বোতল বন্দী রহস্য – ছোট গল্প

বোতল বন্দী রহস্য

লেখক: রেজাউল করিম আকাশ

 

কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতে ঘুরতে যাওয়া সবারই একটা বড় স্বপ্ন। ঠিক তেমনই ২০২২ এর ডিসেম্বর এ আমি আর আমার বন্ধু নিজাম বের হয়ে পড়লাম এই স্বপ্ন পূরনের উদ্দেশ্যে। নিজাম আমার সবচেয়ে কাছের বন্ধু, ওর সাথে কোথাও ঘুরতে যাওয়া মানে স্বর্গসুখে থাকা। আমরা রাতের বাস’টাই ঠিক করি কক্সবাজারের উদ্দেশ্যে। শীতের রাত, প্রবল বেগে যাচ্ছে বাস, পাশে নিজাম, মুহুর্ত টা যেন অতুলনীয়। খুব উপভোগ করলাম সেদিন বাস জার্নি টা।

পরের দিন প্রায় দুপুরে আমরা হোটেল এ উঠলাম। হোটেল পেয়েছি একদম মনের মতো। হোটেলের জানালা থেকেই সমুদ্রের অপরুপ দৃশ্য দেখা যায়।

যথারীতি কিছুক্ষণ বিশ্রাম করেই আমরা সমুদ্রে নেমে পড়লাম। দীর্ঘ সময় সমুদ্রে সাতার কাটলাম,নানারকম মাছ, সামুদ্রিক জীব ধরলাম। মনে হচ্ছিলো যেন,জগতের সব সুখ সমুদ্রেই লুকিয়ে আছে। সমুদ্রের ঢেউয়ের লীলাখেলা আর ডুবন্ত সুর্য, উফ কি যে চমৎকার দৃশ্য, বলে বোঝানো সম্ভব না। সন্ধায় আমরা হোটেল এ ফিরে ফ্রেশ হয়ে হালকা কিছু নাস্তা করলাম; তারপর আবার বেড়িয়ে পরলাম বাইরে হাটার জন্য।

বিকেলে যেই সমুদ্র’কে অপরুপ সুন্দর দেখাচ্ছিল, রাতে যেন সেই সমুদ্রই ভিন্ন এক রহস্যময়ী রুপ ধারণা করেছে। চারদিকে ঘুটঘুটে অন্ধকার, সামনে বিশাল সমুদ্র, তার একপাশে বিশাল বড় বড় গাছপালা। আমরা হাটতে হাটতে সেদিক টাই গেলাম। অনেকক্ষন হাটার পর বুঝলাম অনেক ভেতরে চলে এসেছি, রাত ও অনেক হয়েছে এবার হোটেলে ফেরা দরকার। কুয়াশার কারণে চারপাশ যেন আরও অন্ধকার হয়ে আছে, মোবাইল এর আলোতেও খুব একটা দেখা যাচ্ছিল না।

আমরা ধীরে হোটেল এর দিকে যাচ্ছিলাম। হঠাৎ নিজাম কিছু একটায় পা দিয়ে মাটিতে পড়ে যায়। স্বাভাবিক হয়ে পায়ের দিকে তাকিয়ে দেখে একটা কাচের বোতল যার ভেতর থেকে অদ্ভুত নীলাভ আলো ও ধোঁয়ার মতো দেখাচ্ছিল। কৌতুহলবসত নিজাম বোতল টা হোটেল এ নিয়েই আসে।

বোতল বন্দী রহস্য

রাতের খাবার খেয়ে ঘুমানোর আগে নিজাম বোতল টা দেখতে থাকে এবং খুলবে কি না ভাবতে থাকে। বোতল টা যথেষ্ট শক্তপোক্ত ভাবে গীট দেয়া ছিলো যার কারণে খোলা প্রায় অসম্ভব ছিলো। অনেক চেষ্টা করেও নিজাম বোতল’টা খুলতে পারছিলো না দেখে এক পর্যায়ে সে বোতল টা ভেঙে ফেলে। সাথে সাথেই রুম যেন ধোয়াশায় ভরে যায় এবং একটা অদ্ভুত গোড়ানোর শব্দ শুনতে পাওয়া যায়। রুমের পরিবেশ খুবই ভারই আর গরম হতে শুরু করে।

গরমের মাত্রা এতটাই বেড়ে যায় আমি বাধ্য হয়ে  দরজা খুলে দিতেই মনে হলো কিছু একটা খুব দ্রুত আমার পাশ কাটিয়ে বেড়িয়ে গেলো আর সাথে সাথে রুম স্বাভাবিক হয়ে গেলো। রুমের ভেতরে নজর দিতেই দেখি নিজাম অচেতন অবস্থায় ফ্লোরে পড়ে আছে। তাকে তাড়াতাড়ি বিছানায় তুলে মুখে পানি দিয়ে জ্ঞান ফেরানোর চেষ্টা করি। অনেক্ক্ষণ পানি দেয়ার পর তার জ্ঞান ফিরে এবং সে স্বাভাবিক হয়। সে অজ্ঞান হলো কিভাবে জিজ্ঞেস করায় বলে, বোতল’টা খোলার পড়েই কেউ তার মাথায় খুবই জোরে আঘাত করায় সে অজ্ঞান হয়ে যায়।

নিজামের মাথার দিকে তাকিয়ে দেখি সে সত্যই বলছে; কারণ তখনও তার মাথার বাম সাইড’টা যথেষ্ট ফোলা ছিলো। তাকে কিছু ব্যথার টেবলেট খাইয়ে আমরা ঘুমাতে চলে যাই।

রাত প্রায় সাড়ে তিন টা,নিজামের চিৎকারে আমার ঘুম ভেঙে যায়। দেখলাম সে মাথায় হাত দিয়ে কান্না করছে। ওর অস্বাভাবিক আচরণ দেখে আমি ওঁকে কিছু সুরা পরে মাথায় ফুঁ দেয়ার সাথে সাথেই নিজাম আমাকে এত জোরে একটা চড় দিলো যে, আমার চোখ দিয়ে পানি বেড়িয়ে যায়। মনে হলো যেন কোনো দানব আমাকে থাপ্পড়’টা দিলো। সেদিন ওর জন্য আর ঘুম হলো না; সারারাত ওর চিৎকারে আর কান্না দেখেই কেটে গেলো।

তবে সকালেও ওর অবস্থার কোনো উন্নতি হচ্ছিল না; রাতের মতোই চিৎকার করছে। কোনো উপায় না দেখে সেদিনই আমরা একটা প্রাইভেট কার ভাড়া করে ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা দেই।

গাড়িতে পুরোটা সময় নিজাম পিছনের দিকে তাকিয়ে ছিলো আর বিরবির করে বলছিলো, ও আমাকে ছাড়বে না, আমাকে মেরে ফেলবে। বাসায় এসেই সবাইকে সবটা খুলে বলি এবং ওঁকে হাঁসপাতালে এডমিট করি। কিন্তু তাতেও কোনো লাভ হলো না। কিছুতেই যেন ওর মাথার যন্ত্রণা কমছিলো না।

তাই আর হাঁসপাতালে সময় নষ্ট না করে আমরা ওঁকে বাসায় নিয়ে আসি।

সেদিন রাতেই আন্টি স্বপ্ন দেখে কেউ তাকে বলছে, যদি ছেলের ভালো চাস তাহলে কোথায় নিয়ে যাস না; সময় হলে আমিই ওঁকে ছেড়ে দেবো। রাতের স্বপ্নের কারণে আন্টি খুব ভয় পেয়ে যায়। যাবে না, যাবে না ভেবেও একজন হুজুরের সাথে দেখা করে। হুজুর নিজামের ঘটনা শুনে তাকে মসজিদ এ নিয়ে আসতে বলে। সেদিনই মাগরিবের পর আমরা নিজাম কে নিয়ে হুজুরের কাছে যাই আর তার বর্ণনা টা ছিলো এরুপ – বোতল টায় বহু বছর ধরে এক খারাপ জিন কে বন্দী করে রাখা হয়েছিলো।

তার এই অবস্থার জন্য সে নিজাম’কেই দোষী ভাবছে এবং সে প্রতিশোধ নিতে চায়। হুজুর একটা তাবিজ দিয়ে বলেন, ফজরের আযান শুরু হওয়া মাত্রই নিজাম’কে তাবিজটা পড়িয়ে দিবেন, ইনশাআল্লাহ খারাপ জিনিস দূর হয়ে যাবে।

বাসায় আসার পরেই কেনো যেন মনে হচ্ছিল বাসার পরিবেশ স্বাভাবিক না। সেদিনের মতো গরম আর ভারই লাগছে চারপাশ টা। সাথে সাথেই কারেন্ট চলে যায় আর নিজামের চিৎকার শুনতে পাওয়া যায়। আলো জ্বালিয়ে ওকে খোঁজার চেষ্টা করছি; কিন্তু কোথাও তাকে দেখতে পেলাম না।

খেয়াল করলাম বাথরুমের দিকে, দরজা’টা ভেতর থেকে বন্ধ; হয়তো নিজাম’ই ভেতরে আছে। ডাকাডাকির পরেও ভেতর থেকে তার কোনো সাড়া পাওয়া গেলো না। হঠাৎ দেখলাম বাথরুম এর ভেতর থেকে সেই বোতলের মতো নীলাভ আলো বের হচ্ছে আর নিজামের চিৎকার শোনা যাচ্ছে। যেন প্রাণ বাঁচানোর জন্য সে নিজের সবটা দিয়ে চিৎকার করে যাচ্ছে। হঠাৎ কিছু একটা ভেঙে যাওয়ার মতো আওয়াজ হলো আর নিজামের চিৎকার থেমে গেলো।

পরক্ষণেই দরজা খুলে গেলো এবং একটা অবয়ব প্রকটভাবে সদর দরজা দিয়ে বেড়িয়ে গেলো; যেতে যেতে বললো, বলেছিলাম ওঁকে কোথাও নিয়ে যাস না।

এরপরই পরিস্থিতিও স্বাভাবিক হয়ে কারেন্ট চলে আসলো। আন্টি বাথরুমে ঢোকা মাত্রই জ্ঞান হারিয়ে ফেললেন। কারণ নিজামের প্রাণহীন দেহটা সেখানে রক্তাক্ত অবস্থায় পড়ে ছিলো। তার ঘাড়’টা কেউ এমন ভাবে ভেঙেছে যে মাথা সম্পূর্ণ উল্টো দিকে চলে গেছে। কোনো ভাবেই এ দৃশ্য চোখে দেখার মতো না। যেন মুহুর্তেই শোকের বন্যা বয়ে গেলো বাসায়। তার ঘাড়’টা আর সোজা করানো যায়নি এবং এভাবেই তাকে উল্টো মাথায় দাফন করা হয়।

নিজের সবচেয়ে কাছের বন্ধুকে হারিয়ে আমিও ডিপ্রেশন চলে গিয়েছিলাম। আজও নিজামের মৃত্যুর জন্য নিজেকেই দায়ী মনে হয়। দোয়া করি আল্লাহ যেন তাকে জান্নাতবাসী করেন।

 

{ আরো পড়ুন – বিস্ময়ভিলা

 

( বোতল বন্দী রহস্য – ছোট গল্পটি আপনাদের কেমন লাগলো তা কমেন্ট করে অবশ্যই জানাবেন।

পরবর্তী গল্প পড়ার আমন্ত্রণ জানালাম। ধন্যবাদ।)

বোতল বন্দী রহস্য

” সমাপ্ত”