিয়ে গেলাম। হঠাৎ মাথায় প্রচন্ড আঘাত পেয়ে ঘুম ভাঙে। উঠে দেখি আমার বাচ্চারা ঘুমুচ্ছে। ভাবি, তবে আঘাত পেলাম কীভাবে! সেই বিকেলে আমি উত্তরের রুমে ছিলাম। উঠে দ্রুত বাচ্চাদের নিয়ে অন্য রুমে চলে যাই। এরপর ঐ উত্তরের রুমে যাওয়া পুরপুরি বন্ধ করে দেই।

এক দিনের বেলায় আমার মেয়েটাকে ঘুম পারাচ্ছি। হঠাৎ রুমের মধ্যে খেয়াল করি প্রকান্ড এক ধোয়ার মতো কালো ছায়া। ভয়ানক দৃশ্যটা দেখে আমি নিজেকে সামলে আয়াতুল কুরসি পড়া শুরু করলে সেটা অদৃশ্য হয়ে যায়। এছাড়াও ছাঁদে প্রচন্ড আওয়াজ হতো। সেই আওয়াজ আবার আমিই একা শুনতাম, আমার হাজবেন্ড শুনতে পেতেন না।

এসব ছাড়াও ক্ষণে ক্ষণে কোনোকিছুর সাথে ধাক্কা খেতে শুরু করি আমি। যেমন, একবার সিঁড়ির নিচে অদৃশ্য বস্তুর সাথে ধাক্কা খাই। হাজবেন্ড’কে জানালে তিনি সিরিয়াসলি নেন না বিষয়টা। অদৃশ্য বস্তুটার তান্ডব বাড়তে থাকে। রাতের গভীরতা বাড়লে প্রায় সময়ই আমাকে ঘুমের মধ্যে চেপে ধরতো। স্বপ্নে দেখতে পেতাম, কুচকুচে কালো একটা ছেলে এসে বলে, তোরা এখান থেকে চলে যা, এটা আমার ঘর, আমার পরিবার থাকবে। এই এক স্বপ্ন আমি বারবার দেখতে থাকি। ভয়ে আতংকে সারাদিন সূরা পড়ে সময় কাটাতে থাকি।

৩।

এসব অব্দি আমার হাজবেন্ড বিশেষ গুরুত্ব দেয়নি। তবে একদিন হুট করেই আমি দেখি আমার হাজবেন্ড এসে আমার গায়ের উপর উঠে জোড়ে আমারই গলা চেপে ধরে আছে। যেনো সে নিজ জ্ঞানে নেই; আছে পুরপুরি অন্য কারো নিয়ন্ত্রণে। হয়তো ঐ অদৃশ্য বস্তুটারই। কি তার সেই অভূতপূর্ব ভয়ানক রূপ! আমি সূরা পড়তে শুরু করি। আয়াতুল কুরসি, সূরা বাকারা’র প্রথম ও শেষ আয়াত পড়ছি আর নিজেকে ছাড়াতে অপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।

তখন আমার হাজবেন্ড’ও দেখি নিজ স্বত্বায় এসে সূরা পড়তে শুরু করেন। এরপর কিছু সময়ের মধ্যেই তিনি আমাকে ছেড়ে দেন, শরীর হালকা হয়।

এই ঘটনার পর আমার মতোই আমার হাজবেন্ড’ও প্রচুর ভয় পেয়ে যান। সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় যত দ্রুত সম্ভব বাসা পরিবর্তন করার। খুঁজতে থাকি নতুন বাসা। তবে কোন এক অদ্ভুত কারণে আমরা বাসা পাচ্ছিলাম না। এরপর আবার আরেক প্রতিবেশি আমাদের জিজ্ঞেস করেন, এখানে সমস্যাটা কি ? কোন ভাড়াটিয়ারা বেশিদিন থাকেনা, শুধু আপনারাই থাকছেন!

একটা বাসা ঠিক করলাম শত যুদ্ধের পর। তবে শেষ মূহুর্তে এসে ঐ বাসার আগের পরিবার জানান, তারা কোনভাবে বাসা পরিবর্তন করতে পারছেন না; আমরা যেনো নতুন বাসা খুঁজি। এই ঘটনাটাও অপ্রত্যাশিত ছিল। মনে হচ্ছিলো, কেনো এতো বাঁধা আসছে! তবে ভাগ্য হয়তো সেবার সহায় ছিল। এক মসজিদের পাশে একটা বাসা খুঁজে পেয়ে যাই। দ্রুত আমরা সেখানে স্থানান্তরিত হয়ে পড়ি। আর নতুন বাসায় উঠার পর আমার পরিবারে আবারো সুখ-শান্তি ফিরে আসে।

আমাদের সাথে ঘটে যাওয়া ঘটনাটার পর যা মনে হলো, দোয়া পড়তে থাকার জন্য বিশেষ ক্ষতি করতে পারেনি আমাদের। আর আগের বাসার বাড়িওয়ালা আন্টিকে এব্যাপারে বলেও কোন সমাধান আমরা পাইনি। তিনি উল্টো আমাদের বলেন, সব আমাদের মনের ভুল। উল্লেখ্য, সেই আন্টির হাজবেন্ড ৪-৫ বছর যাবত মানসিক ভারসাম্যহীন হয়ে পড়ে আছেন। উনাকে ঘরে বেধে রাখা হতো। কে জানে, হয়তো ঐ বাসাটার সমস্যার জন্যই সেই আঙ্কেলের এই অবস্থা!

পরিশেষে বলবো, বাসায় এমন কিছু সমস্যা ফেস করে থাকলে দ্রুত বাসা পরিবর্তন করা উচিত।

 

 

{ আরো পড়ুন – হোস্টেল ডায়েরী

 

( বিস্ময়ভিলা – ছোট গল্পটি আপনাদের কেমন লাগলো তা কমেন্ট করে অবশ্যই জানাবেন।

পরবর্তী গল্প পড়ার আমন্ত্রণ জানালাম। ধন্যবাদ।)

বিস্ময়ভিলা

” সমাপ্ত”