আত্মার প্রতিশোধ – ভয়ানক এক আত্মার গল্প

আত্মার প্রতিশোধ –

লেখক:  রিমন হোসেন

 

সেদিন কাজ থেকে ফিরতে একটু বেশিই দেরি হয়েছিল। রাত প্রায় দুইটা বাজে। রাস্তাঘাট বেশ ভালোই ফাঁকা! ফাঁকা হওয়ার কথা! আসলে আমাদের এই অঞ্চলটা মূল শহর থেকে বেশ দূরে।

তাই রাত বারোটার পর পরই সবকিছু স্তব্ধ হয়ে যায়।

তো আমি কাজ শেষ করে ফিরছিলাম। হঠাৎ করে মনে হলো আমাকে ফিরতে হলে তো একটা জঙ্গল পার হতে হবে। জঙ্গলের কথা মনে আসতেই শরীরটা কেমন যেন শিরশির করে উঠলো! একে জঙ্গল দুইয়ে আবার এত বেশি রাত! ভয় হওয়ারই কথা! তবুও এক পা দু’পা করে এগিয়ে যাচ্ছিলাম।

আর মনে মনে ভাবছিলাম, যদি এখন কাউকে সাথে পেতাম তাহলে তার সাথেই জঙ্গলটা পার হওয়া যেত।ভাবতে ভাবতে এগুচ্ছি, এমন সময় মনে হল পেছন থেকে কেউ যেন এদিকেই আসছে।

একটু পরে সে আমার কাছে আসলো। দেখে মনে হল একটা বৃদ্ধ হাতে লাঠি নিয়ে গায়ে চাঁদর জড়িয়ে আছে। সত্যি বলতে ভূতের ভয়ের থেকে তাকে দেখেই আমার বেশি ভয় হচ্ছিল। তবুও মনে সাহস এনে তাকে প্রশ্ন করলাম,

আচ্ছা কাকা, আপনি কি জঙ্গলের ওপারে যাবেন?

হ্যাঁ বাবা। তুমিও কি ওপারে যাবে?

বৃদ্ধ লোকটির কথাবার্তার ধরণ দেখে ভয় অনেকটা কেটে গেল। আমি বেশ বিনম্রভাবে বললাম,

হ্যাঁ কাকা। আমিও ওপারে যাব।

তা বেশ তো! চলো একসাথেই যাই।।

আমরা একসাথে চলতে শুরু করলাম। আমার অবশ্য বেশ ভালই হল। জঙ্গলটা বেশ বড়। হেঁটে পার হতে তা প্রায় বারো মিনিট লাগে। আমরা আস্তে আস্তেই হাঁটা শুরু করলাম। যেতে যেতে আমি বৃদ্ধ লোকটিকে প্রশ্ন করলাম,

কাকা, আপনার হাতে লাঠি! কোথায় থেকে এত রাতে আসছেন?

আসছিনা, আমি এখন যাচ্ছি। মানে আমি আমার এক বন্ধুর বাড়ি যাচ্ছি।

এতো রাতে বন্ধুর বাড়ি?

হ্যাঁ বাবা। অনেক বড় একটা ঋণ আছে।

ঋণ আছে? কিসের ঋণ?

মৃত্যুর ঋণ।

তার এই রকম উত্তর শুনে আমি আর কিছু বললাম না। আমরা দুজনে প্রায় মিনিট পাঁচেক হলো হাঁটছি। হঠাৎ করে বৃদ্ধ লোকটি আমায় প্রশ্ন করে,

তুমি কোথায় যাচ্ছ বাবা?

আমি বাড়ি ফিরছি।

অফিস থেকে বুঝি?

হ্যাঁ কাকা। আসলে আজ কাজ করতে একটু বেশিই দেরি হয়ে গেল।

তা বেশ।।

হাঁটতে হাঁটতে প্রায় পনেরো মিনিট পার হয়ে গেল। কিন্তু জঙ্গল আর শেষ হলো না! জঙ্গলটা ক্রমশ গভীর থেকে গভীর হতে লাগল। আমি তো কিছু বুঝতেই পারলাম না। হঠাৎ করে মাথাটা ঝমঝম করে উঠলো।

তারপর পাশে তাকিয়ে দেখি আমার সাথে আসা বৃদ্ধ লোকটি আর নেই! আশপাশ ভালো করে দেখি। কোথাও নেই!

আমি কিছু বুঝে ওঠার আগেই চারপাশ ঘন কুয়াশায় ঢেকে যায়। কিন্তু এই সময় কুয়াশা আসবে কিভাবে? মাথাটা ঘুরে গেল।কিছুক্ষণ পর কুয়াশাগুলো সরে গেল। এ কি!! আমি রাস্তা থেকে জঙ্গলের ভিতরে আসলাম কিভাবে??

বুকের ভিতর ধক ধক করা শুরু করল। আমি জঙ্গল থেকে বের হওয়ার চেষ্টা করলাম। কিন্তু আমার মনে হতে লাগল আমি যেন আরো গভীরে যাচ্ছি।

জঙ্গল আর শেষ হয় না! তাও আমি এদিকে ওদিকে আরো ঘুরাঘুরি করলাম। কিন্তু কোন লাভ হল না।দৈবাৎ কোন কিছুর সাথে আমি হোঁচট খেলাম। নিচে তাকিয়ে দেখি, সেই বৃদ্ধ লোকটির হাতের লাঠি পড়ে আছে।

রাতের গভীরতা যেন আরো বেড়ে গেলো। চারপাশ আরো অন্ধকার হয়ে গেলো।

আমি তার লাঠিটা তুলে নিলাম। আর ভাবতে লাগলাম, এটা এখানে আসলো কিভাবে? হয়তো সেও আমার মত এভাবে এখানে ফেঁসে গেছে।

আমি আর কিছু ভাবতে পারলাম না। দৈবাৎ লক্ষ্য করলাম ঐদিকে কিসের যেন ক্ষীণ আলোর ঝলক। মনে মনে ভয় হলো। তবু সেই আলোর ঝলক অনুসরণ করলাম। কিছুক্ষণ পর বুঝতে পারলাম এটা কারো একটা ঘর।

বেশ পুরনো। মনে হয় ভিতরে কেউ আছে! তাই দরজায় কড়া নাড়া জন্য আরো কাছে গেলাম।

দরজায় কড়া নাড়া দিতেই বুঝতে পারলাম দরজাটা খোলাই আছে। ভিতরে যাওয়ার সাহস হলো না। তাই সেখান থেকে চলে আসার জন্য পিছু হাটতে লাগলাম।কিন্তু আমার মনে হতে লাগল আমি একই স্থানে আছি।

আত্মার প্রতিশোধ

আর পায়ের নিচ থেকে মাটি সরে যাচ্ছে! আমি ভয়ে ভয়ে নিচে তাকাই! দেখি সত্যিই আমি স্থির আছি আর মাটি পায়ের নিচ থেকে সরে যাচ্ছে!

আমি আর পালানোর চেষ্টা করলাম না। আমি ঠিক করলাম যে, আমি ওই ঘরের ভিতরে যাব। আর দেরি করলাম না। ধীর পায়ে ঘরটার ভিতরে ঢুকে পড়লাম। ঘরের আসবাবপত্র দেখে মনে হয় এখানে এখনো হয়তো কেউ বাস করে!

ঘরের শেষপ্রান্তে রাখা আলমারীর উপর একটা বন্দুক রাখা আছে। মনে হয় বেশ পুরনো! ঘরের ভিতরে তেমন কিছু পেলাম না।

তাই বেরিয়ে আসার জন্য পা বাড়িয়েছি এমন সময় হঠাৎ কারও চিৎকার ভেসে আসলো।

প্রথমে ভাবলাম চিৎকারটা বাহির থেকে আসছে। কিন্তু দ্বিতীয়বার যখন আবার কারো চিৎকার শুনতে পেলাম! তখন আমার আর কোন সন্দেহ রইল না যে, চিৎকারটা এই ঘরেরই নিচ থেকে আসছে!

কিন্তু কিভাবে সম্ভব?

মনে হচ্ছে এই ঘরের নিচে গোপন আর একটা ঘর আছে! দেখতে হবে রহস্যটা কি? আমি আশপাশ খুজতে লাগলাম কোথাও নিশ্চয়ই গোপন পথ

আছে। খুজতে খুজতে পেয়েও গেলাম। মেঝেতে একটা কার্পেট ছড়ানো ছিল তার নিচেই নেমে গেছে সিঁড়ি।

আমি সেই সিঁড়ি ধরে নিচে নামলাম। নিচে নেমে আমি অবাক হয়ে গেলাম! উপর এত ছোট একটা ঘর আর নিচে এত বড় একটা জায়গা! এখানে নিশ্চয়ই কোন অন্যায় কাজ করা হয়!

নিচে অনেক বড় বড় কাগজের, কাঠের বাক্স রাখা ছিল। আমি বাক্সগুলোর আড়ালে গিয়ে লুকোলাম।

কিন্তু আমার মনে ভয় এর তুলনায় কে চিৎকার করেছে সেটা জানার আগ্রহই বেশি ছিল। কিন্তু সেখানে আমি কোন মানুষের চিহ্নও পেলাম না। আস্তে আস্তে আমার মনের ভেতর ভয় বাসা বাঁধলো।

আমার মন একবার বলছে, এখান থেকে চলে যেতে। আবার আর একবার বলছে, কি হয় তা দেখতে। মনের সাথে লড়াই করে আমি ওখানেই থেকে গেলাম।

কিছুক্ষণ পর আবার সেই চিৎকার শুনতে পেলাম। কেউ যেন চিৎকার করে বলছে, বাঁচাও! বাঁচাও!

মনে হচ্ছে এই ঘরের ভেতর আর একটা ঘর আছে! আমার হাতে থাকা লাঠিটা দিয়ে আমি সেই ঘরের দেয়ালের টোকা দিতে লাগলাম। একটু পরে বুঝতে পারলাম, যা ভেবেছি তাই সত্যি! এই এখানেই আছে আরেকটা পথ!

আর এর ঐপাশ থেকেই হয়তো চিৎকার আসছে!আমি এখানকার পথ খুঁজতে লাগলাম। হঠাৎ আবার চিৎকার ভেসে এলো। কেউ যেন বলছে, ক্ষমা করে দাও! বাচাও! বাচাও আমাকে!

ভেতরে যাওয়ার কোন পথ না পেয়ে আমি হাতের লাঠি দিয়ে দেয়ালে আঘাত করলাম। তিনবার আঘাত করার পর হঠাৎ করে দেয়ালের কিছু অংশ সরে গিয়ে একটা পথ তৈরি হলো।

আমি সেই পথ ধরে ভেতরে গেলাম। একি! ভিতরে প্রবেশ করার সাথে সাথে আমি হিম পাথর হয়ে গেলাম! এত রক্ত! এত লাশ! এখানে কি হয়?

আমি পালিয়ে আসার চেষ্টা করলাম। হঠাৎ আবার চিৎকার শুনতে পেলাম। আমি পেছন ফিরে তাকালাম।

মনে হলো ওই ঘরের শেষপ্রান্তে কেউ আছে! তাই ধীর পায়ে এগিয়ে গেলাম।তারপর যা দেখলাম, তাতে সত্যিই পায়ের নিচ থেকে মাটি সরে গেল!

আমি দেখলাম……। আমি দেখলাম সারি সারি করে বিছিয়ে রাখা লাশ! এত রক্ত! আমি এর আগে কখনো দেখিনি। ঘরের শেষপ্রান্তে একটা যুবক ভয় পেয়ে দাড়িয়ে আছে।

ও আমাকে দেখার সাথে সাথে চিৎকার করে বলল, বাঁচাও! বাঁচাও আমাকে। আমি বাঁচতে চাই। আমাকে মেরে ফেলবে। বাঁচাও আমাকে! এতক্ষণ এরই চিৎকার ভেসে আসছিল।

আমি যুবকটির কাছে গেলাম আর সঙ্গে সঙ্গে চমকে উঠলাম!

একি! এতো সেই বৃদ্ধ লোকটি! চোখ দুটো লাল! শরীর রক্তাক্ত! আমার মাথায় কিছু আসছিল না। বৃদ্ধ লোকটি আমার দিকে তাকাতেই আমার কোমর থেকে পা পর্যন্ত সব যেন জমে গেল!আমি পা নাড়াতে পারছিলাম না।

হঠাৎ করে দেখলাম, বৃদ্ধ লোকটি যুবকটির গলা ধরে উঁচু করে ফেলল। তারপর ছুরে ফেলে দিলো কয়েকটা লাশের উপরে।

আমার আর বুঝতে বাকি রইলো না যে, বৃদ্ধ লোকটি কোন মানুষ নয়! আর এও বুঝতে পারছিলাম যে, যুবকটির আর হয়তো রক্ষা নেই! কিন্তু আমার ভয় হচ্ছিল হয়তো এর পর আমার পালা।

ভয়ে আমার গলা দিয়ে কোন আওয়াজ বের হচ্ছিলো না। আমি শুধু নির্বাক দর্শকের মত দেখছিলাম, একটা আত্মার প্রতিশোধ।

বৃদ্ধ লোকটি যুবকটিকে কষ্টের পর কষ্ট দিতে থাকে। প্রথমে চুলের গোড়া ধরে সারা ঘর টেনে নিয়ে বেড়ায়। তারপর নখ দিয়ে সারা শরীর আঁচরাতে থাকে। অবশেষে আমাদের হাতে চলে গেল।

আর বৃদ্ধ লোকটি লাঠি যুবকটির পেটে ঢুকিয়ে এফোঁড়- ওফোঁড় করে দিলো। ছটফট করতে করতে মারা গেল যুবকটি।

তারপর বৃদ্ধ লোকটি আমার কাছে আসলো। আমি খুবই ভয় পেয়ে যাই। ভাবলাম, এখানেই হয়তো আমার ইতি।বৃদ্ধ লোকটি আমার কাছে এসে তার লাঠিটা ছুইয়ে দিতেই আমি ঠিক হয়ে গেলাম।

কিন্তু আমি তাও কেন জানি না সেখানেই দাঁড়িয়ে ছিলাম। হঠাৎ দেখলাম, বৃদ্ধ লোকটির চোখ বেয়ে বেয়ে পানি ঝরছে। সে বলতে লাগল,

জানো তো বাবা! এই ঘর থেকেই এই সবকিছু শুরু হয়েছিল। আর আজ এখানেই শেষ হলো। এরা তিন বন্ধু আমায় এখানেই মেরে ফেলেছিল।

কেন জানো?আমি এদের অন্যায় কাজে বাঁধা দিয়েছিলাম তাই।সেদিন আমি বলেছিলাম আমায় দিতে। আমার নাতনী হাসপাতালে ভর্তি আছে।

আমি ছাড়া তার আর কেউ নাই। কিন্তু ওরা আমাকে ছাড়েনি। আমাকে মেরে ফেলেছে। এরা তিন বন্ধু মিলে এখানে মানুষদের মেরে তাদের শরীরের অঙ্গ চুরি করত। দুজনকে তো আগেই মেরে ফেলেছি।

আর আজকে একে মেরে মৃত্যুর ঋণ শোধ করলাম। আজ আমি মুক্তি পেলাম আর এখন তুমিও মুক্ত।

তারপর আস্তে আস্তে বৃদ্ধ লোকটি ধোঁয়ার সাথে মিশে গেলো।

আর মনের অজান্তেই আমার চোখ থেকে এক ফোঁটা পানি গড়িয়ে পরল।

 

 

{ আরো পড়ুন – ভয়ংকর বাসের সফর – ভয়ঙ্কর এক অভিজ্ঞতা

 

( আত্মার প্রতিশোধ – ভয়ানক এক আত্মার গল্প আপনাদের কেমন লাগলো তা কমেন্ট করে অবশ্যই জানাবেন। পরবর্তী পর্বের জন্য আমাদের সাথেই থাকুন । ধন্যবাদ।)

 

আত্মার প্রতিশোধ – ভয়ানক এক আত্মার গল্প

” সমাপ্ত”