রাদীন
লেখকঃ তানভীর আহমেদ তূর্য
বিকেল থেকে ঝড়বৃষ্টি হচ্ছে বাইরে। কালবৈশাখী ঝড়। মনে হচ্ছে যেনো এক্ষুনি উঠানের বড় আম গাছটা ভেঙে ঘরের ঠিক উপর এসে পড়বে। ঘরের চালও উড়িয়ে নিতে পারে। এসব ঝড়ের বিশ্বাস নেই।
ক’দিন আগেই বাড়িসুদ্ধ নতুন টিন লাগানো হয়েছে, এখন যদি চাল উড়ে যায়, হবে টা কি – ভাবছেন জাহানারা বেগম। জাহানারা বেগমের বাড়িতে আছে কেবল তার ৮ বছর বয়সী নাতি রাদিন এবং রাদিনের বাবা ইশতিয়াক হোসাইন। ইশতিয়াক হোসাইন অবশ্য বাড়ি থাকেন না, তিনি থাকেন ঢাকায়।
সেখানের এক স্কুলের ইংরেজি শিক্ষক তিনি। বিবাহিত ছিলেন, তবে বছরখানেক আগে দুজনের বিচ্ছেদ হয়েছে। তারপর থেকে রাদিন দাদীর সাথেই থাকে। দাদীকে খুব ভালোবাসে ছেলেটা, দাদীও।
বাইরে থেকে এশার আযান শোনা যাচ্ছে। জাহানারা বেগম ঘরের মেঝেতে হ্যারিকেন জ্বালিয়ে বসে বসে মাছ কাটছেন, রাদিন দাদীর পাশে বসে অঙ্ক করছে। রাদিন দাদীর এই হঠাৎ এই উৎফুল্লতার কারণ জানতে চাইলে জাহানারা বেগম বলেন, তোমার আব্বু আসছেন।
কথাটা শুনে রাদিন’ও সমান খুশি হয়। খুশি মনে বার বার জিজ্ঞেস করছে, আর কতক্ষণ পর আসবে দাদু ? আর কতক্ষণ ? আচ্ছা, যদি আমি ঘুমিয়ে যাই আমাকে ডেকে দিও ?
আচ্ছা।
ডেকে দিবোনে।
এখন মন দিয়ে পড়তে থাকো দাদা।
কিছুক্ষণ আগে ছেলে মোবাইল-কলে জানায় সে ট্রেনে আছে; বাড়ি ফিরছে। ছেলের বাড়ি ফেরার খবরেই জাহানারা বেগমের এই উৎফুল্লতা।
আর তাই তিনি এই অবেলায় রান্নার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। রাঁধবেন মাশকলাই এর ডাল, বেগুন দিয়ে সদ্য কাটা মাছ এর তরকারি ও গরুর খাঁটি দুধ। ছেলে খুব পছন্দ করে এগুলো।
জাহানারা বেগম ঘর থেকে প্রয়োজনীয় উপকরণ নিয়ে রান্নাঘরের দিকে যাচ্ছেন। গ্রামের দিকে যেমনটা হয়, রান্নাঘর মূল ঘরের উঠানে কিংবা কিছুটা দূরে হয়ে থাকে, তাদেরও তাই, উঠানে একটা ছোট চালের নিচে রান্নার চুলা, চারপাশে খোলা।
রান্না করার জায়গাটার পাশে দু-তিনটা পেঁপে গাছ, একটা পেয়ারা গাছ ও কিছুটা সামনে থেকে ফলমূল ও অন্যান্য গাছ, তারপর বাড়ির বাউন্ডারির দরজা।
দাদু, আমি তোমার কাছে বসে পড়ি ?
এখানে কাঁদা অনেক। যাও, তুমি ঘরে যেয়ে পড়ো দাদা…
না দাদু, আমি তোমার এখানেই পড়বো।
নাতীর কথা আর ফেলতে পারলেন না জাহানারা বেগম। পড়ুক বসে এখানে। তিনি একমনে রাঁধতে থাকলেন। সবে ডাল নামিয়ে মাছ চড়িয়েছেন, অমনি আবার বৃষ্টির ফোঁটা পড়তে শুরু হলো।
জাহানারা বেগম নাতিকে বললেন, তুমি ঘরে চলে যাও, আমি রান্না নিয়েই আসতেসি। এখানে থাকলে বৃষ্টির ছিটা লাগবে শরীরে, জ্বর আসবে। নাতীর উত্তর না পেয়ে পেছনে ফেরেন জাহানারা বেগম।
তবে তিনি অবাক হন। নাতী নেই। ভাবেন – ছেলেটা কখন গেলো, খেয়ালই করলাম নাহ! যাকগে, ভালো হয়েছে গেছে, নয়তো ভিজা কাঁক হয়ে যেতো। রান্নাঘরটা পরেরবার বড় করা দরকার। ছেলেকে বলা লাগবে। কাজে মন দেন জাহানারা বেগম। তবে তার কেনো যেনো মনে হতে লাগে কেউ তার দিকে তাকিয়ে দেখছে একদৃষ্টে।
কেমন অদ্ভুত অনুভূতি।
অস্বস্তিকর।
বারবার তিনি বাড়ির বাউন্ডারির দরজার দিকে তাকচ্ছেন। মনে হচ্ছে বাউন্ডারির ওপাশ থেকেই দৃষ্টিতীর’টা আসছে। কি অদ্ভুত, ওখানে আবার এতো রাতে কে থাকবে এই জনশূন্য গ্রামে!
মাছ রান্না হয়ে আসলে ভাত বসিয়ে দেন জাহানারা বেগম। ছেলেকে দুপুরের ভাত দেওয়া যাবেনা। বেচারা এতোদিন পর বাড়ি আসবে, একটু যত্নাদি না করলে হয়! শহরে থাকতে থাকতে দেখা যাবে আবারো বকের মতো শরীর নিয়ে ফিরবে। প্রতিবার এমন করে ছেলেটা।
ওখানে নাকি মেসের কোন খালা রান্না করে দিয়ে যায়, একটুও স্বাদ লাগেনা। খাবার স্বাদ না হলে শরীর হয় !
একামনে ভেবে যাচ্ছেন তিনি। অমনি মনে হলো কেউ যেনো তার সেই বাউন্ডারির দরজার সামনে শব্দ করলো। তিনি কান পেতে শুনতে চেষ্টা করলেন। কেউ একজন মাত্রই বললো দরজা খুলতে।
মহিলা কন্ঠ, খুবই পরিচিত, এ গ্রামেরই, তবে মনে করা যাচ্ছেনা ঠিক কার কন্ঠ ওটা। অগত্যা এগিয়ে যেয়ে দরজা খুলে দিলেন জাহানারা বেগম। তবে তিনি বেশ বিষ্মিত হন এটা দেখে যে, আশেপাশে যতদূর চোখ যায়- কেউ নেই।
ভাবেন, মনের ভুল। বয়স হচ্ছে তো! বয়স হলে নাকি মানুষ যা তা কল্পনা করতে শুরু করে। সে যাগকে। জাহানারা বেগম এসে চুলা থেকে ভাত নামিয়ে দুধ বসালেন। ভাতের মার সংরক্ষন হচ্ছে একটা বাসনে।
এগুলো ছাগলের বাচ্চাদের দিবেন জাহানারা বেগম। কিছুদিন আগেই ওপাড়া থেকে একজোড়া ছাগলের বাচ্চা কিনে এনেছেন তিনি। লম্বা লম্বা কানওয়ালা ছাগলজোড়া, দেখতে বেশ সুন্দর, দুটোই সোনালী-কালো রঙের। দুধ হয়ে গেলে সেসব সহ ঘরে ফিরেন জাহানারা বেগম।
রাদীন বিছানায় বইখাতার উপরেই ঘুমিয়ে গেছে। মা হারা কি নিষ্পাপ ছেলেটা দেখো! কেমন জাতের মেয়েমানুষ অমন ফেরেশতার মতো ছেলেটাকে ফেলে আরেক বেটার সাথে চলে যেতে পারে!
ছিঃ ঘৃণার পাশাপাশি হৃদয়টা যেনো অজানা কষ্টে ভার হয়ে উঠে জাহানারা বেগমের। তিনি রান্না করা পাতিলগুলো রেখে এসে নাতীর বইপত্র টেবিলে রেখে নিজেও শুয়ে পড়েন নাতীর পাশে।
রাত খুব হয়েছে। ছেলে কখন ফিরবে কে জানে! একটা কল করা উচিৎ; কিন্তু তিনি কল করতে পারেন না, এক জায়গায় কল দিলে আরেক জায়গায় চলে যায়। শুধু কল ধরতে পারেন।
অগত্যা চোখ বুজে ঘুমের দুনিয়ায় হারিয়ে গেলেন তিনি।
সময় ঠিক ক’টা, জানেন না জাহানারা বেগম। তবে মনে হয়না ফজরের আযান দিয়েছে। বাহিরে ঝড় বইছে খুব। সে ঝড়ের মধ্যেই ছেলের ডাক শুনে ঘুম ভেঙেছে তার।
ছেলে ফিরেছে কতক্ষণ আগে জানা নেই, তখনো দাঁড়িয়ে আছে দরজার বাইরে। দ্রুত উঠে তিনি দরজা খুলে দিলে ইশতিয়াক হোসাইন ঘরে ঢুকে যান। জাহানারা বেগম টেবিলে খাবার দিতে দিতে ছেলেকে হাত মুখ ধুয়ে আসতে বললে ছেলে জানায়, সে বাইরের কল থেকে ধুয়ে ফিরেছে। সোজা খেতে বসে যায় সে।
হ্যাঁ বাবা ? ওখানে কেমন আছিস তুই ? কোন সমস্যা হচ্ছে না তো ?
ভালো। ভালো আছি আমি।
এতোদিন পর বাড়ির কথা মনে পড়ছে তোর ? গতমাসে আসিস নি কেন ?
ব্যাস্ততা বেশি ছিল মা। মাথাটা খুব ব্যাথা করছে আজ।
অহো, সেই কখন থেকে জার্নি করছিস, ব্যাথা তো করবেই। দ্রুত খাবার খেয়ে ঘুমাতে যা।
ইশতিয়াক হোসাইন খাবার খেতে খেতে কেমন অদ্ভুত দৃষ্টিতে খাটে ছেলের দিকে তাকিয়ে দেখছেন।
তুই আসবি জানার পর থেকে খালি জিজ্ঞেস করছিলো আর কতক্ষন পর আসবি, ওকে ডেকে দিতে বলেছিল।
ডাকো তবে।
থাক, ঘুমাক আজ; সকালে দেখিস। দিনে তো ঘুমায়ই না, সারাদিন দৌড়াদৌড়ি করে জানিস! খাবারও খেতে চায়না, জোর করে খাওয়াই যতটুকু। তুই একটু বুঝিয়ে বলে যাস কেমন, তোর কথা তো মানে।
সমস্যা নেই। ডাকো।
কি বিপদ! আচ্ছা ডাকছি…
নাতীকে ডেকে বাবা আসছে বলতেই রাদীন এক লাফে উঠে যায়। উঠেই সোজা বাবার কোলে এসে বসে। বাবা ইশতিয়াক হোসাইনও ছেলের শরীরে হাত বুলিয়ে দিতে থাকে। ততক্ষণে খাবার খেয়ে হাত ধুয়ে নিয়েছেন তিনি।
ও কি আজকে তোর সাথে থাকবে ?
থাক। আমার সাথেই থাক ও।
আচ্ছা। আমি তোর ঘর পরিষ্কার করে গুছিয়ে রেখেছি। যা তবে ওকে নিয়ে।
আচ্ছা।
ইশতিয়াক হোসাইন ছেলেকে নিয়ে পাশেই – নিজের রুমে চলে গেলেন। জাহানারা বেগমও নিজের বিছানায় এসে শুয়ে পড়লেন।
সকালে জাহানারা বেগমের ঘুম ভাঙে বাড়ির গেটে কারো শব্দ শুনে। তখন আলো ফুটে গেলেও পুরপুরি সকাল হয়নি। হয়তো তখনও মসজিদে মুসল্লিরা ফজরের নামায শেষ করেননি।
বৃষ্টির মৃদু ফোঁটায় ভিজে ভিজে যেয়ে বাড়ির গেটের দরজা খুলে দিলে তিনি দেখতে পান কাকভেজা হয়ে ছেলে ইশতিয়াক দাঁড়িয়ে আছে ব্যাগ হাতে। ছেলেকে দেখে তিনি থমকে যান।
আপন মনে ভাবনার দুনিয়ায় হারিয়ে যেনো কিছু একটা ভাবতে থাকেন তিনি। ছেলের ডাকে হুশ ফিরলে ছেলে ব্যাগ হাতে দিয়ে কলের দিকে আগাতে থাকে; মা কল চেপে দিচ্ছেন আর তিনি হাত-পা ধুয়ে পরিষ্কার হয়ে নিচ্ছেন পুরোপুরি।
মা বলতে শুরু করলেন, কাল রাতে স্বপ্নে দেখেছি যেনো তুই আসলি। এসে আমার সাথে কথা বলে খাবার খেয়ে তোর ঘরে ঘুমাতে গেলি রাদীনকে নিয়ে। আমি এতোক্ষন মনে হলো সেই ঘোরেই ছিলাম। ইশতিয়াক হোসাইন হাসতে থাকেন।
ছেলেকে না দেখে আছো যে, সেজন্যই স্বপ্নে আগেভাগে স্বাগত জানিয়ে নিলা। চলো, ঘরে চলো।
চল। ভিজেই তো গেলি!
ঘরে ঢুকে জাহানারা বেগম আরো বেশি হতভম্ব হয়ে যান। তার ঘরে রাদীন নেই। এক মূহুর্ত সময় নিয়ে ভেবে নিলেন, যদি কাল রাতের ব্যাপারটা স্বপ্নই হয়ে থাকে, তো রাদীন কোথায় গেলো! ছেলে ইশতিয়াক সহ দ্রুত তিনি ছেলের ঘরের দিকে পা বাড়ান। তরিঘরি করে ঘরে ঢুকে কিছু একটা দেখে জাহানারা বেগম জ্ঞান হারান। ছেলে ইশতিয়াক কিছু বুঝে উঠতে পারলেন না।
শুধু দেখলেন তার বিছানার উপর রক্তের ছোপ ছোপ কালচে দাগ…
( রাদীন – ছোট গল্পটি আপনাদের কেমন লাগলো তা কমেন্ট করে অবশ্যই জানাবেন।
পরবর্তী গল্প পড়ার আমন্ত্রণ জানালাম। ধন্যবাদ।)
Leave a Reply