দরজার ওপাশে

দরজার ওপাশে –

লেখক: মহুয়া

 

কিছুদিন আগে একবার গাড়িতে উঠার সময় হাতে থাকা ফোনটায় টুং করে একটা মেসেজের শব্দ হলো। সিট নিয়ে বসার পর দেখি একটা মেসেজ,

দোপাট্টার আঁচলটা টেনে সাবধান হোন। নয়তো চাকার সাথে লেগে যাবে।

সত্যিই ওড়নার এক পাশটা চাকার কাছাকাছি নেমে গেছে। সামনের দিকে টেনে নিয়ে ঠিকভাবে বসলাম। ফোনের স্ক্রিনে খেয়াল করলাম নাম্বারটা অপরিচিত। ততক্ষনে গাড়ি চলা শুরু করে দিয়েছে। কি খুঁজতে হঠাৎ চারপাশে তাকালাম। তেমন কিছু চোখে পড়লো না। আমি বেশ অবাক হলাম।

এরপরে একদিন, বাস স্ট্যান্ড থেকে কলেজ পর্যন্ত সর্বোচ্চ পাঁচ মিনিটের রাস্তা। এতো কড়া রোদে হাঁটতে বেশ অসুবিধা হলেও রাস্তা কম দেখে হেঁটেই যাচ্ছিলাম। হঠাৎ মাথাটা কেমন যেনো ঘুরছে মনে হলো। বেশ কিছুদিন অসুস্থ থাকার পর সুস্থ হলেও শরীর বেশ দুর্বল।

তার মধ্যে এতো রোদ। মনে হচ্ছিলো যেনো জ্ঞান হারাবো। এমন সময় ফোনে টুং করে একটা শব্দ হলো। ফোন চেক করার মতো ইচ্ছে বা আগ্রহ কোনোটাই ছিলো না। পরক্ষণেই আরও দুবার টুং শব্দ। স্ক্রিন অন করে দেখি তিনটে আনরিড মেসেজ। লাস্ট মেসেজটায় কোনো রকমে চোখ বুলালাম।

ঠিক ডানদিকে দু পা পিছনে একটা লেডিস কর্নার আছে। রেস্ট না করে সামনে না যাওয়াই ভালো ‘

অবাক হওয়ার মতো অবস্থায় না থাকলেও বেশ অবাক হলাম। কেউ আমাকে সর্বক্ষন অনুসরণ করছে। কিন্তু কেনো?

রেস্ট নিতে গিয়ে ঘুমিয়ে গেছিলাম। এক ঘন্টার মতো ঘুমিয়েছি। বের হওয়ার সময় এক মেয়ে বললো, ‘আপু সাবধানে যাবেন।’

আশ্চর্য! হুট করে অপরিচিত একটা মেয়ে এভাবে চলে এলো। প্রায় ঘন্টা খানিক জায়গা দখল করে নিয়েছিলো। তার উপর বিন্দু মাত্র সার্ভিস নিলো না। তার সাথে আবার এতো সুন্দর ব্যবহার করছে।

ব্যাপারটা কি স্বাভাবিক? হয়তো। ইদানিং আমিই সব কিছুতে সন্দেহ করে করে ঝামেলাপূর্ণ মনে করছি। যাক গে। কলেজ যাবো নাকি বাসায় ফিরে যাবো তাই ভাবছিলাম। এমন সময় প্রিয়ন্তীর ফোন।

প্রিয়ন্তীর সাথে পরিচয়টা কলেজ কেন্দ্রিক হলেও বর্তমানে তা আত্নীয়দের মতো হয়ে গেছে । ওর বাসা কলেজ থেকে কাছেই। অসুস্থ শুনার পর আমাকে বের হতে না করলো।

প্রায় পাঁচ মিনিটের মধ্যে প্রিয়ন্তী চলে এলো। প্রিয়ন্তীর আম্মু আমাকে খুব ভালোবাসেন। ওদের বাসায় যাওয়ার পরই খাবার খাওয়ার জন্য আন্টি জোর করতে থাকলো। আমিও আর কোনো কথা না বলে খেয়ে নিলাম। এর মধ্যে প্রিয়ন্তির বড় ভাই একবার এসে দেখে গেলো।

কেনো যেনো প্রিয়ন্তীর ভাই আমাকে খুব একটা পছন্দ করেন না। যদিও এর নির্দিষ্ট কোনো কারন আমি আদৌ খুঁজে পাইনি।

ভাইয়ার সাথে কখনো সেভাবে পরিচয়ও হয় নি।এজন্যই আমি এ বাসায় আসতে চাই না৷ কিন্তু প্রিয়ন্তীর জোরাজোরিতেই আজ আবারও আসতে হলো। খাবার খাওয়ার পর দুজনে গল্প করছিলাম। আজ সারাদিনে কি কি হয়েছে।

অপরিচিত নাম্বার থেকে বার বার সতর্কতা মেসেজ, আড়ালে থেকে আমার উপর কারও খেয়াল রাখা। নাম্বারটাও প্রিয়ন্তীকে দেখালাম। কিন্তু সে তো হেসেই যাচ্ছে শুধু। হাসতে হাসতে বার বার টিপ্পনি কাটছে। আমি আর কিছু বললাম না।

বালিশটা নিয়ে প্রিয়ন্তীর কোলে মাথা রেখে সুয়ে পড়লাম। প্রিয়ন্তি আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছিলো।

ডায়েরীর মতোন আমার কথাদের জমা রাখার একটা সিন্দুক হচ্ছে প্রিয়ন্তী। শুধু কি কথা! ব্যক্তিগত কষ্ট, দুঃখ, হাসি, আনন্দ, কিংবা যে কোনো সমস্যার সমাধান, সারি সারি করে সাজিয়ে রাখার তালাবিহীন বিশ্বাসযোগ্য একটা সিন্দুক হচ্ছে এই মেয়েটি।

পৃথিবীতে খুবই অল্প সংখ্যক মানুষের এমন টা নির্দিষ্ট নিজস্ব সিন্দুক থাকে এবং নিঃসন্দেহে তারা ভাগ্যবতী বা ভাগ্যবান।

প্রিয়ন্তী এতো সুন্দর করে মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছিলো যে আমি আবারও ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। বার বার ঘুমিয়ে যাওয়াতে বুঝতে পারছিলাম আমার শরীর কতটা দুর্বল হয়ে পড়েছে ।

চোখ খুলতে ইচ্ছে করছিলো না। এদিকে দুপুর গড়িয়ে বিকেল হওয়ার পথে। আন্টি পাশে বসেছিলেন কিছুক্ষণ। আমার মায়ের মতোই মমতাময়ী কন্ঠ ওনার। পৃথিবীতে সব মায়েরাই মনে হয় মমতাময়ী হয়। উনি বার বার বলছিলেন, এমন দুর্বল শরীরে না গিয়ে আজকে যেনো এখানেই থেকে যাই। ঘুম আসার আগে প্রিয়ন্তীও এই একই কথা বলছিলো।

কি করবো বুঝতেছিলাম না। এর মধ্যে মায়ের ফোন। আম্মু বললো, নানুর শরীরটা একটু খারাপ করেছে । তাই আম্মু সেখানে যাচ্ছে। আমি যেনো বাসায় না গিয়ে সোজা নানু বাড়ি চলে যাই।

ওই বাড়িতে আমার একদম যেতে ইচ্ছে করে না। খুব বেশি প্রয়োজন ছাড়া কখনো যাইও না। এদিকে আমি যে অসুস্থ হয়ে পড়েছি আম্মু তাও জানেনা। এখন তো মনে হচ্ছে ওবাড়িতে যাওয়ার থেকে এখানে থাকাই ভালো হবে।

তারপর আমার হাত থেকে ফোনটা নিয়ে প্রিয়ন্তী নিজেই সব বলে দিলো এবং কায়দা করে আজ ওদের বাসায় থাকার পারমিশনটাও নিয়ে নিলো।

রাত তখন বারোটা, প্রিয়ন্তী ঘুমিয়ে গেছে। এদিকে আমার কিছুতেই ঘুম আসছিলো না। বিছানা ছেড়ে জানালার কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম। আবছা চাঁদের আলো খানিকটা জোর করে জানালা পর্যন্ত আসতে চাইছে। কিন্তু জানালার ওপাশে থাকা হাসনাহেনা গাছের অনুরোধে আলোর রশ্মি কেবল ফুলগুলোর সৌন্দর্যকেই বাড়িয়ে দিচ্ছে ।

আলোর রশ্মিগুলো মাঝে মাঝে আবার অভিমানও করছে, সেই অভিমানের সঙ্গ দিচ্ছে হঠাৎ হঠাৎ ছুটে আসা মেঘেদের দল।

বিদ্যুৎ চলে গেছে। চাঁদের আলোর অভিমানকে সম্মতি দিয়ে সারা বাড়িতে গাঢ়ো অন্ধকার তার নিজস্ব সত্তার জানান দিচ্ছে খুব ভালো ভাবেই।

ছাঁদে যেতে ইচ্ছে করছে ভীষন। প্রিয়ন্তীকে ডাকলাম কয়েকবার। সে তো সাড়াও দিচ্ছে না। কি করবো ভাবছিলাম। এক পা দু পা করে দরজা পর্যন্ত এগিয়ে আবার ফিরে এলাম। আবার দরজা পর্যন্ত গেলাম। আবার ফিরে এলাম।

দরজা থেকে এক হাত দূরেই ছাদে উঠার সিড়িটা। ঘুটঘুটে অন্ধকারের মধ্যে দুই সিড়ির মাঝখানের খোলা জানালাটা থেকে চাঁদের আলোর মৃদু রশ্মি এসে পড়েছে।

একা এতো রাতে ছাদে যাওয়াটা কি ঠিক হবে?

কেনো ঠিক হবে না। ভূত টূতে তো আর আমার তেমন ভয় নেই। তাছাড়া কিছুক্ষন পরেই তো চলে আসবো। তাহলে আর কি, যাই।

মানুষ নিজের ইচ্ছার পক্ষে কোনো কাজ করতে চাইলে,নিজে নিজেই বিভিন্ন যুক্তি দাঁড় করায়। বিপরীতে না করতে চাইলেও তার বিপক্ষে কিছু যুক্তি দাঁড় করায়। আসলে মানুষ নিজের মস্তিষ্ককে যা বলে মস্তিষ্ক  তাই শুনে।

ছাদে যাচ্ছিলাম। দুই সিড়ির মাঝ বরাবর বেশ বড়োসড়ো একটা বারান্দা আছে। সেই বারান্দায় যাওয়ার জন্য ছোট মতন সুন্দর একটা দরজাও আছে। দরজাটা বন্ধ। পাশের জানালাটা খোলা। প্রিয়ন্তীর আব্বু যে বাড়ির সৌন্দর্যের ব্যাপারে কতটা পর্যবেক্ষণকারী, তা এই বাড়ির ডিজাইন দেখলেই বুঝা যায়।

যাইহোক আমি চুপিচুপি ছাদে উঠে গেলাম। কিন্তু ছাদে যাওয়ার পরই মনে হলো ফোনটা নিয়ে আসলে ভালো করতাম। স্লো মোশনের একটা গান কিংবা কবিতা শুনতে পারতাম।

এতো রাতে এমন নিস্তব্ধ পরিবেশে কবিতা শোনার আগ্রহটা দমিয়ে রাখতে পারলাম না। তাই রুমে ফিরে গেলাম ফোনটা নিয়ে আসার জন্য। ফোন নিয়ে পুনরায় ফেরার পথে সিড়ির মাঝের বারান্দাটায় হঠাৎ চোখ আটকে গেলো।

জানালা থেকে ভেতরে তাকাতেই যেনো মনে হলো দশ কি বারো বছরের একটা বাচ্চা ছেলের অবয়ব দেখতে পেলাম। আরেহ্!  এটা কি দেখলাম।

চোখ মুছে আবার তাকালাম। কই এখন তো কিছু দেখছিনা। চোখের ভুল ভেবে আবার ছাদের উদ্দ্যেশ্যে পা বাড়ালাম।

কোন কবিতাটা শুনবো বাছাই করছিলাম।

বর্তমান সময়ের বেশ জনপ্রিয় কবি সালমান হাবীবের লেখা ‘প্রযত্নে’ কবিতাটা আমার ভীষন প্রিয়। আপাতত কবিতা শোনায় মনযোগী হওয়াটাই সবচেয়ে উত্তম।

কিন্তু মনযোগটা বেশিক্ষন ধরে রাখতে পারলাম না।

নিচ থেকে খুবই মৃদু একটা কন্ঠস্বর ভেসে আসছিলো। যেনো কেউ একজন বই পড়ছে। কিন্তু এতো রাতে কে বই পড়বে। তাও আবার এতো অল্পবয়সী বাচ্চার গলার স্বর। পরক্ষনেই সেই অবয়বটার কথা মনে হলো। আমার জানা মতে এতো কম বয়সের কেউ এই বাসায় নেই।

তাহলে কে?

এমন সময় একটা পাখি ডানা ঝাপটিয়ে এক ডাল থেকে অন্য ডালে উড়ে গেলো। উফ, এই পাখিটাকেও এক্ষুনি উড়ে যেতে হলো। আরেকটু হলেই তো চিৎকার দিয়ে ফেলতাম।

বুকে থু থু দিয়ে খানিকটা সাহস সঞ্চয় করলাম। বই পড়ার শব্দটাকে অনুসরণ করে সিড়ির মাঝখানটায় এসে থামলাম।

হরর মুভি গুলোতে দেখেছি যারা ভূতে বিশ্বাস না করে বেশি সাহসীকতা দেখাতে যায় তারাই সবার আগে প্রান হারায়। কে জানে, তেমন কিছু আবার আমার সাথে হবে নাকি।

এই বাড়িতে তো এর আগেও আমি রাতের বেলায় থেকেছি । কই ভয় পাওয়ার মতো এমন কিছু তো কখনো শুনি নি।

ভয়ে ভয়ে খুব সন্তর্পণে জানালায় কান পেতে দাঁড়ালাম। খুব ধীরে একটা শব্দ শোনা যাচ্ছে।অল্প বয়সী একটা ছেলে বই পড়ছে। কিন্তু সারা বাড়ির কোথাও বিদ্যুৎ নেই। এই বারান্দা ঘরেও কোথাও আলো দেখা যাচ্ছে না। আশ্চর্য,তাহলে আলো ছাড়া বই পড়ছে কি করে?

আর তার থেকেও বড় কথা এই বয়সের কেউ এ বাসায় নেই। প্রিয়ন্তীর কোনো ছোট ভাই বোন নেই। বাসায় কেবল ওরা চার জন সদস্য। প্রিয়ন্তীর বড় ভাই তার কোনো এক ফ্রেন্ডের বাসায় গেছে বিকেলে ৷ আমি এসছি বলেই হয়তো ভাইয়া আজ বাসায় ফিরেনি।

এর আগেও আমি যতবার এই বাসায় এসেছি ততবারই দেখেছি ভাইয়াকে অন্য কোথাও চলে যেতে।

কোথা থেকে একটা উদ্ভট বিশ্রি গন্ধ নাকে আসছে।এমন সময় হঠাৎ ফোনে টুং করে একটা শব্দ হলো। মেসেজটা অন করে দেখি ।

মেসেজ – ‘চুপচাপ রুমে ফিরে ঘুমান।’

আশ্চর্য! এই রাতের বেলায়ও কে আমাকে অনুসরন করছে? কে হতে পারে?

দ্রুত রুমে ফিরে গেলাম। মস্তিষ্কে ভয় আর দুশ্চিন্তা একত্রে এক বিশ্রি রকমের অনুভূতি দিচ্ছে। প্রিয়ন্তীকে একবার ডাকলাম। কিন্তু কোনো সাড়া দিলো না। মানুষ এতো ঘুমায় কিভাবে।

রাতে ঘুমুতে দেরি হওয়ায় সকালে বেশ বেলা করে ঘুম ভেঙ্গেছে। কিন্তু সকালে উঠে আরেক দফা বিপদ হলো। বাথরুম থেকে বের হতে না হতেই হঠাৎ মাথা ঘুরে পড়ে অজ্ঞান হয়ে গেলাম।

জ্ঞান ফেরার পর দেখি প্রিয়ন্তী আমার পাশে বসা।পিয়াস ভাইয়া, আন্টি, আঙ্কেল সবাই দাঁড়িয়ে আছে। আমি প্রিয়ন্তীকে আস্তে আস্তে জিজ্ঞেস করলাম,

কি হয়েছে?

প্রিয়ন্তী কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলো। এমন সময় পিয়াস ভাইয়া জিজ্ঞেস করলো,

এখন কেমন লাগছে?

আমি বললাম,

ভালো।

দু ঘন্টা পর,

বাড়ি যাওয়ার জন্য অস্থির লাগছিলো।একটু জোর করেই অসুস্থ শরীরে বের হয়ে এলাম।প্রিয়ন্তী হয়তো খানিকটা রাগ করেছে। করলে করুক। ওর রাগ পরে ভাঙ্গানো যাবে। এতো তাড়াহুড়ো করে বের হওয়ার কারন হচ্ছে, সেই অপরিচিত নাম্বার থেকে বেশ কয়েকটা মেসেজ এসেছে, আমি যেনো তাড়াতাড়ি বাসায় ফিরে যাই।

গাড়িতে উঠার পর মনে হলো এভাবে আসাটা ঠিক হয়নি। একটা অপরিচিত নাম্বার থেকে আমাকে ইন্সট্রাকশন দিচ্ছে আর আমি কি না তার কথা শুনছি। এটা কি করছি আমি। কেনো এই লোকটার কথায় এতোটা পাত্তা দিচ্ছি। সে কে, কি চায়, কেনোই বা আমার প্রতিটি পায়ের পদক্ষেপ লক্ষ করছে।

এইসব প্রশ্ন বার বার মাথার মধ্যে উঁকি দিচ্ছিলো।

হঠাৎ ড্রাইভার গাড়ির ব্রেক চাপলো। অকস্মাৎ এভাবে ব্রেক চাপায় নিজেদের ব্যালেন্স সামলাতে সবারই একটু সমস্যা হয়ে পড়ে। কিন্তু স্ট্যান্ড ছাড়া গাড়ি দাঁড়ানোর কোনো কারন বুঝতে পারলাম না।

এর মধ্যে কেউ কেউ ড্রাইভারকে গালাগালি করা শুরু করে দিয়েছে। পিছনে এক ছেলে দাঁড়ানো ছিলো, সে তার পাশের সিটে বসা এক মেয়ের উপর হেলে পড়েছে বলে মেয়েটি তাকে খুব কথা শুনাচ্ছে।

এক বৃদ্ধার হাত থেকে তার লাঠি পড়ে গেছে। এজন্য সে চিৎকার করছে। কি এক অবস্থা শুরু হয়ে গেলো এক মুহূর্তের মধ্যে।

একটু পর দুজন পুলিশ বাসে উঠে আসায় বাসে থাকা সবাই হঠাৎ চুপ হয়ে গেলো। যেনো সারা বাসের মধ্যে একজনও মানুষ নাই, কিংবা সবাই একসঙ্গে বোবা হয়ে গেছে। হঠাৎ করে সবার ভয় পাওয়া মুখ দেখে আমার খুব হাসি পেলো।

কিন্তু এখন হাসলেও বিপদ। বাসের মধ্যে পুলিশ কি খুঁজতে এসেছে তা তো জানিনা। এখন এই সিরিয়াস মুহূর্তে অযথা হাসার কারনে হয়তো দেখা যাবে এই হাসির জন্যই আমাকে থানায় তুলে নিয়ে গেলো। হঠাৎ আমার ফোনের রিংটোন-টা বেজে উঠলো।

অপরিচিত নাম্বার। রিসিভ করবো কি করবো না ভাবতে ভাবতেই ফোনটা কেটে গেলো। দ্বিতীয় বার ফোন বাজার শব্দ শুনে একজন পুলিশ আমার সামনে এসে দাঁড়ালো। সে বললো,

ম্যাডাম, আপনার ফোন বাজছে। ফোনটা তুলুন।

আমি একটু অবাক হলাম। আশে পাশের সবাই আমার দিকে এমন ভাবে তাকাচ্ছে যেনো আমি ভিন গ্রহের কোনো প্রানী। আজব। তাছাড়া পুলিশ সামান্য আমার ফোনকল নিয়ে পড়েছে কেনো।

তিনি আবারও ধমকের সুরে বললেন,

ফোনটা তুলুন, ম্যাডাম।

রিসিভ করার সাথে সাথে একটা ভারী কন্ঠের আওয়াজ। ভাবছিলাম, একটা মানুষের গলার স্বর এতোটা বাজে কি করে হতে পারে।

সে কি তার ভয়েস কর্কশ হওয়ার জন্য নিয়মিত প্র্যাকটিস করে নাকি। তবে এতো ভয়ের মধ্যে একটা ভালো হচ্ছে, কন্ঠস্বরটি আমাকে আশ্বাস দিচ্ছে। সে বলছে,

ভয় পেয়ো না। কিচ্ছু হবে না তোমার।

আদৌ এই কথাটা আমার ভয় দূর হওয়ার পরিবর্তে আরও বেড়ে গেলো।এই একটা কথা বলার সাথে সাথেই পুলিশ ইন্সপেক্টর আমার হাত থেকে ফোনটা ছোঁ মেরে নিয়ে নেয়।

তিনি কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলো কিন্তু ফোনটা ততক্ষণে ওপাশ থেকে কেটে দেওয়া হয়েছে। ইন্সপেক্টরের মুখটা রাগে লাল হয়ে গেছে। তার মুখ থেকে অস্ফুটশব্দে কয়েকটা বাজে গালি বের হয়ে এলো। এর মধ্যে তিনি আমাকে বলছেন, বাস থেকে নেমে থানায় যেতে।

আমার অবাক হওয়ার সমস্ত মাত্রা ছাড়িয়ে গেলো।

আমি থানায় যাবো মানে?

পুলিশ ইন্সপেক্টর আমার ফোনটা নেড়ে চেড়ে দেখে বললো,

এই ফোনটা তো আপনার। তাই না?

জ্বি, আমার। কিন্তু তার সাথে আমার থানায় যাওয়ার কি সম্পর্ক?

কি সম্পর্ক বুঝতে পারছেন না, তাই না। মার্ডার কেস, ম্যাডাম। মার্ডার কেস। চলুন আমাদের সাথে, ধীরে ধীরে সব বুঝতে পারবেন।

কি বলছেন আপনারা? কার মার্ডার, কিসের মার্ডার?

চলুন, যেতে যেতে মনে করিয়ে দেই আপনাকে।প্লিজ।

বাস থেকে নামার সময় সবার অতি আগ্রহী নজর গুলো হাজারটা প্রশ্ন নিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। যেতে যেতে ইনস্প্যাক্টর বলতে লাগলেন,

তো ম্যাডাম, জানতাম এখন কিছুই বুঝবেন না। চিনবেন না। তবুও আপনার সুবিধার্থে আরেকবার মনে করিয়ে দিচ্ছি।’রায়হান হাসান’কে চিনেন নিশ্চই। বর্তমান সময়ের বেশ জনপ্রিয় লেখক ছিলেন।

আপনার সাবেক প্রতিবেশি। মানে হচ্ছে, আগে আপনারা যে বাসায় ভাড়া থাকতেন, সে বাসাতেই ঠিক আপনাদের বিপরীত পার্শ্বে যে ছেলেটি ভাড়া থাকতো আমি তার কথাই বলছি।

হ্যাঁ, তো। তিনি ফ্যামিলি সহ থাকার জন্য বাসাটা ভাড়া নিয়েছিলেন। কিন্তু পরবর্তীতে উনার ফ্যামিলির সাথে ঝামেলা হওয়ায় তিনি একাই থাকতেন।

বাড়িওয়ালা আমাদের তাই বলেছিলো। কিন্তু তার সাথে আমার থানায় যাওয়ার কি সম্পর্ক বুঝতে পারছি না।

পাঠকপ্রিয় বহু পরিচিত সেই রায়হান হাসান একদিন আগে খুন হয়েছে। আর তার বাসায় আপনার সেলফোনের সিমকার্ডটি পাওয়া গেছে।

আমার মাথায় যেনো আস্ত আকাশ ভেঙ্গে পড়লো।লেখক ‘রায়হান হাসান’ খুন হয়েছে এই নিউজ গত একদিনেই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তুমুল ঝড় ফেলে দিয়েছে। কিন্তু সেখানে আমার ফোনের সিম কার্ড কিভাবে পাওয়া সম্ভব।

এমন সময় আমার ফোনের রিংটোন আবারও বেজে উঠলো। ফোনটা আমার হাতেই ছিলো। ইন্সপেক্টর রিসিভ করে স্পীকারে দিতে বললেন। কোনো এক অজানা ভয়ে আমার কপাল বেয়ে ঘাম ঝড়ছিলো।

ফোনের দিকে তাকাতেই দেখি প্রিয়ন্তী ফোন দিয়েছে। বাসায় পৌঁছে গেছি কি না জানার জন্য হয়তো ফোন করছে।

প্রিয়ন্তীর একসাথে একাধিক প্রশ্ন করার বাজে স্বভাব আছে।

সে বলতেই থাকলো,

বাসায় পৌঁছে গেছি কি না? কখন পৌঁছেছি?শরীর কেমন এখন? বাসার সবাই ফিরেছে কি না?কাল রাতে ছাদে আমি কি দেখে ভয় পেয়েছিলাম?আমি আগে পিছে কিছু না ভেবে দুম করে বলে দিলাম,

বাসায় এসেছি। খুব টায়ার্ড লাগছে পরে কথা হবে’।

বলেই কলটা কেটে দিলাম। এরকম একটা মিথ্যা বলায় পুলিশ অফিসার আরিফুল ইসলাম আমার দিকে কিছুক্ষণ ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে রইলেন। আমি একটা মুচকি হাসি দিয়ে বললাম,

অসুস্থ শরীরে বের হয়েছি তো। তার উপর এতকিছু শুনলে অযথা টেনশন করবে, তাই আর কি।

হুম, মিস অদ্বিতীয়া অনু। আপনে বেশ বুদ্ধিমতী একটা মেয়ে। বুদ্ধিমতি কেনো বললাম তার কারনটা অন্য কখনো বলবো। আপাতত চলুন আমার সাথে।

থানায় যাওয়ার পর একেকটা কথা শুনে আমি শুধু বার বার অবাক-ই হচ্ছি। জনপ্রিয় লেখক রায়হান হাসান খুন হওয়ার পেছনে শক্তিশালী এবং জোরালো কিছু প্রমান পাওয়া গেছে, যা দ্বারা কিনা এটাই প্রমানিত হয় যে লেখক সাহেবকে মার্ডার আমিই করেছি।

আশ্চর্য! এটা কি করে সম্ভব। আমি কেনোই বা তাকে খুন করতে যাবো?

সেইটা তো আপনিই ভালো জানেন ম্যাডাম। এবার ঘটনাটা খুলে বলুন শুনি।

আমি বুঝতে পারছিলাম না কি করবো। এমনিতেই কদিন যাবৎ শরীরটা দুর্বল। তার উপর এখন এসব শুনে মনে হচ্ছে আমি আবারও যেকোনো সময় মাথা ঘুরে পড়ে যাবো।

বাসায় থেকে যদি শুনতে পারে এসব তাহলে কি হবে। পুলিশ আমাকে ধরে নিয়ে এসেছে তাও আবার মার্ডার কেসের দায়ে। কি করবো এখন।কাকে বলবো। উফ, মাথা কাজ করছে না।

আর কিছু না বুঝে প্রিয়ন্তীকে থানায় আসার জন্য একটা মেসেজ করি। অফিসার আরিফুল ইসলাম তা ভালো ভাবেই বুঝতে পারলেন। তিনি অবশ্য কিছু বললেন না।

এরপর তিনি আমার দিকে এক গ্লাস পানি এগিয়ে দিয়ে বললেন,

শুনুন ম্যাডাম। আপনি খুনটা করেছেন কি করেন নি সে প্রসঙ্গে আমি যাচ্ছি না। আমি আপনার থেকে পুরো গল্পটা শুনতে চাচ্ছি, যেটাতে কোনো মিথ্যা থাকবে না। আপনি কিছুই করেন নি, কিছুই জানেন না দয়া করে এসব বলে অযথা সময় নষ্ট করবেন না। আপনি যতটা জানুন ততটাই বলুন।

পানি খাওয়ার পর আমি দু মিনিট সময় নিলাম। ঠিক করলাম রায়হান হাসান সম্পর্কে আমি যতটুকু জানি তার পুরোটাই বলবো।

অতঃপর বলা শুরু করলাম,

রায়হান হাসান খুব ভালো থ্রিলার লিখতেন।আমি তার লেখার ফ্যান ছিলাম। নিয়মিত পড়তাম তার সব লেখা। কিন্তু তখনো জানিনা যে তিনি আমার প্রতিবেশী।

ফেসবুকে খুব কম ছবি শেয়ার করায় তার ফেসটা তখনো দেখা হয় নি। বা বলতে পারেন ছবি দেখার আগ্রহ সেভাবে হয় নি। পরবর্তীতে পরিচয় হওয়ার পর খুব বেশি অবাক হই এটা জেনে যে, আমাদের বাসার পাশেই তিনি থাকেন।

এরপর আমাদের রোজ দেখা হতো। রায়হান গানও খুব ভালো গাইতো। মাঝে মাঝে আমরা ছাদে বসে গল্প করতাম। মাঝে মাঝে রায়হান গান শুনাতো।

কিছুদিনের মধ্যেই আমরা খুব ভালো বন্ধু হয়ে যাই।কিন্তু আমরা শুধু বন্ধুই ছিলাম। এর থেকে বেশি কিছু না। আমরা আগে যে বাসায় থাকতাম সেই বাসায় আমাদের ঠিক বিপরীত পাশে তিনি থাকতেন। তার পরিবার নিয়েই বাসায় থাকার কথা ছিলো।

কিন্তু শুনেছি পরবর্তীতে তার পরিবারের সাথে ঝামেলা হওয়ায় তিনি একাই থাকতেন।অবশ্য তার পরিবারে কে কে ছিলো তা আমি সঠিক জানিনা। কখনো জিজ্ঞেসও করা হয় নি। এর কিছুদিন পর আমরা ওই বাসা ছেড়ে দেই। তখনো রায়হানের সাথে আমার বেশ ভালোই যোগাযোগ ছিলো।

সবকিছু ঠিক ঠাক এবং স্বাভাবিক ঘটনা। কিন্তু এসবের সাথে রায়হানের খুন হওয়ার ঘটনা আর এজন্য আমাকে…

কথাটা শেষ করার আগেই প্রিয়ন্তী আর পিয়াস ভাইয়া এসে পৌঁছলো থানায় । প্রিয়ন্তী এক প্রকার দৌড়ে এসে আমাকে জিজ্ঞেস করছে,

কি হয়েছে? তুই এখানে কেনো?

আমি কিছু বলার আগেই অফিসার প্রিয়ন্তীকে চুপ করে দাঁড়াতে বললেন। আর আমাকে পরের ঘটনা বলতে বলে।আমি আবার শুরু করলাম,

রায়হান যেদিন খুন হয় সেদিন সকালে তার সাথে আমার দেখা হয়েছিলো। সে আমাকে অদ্ভুত কিছু কথা বলছিলো ফোনে। যা শুনে আমি প্রচন্ড পরিমানে রেগে যাই এবং ওই মুহূর্তেই আমি তার বাসায় যাই। আমার কথা বিশ্বাস না হলে আপনি প্রিয়ন্তীকে জিজ্ঞেস করতে পারেন।

ওই সময় প্রিয়ন্তী আমাদের বাসায়ই ছিলো। আমি এতো টাই রেগে গিয়েছিলাম যে ওকে আমাদের বাসায় রেখেই রায়হানের বাসায় চলে যাই। গিয়ে দেখি রায়হান ছাদের এক কোণায় কার্নিশের কাছে বসে লেখালেখি করছিলো।

এরপর আমি বলার আগেই অফিসার নিজে বলা শুরু করলো,

আর তারপর সেই রাগ থেকেই আপনি প্রথমে তার লেখার কাগজ গুলো ছিড়ে ফেললেন। এরপর পাশে থাকা গ্লাস থেকে তার শরীরে পানি ছুড়লেন।

এরপরও আপনার রাগ না কমায় হাতাহাতি শুরু করলেন। হাতা হাতির এক পর্যায়ে আপনি তাকে ছাদের খুব কাছে নিয়ে গেলেন। কারন আপনি খুব ভালো করেই জানতেন যে তার ‘এ্যাক্রোফোবিয়া’ আছে। উচ্চতা ভীতি তার মধ্যে খুব বেশি।

তাই আপনি ইচ্ছাকৃত ভাবে তাকে ছাদের এক কোণায় নিয়ে গেলেন এবং ছাঁদ থেকে নিচের দিকে তাকিয়ে তার ভয় পাওয়া অসহায় দুর্বল শরীরটাকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিলেন। ঠিক বললাম তো?

না অফিসার। নিজের মন গড়া গল্প বলে আপনি আমার সম্পর্কে যা ইচ্ছা তাই বলতে পারেন না।

প্রিয়ন্তীর মুখটা হঠাৎ দমে গেলো। পিয়াস ভাইয়া আমার দিকে অসহায়ের মতো তাকিয়ে আছে। খুব সম্ভবত তারাও এখন এই অফিসারের কথাগুলো বিশ্বাস করছে। ভাইয়া এমনিতেই আমাকে দেখতে পারে না।

তবুও যে আমার জন্য এখানে এসেছে এটাই অনেক। কিন্তু আসার পর যা যা শুনলো তার পর না জানি আরও কতটা খারাপ ভাববে আমাকে। সত্য মিথ্যার যাচাই পরের ব্যাপার।

কিন্তু আমার বাসার লোকজন, আত্নীয় স্বজন, প্রিয়ন্তীর বাবা মা সবাই আমাকে কতটা খারাপ ভাববে।

এক মূহুর্তের জন্য মনে হলো কোনো এক অলৌকিক ক্ষমতায় যদি পৃথিবীর সময়টা হঠাৎ থমকে যেতো। পৃথিবীর আর কোনো ভবিষ্যৎ বর্তমানে পরিণত না হতো।

নিজেকে এতো বেশি অসহায় লাগছিলো যা বলে বুঝানোর মতো না। আমার দিকে তাকিয়ে প্রিয়ন্তীর চোখ ছলছল করছিলো। খানিকটা এগিয়ে এসে ইশারায় আমাকে শান্ত হতে বললো।

হঠাৎ পিয়াস ভাইয়া অফিসারকে বললো,

কি এমন প্রমান আছে যে এসবের সাথে অদ্বিতীয়াই যুক্ত আছে? না মানে, অন্য কেউ-উ তো হতে পারে।

রায়হান হাসান খুন হওয়ার আগে শেষবার যার সাথে দেখা হয়েছিলো সেই মেয়েটি অদ্বিতীয়া। শেষবার কথাও হয়েছিলো অদ্বিতীয়ার সাথে।

হ্যাঁ, তো? এর দ্বারা কি বা প্রমান হয়?

ঘটনাস্থলে আমরা অদ্বিতীয়ার ফোনের সিম কার্ড পেয়েছি। তারপর রায়হান হাসান যখন ছাদে বসে লেখালেখি করছিলেন তখন সেখানে থাকা কাচের গ্লাসটিতে আমরা যার হাতের ছাপ পাই তা অদ্বিতীয়ার-ই। সেখানে পড়ে থাকা আংটি, হাতের ছাপ, সিম কার্ড এতো এতো সব কিছু তো আর মিথ্যা হতে পারে না তাই না।

আচ্ছা ম্যাডাম অদ্বিতীয়া, রায়হান হাসানের সাথে আপনার সম্পর্কটা কি শুধু মাত্র বন্ধুত্ব পর্যন্তই ছিলো নাকি অন্য কোনো ব্যাপারও ছিলো? যার কারনে হয়তো সে আপনাকে ব্ল্যাকমেইল করার একটা পথ খুঁজে পেয়েছিলো। আর তাই আপনি তাকে…

পুলিশ অফিসারের আমাকে নিয়ে বলা শেষ কথাটা পিয়াস ভাইয়া শেষ করতে দিলো না।

তার আগেই তিনি অফিসারের উপর রেগে গেলেন। আমি আর প্রিয়ন্তী মিলে কোনো রকমে ভাইয়াকে শান্ত করলাম। এদিকে আরিফুল ইসলাম তো রাগে ফুঁসছিলেন শুধু। তাকে দেখে মনে হচ্ছিলো পারলে তিনি আমার বদলে পিয়াস ভাইয়াকেই আটকে রাখবেন।

আমি বললাম, দেখুন অফিসার, রায়হান হাসানের সাথে আমার সম্পর্কটা কেবল বন্ধুত্বের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিলো। এখন আপনি জোর করে অন্য কিছু তৈরী করতে চাইলে তো হবে না।

এটা একদম সত্যি কথা। আরও একটা সত্যি কথা হচ্ছে তার মার্ডার হওয়ার পেছনে আমার কোনো রকম ভূমিকা নেই। আপনি অযথা সময় নষ্ট করছেন।

আমার সময় নিয়ে আপনাকে ভাবতে হবে না মিস অদ্বিতীয়া। এখন আপনি আপনার এই প্রানপ্রিয় বান্ধুবী আর তার ভাই মিলে নিজেকে নির্দোষ প্রমান করার কথা ভাবুন। তাতেই বরং আপনার লাভ হবে।

কিভাবে কি করবো কিছুই বুঝতাছি না। নিজেকে নির্দোষ প্রমান করার জন্য হলে তো আমাকে বাইরে থাকতে হবে।

আমি জানি এই কাজটা খুব কঠিন, তবু নিজের উপর আমার সম্পূর্ণ ভরসা আছে। এতক্ষণে অফিসার আরিফুল ইসলামও হয়তো কিছুটা তা বুঝতে পেরেছে। কিন্তু কি করে বের হবো বাইরে। এরা যা প্রমান পেয়েছে তারপর আমাকে ছাড়বে তো দূর, সারাজীবন এখানেই না রেখে দেয়।

প্রিয়ন্তী এতক্ষণ পর হঠাৎ কথা বললো,

রায়হান হাসান খুন হওয়ার দিন আমি অনুর বাসায় যাচ্ছিলাম। রাস্তায় রায়হানের বন্ধু হাবীবের সাথে আমার দেখা হয়েছিলো। আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘কোথায় যাচ্ছো?’ – সে বললো, রায়হানের বাসায় যাচ্ছে ৷

কি না কি দরকারি কাজ আছে। সে কি তবে গিয়েছিলো? কোথাও এমনটা নয় তো যে, এসবের পিছনে সেই জড়িয়ে। খামোখা অনুকে হ্যারাজমেন্ট করছেন। আপনারা তার কাছে কেনো যাচ্ছেন না।

আমরা তাকে থানায় ডেকেছি। নিশ্চই খুব দ্রুতই সে চলে আসবে।

আমরা সবাই হাবীবের জন্য অপেক্ষা করতে লাগলাম। এর মধ্যে পিয়াস ভাইয়ার কি একটা কাজ পড়ে যাওয়ার সে বেরিয়ে যেতে চাইলো।

চলে যাওয়ার আগে ভাইয়া সবার চোখকে ফাঁকি দিয়ে আমার হাতে একটা ফোন ধরিয়ে দেয়। আর বলে এটাকে সাবধানে নিজের কাছে লুকিয়ে রাখতে।

পুলিশ অফিসার কোথায় কখন কি করছে তা একটু খেয়াল রাখতে এবং তা এই ফোনের মাধ্যমে জানাতে।

আমাকে যদি বাইরে না যেতে দেওয়া হয় তাহলে এই ফোনটাই হবে থানার ভিতর আর বাইরের মধ্যে যোগাযোগ রাখার এক সুক্ষ মাধ্যম। কারন, অনুর নিজের ফোনটি আপাতত পুলিশ হেফাজতে আছে।

আমি অবাক হয়ে পিয়াস ভাইয়ার দিকে তাকিয়ে রইলাম। এতো ভাবেন তিনি আমাকে নিয়ে। অথচ এতোদিন ধরে আমি কি না ভাবতাম ভাইয়া আমাকে একদমই পছন্দ করে না।

বের হওয়ার সময় দরজা থেকে তিনি আরও একবার আমার দিকে তাকালেন । মুখ দেখে মনে হচ্ছিলো তিনি কিছু একটা বলতে চাইছেন কিন্তু সময় এবং পরিস্থিতি তার কথাগুলোকে বার বার আটকে দিচ্ছে। তার সহানুভূতি দৃষ্টি পর্যবেক্ষণে আমার নিজের অজান্তেই হঠাৎ করে চোখ থেকে টুপ করে দু-ফোঁটা নোনতা অশ্রু গড়িয়ে পড়লো।

এই মুহূর্তটাও পিয়াস ভাইয়ার নজর এড়ালো না। সে চোখের ইশারায় আমাকে খানিকটা আশ্বস্ত করে বেরিয়ে পড়লো।

কিছুক্ষণের মধ্যে হাবীব চলে এলো। অফিসার আরিফুল ইসলাম তার মতো করে জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করলো,

তো বলুন, মিস্টার হাবীব ওয়াহিদ। ২৮ জুলাই সকাল বেলা আপনি রায়হান হাসানের বাসায় কেনো গিয়েছিলেন?

রায়হান আমার খুব ভালো বন্ধু ছিলো। তার বাসায় যেতে নির্দিষ্ট কারন খুঁজতে হবে এমনটাও না। আমি যে কোনো সময় তার বাসায় যাওয়া আসা করতাম।

হাবীব সাহেব ,আপনি ভুলে যাবেন না আপনাকে একটা মার্ডার কেসের জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ডাকা হয়েছে। আপনাকে জিজ্ঞেস করা হয়েছে ঠিক কোন কারনে আপনি তার বাসায় গিয়েছিলেন যে পথিমধ্যে প্রিয়ন্তীর সঙ্গে সামান্য দুটো কথা বলতেও প্রচন্ড তাড়া ছিলো আপনার।

বলুন।

ওকে বলছি।

২৭ জুলাই রাতে রায়হানের সাথে আমার একটু ঝগড়া হয়। আর ওতো আমার বন্ধু ছিলো, তাই না। তাই রাতের রাগারাগি ঝামেলা মিটাতেই আমি ওর বাসায় সেদিন গিয়েছিলাম।

ঝগড়া বা রাগারাগির কারনটা কি ছিলো?

জ্বি, তেমন সিরিয়াস কিছু না। এমনি বন্ধুদের সাথে তো কত রকম বিষয় নিয়ে কথা কাটাকাটি হয় তেমনি।

হাবীবকে দেখে মনে হচ্ছিলো সে প্রচন্ড রকম ভয় পাচ্ছে। আমার অবশ্য বেশ হাসি পাচ্ছিলো। আসলে সিরিয়াস মোমেন্টে ফিক করে হেসে ফেলে অন্যের সমস্যা নিজের ঘাড়ে বইবার অসীম ক্ষমতা আছে আমার।

তবে এ ব্যাপারে আমার নিজের উপরেই যথেষ্ট প্যারা যাচ্ছে। নতুন করে আর নিজের ঝামেলা বাড়াতে ইচ্ছুক নই বলে খুব কষ্টে হাসি চেপে রাখতে হচ্ছে।

হাসি পাওয়ার মূল কারন হচ্ছে, তাকে সামান্য জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে তাতেই এতোটা ভয় পাচ্ছে যে মাত্র দশ মিনিটেরো কম সময়ের মধ্যে তিন গ্লাস পানি শেষ করে ফেলেছেন।

যাইহোক গ্লাসের শেষ পানিটুকু শেষ করার পর অফিসার আবারও তার কাছে ঝগড়ার কারনটা জানতে চাইলেন। হাবীব বলতে লাগলো,

রায়হানের মতো আমিও লেখালেখি করি। কিন্তু তার মতো অতো জনপ্রিয়তা আমার নেই। আর থ্রিলার আমিও খুব ভালোবাসি। যদিও আমি থ্রিলার লিখতে পারি না। আমি অন্যান্য বিষয়ে লিখতাম। রায়হানের দু-লাইনের খুব ছোট একটা লেখা আমি আমার ফেসবুক ওয়ালে ক্যাপশন হিসেবে পোস্ট করি।

কিন্তু ক্রেডিট দেই নি। আসলে ইচ্ছে করেই দেই নি। নিজের ওয়ালে অন্য কারও নামের ট্যাগ বসানো টা আমার পছন্দ না।

তাই রায়হান আমাকে ফোন দিয়ে বললো, কার্টেসী ছাড়া বা অনুমতি ছাড়া কোনো লেখা কপি করলে তাকে চোর বলা হয়। ব্যাস, আমার মাথা গরম হয়ে গেলো। এরপর ই দুজনের ঝগড়া লেগে গেলো।

কিন্তু অফিসার,পরে আমি বুঝতে পেরেছিলাম যে আমিই ভুল করেছি। আর এজন্য লেখাটা ডিলিট করে দেই আর ওকে সরি বলার জন্য ওর বাসায় যাই।

কিন্তু ওর বাসায় গিয়ে আমি ওকে পাইনি। ঘরের দরজা খোলাই ছিলো। কিন্তু ভেতরে রায়হান ছিলো না। এজন্য আমি বের হয়ে যাই এবং নিজের বাসায় ফেরত আসি।

মিস্টার হাবীব, লাস্ট কথাটার আগে পর্যন্ত আপনি হয়তো সত্যি বলেছেন। কিন্তু আপনার বলা শেষ কথাটা আমি মানতে পারলাম না। রায়হান হাসানের রুমের দরজা খোলা কিন্তু ভিতরে সে ছিলো না। আপনি ভাবলেন সে হয়তো দরজা খোলা রেখে ছাদে গেছে।

আর তারপর আপনি ছাদেও গেলেন। কিন্তু আপনি তখনো জানতেন না যে তার কিছুক্ষণ আগেই রায়হান হাসান ছাদ থেকে পড়ে মারা যায়। আই মিন কেউ তাকে ইচ্ছে করে ফেলে খুন করে।

কিন্তু আপনি ছাদে যাওয়ার ব্যাপারটা বললেন না কেনো লেখক সাহেব। বলুন।

আমি মনোযোগ দিয়ে দুজনের কথা শুনছিলাম। অফিসার আরিফুল ইসলাম যে হাবীবের না বলা কথাটা ধরে ফেলবেন সেটা হয়তো বেচারা লেখক আন্দাজও করতে পারেনি।

আরও এক গ্লাস পানি লেখক হাবীব ওয়াহিদ চেয়ে নিলেন। পুরো গ্লাসের পানি এক নিঃশ্বাসে এমন ভাবে শেষ করে ফেললেন যেনো সারাদিন তৃষ্ণার্ত থাকার পর প্রথম গ্লাস পানির দেখা পেয়েছেন।

পানি খাওয়া শেষে হাবীব যা বললো তা শোনার জন্য পুলিশ অফিসার আরিফুল ইসলাম কিংবা আমি নিজেও হয়তো প্রস্তুত ছিলাম না।

আমি তাদের দুজনের কথোপকথনে আরেকটু মনযোগী হলাম। তিনি বললেন,

স্যার, রায়হান-কে আমি মেরেছি। আমিই তাকে ছাদ থেকে ধাক্কা মেরে ফেলে দেই। (হাবীব)

হোয়াট? আপনি জানেন আপনি কি বলছেন? (অফিসার)

হ্যাঁ, স্যার। আমি আমার দোষ স্বীকার করছি।

এই জঘন্যতম কাজ করে আমি এক মুহূর্তের জন্যও শান্তি পাচ্ছি না। আমার শাস্তি পাওয়া উচিত।

আচ্ছা, ধরে নিলাম আপনি তাকে ধাক্কা দিয়ে ছাদ থেকে ফেলে দিয়েছেন। কিন্তু তাহলে রায়হানের বডিতে বা ঘটনাস্থলে কোথাও আপনার হাতের ছাপ বা কোনো রকম উপস্থিতি পাওয়া যায়নি কেনো? (অফিসার)

কারন আমি হ্যান্ড গ্লাবস পড়া ছিলাম। হ্যান্ড গ্লাবস দেখে রায়হান অবশ্য মুচকি হেসেছিলো। কিন্তু তখন তো আর সে জানতোনা যে, এটাই তার জীবনের শেষ হাসি।

আপনি যে ছাদে গিয়েছিলেন এটা তো আমরা বুঝতে পেরেছি ছাদে আপনার জুতোর ছাপ দেখে। আচ্ছা এখন আপনি এটা বলুন যে, আপনি রায়হান হাসানকে মারলেন কেনো?

সে তো আপনার বন্ধু ছিলো? (অফিসার)

ওই তো, বললাম না আমি ওর উপর খুব রেগে ছিলাম। তারপর রুমে ওকে না পেয়ে ছাদে যাই আর দেখি রায়হান তার নতুন থ্রিলার বইয়ের পান্ডুলিপি প্রস্তুত করছে।

রাগ নিয়ন্ত্রনে না নিতে পারায় এক পর্যায়ে আমাদের মধ্যে হাতাহাতি শুরু হয়ে যায়। আর তখন ভুল বশত পেছন থেকে জোরে আঘাত করে ফেলি।

এদিকে রায়হান ছাদের কার্নিশের ধারে চলে যায়। তার মধ্যে ওর উচ্চতা ভীতি ছিলো। একদিকে নিজের তাল সামলানো কষ্ট হয়ে পড়ে আর অন্য দিকে ‘এ্যাক্রোফোবিয়া’-র ভীতি।

ফলাফল কয়েক সেকেন্ডের ব্যবধানে সে নিচে পড়ে যায়। আর তারপর আমি দৌড়ে নিচে নেমে স্বাভাবিক ভাবে অন্য সব মানুষদের সাথে ভিড় ঠেলে লাশ দেখতে চলে যাই।

রাগে নিজের বন্ধুকেই মেরে দিলেন। বাহ্।

তা মারলেনই যখন, আবার এতো সহজে নিজের মুখে স্বীকার-ই বা করছেন কেনো হঠাৎ? উদ্দেশ্যটা কি আপনার? (অফিসার)

কোনো উদ্দেশ্য নেই অফিসার। অপরাধবোধে আমি এক দন্ড শান্তি পাচ্ছি না। ঘুমুতে পারছি না, খেতে পারছিনা, লেখাতে মনোযোগ দিতে পারছি না।

দুদিনেই আমার জীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে। তাই ঠিক করলাম নিজে থেকে সবটা জানাবো আপনাদের। আমি দোষী, আমি অপরাধী। আপনারা আমাকে শাস্তি দিন, অদ্বিতীয়াকে ছেড়ে দিন। তার কোনো দোষ নেই।

লাস্ট কথাটা শুনে হা করে লোকটার দিকে তাকিয়ে রইলাম। আরেহ্, কি বলছে এই লোকটা। পাগল টাগল হয়ে গেলো নাকি। অফিসার আরিফুলও আমার দিকে কেমন সন্দেহের দৃষ্টিতে তাকাচ্ছেন।তারপর মিনিটখানিক চোখ বন্ধ করে চুপচাপ বসে রইলেন।

এরপর হাবীবের দিকে তাকিয়ে পুনরায় প্রশ্ন করলেন,

যদি আপনিই রায়হান হাসানের মার্ডার করে থাকেন তবে ঘটনাস্থল থেকে আমরা অদ্বিতীয়ার জিনিসপত্র পেলাম কেনো? তার হাতের ছাপ, আংটি এসব? (অফিসার)

হতে পারে সেদিন অনুও গিয়েছিলো সেখানে এবং আমি যাওয়ার পূর্বেই আবার চলে গিয়েছিলো। আর আমি যেহেতু গ্লাভস পরে ছিলাম তাই আমার উপস্থিতি আপনারা তেমন ভাবে পান নি সেখানে।

হাবীব সাহেব! গল্পটা বেশ ভালোই। তবে এটা কি সত্যি? আমার কেনো যেনো মনে হচ্ছে, আপনি অদ্বিতীয়াকে বাঁচাতে চাচ্ছেন। আর তাই সব দোষ নিজের কাঁধে নিতে চাইছেন। (অফিসার)

না,স্যার। আমি কেনো তাকে বাঁচাতে চাইবো। আমি তো শুধু নিজের দোষ স্বীকার করছি।  তাছাড়া অদ্বিতীয়া তো আমাকে ঠিক মতো চিনেও না।

এবার আমি মুখ খুললাম।

লেখক হাবীব সাহেব একদম ঠিক বলছেন স্যার।ফেসবুকে তার লেখা আমি মাঝে মাঝে এক দুবার পড়েছি । এছাড়া তার সাথে আমার তেমন পরিচয় হয় নি কখনো।

পুলিশ অফিসার হয়তো আমার কথা তেমন বিশ্বাস করলেন না। তিনি এখনো কিছুটা সন্দেহের চোখে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন। তারপর হাবীব সাহেবকে বললেন,

দেখুন লেখক সাহেব, আপনার কথার কোথাও একটা খাপছাড়া ভাব আছে। হিসেবটা আমার কাছে ঠিক মিলছে না৷ আপনি বললেন, আপনি আপনার বন্ধুর উপর রেগে ছিলেন।

তাও একটা সামান্য বিষয় নিয়ে। তার লেখায় ক্রেডিট দেওয়া হয়নি তাই সেটা নিয়ে ঝগড়া । পরের দিন আপনি সরি বলার জন্য গেলেন। আপনি তো তাকে মেরে ফেলার উদ্দেশ্যে যান নি। তাহলে হ্যান্ড গ্লাবস-ই বা কেনো পরেছিলেন? (অফিসার)

ইয়ে না মানে..মানে হচ্ছে যে…

প্রফেশনাল ভাবে যারা মার্ডার করেন তারাও একটা খুন করার আগে পূর্ব পরিকল্পনা করেন। আর আপনি তো সেখানে…

সমস্ত ব্যাপারটা আমার কাছে ধোঁয়াশার মতো লাগছে। হাবীব ওয়াহিদের ব্যাপারটা ঠিক বুঝতে পারছি না। আসলেই কি তিনি এই মার্ডারের সাথে জড়িত। নাকি কোনো কারনে মিথ্যা বলছেন।

কিন্তু তিনি মিথ্যা বলবেন কেনো। তাও আবার এই রকম একটা ব্যাপারে। যেখানে আমি নিজেকে বাঁচানোর জন্য এত কিছু ভেবে চলেছি। আর সেখানে তিনি কিনা নিজেই নিজেকে অপরাধী প্রমান করতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন।

এদিকে পুলিশ অফিসারও তার বলা কথাগুলোকে শতভাগ সত্যি বলে বিশ্বাস করতে চাইছেন না। মানব মস্তিষ্ক হয়তো আসলেই সত্যকে সহজে গ্রহন করতে জানে না। যদি হাবীব সাহেবের বলা এসব কথা গুলোই পুলিশ তদন্ত করে জানতে পারতো, তাহলে তাকেই আসল অপরাধী হিসেবে এতক্ষনে প্রমান করে ফেলতো তারা।

আজব দুনিয়া! আজব মানুষ সব!

হঠাৎ পিয়াস ভাইয়ার মেসেজ। আমি ছোট করে মেসেজের রিপ্লাই দিয়ে হাবীবের ব্যাপারটা ভাইয়াকে জানালাম। ক্ষুদে বার্তায় তথ্য আদান-প্রদানে ভাইয়ার রিয়েকশনটা ঠিক বুঝা গেলো না।

আরিফুল ইসলাম আমার দিকে এগিয়ে আসছেন দেখে ফোনটা খুব সাবধানে আড়াল করলাম। কে জানে তিনি দেখে ফেলেছেন কি না। উনার যা দৃষ্টি শক্তি আর পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা।

সবার কথা বলার ধরনেই বুঝে যান কোন কথাটা সত্যি বলছে আর কোনটা মিথ্যা। আচ্ছা, তাহলে আমি যে সত্যি বলছি তা তিনি কেনো বুঝতে পারছেন না। এই বিষয়টা মাথায় আসতেই নিজেকে পুনরায় অসহায় লাগা শুরু হলো।

যাক গে, পুলিশ অফিসার খুব স্বাভাবিক ভঙ্গিতেই আমার সামনে এসে দাঁড়ালেন। তার মানে লুকোনো ফোনটার ব্যাপারে এখনো অব্দি কিছু বুঝতে পারেন নি তিনি। আমাকে উদ্দেশ্য করে বললেন,

আচ্ছা মিস অদ্বিতীয়া অনু।

বলুন তো, হাবীব ওয়াহিদ কি সত্যি সত্যি এই খুনটা করেছে নাকি সে আপনাকে বাঁচাতে চাইছে? (অফিসার)

তা আমি কি করে জানবো। উনি সত্যি বলছে নাকি মিথ্যা বলছে তা আপনারাই ভালো জানেন। তবে সে যখন নিজের দোষ স্বীকার করে নিচ্ছে তাহলে অযথা আমাকে এখানে কেনো আটকে রেখেছেন। সামান্য কয়েকটা জিনিসের উপর ভিত্তি করে আপনারা এভাবে আমাকে আটকে রাখতে পারেন না।

ইতোমধ্যে আমার জবানবন্দি আপনাদেরকে দিয়েছি। তাছাড়া আমি তো এ শহর ছেড়ে পালিয়ে যাচ্ছি না। আপনারা যে কোনো সময় ডাকলেই আমি চলে আসবো।

তা না হয় বুঝলাম। কিন্তু যে সিম কার্ডটির জন্য আপনি এই কেসে অপরাধী হিসেবে থানায় আসলেন সেই সিম কার্ডটি কোথায়? ৷ (অফিসার)

সিম কার্ড আমার ফোনেই আছে। এক্ষুনি দিচ্ছি।

কিন্তু ব্যাপার টা হলো যে, আরিফুল ইসলামের টেবিলে থাকা আমার ফোনটার মধ্যে কাঙ্খিত সিমকার্ডটি পাওয়া গেলো না।

উফ, এতো অল্প সময়ের মধ্যে সিম কার্ডটা কোথায় গেলো।আমার ফোনেই তো থাকার কথা।

অফিসার আমার উপর খুব রেগে গেলেন। জিজ্ঞেস করলেন, ফোন থেকে গত দুদিনের মধ্যে কোনো সিমকার্ড খুলেছি কি না বা নতুন কোনো সিম কার্ড তুলেছি কি না।

কিন্তু আমার তো একবারও মনে পড়ে না গত এক দুদিনের মধ্যে ফোন থেকে সিম কার্ড খুলেছি যে। তাছাড়া দুটো সিমের মধ্যে আমি একটা সিম কার্ড ইউজ করছি এই ব্যাপারটাই তো মাত্র খেয়াল করলাম।

তাও আরিফুল ইসলাম বলার পরে বুঝতে পারলাম। এখন যদি এটা এখানে বলি, এরা আমার কথা বিশ্বাস করবে তো দূর উল্টে আরও হাসবে সবাই।

ধূুর, অসহ্য লাগছে সবকিছু। সবদিক অগোছালো আর এলোমেলো লাগছে। এই কয়েকদিনের অসুস্থতায় আমার জীবনটাকে একদম উলট পালট করে দিলো।

কত কিছু ভুলে গেলাম। কত ভুলে জড়িয়ে গেলাম। এখন কি বলবো এদের আমি।

এর মধ্যে এক কনস্টেবল এলো রায়হান হাসানের পোস্টমর্টেম রিপোর্ট নিয়ে। রিপোর্ট দেখে আরিফুল ইসলামকে বেশ অবাক হতে দেখা গেলো। তিনি রিপোর্টের উপর থেকে চোখ সরিয়ে সবার দিকে একবার করে তাকালেন।

এরপর আবার রিপোর্টে দৃষ্টি নিক্ষেপ করলেন। রিপোর্ট দেখা শেষ হলে তিনি ডেস্কের উপর রেখে যা বললেন তা হলো এই যে…

রায়হান হাসানের কি ‘এপিলেপসি’ ছিলো?

আমি বললাম,

আমার জানা মতে ছিলো না। হাবীব সাহেব যেহেতু তার ভালো ভালো বন্ধু ছিলেন, আমার চাইতে সে হয়তো ভালো বলতে পারবে। অতঃপর অফিসার  হাবীবের উত্তর জানার জন্য তার দিকে  তাকালেন। উত্তরে হাবীব সাহেব বললেন,

না স্যার। আমি যতদূর তাকে জানি তাতে এপিলেপসি বা মৃগী রোগ রায়হানের ছিলো না।

আরিফুল ইসলাম খানিক কপাল কুঁচকে আবারও প্রশ্ন ছুড়লেন,

আচ্ছা, তিনি কি ‘ডিমেনশিয়া’ বা ‘আলঝেইমার্স’ এসব কোনো সমস্যায় ভুগছিলেন?

প্রশ্নটা নির্দিষ্ট করে কাউকে করা হয়নি বলে আপাতত আমরা দুজনেই চুপ করে আছি। মিনিট খানিক আমাদের চুপ থাকতে দেখে আরিফুল ইসলাম কথা বাড়াতে থাকলেন,

আমি কি জিজ্ঞেস করছি তা যদি না বুঝে থাকেন তাহলে সরাসরি বুঝিয়ে বলছি।

‘ডিমেনশিয়া’ হলো এমন একটি রোগ যেটা মস্তিষ্কের কার্যক্ষমতার উপর দারুন প্রভাব ফেলে। যার ফলে সে অনেক কিছুই মনে রাখতে পারে না।  ‘আলঝেইমার্স ডিজিস’ ও এমন একটি রোগ।

যেটা কয়েক বছর ধরে আস্তে আস্তে বাড়তে থাকে। যার ফলে কোনো ছোট খাটো ঘটনা থেকে শুরু করে অনেক কিছুই তারা ভুলে যেতে পারে। আর আপনারা তাকে বেশ কয়েক বছর ধরে চিনেন। এবার বলুন এমন কোনো সমস্যা কি রায়হান হাসানের ছিলো?

লেখক হাবীব সাহেব এর মধ্যেই মুখ খুললেন।

তিনি বললেন,

স্যার, এমন কোনো রোগ ওর ছিলো না। কোনো কিছু ও সহজে ভুলে যেতো না। বরং অনেক দিন পর্যন্ত মনে রাখতে পারতো।

মনে হচ্ছে হাবীবের উত্তর শুনে আরিফুল ইসলাম সন্তুষ্ট হতে পারলেন না। তিনি হয়তো ভেবেছিলেন হাবীব সাহেব ‘হ্যাঁ’ বলবেন। তারপর তিনি আমাকে জিজ্ঞেস করলেন,

মিস অদ্বিতীয়া, একটু ভালো করে ভেবে দেখুন তো। এমন কোনো সমস্যায় তিনি ভুগছিলেন কিনা? (অফিসার)

আমি একটু সময় নিয়ে মনে করতে লাগলাম,

লাস্ট এক সপ্তাহে রায়হানের মধ্যে খুবই সুক্ষ্ম একটা পরিবর্তন পেয়েছিলাম। কিন্তু তখন তেমন পাত্তা দেই নি। এখন তো মনে হচ্ছে খেয়াল করাটা জরুরি ছিলো।

কি ধরনের পরিবর্তন? (অফিসার)

রায়হান সহজে কোনো কিছু ভুলে যেতো না। তার বহু পুরাতন গল্প লেখার ডায়েরি, তার লেখা গানের খাতা সব কিছুই সব সময় যত্ন করে রাখতো।নিয়মিত সেগুলা আলমারি থেকে নামিয়ে পরিষ্কার করতো।

কিন্তু লাস্ট এক সপ্তাহ সে ছোট ছোট অনেক কিছুই ভুলে যেতে থাকে।

যেমন রায়হান মারা হওয়ার কয়েকদিন আগে আমি আর আমার এক বন্ধু তার বাসায় গিয়ছিলাম।,

তখন আমাকে দেখে সে বলছে

কে আপনি? আমি তো রীতিমতো অবাক।

ভাবলাম হয়তো মজা করে বলছে।

কিছুক্ষণ বসেছিলাম সেখানে। এর মধ্যে রায়হান একটাও কথা নিজে থেকে বলেনি। তারপর উঠে রান্না ঘরে চা করতে গেলো। অনেকক্ষণ হওয়ার পরেও রায়হান ফিরলো না দেখে আমরা চলে আসার সিদ্ধান্ত নেই। দরজা পর্যন্ত এসে মনে হলো রায়হানকে বরং বলেই যাই, না বলে যাওয়াটা কেমন দেখায়।

তারপর রান্না ঘরে গিয়ে দেখি সে তিনটে চায়ের কাপে মরিচ গুড়ো দিচ্ছে। এদিকে চুলোয় বসানো গরম পানিতে চা পাতি দেওয়ার পর আবার হলুদ দিচ্ছে। এই দৃশ্য দেখে অবাক হবো কি, হাসতে হাসতে শেষ আমরা।

বলেন কি?  চায়ের কাপে মরিচ গুড়ো, পাতিলে আবার হলুদ গুড়ো। (অফিসার)

হ্যাঁ স্যার। আমরা তো এই বিষয়টা নিয়ে পরে বন্ধুদের সাথে মজাও করেছি।

কিন্তু আপনার কথা অনুযায়ী আসলে রায়হান অসুস্থ ছিলো। ইশ, কেনো যে তখন বিষয়টা খেয়াল করলাম না।

তার মানে আপনি বলতে চাইছেন যে, রায়হান হাসানের এই সমস্যাটা রিসেন্ট হচ্ছিলো। আগে থেকে ছিলো না। তাই তো? (অফিসার)

একদম তাই।

কিছু তো একটা ঝামেলা আছেই। হাবীব সাহেব আপনার বন্ধুর এরকম কোনো পরিবর্তন আপনার নজরে কখনো আসেনি? (অফিসার)

না স্যার। আমি সেভাবে কখনো খেয়াল করি নি। আমার কাছে তো সব স্বাভাবিক – ই লাগছিলো।

অফিসার নিজের চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বিড় বিড় করে বলতে লাগলেন,

রায়হান হাসান ডিমনেশিয়া বা আলঝেইমার্স ডিজিজে আক্রান্ত ছিলেন না। তার এই ভুলে যাওয়ার সমস্যাটা রিসেন্ট হচ্ছিলো। মানে দাঁড়াচ্ছে এটাই যে, কেউ ইচ্ছে করে তাকে সব কিছু ভুলিয়ে দিতে চাইছিলো।

কেউ একজন চাইছিলো যে তার শর্ট টাইম বা লং টাইম মেমোরি লস হোক।

কিন্তু তার উদ্দেশ্যটা কি ছিলো?

আচ্ছা, মিস অদ্বিতীয়া অনু আর লেখক হাবীব সাহেব আপনারা এখন যেতে পারেন। কিন্তু প্রয়োজনে আপনাদের আবার ডাকা হবে। (অফিসার)

আমরা এক সঙ্গে অবাক হয়ে আরিফুল ইসলামের দিকে তাকিয়ে রইলাম। উনি আমাদের যেতে দিচ্ছেন। সিরিয়াসলি।

কিন্তু আপনি তো বলেছিলেন আমার নামে নাকি এরেস্ট ওয়ারেন্ট আছে। তাহলে আমাকে যেতে দিচ্ছেন কেনো হঠাৎ?  (অনু)

অফিসার নিজের মুখে এক প্রশস্ত হাসির রেখা ধরে রেখে বললেন, ওইটা এমনি বলেছিলাম। জবানবন্দির জন্য আপনাকে আমাদের প্রয়োজন ছিলো।

কিন্তু আপনি সীম কার্ড খুলে রাখায় আপনার ফোন বার বার অফ দেখাচ্ছিলো। যার কারনে আপনাকে রাস্তা থেকেই তুলে আনতে হলো। আর পুলিশের এতোটা সময় নষ্ট করার জন্য একটা ছোট্ট মিথ্যা বলে একটু টেনশনে রেখেছিলাম।

আপাতত আপনাকে যেতে দিচ্ছি। তবে সিম কার্ডটি দিয়ে যাবেন কালই। আর এই শহর ছেড়ে কোথাও যাওয়ার চেষ্টা করবেন না। নয়তো জেলের ভিতর বসিয়ে রাখবো।

এদিকে অদ্বিতীয়াকে যেতে দেওয়ায় হাবীব সাহেবকে একটু খুশি মনে হলো।

কৌতূহল বশত অফিসারকে একটা কথা জিজ্ঞেস করার অনুমতি চাইলাম,

হাবীব সাহেব তো নিজের দোষ স্বীকার করে নিলেন তাহলে তাকে তো চাইলে আপনারা আটকে রাখতেই পারতেন। না মানে, আমার কথায় অন্য কিছু মনে করবেন না প্লিজ। (অনু)

হ্যাঁ, তা পারি। কিন্তু কথা হচ্ছে যে, ক্রাইম ব্রাঞ্চ এই কেসের ইনভেস্টিগেশন করছে। আর আপনাদের এখানে ডাকা হয়েছিলো শুধু মাত্র জবানবন্দি নেওয়ার জন্য।

রায়হান হাসান খুন হওয়ার সময়ে হাবীব সাহেব মেডিক্যাল হসপিটালে ছিলেন। সেখানে তার এক আত্নীয় অসুস্থ বলে তাকে দেখতে গিয়েছিলেন। তার রিপোর্ট কিছুক্ষণ আগেই আমি পেয়েছি।

তাই আপাত দৃষ্টিতে তার বলা গল্পটা আমাদেরকে মিথ্যা বলে ধরে নিতে হচ্ছে ।  আর এজন্যই তাকে আমরা যেতে দিতে বাধ্য হচ্ছি।

যদি তার বলা গল্পটা মিথ্যা হয় তাহলে ধরে নিতে পারি তিনি আপনাকে বাঁচাতেই এসব বলেছেন। আর যদি সত্যি হয়, তাহলে সেটাও আমরা খুব শিগ্রই খুঁজে বের করবো।

আরিফুল ইসলাম আমার সুইচড অফ ফোনটা ফেরত দিলেন। এরপর থানা থেকে বের হয়ে সোজা বাসায় চলে আসলাম। শরীরটা খুব ক্লান্ত লাগছে। সারাদিন আজ কি সব গেলো।উফ।

রোজ কিছু না কিছু নিয়ে ঝামেলা হচ্ছে তো হচ্ছেই। মানুষের উপকার করতে গিয়ে নিজে উটকো ঝামেলায় ফেসে যাই বার বার। ফ্রেশ হয়ে বিছানায় গা এলিয়ে দিতেই চোখের পাতায় ঘুমের অস্তিত্ব জানান দিতে চাইলো।

এদিকে সারাদিন কিছু খাওয়া হয় নি। এখনো খেতে ইচ্ছে করছে না। মাকে এখনি কিছু বলা যাবে না। নাহলে শুধু শুধু টেনশন করবে। দেখি আগে ঝামেলাটা কোন পর্যন্ত যায়। তারপর না হয় জানলে জানবে। যাইহোক, কোনোমতে খাওয়া দাওয়া শেষ করে ঘুমুতে চলে গেলাম আর খুব দ্রুত ঘুমিয়ে পড়লাম।

ঘুম ভাঙ্গলো একেবারে পরের দিন সকালে। তাও ফোনের রিংটোন শুনে। তাকিয়ে দেখি পুলিশ অফিসার আরিফুল ইসলাম ফোন করেছে।

তিনি বললেন যত তাড়াতাড়ি সম্ভব সিমকার্ড টা নিয়ে থানায় যেতে।

আধঘন্টার মধ্যে নাস্তা করে রেডি হয়ে নিলাম। কাঙ্খিত সীম কার্ডটা নিয়ে বাসা থেকে বের হওয়ার সময় মায়ের বার বার প্রশ্ন, ‘কোথায় যাচ্ছিস’ ‘কেনো যাচ্ছিস’।

বাধ্য হয়ে মাকে থানার কথাটাই বলতে হলো। কিন্তু আমাকে অবাক করে দিয়ে মা এবার কোনো প্রশ্নই করলো না। হয়তো আমার তাড়াহুড়ো দেখে আর কিছু জিজ্ঞেস করে নি। বাসায় আসার পর নিশ্চিতভাবেই সব জানতে চাইবে। আমিও আর কোনো কথা না বলে বের হয়ে এলাম।

মিনিট দশেক পর, সেই অপরিচিত নাম্বারটা থেকে আবার মেসেজ – “এতো তাড়াহুড়ো করে কোথাও বেরুতে নেই, ধীরে সুস্থে চলুন” ৷

ধুর, মেসেজ দেখতে গিয়ে বাসটা মিস করে ফেললাম। এখন বাসের জন্য অপেক্ষা করা লাগবে।

কিন্তু এটা কার নাম্বার। কে আমাকে খেয়াল করছে। কখন কি করছি না করছি সে কিভাবে সব জানতে পারছে। প্রিয়ন্তীকে জানিয়ে কোনো লাভ হয় নি। সে ব্যাপারটা সিরিয়াস তো নেয়-ই-নি। বরং নিজেই হেসে খুন হচ্ছে বার বার।

এর মধ্যে একটা বাস চলে এলো। আমি দ্রুত বাসে উঠে পড়ি। ভাগ্যক্রমে সামনের দিকে একটা সিট পাই। বাসে বসে থেকে একটা কথাই কেবল মাথায় ঘুরছে, গতকাল প্রায় সারাদিনে রাতে এই নাম্বার থেকে একটাও মেসেজ আসেনি।

ফোন তো সারাদিন বন্ধ ছিলো না। তবে কি সে গতকাল আমাকে অনুসরন করেনি? না. কি… গতকাল আমার সাথেই সে ছিলো?

এই অপরিচিত মানুষটি কে হতে পারে?

রায়হান হওয়ার একটা সুযোগ ছিলো যদিও। কিন্ত হি ইজ ডেড।

তবে কে? পিয়াস ভাইয়া?

পিয়াস ভাইয়া হওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম। কারন, আমি এই সমস্যায় না পড়লে ভাইয়া হয়তো আমাকে ভালো করে চিনতোই না।

তবে কি হাবীব ওয়াহিদ?

সে নাকি আমাকে ছাড়ানোর জন্য নিজে দোষ স্বীকার করেছিলো। ব্যাপারটা কি এতোই সহজ?

আমার কেনো যেনো এই লোকটার উপর বেশ সন্দেহ হচ্ছে। মার্ডারের মতো একটা ঘটনা, আর সে কি না আমাকে বাঁচানোর জন্য এমন একটা দোষ নিজের কাঁধে নিয়ে নিবে।

তাও যদি এমন হতো, আমি তার কাছের কেউ তাহলেও একটা কথা ছিলো। মনে হচ্ছে হাবীব সাহেবের মধ্যে কিছু একটা ঝামেলা আছে। কিছু একটা ভুল হয়তো সে করেছে। আর এখন হয়তো খানিকটা অপরাধবোধে ভুগছে৷ যতই হোক বন্ধু ছিলো তো৷

এইসব ঝামেলা থেকে দ্রুত বের হতে চাইলে হাবীব সাহেবের ব্যাপারে একটু খোঁজ নিতে হবে।

ভাবতে ভাবতে বাস হঠাৎ থামলো। তাকিয়ে দেখি স্টপেজে এসে গেছি। এখান থেকে থানা পর্যন্ত মিনিট পাঁচেকের হাঁটা রাস্তা। আমি বাস থেকে নেমে

কয়েক পা এগিয়ে যেতেই অফিসার আরিফুল ইসলাম এর সাথে দেখা। সাথে ক্রাইম বাঞ্চের অফিসার সিফাত আরহাম। তাদের মধ্যে বেশ তাড়াহুড়ো দেখা গেলো।

আমি সিম কার্ডটা দেওয়ার জন্য এগিয়ে গেলাম। ঠিক সে সময় প্রিয়ন্তীর ফোন।   রিসিভ করলাম, কিন্তু ওপাশ থেকে কোনো আওয়াজ এলো না। কেটে দিবো এমন সময় ঝাপসাভাবে আন্টির গলার আওয়াজ শুনতে পেলাম।

আমি প্রিয়ন্তী বলে একবার ডাক দিতেই ওপাশ থেকে ফুঁপিয়ে কান্নার আওয়াজ ভেসে এলো। ফোনটা কেটে ভাবলাম এখান থেকে সোজা প্রিয়ন্তীর বাসায় যাবো।

আরিফুল ইসলাম হয়তো বুঝতে পারলেন আমি প্রিয়ন্তীর বাসায় যাবো। কি মনে করে সিফাত আরহাম আমাকে গাড়িতে উঠতে বললেন। তিনি বললেন,

আমরাও ওদিকটায় যাচ্ছি। লেখক রায়হান সাহেবের বাসায় যাবো। আপনার সমস্যা না থাকলে আমরা আপনাকে হেল্প করতে পারি। তবে তারজন্য আমাদেরকেও একটা হেল্প করে দিতে হবে।

আমি মুচকি হেসে গাড়িতে উঠে বসলাম। বললাম,

সমস্যা নেই। চলুন তবে।

একে তো পুলিশের গাড়ি তাও সঙ্গে আবার দায়িত্বশীল দুজন আইনরক্ষা বাহিনীর সদস্য। প্রথমে একটু ভয় ভয় লাগলেও একটু পরে তাদের দুজনের কথোপকথনে বেশ অবাক হচ্ছিলাম সাথে আবার বেশ হাসিও পাচ্ছিলো।

আশ্চর্য হলেও সত্যি যে, মিস্টার আরিফুল ইসলাম আমার বান্ধবী প্রিয়ন্তীকে নিয়ে কথা বলছিলেন। তাদের কনভারসনের সাউন্ড খুবই অল্প পরিমানে হওয়ায় তাদের কথাগুলো যদিও স্পষ্ট শুনতে পারছি না। চালাকি করে তারা প্রিয়ম্তীর নামও মুখে নেয়নি৷

যদি আবার আমি শুনে ফেলি। বাহ, বাহ, কি বুদ্ধি তাদের! কিন্তু নাম না নিলেও এদিকে তাদের আলাপচারিতা হালকার উপর ঝাপসা আমার কর্ণকুহরে প্রবেশ করেই যে মানুষটি কে হতে পারে তা সম্পর্কে আমার মস্তিষ্ক বুঝে ফেলেছে, সে খবর তো আর তারা জানেনা।

ওয়েট ওয়েট.. তারা আবার আমাকে শুনিয়ে শুনিয়ে ইচ্ছে করেই প্রিয়ন্তীর নামে এসব বলছে না তো, যাতে আমি আবার গিয়ে প্রিয়ন্তীকে সব বলে দেই।

হতেই পারে, আমার বান্ধবী তো আর কম সুন্দরী না৷

দরজার ওপাশে

পুরো একদিন তাকে সরাসরি দেখে হয়তো অফিসারের মাথাটাই ঘুরে গেছে। আমি বরং ভাবছি বান্ধুবীর বয়ফ্রেন্ড যদি একজন পুলিশ অফিসার থাকে, তো বেশ সুবিধাই  হবে।

ইস, যদি এই পুলিশ অফিসারের সাথে প্রিয়ন্তীর আগে থেকে পরিচয় থাকতো তবে গত বছর এক জুনিয়রকে ভয়ংকর ভাবে রেগ দেওয়ার কারনে যে আইনি ঝামেলাটা হয়েছিলো সেটা থেকে অন্তত আমরা রেহাই পেতাম৷

গাড়ি হঠাৎ ব্রেক চাপায় আমার এক সমুদ্র ভাবনার দলও হঠাৎ বাস্তবতায় ফিরে আসতে বাধ্য হলো। সিরিয়াসলি,  সামান্য কোথাকার কথা থেকে কোথায় চলে গেলাম।

এই বিশেষ ক্ষমতার জন্য আমার মস্তিষ্ক মোটামুটি অরিজিনাল না হলেও ডুপলিকেট টাইপের একটা অস্কার পাওয়ার যোগ্যতা রাখে। কিন্তু আফসোস, সেইটা কেউ বুঝলো না।

প্রিয়ন্তীর বাসার সামনে এসে গাড়ি থামলো। তাকিয়ে দেখি আমার আগেই আরিফুল ইসলাম এবং সিফাত আরহাম গাড়ি থেকে নেমে বাসায় প্রবেশ করছে।

আশ্চর্য! প্রিয়ন্তীদের বাসায় এরা কেনো এসেছে৷ এতক্ষণ এরা আরও কি কি কথা বলেছে। আমি একটা বিষয় নিয়ে ভেবেই সম্পূর্ণ রাস্তা পার করে ফেললাম।

এখন তো মনে হচ্ছে ডুপলিকেট অস্কার না বরং অরিজিনাল অস্কারটাই ডিজার্ভ করি আমি।

দুবার কলিং বেল বেজে যাওয়ার পর পিয়াস ভাইয়া দরজা খুলে দিলো। আরিফুল ইসলাম আর সিফাত আরহাম ভেতরে প্রবেশ করার পর ভাইয়া আমাকে দেখে ভীষন রকম অবাক হলো৷

পিয়াস ভাইয়া হয়তো ভাবছে এসময় আমি এদের সাথে কেনো। সে যাই হোক, ভাইয়া না হয় খামোখা একটু টেনশন করুক।  আমি ভাইয়াকে দরজার কাছে রেখে একটা চোখ টিপ মেরে মুচকি হেসে ভেতরে চলে গেলাম।

আন্টি হয়তো আমরা আসার আগেই  নিজেদের জন্য লেবুর শরবত করছিলো। এদিকে আমারও লেবুর শরবত ভীষন পছন্দের। তাই সোজা রান্নাঘরের দিকে এগিয়ে গেলাম আন্টিকে লেবু কেটে একটু হেল্প করার জন্য।

রান্না ঘরে প্রিয়ন্তীও ছিলো। প্রিয়ন্তীও একটু টেনশন নিয়ে আমার দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টি নিয়ে তাকালো, কিন্তু আমি একটা হাসি দিয়ে আপাতত টেনশনটাকে আরও একটু বাড়িয়ে দিলাম।

ড্রয়িং রুমে আরিফুল ইসলাম, সিফাত আরহাম, পিয়াস ভাইয়া আর আঙ্কেল বসেছিলেন। আমি প্রিয়ন্তীকে নিয়ে সেখানেই গিয়ে বসলাম। একটু পরে পিয়াস ভাইয়া উঠে গিয়ে রান্নাঘর থেকে একটা ট্রে তে করে মোট ছয় গ্লাস লেবুর শরবত নিয়ে এলো।

আমি খেয়াল করলাম ট্রের দিকে সবচেয়ে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি ছিলো ক্রাইম ব্রাঞ্চ অফিসার সিফাত সাহেবের।মনে হচ্ছে লেবুর শরবত দেখে সে সমস্ত কথা বন্ধ করে দিয়ে গ্লাসটা হাতে পাওয়ার অপেক্ষা করছে।

প্রথমে তিনিই ছয়টা গ্লাসের মধ্যে মাঝের দিক থেকে একটা গ্লাস হাতে তুলে নিলেন এবং বললেন,

‘গ্লাসের ডিজাইনটা খুব সুন্দর’।

আমি মনে মনে বলছিলাম আর একা একাই হাসতেছিলাম, প্রথমে আমার বান্ধবী তারপর এখন তার বাসার গ্লাস। একটু পরে হয়তো বাসার বিড়াল কুকুর টাকেও পছন্দ হয়ে যাবে আপনাদের।

আমার হাসি দেখে প্রিয়ন্তী হেঁচকা টান মেরে বললো,

কি রে, একা একা হাসছিস কেনো? ঘটনা কি?

আমি আরেক ঝলক হেসে একটু জোরেই বললাম,

শুধু গ্লাস না স্যার, এই বাসার দেয়াল, লাইট, টব, থালা-বাসন, এমনকি কাটাচামিচ গুলাও খুব সুন্দর। আপনি চাইলে দেখতে পারেন।

আমার রসিকতা কিছু বুঝলো কি না কে জানে। হঠাৎ সিফাত সাহেব দাঁড়িয়ে গেলেন। আর বললেন…

উনার কি একটা জরুরি কাজ আছে তাই এক্ষুনি বেরুতে হবে।

আমি আর প্রিয়ন্তী ভেতরের রুমে চললাম। সিফাত আরহাম আরিফুল ইসলামকে নিয়ে বেরিয়ে গেছেন। এর দশ মিনিটের মধ্যে অফিসারের ফোন৷ তিনি বললেন,

আমাদেরকে সাহায্য করার কথা ছিলো আপনার, ভুলে গেলেন সেইটা? (অফিসার)

না স্যার। ভুলিনি। কি করতে হবে বলুন।

ওকে। আমি একটা এড্রেস মেসেজ করে দিচ্ছি। ঠিক একঘন্টার মধ্যে সেখানে যাবেন। কিন্ত আমি দ্বিতীয়বার আপনাকে কিছু না বলা পর্যন্ত আপনি ভেতরে প্রবেশ করবেন না। মনে থাকবে? (অফিসার)

কিন্তু স্যার আমাকে কোথায় যেতে হবে? আর কাজটা কি?

প্রশ্ন করা বন্ধ করুন। আপনি যাবেন কি না? (অফিসার)

আচ্ছা আচ্ছা যাচ্ছি।

প্রায় পয়তাল্লিশ  মিনিট পর মেসেজের সেই কাঙ্ক্ষিত এড্রেসে চলে এলাম। জানিনা এই এলাকার নামটাই বা কি। শহর থেকে বেশ কিছুটা দূরে, মনে হচ্ছে আলাদা কোনো পৃথিবীতে চলে এলাম।

প্রিয়ন্তীর বাসায় আসার জন্য পুলিশের গাড়ি ব্যবহার করেছি বলে এখন এতো বড় একটা রিটার্ন হেল্প করতে হচ্ছে।

ধূর, কেনো যে সাহায্য করার কথা বলেছিলাম। এখন একা একা এই ভর দুপুরে এমন একটা জায়গায় আসতে হলো, যেখান থেকে আদৌ সুস্থ স্বাভাবিক ভাবে বাসায় ফিরতে পারবো কি না কে জানে।

একদিক দিয়ে বেশ ভালোই লাগছে। আমার পছন্দের জায়গার মতো বেশ এডভেঞ্চারাস, মানুষ জন নেই। তবে যদি কোনো বিপদ আপদ হয় তাহলে নিশ্চিত এখান থেকে জীবিত বের হতে পারবোনা। আরিফুল ইসলাম আমাকে এখানে কেনো আসতে বললেন। কাউকেই তো দেখছিনা।

প্রায় দশ মিনিট এক জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকার পর একটা কুকুরকে দেখতে পেলাম। কুকুরটির মুখে একটা লাল গোলাপ। আমার কাছে এসে একটু দাড়িয়ে আবার উল্টো দিকে হাঁটতে শুরু করলো।

যার অর্থ হচ্ছে এই যে, আমাকে এই কুকুরটিকে অনুসরন করতে হবে। কিন্তু আরিফুল ইসলাম বলেছিলো তিনি না বলা পর্যন্ত আমি যেনো ভেতরের দিকে না যাই। কি করবো তবে?

ভাবতে ভাবতেই অফিসারের মেসেজ। তিনি বললেন আমি যেনো কুকুরটিকে অনুসরন করি। এটাও বললেন যে এরপর আর তিনি আমাকে কোনোরকম দিক নির্দেশনা দিবেন না।

কিন্তু আমি যেনো ভয় না পাই, পুলিশ ফোর্স এবং ক্রাইম ব্রাঞ্চের কয়েকজন অফিসার আশেপাশেই আছেন।

আমি কুকুরটিকে অনুসরন করলাম। বড় বড় গাছ গাছালিতে  সম্পূর্ন জায়গাটা ঘন জঙ্গলের মতোন দেখাচ্ছে। যে রাস্তাটা দিয়ে আমি যাচ্ছি সেই রাস্তার দু পাশ দিয়ে লম্বা তাল গাছের সারি।

তার ফাঁকে ফাঁকে আবার রেইনট্রি দাঁড়িয়ে আছে। আমাদের দেশে এই ‘রেইনট্রি’- কড়ই নামে পরিচিত। দশ মিনিটের পথ পেরিয়ে একটা বড় কৃঞ্চচূড়া গাছের সামনের বাড়িটায় এসে কুকুরটা থাকলো।

আমি সন্তর্পনে ভেতরে প্রবেশ করলাম। বাইরেটা দেখতে অতোটা আহামরি সুন্দর না হলেও বাড়ির ভেতরটা বেশ সুন্দর, পরিপাটি।

তবে এতো সুন্দর বাড়িটায় একটাই মাত্র কক্ষ। ঘরের ভিতর বিশাল জায়গা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে কয়েকটা পিলার। মাঝখানে একটা টেবিল, মোট চারটে চেয়ার। টেবিলে কয়েকটা কাটা চামিচ, আর একটা গ্লাস রাখা। একটু  পিছনে ছাদে উঠার একটা সিড়ি।

সিড়ির কাছে কয়েকটা ফ্লাওয়ার ভাস সুন্দর ভাবে দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু তাতে কোনো ফুল নেই। আরেকপাশে বেশ আকর্ষনীয় দুটো সোফা রাখা আছে। ছাদ থেকে কয়েক রকমের ল্যাম্প ঝুলছে।

আমি ভাবছি এই ঘন অরন্যের মধ্যে এতো সুন্দর একটা বাসা কেনো। এতক্ষণ যে ভয়টা পাচ্ছিলাম এখন আর তা নেই। বরং ঘরের ভিতরের আঁধো আলো আঁধো ছায়া অন্য রকম এক মোহ কাজ করছিলো।

তবুও অপরিচিত জায়গা, তাছাড়া এখানে কি কাজ বা কি বিপদ রয়েছে তা কিছুই জানিনা। এজন্য একটু টেনশন হচ্ছিলো।

পিছনের দিকের দরজায় নকশা খচিত কারুকার্যে মুগ্ধ হয়ে দরজার সৌন্দর্য দেখছিলাম। এমন সময় সিড়ির উপর থেকে কেউ একজন আমার নাম ধরে ডেকে উঠে।

আমি পিছন ফিরে তাকালাম। কিন্তু আবছা আলো ছায়ায় তার মুখটা ঠিক দেখা যাচ্ছিলো না। কন্ঠ টা পরিচিত লাগছে। কিন্তু কে? ঠিক বুঝে উঠতে পারলাম না।

সে ধীরে ধীরে এগিয়ে এলো। তার উপস্থিতির কারনে কক্ষের আলো গুলো যেনো আরেকটু  কমিয়ে দেওয়া হয়েছে। হয়তো আমি চিনে ফেলবো এজন্যই এমনটা করা হয়েছে।

এবার সে এগিয়ে এসে সিড়ির কাছ থেকে একটা ফ্লাওয়ার ভাস তুলে এনে টেবিলের উপর রাখলো।তাতে ভেঙ্গে পড়া কৃঞ্চচূড়ার ছোট ছোট কয়েক পিস ডাল রাখলো। আরও দুটো কৃঞ্চচূড়ার পাপড়ি টেবিলের উপর রাখলো। বামহাতে একটা ছোট গোলাপের কলি।

আমি এগিয়ে এলাম। কিন্তু আমি এগিয়ে আসায় সে খানিকটা সরে গিয়ে একটা চেয়ার টেনে বসলো। এবার ঘরের সব আলো নিভে গিয়ে কেবল মাত্র একটি আলো জ্বলে উঠলো।

আর তার আলো টেবিলের উপর থেকে খানিকটা আমি যে পাশের চেয়ারটায় বসলাম তার মাঝখান পর্যন্ত।

দরজার ওপাশে

এবার আমি মুখ বললাম,

কে আপনি? আমাকে এখানে কেনো ডাকা হয়েছে?  তাছাড়া আপনার নিজেকে আড়াল করার এতোই যখন ইচ্ছে, তাহলে আমার সামনে আসলেন কেনো?

তিনি বেশ শব্দ করে হাসলেন। হাসিটাও পরিচিত লাগছে। হাসির সাথে সাথে লোকটার হাতে যে গোলাপটি ছিলো তা এতক্ষণে দুমড়ে মুচড়ে ছিঁড়ে ফেলেছেন তিনি।

মুহূর্তের মধ্যে এতো সুন্দর গোলাপের এই অবস্থা দেখে কেনো যেনো নিজের মধ্যে ভয়ের অস্তিত্ব টের পেলাম। যে লোক কোনো কারন ছাড়াই একটা গোলাপকে কাঁটা ছেড়া করতে পারে, তার দ্বারা পৃথিবীর সমস্ত খারাপ কাজও সম্ভব।

সে আর যাই হোক, অনুভূতি বোঝার ক্ষমতা রাখে না। বেকার এতক্ষণ এই ঘরটির সাজসজ্জার প্রশংসা করছিলাম। আমার কথার উত্তর জানার জন্য আবাও প্রশ্ন করলাম,

হাসছেন কেনো? এতো রহস্যের মানে কি?

নিজের পরিচয় দিতে ভয় পাচ্ছেন নাকি?

এবার তিনি টেবিল থেকে একটা কাটাচামিচ তুলে হাতে নিলেন। পকেট থেকে একটা আপেল বের করলেন। এরপর কাটা চামিচ এবং আপেল দুটোই টেবিলের উপর রাখলেন।

এবার আরেক পকেট থেকে একটা কাগজ বের করে আমার সামনে টেবিলের উপর রাখলেন। এরপর আমাকে বললেন,

এই কাগজে একটা সাইন করুন।

আমি কাগজটা হাতে নিয়ে দেখলাম কাগজে কিছুই লেখা নেই। সাদা পাতা। বুঝতে পারলাম না, এই সাদ কাগজে ইনি কেনো আমাকে হঠাৎ সাইন করতে বলছেন।

তাছাড়া অফিসার আরিফুল ইসলাম বা সিফাত আরহাম এরাই বা কোথায়। আমি  হাতের ইশারায় নিজের ফোনটা খুঁজতে গিয়েও পেলাম না। আমার সামনে বসে থাকা আগন্তুক মুচকি হেসে বললো,

ফোন খুঁজে লাভ নেই খামোখা। সাইনটা দ্রুত করুন। অযথা নিজের বিপদ বাড়াবেন না।

আমি বুঝতে পারলাম না ইনি কোন বিপদের কথা বললেন। তাছাড়া সাদা পাতায় সাইন করেই বা কি হবে। তবে সাইন করার আগে আমি একটা শর্ত জুড়ে দিলাম। আমি বললাম,

আপনাকে না দেখা পর্যন্ত আমি সাইন করবো না।

তিনি মুখে প্রচন্ড বিরক্তি নিয়ে কয়েকটা বাজে ভাষায় গালি দিলেন। অতঃপর তিনি বললেন,

আমার মুখ দেখলে আপনি নিজেকে সামলাতে পারবেন তো?

সে চিন্তা আপনাকে করতে হবে না। যদি আপনি আমার সামনে আসতে ভয় না পেয়ে থাকেন তাহলে আসুন সামনে।

ভয় তো সামনে আসার না। ভয়টা হচ্ছে, আমাকে দেখার পর যদি আপনি নিজের মত বদলে ফেলেন তবে আমার বেঁচে থাকা-ই কষ্টের হয়ে যাবে।

আশ্চর্য!  আমার একটা সাইন আপনার জীবনে এতো বেশি প্রভাব ফেলতে পারে? তবে সাদা কাগজে সাইনটা কিসের জন্য করছি নিশ্চই এতটুকু জানার অধিকার আমার আছে। তাই না?

হ্যাঁ, বলবো অবশ্যই। যদি না আপনি সিদ্ধান্ত বদলে ফেলেন তবে।

ওকে। আপনাকে দেখার আর এই সাইনটা করার মূল কারন আমাকে খুব বেশী আগ্রহী করে তুলছে। আমি প্রস্তুত এই রহস্য জানার জন্য।

এর দু মিনিট পর্যন্ত আমরা উভয়ই নিরব ছিলাম। কেউ কোনো কথা বলা হয় নি ৷ তার পরেই তিনি চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন। তৎক্ষনাৎ ঘরের অন্যান্য আলোগুলো জ্বলে উঠলো।

আরেহ্, এতো পিয়াস ভাইয়া। এইখানে এই অবস্থায় পিয়াস ভাইয়া কি করে হতে পারে? তাছাড়া পিয়াস ভাইয়া এতো রহস্য করার কারনটা কি?

আমার অবাক হওয়া মুখটা দেখে পিয়াস ভাইয়া মুচকি হাসছেন। বললেন,

কি, খুব বেশি অবাক হলে নাকি? এখনি এতো অবাক হলে চলবে? অবাক হওয়ার আরও অনেক কিছু বাকি আছে এখনো। সবে তো একটা সারপ্রাইজ গেলো।

আমি কিছুই বুঝতে পারছিলাম না। হঠাৎ করে এখানে পিয়াস ভাইয়া কি করছেন। আমি তো অফিসার আরিফুল ইসলামকে হেল্প করার জন্য এখানে এসেছি।

উনি আমাকে এখানে আসতে বলেছেন। তাহলে পিয়াস ভাইয়া আমাকে কিসব

সারপ্রাইজের কথা বলছেন। সে যাই হোক, আপাতত দেখতে থাকি কি হয় এখানে।

পিয়াস ভাইয়া আবারও বলতে শুরু করলেন,

শুনো অনু, তোমাকে অনেক কিছু বলার আছে আমার। আমি জানিনা কতটা কি বলতে পারবো। কিভাবে বলতে হয় অতোটাও আমি বুঝিনা। আমার অগোছালো এলোমেলো কথাগুলো তুমি একটু গুছিয়ে ভেবে নিও ওকে। বলছি তাহলে শুনো,

আমি তোমাকে অনেক আগে থেকেই পছন্দ করতাম। একদিন প্রিয়ন্তী কলেজে অসুস্থ হয়ে পড়ায় আমি ওকে কলেজ থেকে আনতে যাই। সেদিনি আমি তোমাকে দেখি।

কিন্তু সেদিন অতোটা খেয়াল করিনি তোমাকে। এর কয়দিন পরেই তুমি প্রিয়ন্তীর সাথে আমাদের বাসায় এলে। সেদিন তোমাকে দেখে চোখ ফেরাতে পারিনি।

প্রিয়ন্তীর রুমে বারান্দায় বেশ কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিলে, আমি আড়াল থেকে তোমাকে কেবল দেখে গেলাম। কিন্তু কিছুক্ষণ পর যখন তুমি আমার সামনে দিয়েই বাসা থেকে বের হয়ে চলে যাচ্ছিলে, আমার কেমন যেনো ভীষন লজ্জা লাগছিলো।

তাই তোমাকে দেখা মাত্র ভেতরের রুমে চলে গেলাম। এরপর থেকে তুমি আমাদের বাসায় আসলেই আমি তোমার থেকে দূরে দূরে থাকতাম। তোমাকে দেখলেই আমার অস্বস্তি লাগা শুরু হয়।

অনেক বার তোমাকে বলতে চেয়েছি এসব। কিন্তু পারিনি। বেশী সুন্দরী মেয়েদের কাছে যাওয়া কি এতোই সহজ।

তুমি জানো সুন্দরী মেয়েদের ভয় পাওয়াকে কি বলা হয়? ‘ভিনাসট্রোফোবিয়া’৷ সম্ভবত এজন্যই আমি বার বার তোমাকে কাছ থেকে দেখেও কিছু বলতে পারিনি। বরং আরও নির্দিষ্ট দুরত্বে থাকতাম।

পিয়াস ভাইয়ার কথাগুলো শুনছিলাম আর অবাক হয়ে তাকে দেখছিলাম। উনি আমাকে এতোদিন ধরে খেয়াল করছেন। অথচ আমি আরও ভাবতাম, তিনি আমাকে মোটেও পছন্দ করতেন না। এজন্য  আমি তাদের বাসায় গেলে তিনি অন্য কোথাও চলে যেতেন।

পিয়াস ভাইয়া দেখতে মোটামুটি সুন্দর। লম্বায় পাঁচ ফুট আট কি নয় এর মতোন হবে। অপরিচিত যে কোনো মেয়ের চোখে লাগার মতো বাহ্যিক সৌন্দর্য তিনি ধারন করেন।

কথা বার্তায়ও মোটামুটি শালীনতা রয়েছে। বেশ মার্জিত। যদিও বাইরে থেকে দেখে মানুষ চেনার কোনো যৌক্তিকতা নেই। তবুও,

আমি বেশ কয়েকবার তাদের বাসায় গিয়েছি। এমনকি তাদের বাসায় থেকেওছি। এসবের মধ্যে নেগেটিভ কোনোরকম মানসিকতা কখনো চোখে পড়েনি।

তাকে যে আমার পছন্দ না সেইটা ঠিক বলা যাবে না। হয়তো মনে মনে আমিও তাকে পছন্দ করি বা করবো।

তিনি যে এরকম কিছু একটা বলবেন এটা গতকাল থানায় তার ব্যবহারে খানিকটা বুঝেছিলাম। কাল রাতে ঘুমুতে যাবার আগে এসব কথা এক দুবার মাথায়ও এসেছিলো।

কিন্তু আমি মস্তিষ্কের এসব ভাবনাকে সেসময় তেমন পাত্তা দেই নি। যাক গে সেসব কথা, এখন আমার এই ভাবনা গুলোকে বুঝতে দেওয়ার কোনো প্রয়োজন নেই।

তবে আমার মাথায় বেশ কিছু প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে।

যদি পিয়াস ভাইয়া আমাকে এসব বলার জন্যই এখানে ডাকবেন, তাহলে সরাসরি আমাকে বললেই তো পারতেন ৷ এসব তো পিয়াস ভাইয়ার ব্যক্তিগত চিন্তা ভাবনা।

কিন্তু এর সাথে পুলিশ অফিসার আরিফুল ইসলাম বা ক্রাইম ব্রাঞ্চের উপস্থিতির কি কানেকশন? পিয়াস ভাইয়ার এসব ব্যক্তিগত সারপ্রাইজের প্ল্যান আরিফুল ইসলাম কিভাবে জানবেন? আমাকে মেসেজ করে এই এড্রেসটা কেনো আর কিভাবে দিলেন তিনি?

নাহ্ প্রশ্নগুলোর উত্তর না জানা পর্যন্ত আমার অস্বস্তি কাটবে না। কিন্তু এই প্রশ্ন গুলোর উত্তর কি পিয়াস ভাইয়ার কাছ থেকে জানা যাবে নাকি অফিসার আরিফুল ইসলামের কাছ থেকে জানতে হবে?

এইসব ভাবনা চিন্তা করতে করতে আমি পিয়াস ভাইয়ারকে একটি প্রশ্ন করলাম,

আচ্ছা। যদি এসব কিছু আমাকে সারপ্রাইজ দেওয়ার জন্য করা হয়ে থাকে, তবে যে সাদা কাগজে আমাকে সাইন করতে বললে – সেইটা কিসের জন্য?

তোমার এই প্রশ্নের উত্তরও আমি দিবো। কিন্তু তার আগে এই যে এতক্ষন ধরে তোমাকে নিয়ে এতকিছু বললাম, আমার এসব কথার রিটার্ন রিপ্লাই চাই।

রিপ্লাই পরে দিচ্ছি। আগে কারন টা শুনি।

আচ্ছা বলছি। যদিও, এই কারনটা তোমার ভালো নাও লাগতে পারে। এজন্য আমি আগে থেকেই সরি বলছি, ওকে। কিন্তু আমাকে ভুল বুঝোনা প্লিজ।

আচ্ছা।

অনু আমি তোমার খুব ভালোবাসি। তুমি কতটুকু বিশ্বাস করবে আমি জানি না। কিন্তু আমি তোমাকে ছাড়া আর কিছু ভাবতে পারি না। আমার প্রত্যেকটা কাজে কেবল মাত্র তোমার কথাই সারাক্ষণ মনে পড়ে।

আর এই অনুভূতি দীর্ঘদিন ধরে নিজের মধ্যে লালন করে চলতে চলতে এখন এমন একটা পর্যায়ে এসে গেছি যেনো  মনে হচ্ছে, যে কোনো মূল্যে আমার তোমাকেই লাগবে৷ কিন্তু তোমাকে বলার পর তুমি যদি না করে দাও, তবে কি করবো আমি। আমি তো তোমাকে ছাড়া থাকতে পারবো না।

পিয়াস ভাইয়ার বলা প্রতিটা কথা আমার কানে প্রবেশ করার সাথে সাথে মস্তিষ্কে এর প্রভাব বুঝতে পারলাম।

ভাবছিলাম, একটা মানুষ আমাকে এতোদিন ধরে এতোটা গভীর ভাবে ভালোবেসে এসেছে আর আমি বিন্দু মাত্র টের পাই নি। সুখের আভাসের পূর্বমুহূর্তে আমি মন্ত্রমুগ্ধের মতো পিয়াস ভাইয়ার কথাগুলো শুনছিলাম কেবল। আর তিনি বলে চলেছেন,

আর এই কাগজটা হচ্ছে আমাদের কোর্ট ম্যারিজ রেজিস্ট্রির এমন একটা পেপার যেখানে তুমি সাইন করলে আমাদের সম্পর্কটায় আজীবনের জন্য একটা নাম হবে।

যেটা দেখতে আসলে সাধারন কাগজের মতোই । কিন্তু এটা মোটেও সাধারন কাগজ না। আসলে আমি চাইছিলাম সবার আগে তুমি এই কাগজটাতে সাইন করো।

কারন আমি ভয় পাচ্ছিলাম যে, সব কিছু শোনার পর তুমি যদি আমাকে ফিরিয়ে দাও তবে আমি একদম শেষ হয়ে যাবো। আমি তোমাকে ছাড়া থাকতে পারবো না অদ্বিতীয়া।

এখন প্লিজ তুমি সাইনটা করে দাও। আমি তোমাকে কোনো অবস্থাতেই হারাতে চাই না।

কথা গুলো শুনে একদিক থেকে একটু ভয় কাজ করছিলো কিন্তু আবার আরেকদিক থেকে অদ্ভুত ভালো লাগছিলো। সে কি সত্যি আমাকে ভালোবাসে?

আর এতোটাই ভালেবাসে যে আমাকে হারানোর এতোটা ভয় কাজ করে তার মধ্যে? যার জন্য কি না আমাকে না জানিয়ে এইসব কাজ করছিলো? ব্যাপারটা একটু অদ্ভুত। কিন্তু এ সব কিছু সে আমাকে ভালোবাসে বলেই তো করেছে তাই না।

আমি মনে মনে খুব করে চাইছিলাম যেনো এই অবস্থায় এখন আমার মস্তিষ্ক একটা নিরপেক্ষ যুক্তি দাঁড় করায়। পিয়াস ভাইয়াকে আমি পছন্দ করি কি না এর কোনো পক্ষে বা বিপক্ষে কোনো যুক্তি আমার মাথায় আপাতত না আসুক।

এট মধ্যে পিয়াস ভাইয়ার বলা আকুতি ভরা কন্ঠে আমার মনে হলো সে যা করছে, সব কিছু আমাকে পাওয়ার জন্যে করেছে। আমাকে ভালোবেসে করেছে।

আমাকে হারানোর ভয় থেকে করেছে। তার জায়গা থেকে সে তো ভুল নয়। এরপর আমি সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলি, ‘আমি সাইনটা করবো’।

টেবিলের কাছে ফিরে গেলাম। পিয়াস অবাক হয়ে আমাকে দেখছে। কাগজটা সামনে রাখলাম। এবার পিয়াসের চোখে মুখে কিছুটা ভয় দেখা গেলো।

সে হয়তো ভাবছে সবটা জানার পর আমি শেষ পর্যন্ত সাইন নাও করতে পারি। কলমটা হাতে তুলে নিলাম। সাইন করার জন্য হাতটা এগিয়ে নিতেই হঠাৎ কোথা থেকে একটা গুলির শব্দে টেবিলের উপর রাখা গ্লাসটা পড়ে ভেঙ্গে গেলো।

আমি চমকে উঠলাম। গুলিও আওয়াজ?

পিছনে তাকিয়ে দেখি অফিসার আরিফুল ইসলাম সাথে সিফাত আরহাম।

সিফাত চিৎকার করে বলছে,

অদ্বিতীয়া আপনি সাইনটা করবেন না। আপনি এইসব ইমোশনাল কথায় ভিজে যাবেন না, প্লিজ।

এটা ওদের প্ল্যানের একটা অংশ।

বলতে বলতে সিফাত পিস্তল হাতে পিয়াসের দিকে এগিয়ে আসছে। পিয়াস আমার হাত থেকে ছোঁ মেরে কাগজটা নিয়ে পিছনের দরজার দিকে দৌড় দিলো।

এদিকে কোথা থেকে আরও কয়েকজন ভয়ংকর দানবের মতো দেখতে লোক চলে এলো। এরা অফিসার আরিফুল ইসলাম সহ সিফাত এমনকি আমাকে আটকানোর চেষ্টা করছে।

কি হচ্ছে কিছুই বুঝতে পারলাম না। মিনিট খানিকের ব্যবধানে কি শুরু হয়ে গেলো। অফিসারদের দেখে পিয়াস এভাবে চলে গেলো কেনো? আর সিফাত কিসের প্ল্যানের কথা বললো তখন?

সিফাত পিয়াসের যাওয়ার পথে আরও একটা গুলি ছুড়লো।

কিন্তু এবার গুলির শব্দ ছাড়াও বাইরে কেউ একজন পড়ে যাওয়ার শব্দ হলো। তার একটু পরেই সিফাত পিয়াসের কলার ধরে টানতে টানতে ভেতরে নিয়ে আসে।

সিফাত ভেতরে প্রবেশ করার আগে খুঁজে খুঁজে পিছনের দরজার সামনে একটা ডাল বেঁধে দিয়ে এসেছিলো।

যাতে কোনোভাবে পিয়াস হাত ফসকে দৌড় দিতে চাইলেও এই হঠাৎ বাঁধা পিয়াসকে থামিয়ে দেয়। এদিকে সিফাত এই সুযোগেই পিয়াসকে ধরে ফেলবে।

আর এদিকে হলোও তাই। পিছন দরজা দিয়ে দৌড় দিতে চাইলেও পিয়াসের অজান্তে বাঁধা এই ডালটায় পা আটকে যায় আর সে নিচে পড়ে যায়।

ভেতরে নিয়ে আসার পরেই ক্রাইম ব্রাঞ্চের স্পেশাল টিম অফিসার সিফাত আরহাম প্রচন্ড শক্তিবলে পিয়াসের দুই গালে দুইটা চড় মারে। এতে পিয়াস ঘাবড়ে গিয়ে কিছুটা দুর্বল হয়ে পড়ে।

এদিকে অফিসার অনুকে গাড়িতে বসতে বললে সে চুপ করেই দাঁড়িয়ে থাকে। অফিসার তার গতির কোনোরুপ পরিবর্তন না দেখে পুনরায় একই কথা বললে অনু বলে,

আমি আমার প্রশ্নের উত্তর না জানা প্রর্যন্ত এখান থেকে একপাও নড়ব না।

সিফাত অনুর দিকে তাকিয়ে তার মনের অবস্থা সম্পর্কে হয়তো কিছুটা বুঝতে পারলো। সে আর অনুকে জোর করলো না। বরং ঠান্ডা মাথায় বললো,

কি জানতে চাও তুমি, বলো?

আমি সমস্ত ঘটনা প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত শুনতে চাই। যে গল্প এতোদিন ধরে আমার চোখের আড়ালে থেকে গেছে অথচ আপনারা তা জানতেন, আমি সেই গল্প জানতে চাই।

পিয়াসকে আপনারা  এভাবে ধরলেন কেনো ? সে কি করেছে? তাছাড়া পিয়াস আপনাদের দেখে এভাবে পালিয়েই বা যেতে চাইলো কেনো?

সে এতক্ষণ আমাকে যা যা বলছিলো সেসব কিসের প্ল্যান ছিলো?  একজনের ভালোবাসাতে কোথা থেকে কিসের প্ল্যান সাজিয়ে দিচ্ছেন আপনারা? আমি সবটা জানতে চাই, বলুন আমাকে।

চিৎকার করে কথাগুলো বলতে লাগলাম।

নিজেকে কিছুতেই সামলে রাখতে পারছিলাম না। হঠাৎ করেই বুকের মধ্যে প্রচন্ড ফাঁকা ফাঁকা লাগছিলো।

মনে হচ্ছিলো এই বুঝি নিঃশ্বাসটা আটকে যাবে। এই বুঝি দম বন্ধ হয়ে যাবে। গলার কাছে এক খন্ড কষ্টের ধলা কুন্ডলী পাকিয়ে এদিক ওদিক ছুটোছুটি করছে।

যে কষ্টটা আমি গিলেও ফেলতে পারছি না আবার বেরও করে ফেলতে পারছি না। চোখের পানির দল কিছুতেই বাঁধ মানছিলো না। ইচ্ছে করছিলো চিৎকার করে পুরো পৃথিবী কাঁপিয়ে কান্না করি৷ কিন্তু পরিস্থিতি আমাকে কান্না করতেও দিচ্ছে না। আগে আমাকে সবটা জানতে হবে। আমি আবারও জোর গলায় চিৎকার করে বলে উঠলাম,

বলুন অফিসার। আমি সবটা জানতে চাই।

ওকে বলছি। তার আগে আপনি নিজেকে শান্ত করুন। আদৌ কি আপনি  সব কিছু শুনার অবস্থায় আছেন মিস অদ্বিতীয়া? না হলে আপাতত চলুন। পরে একসময় না হয়…

সব কিছু না জানা পর্যন্ত আমি এখান থেকে কোথাও যাবো না।

এর মধ্যে আরিফুল ইসলাম চোখের ইশারায় সিফাতকে সবকিছু বলতে না করলেন। কিন্তু সিফাত তাকে বুঝালেন,

সত্য ভয়ংকর হলেও তা সব সময় সুন্দর হয় ‘।

এরপর সিফাত আরহাম চেয়ারে পিয়াসকে বসিয়ে রশী দিয়ে তাকে শক্ত করে তাকে বাঁধলেন। এক হাতে পিয়াসের মাথায় পিস্তল তাক করে ধরে রইলেন। আমি বুঝতে পারছিলাম না কেনো তার সাথে এই ব্যবহার করা হচ্ছে।

অতঃপর তিনি বলতে শুরু করলেন,

লেখক রায়হান হাসানের খুনের সাথে জড়িত সবাইকেই আমরা বিশেস নজরে রাখি। তার মধ্যে আপনি, লেখক হাবীব ওয়াহিদ, আপনার বান্ধুবী  প্রিয়ন্তী এমনকি তার ভাই পিয়াসও ছিলেন।

খুনের ঘটনাস্থলে আমরা আপনার  ফোনের সিম কার্ড, আপনার হাতের আংটি, সেখানে পড়ে থাকা গ্লাসে আপনার হাতের ছাপ এমনকি রায়হান হাসানের লেখা নতুন থ্রিলার বইটির যে পান্ডুলিপিটি তিনি প্রস্তুত করছিলেন তাতে আপনার হাতের ছাপ পাওয়া গিয়েছিলো।

লেখক রায়হান খুন হওয়ার আগের দিন রাতে তিনি আপনাকে তার ভালোবাসার কথা জানায় এমনকি আপনাকে তার সাথে লিভইন করতে বলা হলে আপনি প্রচন্ড পরিমানে রেগে যান।

এজন্য ঠিক পরের দিন সকালে আপনি রাগ নিয়ে রায়হানের বাসায় ছুটে যান৷ আপনি পুলিশের জবানবন্দিতেও এ কথা বলেছিলেন যে, আপনি প্রচন্ড রাগ নিয়ে রায়হানের বাসায় গিয়েছিলেন।

আর সেসময় প্রিয়ন্তী আপনার বাসায় ছিলো। আপনি এতোটাই রেগে ছিলেন যে প্রিয়ন্তীকে নিজের বাসায় রেখে রায়হানের বাসায় একাই চলে গেলেন।

কিন্তু আপনি পুলিশকে এটা বলেননি যে, ঠিক কোন কারনে আপনি রায়হানের উপর এতোটা রেগে গিয়েছিলেন৷ তো যাই হোক, কারন তো আমরা খুঁজে বের করলাম। এরপর আপনি রায়হানের বাসায় গেলেন। কিন্তু সে সময় তিনি নিজের রুমে ছিলেন না।

রুমে না পেয়ে আপনি ছাদে চলে গেলেন৷ সেখানে রায়হানের সাথে আপনার খুব ঝগড়া হলো। ঝগড়ার একটা সময় রায়হান সাহেব ছাদের খুব কাছে চলে গিয়েছিলো।

সে উপর থেকে নিজের দিকে তাকিয়ে প্রচন্ড ভয় পেয়ে যায়। আর আপনি এইটা খুব ভালো করেই জানতেন যে রায়হান সাহেবের উচ্চতা ভীতি বা ‘এ্যাক্রোফোবিয়া’ ছিলো। এই ভয় পাওয়া অবস্থায় তাকে দেখে আপনার খানিকটা মায়া হয়, তবে রাগটা কমে না।

আর তারপরেই আপনি ঝগড়ার শেষ পর্যায়ে  নিজের হাতে থাকা আংটিটা খুলে সেখানে ছুঁড়ে মারেন, যেই আংটিটা রায়হান অনেক আগেই আপনাকে বন্ধুত্বের নাম করে কিনে দিয়েছিলো।

আমি কি ঠিক বলছি…মিস অদ্বিতীয়া?

হ্যাঁ। কিন্তু ঘটনাস্থলে পড়ে থাকা আমার সিমকার্ড?  তারপর সেখানে থাকা গ্লাসে আমার হাতের ছাপ? এগুলো কিভাবে পাওয়া গেলো , যেখানে কি না আমি কখনো গ্লাসে হাত-ই রাখিনি।

এর সূত্রটা তো আমি বুঝতে পারলাম, যখন আমরা পিয়াসদের বাসায় গেলাম। তোমার মনে আছে নিশ্চই, আমরা যখন পিয়াসদের বাসার ড্রয়িং রুমে বসেছিলাম তখন আমাদের লেবুর শরবত দেওয়া হয়েছিলো।

পিয়াস রান্নাঘর থেকে একটা ট্রে তে করে মোট ছয়টা গ্লাস নিয়ে আসে এবং সেখান থেকে প্রথম গ্লাসটা আমিই নেই।

গ্লাসটা হাতে নিয়ে আমি বলেছিলাম গ্লাসের ডিজাইনটা খুব সুন্দর। তখনি আমার পিয়াসের উপর সন্দেহ হয়৷ কারন সেখানে পাঁচটা গ্লাস ছিলো একই রকম দেখতে, কেবল একটা গ্লাস ছিলো অন্য রকম।

যেখানে সাধারণত এক সেটে একই রকম দেখতে গ্লাসের সংখ্যা হয় ছয়টি। আর এটা সেই গ্লাসের-ই ডিজাইন, যেটা পুলিশ মার্ডার প্লেস থেকে সংগ্রহ করেছে।

আর তাতে আপনার হাতের ছাপ পাওয়া যায়। এদিকে খুনের দিন সকাল থেকে আপনি পিয়াসদের বাসাতেই ছিলেন।

হতে পারে সেখানে আপনি এই গ্লাসটি হাতে নিয়ে পানি পান করেছিলেন। আর পিয়াস এই সুযোগটাই কাজে লাগায়। এজন্যই গ্লাসটিতে আপনার হাতের ছাপ পাওয়া গিয়েছিলো।

দুইয়ে দুইয়ে চার মিলিয়ে যা মনে হলো তা এই যে, রায়হান সাহেবকে খুন হয়তো পিয়াস নিজে করেছে বা তার ইশারায় অন্যকেও  করেছে। আর তার দোষ আপনার উপর দিতে চাইছিলো।

আমি কি ঠিক বললাম মিস্টার পিয়াস? (সিফাত এই কথাটা পিয়াসের দিকে তাকিয়ে বললো এবং উত্তর শুনার অপেক্ষায় কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলেন)

কিন্তু পিয়াস কোনো প্রতি-উত্তর করলো না। সে পূর্বের ন্যায় চুপ করে নিচের দিকেই তাকিয়ে রইলো।

সিফাত আরহামের বলা শেষ কথাটা আমার মাথার সমস্ত চিন্তা ভাবনাকে ঘুরিয়ে দিলো। এসব কি বলছেন তিনি। পিয়াস আমাকে কেনো ফাঁসাতে চাইবে, তাও আবার মার্ডার কেসের মতো এতো জঘন্য একটা কাজে?

তাহলে এতক্ষণ ধরে সে যে আমাকে ভালোবাসি বলছিলো? সেসব কি মিথ্যা? পিয়াস কেনো আমাকে মিথ্যা বলবে? আমার সাথে তার কিসের এতো শত্রুতা যেটা আমি নিজেই জানিনা?

আপনার সাথে তার কিসের শত্রুতা সেইটা তো কেবল পিয়াস নিজেই বলতে পারবে। তাছাড়া ‘মুটিভ অফ মার্ডার’ টাও জানতে হবে। কেনোই বা সে রায়হান সাহেবকে খুন করতে গেলো?

আমি দু পা এগিয়ে পিয়াস যে চেয়ার টায় বসা সেই চেয়ার টার সামনে ফ্লোরে গিয়ে বসলাম। পিয়াস আমার দিকে একবার তাকিয়ে আবার চোখ নামিয়ে নিলো। তার চোখ মুখ বলছে সে অপরাধী। তবুও আমি একবার পিয়াসকে জিজ্ঞেস করলাম,

সিফাত সাহেব যা যা বললেন, তা কি সত্যি পিয়াস?

পিয়াস এমন ভাবে বসে রইলো যেনো সে আমার কথা শুনতেই পায় নি। আমি আরও একবার একই প্রশ্ন করলাম তাকে। এবারও সে আগের মতই চুপ।

মৌনতা সম্মতির লক্ষ্মণ ধরে নিলাম। এতক্ষণ যা যা শুনেছি তার সবই সত্যি। এজন্যই পিয়াস চুপ করে আছে। তার বলার মতো কিছু নেই এখানে।

সিফাত আরহাম পিয়াসকে নিয়ে গাড়ির দিকে এগিয়ে যাচ্ছিলেন। তিনি অফিসার আরিফুল ইসলামকে আরও একটা গুরুত্বপূর্ণ কাজ বাকি আছে বলছিলেন। বাকি কাজের কথা শুনে আমারও হঠাৎ মনে পড়লো, আমার তো আরও একটা বিষয় জানার বাকি আছে।

পিয়াসের আমাকে ভালোবাসার ব্যাপারটা যদি সম্পূর্ণ মিথ্যাই হয় তবে, সে যে একটা সাদা কাগজে আমাকে সাইন করতে বলেছিলো, সেই কাগজটা কিসের ছিলো?

সিফাত সাহেব নিশ্চই এ ব্যাপারে জানেন। কেননা, সাইনটা করার সময় তিনি কোথা থেকে এসে হঠাৎ ব্ল্যাংক বুলেট ছুঁড়েন এবং বলেছিলেন,আমি যেনো সাইনটা না করি। এটা  নাকি তাদের প্ল্যানের-ই একটা অংশ। কোন প্ল্যানের অংশ ?কিসের কাগজ ছিলো সেইটা?…

[ব্ল্যান্ক (blank) বুলেট: এটা এমন এক ধরনের বুলেট যেটা ফায়ার করলে শুধু শব্দই হয়। শুধু মাত্র ভয় দেখানোর জন্য এই বুলেট ব্যবহার করা হয়]

জিজ্ঞেস করতে গিয়েও থেমে গেলাম। থাক, আপাতত এখান থেকে যাওয়া যাক।

পিয়াসকে নিয়ে থানায় যাওয়া হচ্ছে।

আজকের এই সামান্য অভিজ্ঞতা আমার ব্যক্তিগত জীবনে বেশ ভালো ভাবেই প্রভাব ফেলবে বলে মনে হচ্ছে। হয়তো এরপর আর মানুষকে বিশ্বাসই করতে পারবো না।

আচ্ছা, মানুষকে বিশ্বাস করা কি পাপ?নাকি না করা পাপ? মানুষ কেনো মানুষের দুর্বলতার সুযোগ নেয়? কেনো মানুষ অন্য মানুষের অনুভূতি নিয়ে খেলা করে? আমার কোনো কিছুর জন্যে যদি পিয়াসের আমার উপর এতোই রাগ থাকতো তবে তা সে অন্য ভাবেও তো দেখাতে পারতো৷ কেনো এই ভালোবাসার নাটক করলো সে?

উফ, এতটুকুতেই খুব ক্লান্ত লাগছে। না জানি আরও কি কি ঘটনা অজানা আছে।

চার ঘন্টা পর।

বাসায় ফিরে বিছানায় গা এলিয়ে দিতেই ঘুমিয়ে পড়ি। ঘুম ভাঙ্গার পরে আবারও মাথায় সেই ঘটনা গুলোর কথা মনে হতে থাকে। বাসায় ফেরার সময় যে মাথা ব্যাথা নিয়ে ঘুমিয়ে গেছিলাম, সেই মাথা ব্যাথা নিয়েই ঘুম ভাঙ্গলো।

মনে হচ্ছে মাথা ব্যাথাটা ক্রমশ বাড়ছে । উঠে বাথরুমে চলে গেলাম,  লম্বা শাওয়ার নেওয়ার উদ্দেশ্যে।

প্রায় এক ঘন্টা শাওয়ার নেওয়ার পর মাথা ব্যাথাটা একটু কম মনে হলো। এদিকে মা কয়েকবার এসে ডেকে গিয়েছে খাবার খাওয়ার জন্যে । কিন্তু আমি বাইরে যাওয়ার সাহস পাচ্ছিলাম না।

নিজের ঘরে তবুও চোখের পানিটাকে সযত্নে পড়তে দেওয়া যায়, কেউ দেখে ফেলার বা কারও থেকে লুকানোর কোনো ভয় থাকে না। কিন্তু বাইরে গেলে তা আর সম্ভব নয়।

যদি সবার মাঝখানে গিয়ে চোখের এই নোনতা পানির দল চলে আসতে চায়। যদি তা লুকানোর আগেই কেউ দেখে ফেলে।

অস্বস্তি নিয়ে ঘরের মধ্যে পায়চারি করছিলাম। এমন সময়  একটা অচেনা নাম্বার থেকে ফোন আসে। ভাবছিলাম,  এমন সময় কে ফোন দিলো

দ্বিতীয় বার রিং হওয়ার পর কলটা রিসিভ করলাম।

রিসিভ করার সাথে সাথে ওপাশ থেকে প্রথম প্রশ্ন,

তুমি ঠিকাছো তো?

আমার খানিকটা অবাক লাগলো। ফোনটা সামনে এনে দেখি নাম্বারটা অপরিচিত-ই।

রং নাম্বার ভেবে কেটে দিলাম। মাথা ব্যাথাটা আবার বাড়ছে। এদিকে মায়ের ডাক,খেতে ডাকছে।কি আর করার।গেলাম।

রাতে ঘুম আসতে দেরি হওয়ায় সকাল বেলা উঠতে অনেকটা দেরি হয়ে গেলো। তার কিছুক্ষণ পরেই সিফাত আরহামের ফোন। আমাকে আরও একবার থানায় যেতে বলছে।

থানায় তো আমাকে এমনিতেও যেতে হবে। পিয়াসের আমার উপর এতো কিসের শত্রুতা সেইটা এখনো জানা হয় নি৷

বেলা বারোটা নাগাদ আমি থানায় চলে যাই৷ সেখানে গিয়ে প্রিয়ন্তীর সাথে দেখা। স্বাভাবিক ভাবে পিয়াস এখানে রয়েছে, তার মানে প্রিয়ন্তী থানায় আসতেই পারে।

প্রিয়ন্তী আমাকে দেখে কোনো কিছু না বলে বরং মাথা নিচের দিকে করে রইলো। হয়তো আমার সাথে করা তার ভাইয়ের  অন্যায়ের জন্য সে নিজে অনুতপ্ত হচ্ছে। কিন্তু এতে তো প্রিয়ন্তীর  কোনো দোষ নেই। অপরাধী কেবল প্রিয়ন্তীর ভাই পিয়াস।

আমি প্রিয়ন্তীর কাছাকাছি যেতেই আরিফুল ইসলাম আমাকে ডাকলেন। এরপর সেখানে সিফাতও চলে আসলেন। সিফাত আমার দিকে তাকিয়ে একটা ছোট্ট হাসি দিয়ে বললো,

রাতে ঘুমান নি নাকি? (সিফাত)

আমার আরও অনেক কিছু জানার আছে। আর এটা জানতেই আমি এখানে এসেছি।

হ্যাঁ, বুঝেছি। কিন্তু কথা হচ্ছে, কালকে এক দুটো কথা শুনেই তো আপনি অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন। আজ আবার পুরো ঘটনা আপনি সহ্য করতে পারবেন তো?

অবশ্যই পারবো। আই এ্যাম নট উইক।

ওকে, চলুন। পিয়াস সাহেবের মুখ থেকেই সবটা শুনুন তবে।

পিয়াসকে এই অবস্থায় দেখে খারাপ লাগছিলো। মনে হচ্ছে অফিসার আরিফুল ইসলাম তাকে শারীরিকভাবে বেশ আঘাত করেছে।

সে যাই হোক, গল্পের বাকি অংশটুকু জানার জন্য আমি ভীষন উদগ্রীব হয়ে ছিলাম। সিফাত পিয়াসকে কিছু একটা জিজ্ঞেস করতে যাচ্ছিলো। কিন্তু তার আগেই আমিপ্রশ্ন করি,

পিয়াস, কেনো আমাকে মিথ্যা মিথ্যি ভালোবাসার কথা বললে? কিসের শত্রুতা আমার সঙ্গে তোমার?

পিয়াস কিছু বললো না দেখে আমি ফের তাকে প্রশ্ন করলাম,

– যদি আমাকে ভালোবাসার ব্যাপারটা তোমার পূর্ব পরিকল্পনা ছিলো তাহলে আমাকে কিসের কাগজে সাইন করতে বলছিলে তখন?

এবারও পিয়াস কোনো উত্তর করলো না।

পিয়াসের উত্তর না দেওয়ায় সিফাতকে দেখে মনে হচ্ছে সে হয়তো রেগে যাচ্ছে। আমি ইশারায় সিফাতকে শান্ত হতে বলে পিয়াসকে আবারও প্রশ্ন করি,

লেখক রায়হান সাহেবকে মার্ডার কি তুমি করেছো?

পিয়াস কোনো উত্তর না দেওয়ায় আমার বিরক্ত লাগা শুরু হলো। এর মধ্যে অফিসার আরিফুল ইসলাম এসে পিছন থেকে বলতে লাগলেন,

বছর দুই আগে রায়হান সাহেবের সাথে ‘আফরিন পারুসী’ নামের একটা মেয়ের সাথে প্রণয়ের সম্পর্ক ছিলো। এই সম্পর্কের আগে মেয়েটার একবার অনত্র বিয়ে হয়েছিলো। বিয়ের ছ’বছরের মাথায় কোনো কারনে তার ডিভোর্স হয়।

তখন তার সঙ্গে একটা চার বছরের দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী ছেলে সন্তান। বাবার বাড়ি থেকে কিছুটা সাপোর্ট পেলেও এই অবস্থায় সে যেনো কোনো তীর হারা সমুূ্দ্রের সব হারিয়ে ফেলা এক পথযাত্রী। মেয়েটা মানসিক ভাবে খুব ভেঙ্গে পড়েছিলো। সেই ভেঙ্গে যাওয়া সময়টাতে কোনো একটা মাধ্যমে মেয়েটার সাথে লেখক রায়হান সাহেবের পরিচয় হয়।

তাদের মধ্যে নিয়মিত কথা, বন্ধুত্ব আর তারপর বন্ধুত্বের থেকে বেশি কিছু। মেয়েটা যেনো বাঁচার নতুন আশা নতুন পথ খুঁজে পায়।

এর মধ্যে মেয়েটা যখন রায়হান সাহেবের প্রতি অনেক বেশি দুর্বল, ঠিক সে সময়টা থেকে রায়হান সাহেব তাকে ইগনোর করা শুরু করে। বিয়ের প্রতিশ্রুতি দেওয়ার পরেও পরবর্তীতে যখন বিয়ে করতে অস্বীকার করে তখন মেয়েটা আর সহ্য করতে পারেনি।

লোক লজ্জার ভয়ে ভুল সিদ্ধান্ত নিয়ে নেয় এবং আ’ত্নহত্যাকেই একমাত্র পথ হিসেবে বেছে নেয়।

কিন্তু অফিসার, এই ঘটনার সাথে এই কেসের কি সম্পর্ক? (অনু)

সম্পর্ক আছে মিস অদ্বিতীয়া। গভীর এক সম্পর্ক আছে। আর তা হলো,  এই  ‘আফরিন পারুসী’ হলো পিয়াস এবং প্রিয়ন্তীর বড় বোন। যার মৃত্যুর জন্য এরা লেখক রায়হান হাসানকে দোষী ভাবে। আর তাই এরা দুই ভাই – বোন মিলে গত এক মাস ধরে রায়হান হাসানকে মার্ডার করার প্ল্যান করে।

পুলিশ অফিসারের কথা শুনে আমি প্রচন্ড অবাক হলাম। পিয়াসের সাথে প্রিয়ন্তীও? মানে?  এসব কি শুনছি আমি?  অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম,

কিন্তু এসবের সাথে এখানে আমাকে জড়ানোর কি কারন? আমি তো এসব কিছু জানিও না, তাহলে?(অনু)

এতক্ষন চুপ থাকলেও হঠাৎ পিয়াস চিৎকার করে বলে উঠে,

কারন রায়হান হাসান আমার পারু আপুকে ইগনোর করছিলো শুধু মাত্র তোমার জন্যে। সে পারু আপুকে বলেছিলো যে, সে অদ্বিতীয়া অনু নামের একজনকে নাকি সে ভীষন ভালোবাসে। এতো গভীর সম্পর্কের পর আমার পারু আপু রায়হান হাসানের বেইমানি সহ্য করতে না পেরে…

(পিয়াস কথা শেষ করতে পারলো না। তার আগেই ডুকরে কেঁদে উঠে)

এই কারনের জন্য তুমি রায়হানকে মার্ডার করে প্রতিশোধ নিলে ?  আর তার দোষ দিলে আমার উপর? অথচ আমি রায়হানকে সব সময় বন্ধুর চোখেই দেখতাম। আমি তাকে ভালোবাসতাম না।

হ্যাঁ, রায়হান তোমার আপুর সাথে যা করেছে  সেটা তার করা একদমই উচিত হয় নি। কিন্তু তাই বলে তুমি এভাবে প্রতিশোধ নিবে? তোমার বড় আপুর মৃত্যুর সাথে  রায়হানের কোনো কানেকশন খুঁজে পেলেও আমার সাথে এসবের কোনো কানেকশন দেখছিনা।

কিন্তু তুই না থাকলে রায়হান আমার আপুকে এভাবে অবহেলা করতো না। আর আমার আপু এভাবে একটা ভুল সিদ্ধান্তও নিতো না। আমাদের আপুকে আমরা হারিয়ে ফেলেছি…(প্রিয়ন্তী কান্না করতে করতে কথাগুলো বলতে লাগলো)

আমার খুবই আশ্চর্য লাগছে এটা ভেবে যে, শেষমেশ কিনা প্রিয়ন্তীও এসবের সাথে যুক্ত? আরে সেখানে আমি না থেকে অন্য কোনো মেয়েও থাকতে পারতো। আর রায়হান যদি কাউকে পছন্দ করে তাহলে সেখানে মেয়েটার দোষ কোথায়?

আমার অবাক হওয়ার সমস্ত মাত্রা এবার পেরিয়ে গেছে। এখন আর কোনো কথা শুনে অবাক হচ্ছি না। বরং নিজের প্রতি নিজেরই ঘৃনা লাগছে, রাগ হচ্ছে। এরা একটা উদ্দেশ্য নিয়ে আমার ক্ষতি করার জন্য আমার সাথে এতোদিন বন্ধুত্বের কিংবা ভালোবাসার অভিনয় করে গেছে। সত্যি! মানুষ এমনও হয়?

আর কিছু শুনার ইচ্ছে নেই। মানুষ এতো জঘন্য হয়,  ওখান থেকে বেরিয়ে এসে অফিসার আরিফুল ইসলামের টেবিলের কাছে চলে আসলাম।

একটু পরে সিফাত এক গ্লাস পানি এনে আমার সামনে রাখে।

এইসব কথা কাল রাতেই আমরা জানতে পেরেছি। স্বীকার করানোর জন্য  পুলিশের আচরন দেখাতে বাধ্য হয়েছি মাত্র। (অফিসার)

তবে আরও একটা বেশ বড় ঘটনা আছে এখানে। যেই ঘটনার জন্য পিয়াস সেদিন আপনাকে ইমোশনাল ব্ল্যাকমেইল করে সেই সাদা কাগজে সাইন করাতে চেয়েছিলো।

ওহ হ্যাঁ, বলতে ভুলে গেছি। রায়হান সাহেবের পোর্ট মর্টেম রিপোর্ট থেকে জানা গেছে, মৃত্যুর আগে লাস্ট এক সপ্তাহ ধরে তাকে একটা ওষুধ রোজ দেওয়া হতো। যেটার ব্যাপারে পিয়াস কিছু জানে না। (সিফাত)

কিন্তু পিয়াস তো মিথ্যাও বলতে পারে। (অনু)

আমার তা মনে হয় না। কারন, এত বড় একটা ঘটনা সে যখন স্বীকার করে নিয়েছে সেখানে  এই ছোট্ট একটা অপরাধ নিয়ে কেনো মিথ্যা বলবে?(সিফাত)

তার মানে, পিয়াস ছাড়াও রায়হানকে মার্ডার করার মুটিভ আরও কারও ছিলো।

কিন্তু কে সে? (অনু)

 

{ আরো পড়ুন – জ্বিনের পাহাড়ে ব্লাক ম্যাজিক

( দরজার ওপাশে গল্পটি আপনাদের কেমন লাগলো তা কমেন্ট করে অবশ্যই জানাবেন। পরবর্তী পর্বের জন্য আমাদের সাথেই থাকুন । ধন্যবাদ।)