কামিনীর সৌরভে – ছোট গল্প

কামিনীর সৌরভে

লেখকঃ প্রিয়ন্তি হাসান

 

বছর পাঁচেক আগের ঘটনা। আমি তখন সবে এসএসসির ধকল সামলে মুক্ত প্রজাপতির ন্যায় উড়ে বেড়াচ্ছি। আমার বেড়ে ওঠা শহরে। দাদা বাড়ি, নানা বাড়ি উভয়ই গ্রামে হওয়ায় কর্ম ব্যস্ততায় খুব কম যাওয়া হতো।

পরীক্ষা যেহেতু শেষ হাতে অফুরন্ত সময়। চলে গেলাম দাদা বাড়ি। দাদু বাড়িতে আমার ছোট ছোট কয়েকজন কাজিন ছাড়া আর তেমন কোনো সঙ্গী ছিল না।

তাই বেশিদিন থাকা হয়নি, নানা বাড়িতে চলে গিয়েছিলাম।

নানুবাড়িতে আমার সমবয়সী এক কাজিনের সাথেই এখানে ওখানে ঘুরে বেড়াতাম। নানুদের পুকুরের পাশেই ছিল আম বাগান। সেখানের সবথেকে বড় আমগাছে বাঁধা ছিল একটা দোলনা।  ওখানেই সময় কাটানো হতো বেশি।

ফুরফুরে বাতাসে মন ভরে যেত। কোনো এক অজানা কারণে দুপুর বারোটার পরে ওখানে থাকা বারণ ছিল।

এমনই একবার প্রতিদিনকার মতো আমরা বাগানে দোল খাচ্ছি। আনিকা, মানে আমার কাজিনের পেটে চাপ পড়ায় আমাকে রেখেই বাড়ির দিকে দৌড় দিল। আমি হাসতে হাসতে দোল খাচ্ছিলাম।

মিনিট খানেক যেতেই হঠাৎ নাকে এসে ধাক্কা খেল তীব্র কামিনী ফুলের গন্ধ। কেমন যেন নেশালো। কোনো এক ঘোরে চলে গেলাম। স্থির হয়ে বসে রইলাম দোলনায়। হঠাৎ আনিকার স্পর্শে সৎবিৎ ফিরে এলো।

কতক্ষন এভাবে থ হয়ে বসে ছিলাম, অনুমান নেই। দুপুর বারোটা পেরিয়ে এসেছে প্রায়। আনিকার সাথে ফিরে এলাম বাড়িতে। কামিনী ফুলের গন্ধের কথা সারাদিন আর মাথায় ছিলনা।

রাতে যখন সবাই গভীর ঘুমে, তখন আমার ঘুম ভেঙ্গে গেল। আবার নাকে এলো কামিনী ফুলের গন্ধ।

সম্মোহিত হয়ে পড়লাম আবারো। অদ্ভুত এক ইন্দ্রজাল যেন আমাকে টেনে বাইরে নিয়ে এলো। কেউ টের পেল না। এমনকি আমিও না। বাইরে বেশ আলো। চলে এলাম সেই আমবাগানের দোলনার কাছে।

ধবধবে সাদা পাঞ্জাবি পরা এক যুবক দাঁড়িয়ে আছে সেখানে। চেহারার দ্যুতিতে চারপাশ যেন ভেসে যাচ্ছে। চেয়ে রইলাম নির্নিমেষ। তার চোখের মণিতে পান্না আভা স্পষ্ট দেখলাম । কিন্তু সকালে ঘুম থেকে উঠে আমার এ ব্যাপারের কিচ্ছু মনে নেই। কেমন একটা ধোঁয়াটে অনুভূতি!

পরের রাতেও একইভাবে আমবাগানে গিয়েছি। পান্না রঙা চোখের যুবকের সাথে সময় কাটিয়েছি। কিন্তু সকালে ঘুম ভাঙলে এ ব্যাপারটা স্মৃতি থেকে পুরো গায়েব হয়ে যেতো। আবার কখন বা কীভাবে বাড়ি ফিরেছি তা এখনো আমার মনে নেই।

তৃতীয় রাতেও দরজা খুলে বাইরে বেরিয়ে এলাম। কামিনী ফুলের গন্ধে মস্তিস্ক মাতাল। পান্না রঙা চোখের সেই যুবককে দেখার তীব্র বাসনা। আজকে চাঁদের ভরা যৌবন । চারপাশ স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে।

বাগানে পৌঁছতেই দেখি পেছন ফিরে দাঁড়িয়ে থাকা এক নারী মূর্তি। অবাক হলাম। সেই যুবক কোথায়? এগিয়ে গেলাম। হঠাৎ নারী মূর্তিটা আমার দিকে তাকালো। আঁতকে উঠলাম। কি বিভৎস চেহারা! গাঁয়ে কাঁপন ধরেছে। কী করবো বা করা উচিৎ বুঝতে পারছি না। পেছন ঘুরে দৌড় দেব ভাবছি এমন সময় গলা চেপে ধরলো ঐ বিভৎস চেহারার নারী মূর্তি।

বিচ্ছিরি একটা গন্ধ বেরোচ্ছে তার শরীর থেকে। চোখগুলো গর্তে নেই। অতিরিক্ত বড় বড় নোংরা দাঁত। নিঃশ্বাস প্রায় বন্ধ হয়ে আসছে। হাত দিয়ে বার কয়েক আঘাত করেও কোনো কাজ হয়নি।

বরং গা শিউরে ওঠা অট্টহাসিতে বাতাস আরও ভারী হয়েছে। নারী মূর্তিটা তার অন্য হাতের নখ দিয়ে কেটে নিলো আমার কোমর সমান চুল। হাল ছেড়ে দিলাম। চোখ উল্টে এসেছে প্রায়।

হয়তো একটু পরেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়বো। ঠিক তখনই বিচ্ছিরি গল্প ছাপিয়ে চারপাশ ভরে গেলো কামিনী ফুলের মোহনীয় গন্ধে। বেঁচে থাকার তাগিদ পেলাম, ভরসা পেলাম। তারপর আর কিছু মনে নেই।

সকালে ঘুম ভাঙলে এসবের কিছুই মনে করতে পারলাম না। সকলের কাছে শুনলাম ভোরে নামাজ পড়তে উঠে নানা ভাই আমাকে বাড়ির সামনের উঠানে অজ্ঞান অবস্থায় পেয়েছে।

আমার কোমর সমান লম্বা চুলগুলো নাকি কেউ বিচ্ছিরি ভাবে কাঁধের কাছে থেকে কেটে নিয়েছে। সবাই বুঝতে পারলো কি ঘটেছে আমার সাথে। শুধু আমিই বুঝতে পারলাম না কীভাবে বা কেন আমি বাইরে গিয়েছিলাম।

কিন্তু কেমন একটা অস্বস্তি মনের এক কোণে গেঁথে ছিল। সেই তিন রাতের কোনো ঘটনাই বহু দিন আমার মনে ছিল না। ধীরে ধীরে মনে পড়েছে সব।‌

ওহ হ্যাঁ, অজ্ঞান অবস্থায় পাওয়া যাওয়ার পর পরই নানা ভাই আমাকে এক হুজুরের কাছে নিয়ে শরীর বন্ধ করে দিয়েছিলেন। ঐ ঘটনার পর এই পাঁচ বছরে আর সেই কামিনী ফুলের সুবাস পাই নি। কিংবা পান্না রঙা চোখের সেই যুবক।

কিন্তু এই ঘটনা লিখতে লিখতে হঠাৎ আমার রুমের চারপাশ কামিনী ফুলের গন্ধে সুরভিত হয়ে উঠছে!

 

 

{ আরো পড়ুন – অপঘাত

 

( কামিনীর সৌরভে – ছোট গল্পটি আপনাদের কেমন লাগলো তা কমেন্ট করে অবশ্যই জানাবেন।

পরবর্তী গল্প পড়ার আমন্ত্রণ জানালাম। ধন্যবাদ।)

কামিনীর সৌরভে

” সমাপ্ত”