ক্ষণি – লোমহর্ষক ভূতের গল্প

পর্ব ০১

ট্রলার থেকে লাফিয়ে নদীর পাড়ে উঠতে গিয়ে পিচ্ছিল খেয়ে যখন চিৎপটাং হয়ে পড়ে গেলাম, গ্রামের বিচ্ছু ছেলেপেলে বিটকেল কণ্ঠে হেসে দিয়েছিল। ট্রলারের মাঝি আমার ডাক্তারি ব্যাগটা তাড়াতাড়ি নদীর পানি থেকে উঠাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল, আর আমাকে এই গ্রামে নিজের ছেলেকে দেখাতে নিয়ে আসা ইউপি মেম্বার কাদের সাহেব আমাকে শিগগিরই ধরে উঠাতে উঠাতে ছেলেগুলোকে ধমকে উঠে বলল, ” মাগরিবের ওয়াক্তে তোরা নদীর পারে কি করছ? ক্ষণি ধরলে হাসি কোত্থেকে বাইর হইব দেখব নে।”

কথাটার একটা আলাদা জাদু ছিল। এক মুহুর্তে ছেলেগুলোর হাসি থেমে গেল। আর মুহুর্তে জায়গাটা ফাঁকা হয়ে গেল। সেই মুহুর্তেই মাগরিবের আজানটা দিল।

কাদের সাহেব বলল, ” স্যার, জামাকাপড় তো নোংরা হয়ে গেল। আপনার তো আবার ঠান্ডাও লাগছে। ট্রলারে কতগুলো কাশি দিলেন। ছেলের চিকিৎসা করাতে এনে তো আপনাকে বিপদে ফেলে দিলাম।”

আমি বললাম, ” আমারই দোষ। এছাড়া আমার এই গ্রামের ভেতর দিয়েই রাত দশটার ভেতর রহমতপুর বাসস্ট্যান্ডে যেতে হবে। আপনার ছেলেকে এই ফাঁকে দেখে যাওয়াটা আমার জন্য ঝামেলার কিছু ছিল না। আছাড় খাওয়াটা আমার পণ্ডিতীর জন্যই হয়েছে।”

কাদের বলল, ” না স্যার, ঢাকা যাবেন এতরাতের গাড়িতে, শীতও পড়েছে, আপনার আবার কাশিও হয়েছে। ময়লা কাপড়ে আপনাকে রাখা যাবে না। শিগগিরই বাড়িতে আসেন। গরম পানির ব্যবস্থা করি। আর জামাকাপড়গুলো ধুয়ে ইস্ত্রি দিয়ে শুকিয়ে দেব নে, যাতে বাসে সময়মত উঠতে পারেন।”

কিছু কিছু কৃতজ্ঞতা মুখে প্রকাশ করলে ছোট করা হয় উপকারীকে, তাই আমি চুপ করে রইলাম। সিদ্ধান্ত নিলাম, আজকে তো নেহাত শর্টকাটে বাস ধরতে নদী পাড় হয়ে এই গ্রামে এসেছি, আর এক ফাঁকে কাদেরের প্রতিবন্ধী ছেলেকে দেখে দিচ্ছি। এরপর থেকে আমাকে যখনই এই লোক ডাকবে, নিজের প্রয়োজন না থাকলেও এর ছেলেকে দেখে দেব।

এতকিছু ভাবতে ভাবতে কাদেরের সাথে তার বাড়ির দিকে যেতে গিয়ে দেখলাম, লোকটা আমাকে দ্রুত যেতে তাড়া দিচ্ছে। ভাবলাম, নোংরা কাপড় গায়ে বলে ঠান্ডা আরো জাঁকিয়ে বসবে আমার উপর, সেজন্য উনি তাড়া দিচ্ছে। আমি বললাম, ” আমাকে নিয়ে ভেবেন না। আমি আস্তে আস্তেই হাটি। অন্ধকারে গ্রাম্য পথে জোরে হাটতে গিয়ে পা মচকালে সমস্যা।”

তখন হ্ঠাৎ ট্রলারের মাঝি আমার পাশ থেকে বলে উঠল, ” স্যার, সন্ধ্যার মধ্যে নদীর কাছ দিয়া সরা লাগব।”

ওই লোকের হাতে এখনো আমার ডাক্তারি ব্যাগ। সাথে আমার ঢাকায় যাওয়ার লাগেজ। সেও মেম্বারের বাড়ির দিকে চলেছে আমাকে এগিয়ে দিতে। কথা ছিল মেম্বারের বাড়িতে তার ছেলেকে দেখার পর সে-ই আবার আমাকে রাতে বাসস্ট্যান্ডে এগিয়ে দেবে। এখন যেহেতু গোসল করে আমার কাপড় শুকাতে হবে, প্লানটার কি পরিবর্তন হয়, তা জানা নেই।

আমি তাও বললাম, “কেন? আমার কাছে টর্চ আছে। সমস্যা হবে না অন্ধকারে।”

মাঝি বলে উঠল, “না স্যার, অন্ধকার নামলেই নদীর পাড়ে ক্ষণি আসে।”

আমি বললাম, “কিসের খনি?”

মাঝি বলল, ” ক্ষণি স্যার, ক্ষণি পেত্নী…”

কাদের চেঁচিয়ে উঠল হঠাৎ , “আহ বজলু, স্যারকে ভয় দেখাইস না। পা চালা তাড়াতাড়ি।  আইজ আবার অমাবস্যা। ”

আমি বললাম, ” ইন্টারেস্টিং তো। বলেন তো আরো। জিনিসটা কি?”

কাদের মেম্বার শাসনের গলায় বলে উঠল, “স্যার, আপনার কিন্তু গোসল করা লাগবে। দশটায় বাস, এখন সাড়ে পাঁচটা বাজে। কাপড় শুকাতে হবে। এখন পা চালান। ওসব কথা পরে।”

আমি চুপ করে এগোতে লাগলাম।  হঠাৎ পেছনে নদীর দিক থেকে একটা নারীকণ্ঠের ডাক শোনা গেল, “কারা? কারা যায়? একটু শুইনা যা তো বেটারা। দেখি তোগো গায়ে কত রক্ত…”

কণ্ঠ শুনে কণ্ঠের মালকিন কি বলল, তা না শুনেও বোঝা গিয়েছিল, এই কণ্ঠের মালকিন এই পৃথিবীর কিছু না। ভয়ে আমি স্তব্ধ হয়ে গেলাম। কাদের আমার হাত ধরে একটা দৌড় দিল। বজলু মাঝি দৌড়ে আগে চলে গেছে। কাদের বিড়বিড় করে বলল, “জানতাম, আইজ অমাবস্যা… ”

পিছনে এক নাগাড়ে নারী কণ্ঠের অট্টহাসি শোনা যেতে লাগল।

আমার জ্বরটা ঠিক কি কারণে আসল বুঝতে পারলাম না, নদীর পাড়ের কাঁদায় পড়ে অলরেডি লাগা ঠান্ডাটা আরো বেড়ে যাওয়ায়, নাকি একটু আগে পিছনের সেই অদেখা অপার্থিব অট্টহাসি শুনে। তবে শেষের বিষয়টা যে কল্পনা না, তা আমার চেয়ে ভাল কেউ জানে না, তিনজন লোক একই জিনিস শুনে ভয়ে এই সন্ধ্যায় এক ছুটে পালাতে পারে না।

মেম্বারের ঘরের ভেতর একটা চেয়ারে বসে যখন আমি হাফাচ্ছি, মেম্বার ঘরে ঢুকেই তার বিছানায় চিৎ হয়ে শুয়ে পড়েছে, আর বজলু মেঝেতে বসা। মেম্বারের প্রতিবন্ধী ছেলেটার উচ্চকণ্ঠের অসংলগ্ন কথা শোনা যেতে লাগল ভেতরের ঘর থেকে। একটা নারীকণ্ঠ একটা কুপিবাতি হাতে এগিয়ে আসতে আসতে বলল, ” মন্টুর বাবা আসছেন নাকি? কারেন্ট সেই দুপুরে গেছে আর আসে নাই। ডাক্তার সাথে করে আনছেন?”

মেম্বার উত্তর না দিয়ে বিছানায় শুয়ে চোখ বন্ধ করে রইল।

বজলু উত্তর দিল, ” চাচী, ক্ষণিরে দেখছি আমরা একটু আগে। আমাদের ধাওয়া দিছিল।”

জোরে জোরে দোয়া পড়ে ঘরে কুপিবাতি হাতে মেম্বারের বউ ঢুকল। বলল, ” কস কি বজলু?  ওহ, আইজ তো আবার অমাবস্যা।  পোলাডার জ্বর বাইড়া গেছে, নয়ত তোর চাচারে ডাক্তারের কাছে আইজ পাঠাইতাম না।”

মেম্বারকে শুয়ে থাকতে দেখে মহিলা বলে উঠল, ” ও মন্টুর বাপ, ডরাইছ বেশি?”

আরো এক মুহুর্ত চুপ করে থেকে মেম্বার উঠে বসল। দুর্বলকন্ঠে বলল, ” সালমা, স্যার উষ্টা খেয়ে পইড়া গায়ে ময়লা লাগাইছে। গরম পানি করো গোসলের জন্য। কাপড় ধুয়ে দাও। তারপর ভেজা কাপড় শুকানোর ব্যবস্থা কর। কারেন্ট নাই, ইস্ত্রি চলবে না। গরম হাড়ি দিয়ে শুকাবা। স্যারের রাত দশটায় বাস। এরমধ্যে পরার জন্য স্যারকে আমার নতুন গেঞ্জি আর লুঙ্গি দাও। তারপর কিছু খাইতে দাও। সব শেষে মন্টুরে স্যার দেখে দিবে।”

আমি বললাম, ” গেঞ্জি লুঙ্গি লাগবে না। আমার লাগেজে আমার কাপড় আছে।”

বজলু একহাত জিভ বের করে তখনই খবরটা দিল, ” স্যার, ডরের চোটে আপনার লাগেজ পথে ফালাইয়া দৌড়াইছিলাম।”

একটা নিরবতা বিরাজ করল পুরো ঘরটার মধ্যে। আমি রাগ হব না কষ্ট পাব সিদ্ধান্ত নিতে পারলাম না। পাছে হারিয়ে না যায় , তাই লাগেজের বাইরের পকেটে বাসের টিকেট রেখেছিলাম।

যা একটু আগে শুনে এসেছি, এরপরে এই তথ্যটা ঘরের কাউকে দিলেও কারো হাবভাবের পরিবর্তন হল না। আমি সেটা আশাও করি না।

পর্ব ২

কাদের মেম্বারের বউ গরম পানি করে দিল। আমি ওদের বাথরুমে জামাকাপড় ছেড়ে ঢুকে গেলাম। নোংরা জামাকাপড়  নিয়ে সালমা চাচী উঠানের পাশে গেল। একবার ভাবলাম, মানা করি। যার কণ্ঠ শুনেছিলাম নদীর পাড়ে, সে পিছু নিয়ে বাড়ির উঠোনে আসলে সমস্যা। কিন্তু আমার চেয়ে এদেরই ওর ব্যাপারে বেশি জানার কথা। তাই বাধা দিলাম না।

গোসল করতে করতে ভাবলাম, আজকের দিনের কথা। আব্বু আম্মু দুইজনই অসুস্থ। ছুটি নিয়ে তাই আজকে ঢাকায় যাচ্ছি। আমার হাতযশ ভাল দেখে, কাদের মেম্বার ইচ্ছা করেই হাসপাতালে গিয়ে আমার সাথে খাতির করেছিল বহু আগে। সে প্রায়ই বলত, তার একটা প্রতিবন্ধী ছেলে আছে। নাম মন্টু। ছোটবেলা থেকে সে হাটতে পারে না, কথাও বলতে পারে না, কিন্তু শব্দ করতে পারে। তার সমস্যা হল, কয়েকদিন পরপর তার জ্বর হয়। বহু ডাক্তার দেখালেও এই সমস্যা ভাল হয় নি, আমার হাতযশ দেখে সে তার ছেলেকে একবার আমাকে দেখাতে চায়। কিন্তু প্রতিবন্ধী ছেলেকে হাসপাতালে নিয়ে আসা কঠিন, আমি যেন তার বাসায় এসে ছেলেটাকে দেখে যাই। বিনিময়ে এই গ্রামের হাসপাতালে যতদিন থাকব, আমার নিরাপত্তার দায়িত্ব সে নেবে।

আমি কারো বাসায় যাই না। হাসপাতালেই ছেলেটাকে আনতে বলতাম সবসময়।  সেও অনুরোধ করেই যেত। আজকে রহমতপুর স্টান্ডে বাসের টিকেট কাটাতে পাঠিয়েছিলাম আমার এক পিয়নকে। তার কাছ থেকে কাদের শুনেছে আমি ঢাকা যাব। তার গ্রাম থেকে বাসস্ট্যান্ড কাছে। শুধু নদীটা পাড় হতে হয়। আজকে তাই নাছোড়বান্দা হয়েই আমাকে নিয়ে এসেছে সে ছেলেকে দেখাতে। চক্ষুলজ্জায় আজকে নাও বলতে পারি নি, এছাড়া আব্বু আম্মুর অসুখ, যদি একটা প্রতিবন্ধী ছেলের চিকিৎসা করলে সে ভাল হয়, তার দোয়াও এই মুহুর্তে আমার প্রয়োজন। এরপর তো বিকেলে দেখতে আসব শুনে বজলুকে নিয়ে কাদের মেম্বার নিজে আমাকে হাসপাতাল কোয়ার্টার থেকে নিয়ে এসেছে। আর এখানে এসেই একটা উদ্ভট বিপদে পড়লাম।

গোসল শেষ করে মেম্বারের গেঞ্জি আর লুঙ্গি পরে ঘরে ঢুকলাম। ঢুকতে গিয়ে অন্ধকারে হোঁচট খেলাম একটা। পায়ের কাছে তাকিয়ে দেখি মাটি উঠে গিয়েছে এক খাবলা। মাটির কাছে কালো কালো কি যেন একটা। আমি ভাল করে দেখার আগেই পেছনে বাথরুমের পাশে কি যেন একটা শব্দ পেলাম। চট করে পিছনে তাকালাম। কাউকে দেখলাম না। তারপর আবার সেই মাটির দিকে তাকালাম। কাল কাল জিনিসটা আর দেখলাম না। ভয় লাগল হঠাৎ একটু আগের কাহিনী মনে করে। শিগগিরই ঘরে ঢুকলাম।

গিয়ে  দেখি মেম্বারের বউ একটা হাড়ি গরম করে ইস্ত্রির মত ব্যবহার করে আমার ভেজা ধোয়া কাপড় শুকাতে শুরু করেছে। আমি মেম্বারের কাছে গিয়ে বললাম, ” কাদের সাহেব, আমার লাগেজের ভেতরে আমার টিকেট আর টাকা পয়সা। ওটা উদ্ধার না হলে তো সমস্যা।”

কাদের বলল, ” আমি ফোন দিয়েছি কিছু লোককে স্যার। আমার লাঠিয়াল বাহিনী। পাঁচ ছয়জন লাঠিয়াল একত্রে গিয়ে নিয়ে আসবে লাগেজ। চিন্তা করেন না। আপনি আমার ছেলেটাকে এখন দেখবেন?”

আমি বললাম, ” চলেন।”

কাদের আমাকে নিয়ে গেল তার ছেলে মন্টুর কাছে। ছেলেটার মুখ আর পা দেখেই বুঝলাম, ওর সেরিব্রাল পালসি। বললাম, ” ছোটবেলায় মাথায় আঘাত লাগছিল, নাকি?”

কাদের বলল, ” হ্যা। মায়ের পেট থেকে বের করার পর দাইয়ের হাত থেকে মাটিতে পড়ে গেছিল। মাথায় আঘাত লাগছিল তখন। ঝড়ের রাত ছিল, হাসপাতালে প্রসব করাতে পারি নাই। কপাল!”

সেরিব্রাল পালসি এর প্রতিবন্ধী বাচ্চার ঘন ঘন জ্বর আসে। তারমানে লক্ষণ খারাপ। এই জ্বর ইনফেকশনের কারণে আসে না। ছোটবেলায় মস্তিষ্কে যে আঘাত লেগেছিল, বড় হবার পর সেই আঘাত মস্তিষ্কে ছড়িয়ে যাচ্ছে আস্তে আস্তে। সব বাচ্চার এমন হয় না, কিন্তু যাদের হয়, মৃত্যু নিশ্চিত।  ঘন ঘন জ্বর আসার লক্ষণ শুরু হবার এক দুইমাসের মধ্যে মারা যায় সে।

এখন এই কথা কাদের মেম্বারকে বলার সময় এখন না। বললামও না। আমার ডাক্তারি ব্যাগটা বজলু ফেলে নিই। কিছু পরীক্ষা নিরীক্ষা করলাম মন্টুকে। তারপর ওষুধ লিখে দিলাম। কাদের মেম্বারকে বললাম, ” একমাস পর আবার দেখতে হবে ওকে।”

কাদের মেম্বার একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। ছেলেটা তন্দ্রাচ্ছন্ন, কিন্তু একটু পর পর অসংলগ্নভাবে চিৎকার করে উঠছে। আমি কাদেরের সাথে খাবার ঘরে গিয়ে বসলাম। আমার কাপড় শুকানো হয়ে গেছে ওর বউয়ের। খাবার বাড়ছে। মেম্বার বলল, ” সাড়ে সাতটা বাজে স্যার। খেয়ে নেন। লাগেজ খুজতে আবার সময় লাগবে, নইলে আরো পরে দিতাম।”

আমি বসলাম খেতে। বজলুও বসল আমাদের সাথে। খেতে খেতেই কাদের আনমনে বলল, ” আমার ছেলে আর বাঁচবে না, তাই না স্যার?”

আমি থতমত খেয়ে গেলাম। কাদেরের বউ সালমার হাত কাঁপতে লাগল। কিন্তু কাঁপা কাঁপা হাতে সে খাবার বেড়ে দিতে লাগল। আমি চুপ করে রইলাম।

কাদের বলল, ” আপনি যেভাবে আমার ছেলেকে পরীক্ষা করলেন,এরকম কেবল এক ডাক্তারই পরীক্ষা করেছিল। ভারতে নিয়ে গিয়েছিলাম। চেন্নাইয়ের এক বুড়ো প্রফেসর। সব ডাক্তার বিভিন্ন ওষুধ দিয়ে বলেছিল, সমস্যা নাই, সেরে যাবে। কিন্তু আপনার মত পরীক্ষা করে সেই বুড়ো ডাক্তার বলেছিল, ও আর এক দুইমাসের বেশি বাঁচবে না।”

আমি চুপ করে রইলাম। সালমা আমাকে চুপ থাকতে দেখে ফোঁপাতে লাগল। কাদের আবার একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল।

খাওয়া শেষ হলে আমরা কাদেরের লাঠিয়ালদের জন্য অপেক্ষা করতে লাগলাম। আমার লাগেজ উদ্ধার করে ওরাই আমাকে এগিয়ে দেবে বাসস্ট্যান্ড পর্যন্ত।

নিরবতা খুবই খারাপ লাগছিল। আমি কাদেরকে বলে উঠলাম, ” কাদের সাহেব, এই ক্ষণি জিনিসটা কি? এতদিন ধরে এই উপজেলায় আছি। এমন ভয়ংকর কিছুর নাম তো শুনি নি। যদিও নদী পাড় হয়ে এই প্রথম আসলাম এখানে। নদী পাড় হবার ভয়ে এর আগে সবসময় ঘুরপথে বাসস্ট্যান্ডে যেতাম। আমি সাতার জানি না বলে।”

কাদেরও যেন পরিস্থিতি হালকা করার সুযোগ পেয়ে নড়েচড়ে বসল। কিন্তু কথা বলে উঠল বজলু, ” স্যার, ক্ষণিপেত্নী একটা পিশাচ। এই গ্রামে ওই নদীর পাড়ে ঘুরে বেড়ায় রাতের অন্ধকারে। বিশেষ করে অমাবস্যার রাতে। কোনো যুবক সুন্দর স্বাস্থ্যবান পুরুষ দেখলে ধরে নিয়ে গিয়ে রক্ত খায়। আপনি খোজ নিলে আরো শুনতেন, এই গ্রামে কিন্তু প্রায়ই অমাবস্যার রাতে যুবক পুরুষ হারিয়ে যায়। সব ক্ষণির কাজ। বহু তান্ত্রিক কবিরাজ ওরে শায়েস্তা করতে আসছে। লাভ হয় নাই। ”

আমি বললাম, ” কবে থেকে ও এরকম ঘুরে বেড়ায়? আর ও দেখতে কেমন?”

কাদের বলল, ” জটাপড়া চুল। মুখটা বড় বানরের মত। দুইটা বড় দাঁত, যা দিয়ে রক্ত খায় ও। আর গায়ে ছেড়া ময়লা শাড়ি। রাতে চোখ জ্বলে।”

আমি বললাম, ” আপনি দেখেছেন ওকে এর আগেও?”

কাদের বলল, ” আমিই সবচেয়ে বেশি দেখছি। তান্ত্রিকরা বলছিল, ঘরে প্রতিবন্ধী সন্তান থাকলে ওগুলো তার আকর্ষণে ঘরের কাছে আসে। নদীর পাড় থেকে তাই একমাত্র এই বাড়ির উঠানেই ও আসতে পারে। ঘর বাধাই করা, তাই ঢুকতে কেবল পারে না।”

আমার রক্ত ঠান্ডা হয়ে গেল। একটু আগে উঠোনের বাথরুমে গোসল করেছি। বড় সম্ভাবনা ছিল, ওটা আমাকে উঠোনেই ধরতে পারত। বাথরুমের পাশে খসখস শব্দটার কথা মনে পড়ল।

আমি বললাম, ” এই উপদ্রব কবে থেকে? বেশি পুরনো হলে অবশ্যই আমি কাহিনী শুনতাম। আমার এসব কাহিনীতে আগ্রহ, লেখালেখি করি দেখে। আজ পর্যন্ত এখানে এই গ্রামের হাসপাতালে এসে কত ভূতের কাহিনী শুনলাম গ্রামের, এই জিনিসের নাম শুনি নাই।”

কাদের বলল, ” বছর খানেক। এর আগে নদীর পাড়ে ভয়ের কিছু ছিল না।”

আমি বললাম, ” ও কোত্থেকে আসছে, জানেন কিছু?”

কাদের বলল, ” তা জানি না। এক ওঝা বলছিল, দূরের কোনো গ্রামে কাউকে মনে হয় আছড় করছিল। কোনো ওঝায় তাড়িয়ে দিছে সেখান থেকে। সেই ওঝার ভয়ে নিজের গ্রাম ছেড়ে এখানে এসে আস্তানা গাড়ছে।”

এমন সময় বাইরে কিছু লোকের গলা শুনলাম। কাদের বাইরে উকি মেরে বলল, ” কাপড় পরে নেন , স্যার। লাঠিয়ালরা আসছে। আপনার লাগেজ খুজতে চলেন। ভয় পেয়েন না, ক্ষণি পেত্নীর ভয়ে কোনো চোর ছ্যাচড় লাগেজের কাছে এখনো যায় নাই। টাকা পয়সা থাকলে নিরাপদে আছে।”

আমি আমার শুকিয়ে যাওয়া কাপড় পরে দিলাম। একটা বিশ্রী গন্ধ আমার কাপড়ে। অনেকসময় ভেজা কাপড় গরম কিছু দিয়ে শুকানোর চেষ্টা করলে একটা বাজে গন্ধ আসে। এমন কিছুই হবে ভাবলাম।

বাইরে বের হলাম। লাঠিয়ালদের দেখে আমার চোখ কপালে উঠল। প্রত্যেকটা লাঠি হাতের লোক লম্বা একটা আলখাল্লা পরা। হুট করে দেখলে শেরওয়ানী মনে হয়। কিন্তু গেরুয়া রং দেখে বোঝা যায় , এগুলো আলখাল্লা।

আমি অবাক হয়ে কাদের সাহেবের দিকে তাকালাম। বিস্ময়ের সাথে দেখলাম, কাদের সাহেব আর বজলুর গায়েও একই পোশাক।

আমার বুকটা কাঁপতে লাগল। কাদের বলল, ” চলেন স্যার, আপনার লাগেজ খুজে আনি।”

আমি আস্তে আস্তে এগোতে লাগলাম। এগোতে এগোতে নদীর পাড়ের দিকে যেতে লাগলাম। আমার লাগেজ কোথাও দেখলাম না।

কাদের হঠাৎ বলে উঠল, ” চেন্নাইয়ের সেই বুড়ো ডাক্তার এক বছর আগে বলেছিল, আমার ছেলের আয়ু আছে কেবল এক মাস।”

আমি তাকালাম কাদেরের দিকে। কাদেরের মুখমণ্ডলে কোনো ভাবলেশ নেই। হঠাৎ সামনে আলো দেখলাম। তাকাতেই দেখি, নদীর পাড়ে আগুণ জ্বলছে।

কাদের বলল, ” কিন্তু আমার বউ আর কখনো সন্তান নিতে পারবে না। প্রতিবন্ধী হোক, আমারই তো বাচ্চা। মায়া ছাড়া যায় না। তাই ওকে বাঁচাতে শেষমেষ এক অঘোরী তান্ত্রিকের কাছে গেলাম ভারতে থাকতে থাকতেই।”

হঠাৎ আশেপাশে বিকট একটা নারীকণ্ঠের ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কান্না শুনতে লাগলাম। আমার বুকটা শুকিয়ে গেল। বজলু হিসহিস করে কণ্ঠের উদ্দেশ্যে বলল, ” চুপ,মাগী,চুপ কর।”

“মারিস না রে, পোলাডারে মারিস না রে, আমার পোলাডার মত….”

আমি দাঁড়িয়ে গেলাম। কাদের আর ওর লোকজনও দাঁড়িয়ে গেল। কাদের আনমনেই বলল, “অঘোরী আমাকে বলল, যদি প্রতি মাসের অমাবস্যায় একটা করে সুন্দর দেখতে স্বাস্থ্যবান যুবকের গলা কেটে সেই রক্তে আমার মন্টুকে গোসল করাই, ওর আয়ু একমাস করে বাড়বে। আমার ছেলের মরার কথা ছিল একবছর আগেই। ওকে আমি ১২ মাস বাঁচিয়ে রাখছি, ১২ টা মানুষের রক্ত দিয়ে…”

আমি দৌড়ে পালাতে গেলাম। আশেপাশের সেই নারীকণ্ঠের বিলাপ দীর্ঘ হতে লাগল। আমাকে কাদেরের লোকেরা শক্ত করে ধরে মুখ আর হাত পা বেধে দিল। তারপর সেই আগুণের কাছে বয়ে নিয়ে যেতে লাগল।

কাদের একটা গরু জবাইয়ের ছুরি হাতে নিয়ে ধার পরীক্ষা করতে করতে বলল, “আপনাকে টার্গেট করেছি অনেকদিন আগে, স্যার। ফাঁদে ফেলতেই পারতাম না। আজ ফাঁদে ফেলেছি। আমার ফাঁদে শুধু বাধা দেয় একজন। ওই ক্ষণি। ক্ষণি পেত্নী। ক্ষণি পেত্নীর ছেলে মিঠুরে জবাই দিয়েই আমার ছেলের প্রাণ বাঁচানো প্রথম শুরু করেছিলাম। ক্ষণি দেখে ফেলছিল খুনটা। সাক্ষী মেটাতে ক্ষণিকেও জবাই দিছিলাম। তারপর মা বেটার লাশ লুকিয়ে রাখছিলাম সেই গর্তে, যেই গর্তে আপনাকে ফেলব একটুপর। কিন্তু ক্ষণি পেত্নী হয়ে ঘুরে বেড়ায় সেই থেকে। যখনই কোনো শিকারকে নিয়ে আসি ফাঁদে ফেলে, সাবধান করতে চায়। ভয় দেখায়, যাতে আমার সাথে না আসে শিকার, গ্রামে ঢুকতে গিয়েই পালিয়ে যায়।”

ক্ষণির কান্না আরো বিকট হতে লাগল। আমাকে ওরা আগুণের পাশে শোয়াল। কাদের এগিয়ে আসতে লাগল ছুরি হাতে।

হঠাৎ ক্ষণির বিলাপ থেমে গেল। কাদের কিসব বিড়বিড় করতে করতে এগোতে লাগল। বজলু আমার চুল ধরে গলা ফাঁকা করে ধরল। ছুরিটা এগিয়ে আসল।

হঠাৎ আকাশ বাতাস বিদীর্ণ করে কাদেরের বউ সালমার চিৎকার শোনা গেল। সাথে ক্ষণি পেত্নীর অট্টহাসি। কাদের স্তব্ধ হয়ে গেল। সালমার চিৎকার শোনা গেল, ” মন্টুর বাপ, ক্ষণি ঘরে ঢুকছে। বাথরুমের দরজা দিয়া। বাধাই ছুটালো কে ওখানের?”

সবাই আমাকে রেখে দৌড় দিল। সালমা আবার চিৎকার দিল, ” আমার মন্টুরে মারিস না….”

ক্ষণির গা হিম করা কণ্ঠ শোনা গেল, ” প্রতিশোধ…”

কাদেরের আর্তনাদ শোনা গেল, ” মন্টুউউউউউ, বাপ আমার…..”

সব নিস্তব্ধ। হঠাৎ আমার হাতের বাঁধন খুলে গেল। আগুণের পাশে আমার লাগেজ। একটা বিকট নারীকণ্ঠ শোনা গেল, ” পিছনে ফিরে দেখিস না। অজ্ঞান হয়ে যাবি আমারে দেখলে। পালা, ডাক্তার, পালা।”

আমি কাঁপতে কাঁপতে লাগেজ হাতে নিলাম। আমার ডাক্তারি ব্যাগও পাশে। কণ্ঠটা বলে উঠল, ” হোচট খেয়ে বাথরুমের দিকের বাধাই খুলে দিছিস বলে, কাদেরের পোলার ঘাড় মটকাইতে পারছি। ওই পোলা যতদিন বাইচা থাকত, কাদের আমার মত কত মায়ের কোল খালি করত… আমারে মারার পর থেকেই প্রতিশোধ নেবার সুযোগ খুজছি। ও মন্ত্র জানে, ওরে ধরতে পারতাম না। আজ সব শেষ করে দিলাম

আমি আস্তে আস্তে হাটতে লাগলাম। কন্ঠটা বলল, ” পালা বেটা। মায়ের কাছে যা। গিয়া কইস, তোর আরেক মা আইজ তোরে নতুন জীবন দিল। আমারে ভুলিস না। আমি থাকব এইখানেই। কাদেরের শেষ দেখে ছাড়ব…”

বাসস্ট্যান্ডের রাস্তায় উঠে সাহস করে একবার পিছনে ফিরলাম। ক্ষণি এখনো দাঁড়িয়ে আমাকে দেখছে। কাদেরের বর্ণনার মতই ওর চেহারা। কিন্তু গলাটা কাটা। ঝুলে আছে। ওর ছেলে আর ওকে হত্যার সাক্ষ্য বহন করছে সেই কাটা গলা।

 

লেখারায়হান মাসুদ

সমাপ্ত

 

(ক্ষণি – লোমহর্ষক ভূতের গল্পটি আপনাদের কেমন লাগলো তা কমেন্ট করে অবশ্যই জানাবেন। পরবর্তী গল্প পড়ার আমন্ত্রণ জানালাম। ধন্যবাদ।)