শিনে ডাকাত ও বিলপেত্নি

শিনে ডাকাত ও বিলপেত্নি

লেখকঃ শ্রেয়ন নিবির

 

বেগুনখোলা গ্রামের মহাজন জনার্দন চৌধুরির বাড়িতে ডাকাত পড়েছে। যে সে ডাকাত নয়। একেবারে শিনে ডাকাত। জমিদার আর মহাজনেরা বলেন, “সাক্ষাৎ শনি। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির জাঁদরেল অফিসাররা বছরের পর বছর চেষ্টা করেও ধরতে পারেননি।

গত কয়েকদিন প্রবল বৃষ্টি হয়েছে। বন্যার মতো অবস্থা প্রায়৷ আজ বৃষ্টি কম একটু। এর মধ্যে ডাকাত আসবে, মহাজন ভাবতেই পারেননি৷

সবাই ভয়ে কুঁকড়ে আছে। কয়েকজন চাকর পালিয়ে গিয়েছে সুযোগ পেয়ে। কিন্তু বাড়ির চারদিকেই ডাকাত। বাবুরা কোথা দিয়ে পালাবেন?

জনার্দনের বড়ো ছেলে নিশিকান্ত একটা বন্দুক নিয়ে ছাদে উঠেছিলেন। যদি আগ্নেয়াস্ত্র দেখে ডাকাতেরা পালায়। কিন্তু গুলি চালানোর আগেই তাঁর হাতে একটা লাঠির আঘাত পড়ল। বন্দুক পরে গেল হাত থেকে। আর নিশিকান্ত চিৎকার করে অজ্ঞান। কয়েকজন ডাকাত ছাদেও উঠে পড়েছে।

শিনে ডাকাত নিচে দাঁড়িয়ে আছেন। মোষের মতো বলশালী দেহ তাঁর। লম্বা-চওড়া এবং কালো৷ উসকোখুসকো চুল। তাগড়াই গোঁফ দু’দিকে কান পর্যন্ত চলে গেছে৷ ডান হাতে চকচকে বাঁশের লাঠি। রাত্রিবেলা মশালের আলোয় দেখলেই আত্মারাম খাঁচাছাড়া হয়ে যায়।

বাজখাঁই গলায় শিনে ডাকাত হুংকার দেন, “মহাজনকে বের কর এবার। বেঁধে নিয়ে আয়।”

জনার্দন মহাজন, তাঁর স্ত্রী মানময়ী এবং ছোটো ছেলে দিবাকর শোয়ার ঘরে লুকিয়ে ছিলেন। ডাকাতেরা বারবার চিৎকার করতে লাগল, “বেরিয়ে আয় হতচ্ছাড়া” । কিন্তু তাঁরা কিছুতেই বেরোবেন না। মানময়ীর হাতে রয়েছে পারিবারিক সোনার বালগোপাল মূর্তি।

দরজা ভেঙে ডাকাতেরা ভেতরে ঢুকল। জনার্দনকে টেনে-হিঁচড়ে নিয়ে এল উঠোনে৷ মহাজনের স্ত্রী, ছোটো ছেলে এবং বালগোপালের মূর্তিকে ছুঁল না কেউ। শিনে ডাকাতের নির্দেশ আছে, কোনো মহিলার গায়ে হাত দেওয়া যাবে না। ঠাকুর দেবতার মূর্তি লুঠ করা হবে না।

জনার্দনের স্ত্রীকে এক ডাকাত চিৎকার করে বলল, “সিন্দুকের চাবি দিন” । মানময়ী কথা না বাড়িয়ে চাবি দিয়ে দিলেন। এতে যদি স্বামীর জীবন বাঁচে। ডাকাতেরা সিন্দুক ভেঙে সোনাদানা, গয়নাগাটি ঝোলায় পুরতে লাগল।

উঠোনে জনার্দন চৌধুরিকে হাত-পা বেঁধে ফেলে রাখা হয়েছে। শিনে ডাকার হুংকার দেন, তোর খাতাপত্র কোথায় আছে?

জনার্দন কোনো উত্তর দেন না। ডাকাতেরা বাড়িময় খোঁজাখুঁজি করে। দুটো মাত্র খাতা পাওয়া গেছে।

শিনে ডাকাত বলেন, আমার খাঁড়াটা দে তো।

এক ডাকাত একটা বিকট খড়গ নিয়ে আসে। শিনে ডাকাত লাঠি একজনের হাতে দিয়ে খাঁড়া তুলেন নেন। আবার বলেন, কাগজপত্র কোথায় আছে বল। নইলে গলা কাটব।

মহাজন ঠিক করে রেখেছেন, চুপ করে থাকবেন। কিছু বলবেন না।

শিনে ডাকাত এক কোপে জনার্দনের গলা কেটে ফেললেন। মাথা ছিটকে পরে উঠোনের কোণে। রক্ত ফিনকি দিয়ে বেরোয়।

এখন বর্ষাকাল। চারদিকে এমনিই কাদা। তার মধ্যে একগাদা রক্ত পড়ে বীভৎস লাগছে।

জনার্দন চৌধুরির স্ত্রী চিৎকার করে কাঁদতে লাগলেন, আমার সব শেষ হয়ে গেল। কাগজগুলো দিয়ে দিলে কী এমন ক্ষতি হত?

শিনে ডাকাত তাঁর কাছে গিয়ে বলেন, মা, আপনি এবার কাগজপত্র সব দিন।

মানময়ী এদিক ওদিক তাকান। তারপর চুপচাপ উঠে চললেন বাড়ির মন্দিরে। ঠাকুর আসনের তলা থেকে একটা পুঁটুলি বের করে তুলে দেন শিনে ডাকাতের হাতে।

শিনে ডাকাত পুঁটুলি খুলে বের করেন অনেক খাতাপত্র এবং দলিল-দস্তাবেজ। তিনি জোর গলায় বলেন, “চাষিরা এই রক্তচোষার থেকে চড়া সুদে ধার নিতে বাধ্য হয়েছিল জমিদারের অত্যাচারে। আর এই শয়তান তাদের জমি ভিটে মাটি সব কবজা করে নিয়েছে। এগুলো সব ফেরত দিতে হবে চাষিদের।”

তিনি পুঁটুলি দিলেন এক ডাকাতের হাতে। আবার বললেন, “মা, এবার আপনার স্বামীর চোখেমুখে জল দিন। অজ্ঞান হয়ে গেছে। জেগে উঠবে।”

মহাজনের স্ত্রী দেখেন, কোনো রক্ত নেই উঠোনে। জনার্দন চৌধুরির মাথাও কাটা হয়নি। তিনি এক কোণে পড়ে আছেন সংজ্ঞাহীন অবস্থায়। ভদ্রমহিলা একটা ঘটি নিয়ে গিয়ে চোখেমুখে জল ছেঁটাতে লাগলেন।

আস্তে আস্তে উঠে বসেন জনার্দন চৌধুরি। দিব্যি ঠিক আছেন। বলেন, একী গিন্নি! তুমিও কি মরে গেছ নাকি? তোমারও মাথা কেটে ফেলেছে?

অলক্ষুনে কথা বলবে না। আপনি বেঁচে আছেন। মরেননি। আপনার মাথা কেউ কাটেনি।

জনার্দন চৌধুরি নিজের গলায় হাত দিয়ে দেখেন। সত্যিই মাথা আগের জায়গাতেই আছে। ভয়ে ভয়ে তিনি উঠে দাঁড়ান। বাড়িতে কোনো ডাকাত নেই আর। এতক্ষণ কি স্বপ্ন দেখছিলেন?

মহাজন গিন্নিও উঠে দাঁড়ালেন। তিনিও বুঝতে পারলেন না কী হচ্ছে।

ঝি-চাকরেরা এতক্ষণ জড়োসড়ো হয়ে লুকিয়ে ছিল। তারাও এল উঠোনে। জনার্দন এবং তাঁর স্ত্রীকে নিয়ে গেল ঘরে। নিশিকান্তকে অজ্ঞান অবস্থায় নিয়ে আসা হল ছাদ থেকে। চোখেমুখে জল দেওয়ার পরও জ্ঞান ফিরল না তাঁর। প্রবল জ্বর এসেছে৷

মানময়ী বলেন, “ডাকাত কি সত্যিই এসেছিল? আমার কেমন যেন সবকিছু গুলিয়ে যাচ্ছে।

এক চাকরানি বলে, “এসছিল, গিন্নিমা। সত্যি এসছিল। শিনে ডাকাত বিভ্রমবিদ্যা জানে। আমি লোকজনের থেকে শুনেছি।”

সেটা আবার কী রে? মানময়ী অবাক হন।

দেখলেন না, গিন্নিমা। বাবুর গলা কেটে দুইভাগ করে দিল। ধড়-মুন্ডু আলাদা হল। কত রক্ত গড়াল। কিন্তু বাবু আবার বেঁচে উঠলেন। আসলে ডাকাত মাথা কাটেইনি৷ ভেলকি দেখাচ্ছিল।

ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি নামল। ঘরে ঢুকে গেলেন সবাই।

পরের দিন সকালে দেখা যায়, বাড়ির সদর দরজার পাশে আরবি অক্ষর ‘শিন’ লেখা আছে সিঁদুর দিয়ে। গ্রামবাসীরা জড়ো হয়ে দেখছে। তারা বলাবলি করতে লাগল, “শিনে ডাকাত যেখানেই ডাকাতি করতে যায়, এই চিহ্ন লিখে রাখে প্রমাণ হিসেবে।”

তখনও গ্রামেগঞ্জে পুলিশ ব্যবস্থা সেভাবে গড়ে ওঠেনি। হয় জমিদারের বলতে হবে, অথবা কোম্পানির ফৌজদারের কাছে নালিশ জানাতে হবে। তারা কেউই শিনে ডাকাতকে ধরতে পারবে না। মহাজনের তাই হাত কামড়ানো ছাড়া উপায় নেই।

জনাদর্ন চৌধুরির থেকে ঋণ নিয়ে যেসব কৃষক ভিটেমাটি কিংবা জমি খুইয়েছিলেন, এখন তাঁরা নিশ্চিন্ত। ভালো করেই জানেন, শিনে ডাকাতের লোকেরা এসে দলিলপত্র ফিরিয়ে দিয়ে যাবেন।

তাঁদের ওপর ফের জুলুম করার সাহস মহাজনের আর হবে না৷

শিনে ডাকাত থাকেন বজ্রবনে। তাঁর শাগরেদরাও এখানে বসবাস করে। গভীর এই জঙ্গলে ইংরেজ কোম্পানির সেনাবাহিনীও ঢুকতে সাহস পায় না। জমিদারের পাইক-বরকন্দাজরা তো বজ্রবনের নাম শুনলে ভয়ে থরথর করে কাঁপে।

এখানে সবার জন্য একসঙ্গে রান্না হয়। একই খাবার খায় সবাই। শিনে ডাকাতের জন্যও আলাদা কোনো খাবারের ব্যবস্থা নেই। পোড়ামাটির কালীমন্দির রয়েছে জঙ্গলে।

সমস্ত খাবার দেবীকে উৎসর্গ করা হয়। তারপর প্রসাদ পায় সব ডাকাত এবং তাদের পরিবার।

জঙ্গলে থাকলে শিনে ডাকাত নিজেই কালীপুজো করেন প্রত্যেকদিন। তিনি অনুপস্থিত থাকলে ডাকাতদের কেউ একজন পুজো করে।

অথবা তাদের পরিবারের কোনো সদস্যকে পুজো করার দায়িত্ব দেওয়া হয়। আলাদা কোনো পুরোহিত নেই মন্দিরে।

দুপুরে প্রবল বৃষ্টি হচ্ছিল। তার মধ্যেই শিনে ডাকাত পুজো সারলেন মন্দিরে। সামনে খড়বিচুলি দিয়ে নাটমন্দির করা আছে। খাওয়াদাওয়ার আয়োজন হয় সেখানেই।

পুজো শেষ হলে সবাই খেতে বসে। কিন্তু বৃষ্টির সময়ে জলের ছাঁট আসে বলে তখন মন্দিরের পেছনে একটা মাটির ঘরে খাওয়ার ব্যবস্থা করা হয়।

খেতে খেতে শিনে ডাকাত বললেন, “মহাজনের বাড়িতে থেকে চাষিদের দলিলপত্র যেগুলো আনা হয়েছে, সেগুলো বর্ষাকালে ফেরত দেওয়ার প্রয়োজন নেই।

বৃষ্টিতে নিয়ে বেরোলে ভিজে নষ্ট হতে পারে। কাল রাতে অনেক কসরত করে জলের হাত থেকে বাঁচানো গিয়েছে। বর্ষার পর অবশ্যই যেন মনে করে চাষিদের দিয়ে আসা হয়।

রামাই ডাকাত বলল, তাই হবে সর্দার। আপনি একদম চিন্তা করবেন না। শরতের মেঘ দেখা দিলে আমি নিজে গিয়ে মাঝরাতে চাষিদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে দিয়ে আসব।

খাওয়ার পর ডাকাতেরা ফিরে গেছে যার যার ঘরে। কেউ একটু তামাক খায়। কেউ অল্প করে গড়িয়ে নিচ্ছে। কয়েকজন পাহারা দিচ্ছে ঘরের বাইরে। সজাগ থাকতে হয় সর্বদা। আশেপাশে টহল দিতে হয়৷

জঙ্গলের মধ্যে পাহারা দেওয়ার সময়ে শিবু ডাকাত দেখতে পেল, অচেনা দু’জন বৃদ্ধ এবং দু’জন যুবক ছেলে ঘোরাঘুরি করছে একটু দূরে। সে লুকিয়ে পড়ল সঙ্গে সঙ্গে।

কিছুক্ষণ নজর রেখে বুঝল, এরা জমিদার বা কোম্পানির লোক নয়৷ আক্রমণ করতে আসেনি। নেহাতই নিরীহ মানুষ। অসহায়ভাবে কিছু একটা খুঁজছে।

শিবু ডাকাত গিয়ে তাঁদের জিজ্ঞেস করল, আপনারা কারা? ঘোর বর্ষায় এই গভীর জঙ্গলে কী করছেন? পথ হারিয়ে ফেলেছেন নাকি?

একজন বৃদ্ধ লোক বলেন, না, বাবা। আমরা শিনে ডাকাতের খোঁজে এসেছি। শুনেছি তিনি এখানেই থাকেন।

তাঁর সঙ্গে কী দরকার? কোন জমিদার পাঠিয়েছে আপনাদের?

কোনো জমিদার পাঠায়নি, বাবা। আমরা এসছি অনেক দূরের হুতোমখালি গ্রাম থেকে। শিনে ডাকাতের সঙ্গে দেখা করতে চাই।

কী ব্যাপারে কথা বলতে চান?

ভূতুড়ে ব্যাপার, বাবা। আমরা চারপাঁচটা গ্রামের মানুষ একেবারে তটস্থ হয়ে আছি।

ভূতুড়ে ব্যাপার! আচ্ছা। আপনাদের নিয়ে যাচ্ছি। চোখ আর হাত বাঁধতে হবে।

ঠিক আছে বাবা। ডাকাতদের ভয় পাই না। তাঁরা গরিবের কোনো ক্ষতি করবে না। কিন্তু এই জঙ্গলে প্রচুর সাপ৷ তাদের গায়ে পাড়িয়ে দিলে ছোবল মারবে।

আমি ধরে নিয়ে যাব। ভয় নেই।

শিবু আশপাশ থেকে কিছু লতাপাতা ছিঁড়ে চারজনের চোখ এবং হাত বেঁধে দিল। বলল, “চলুন এবার। বনে খুব কাদা। সাবধানে হাঁটবেন। একে অপরকে ধরে থাকবেন৷ পরে যেতে পারেন নইলে।”

জঙ্গলের রাস্তায় ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে নিয়ে গেল শিবু৷ ডেরায় গিয়ে চোখহাতের বাঁধন খুলে দিয়ে বলল, “আগে মা কালীর প্রসাদ খাবেন চলুন। তারপর একটু বিশ্রাম নিন৷ অনেক দূর থেকে এসেছেন আপনারা। শিনে ডাকাতও বিশ্রাম নিচ্ছেন। বিকেলে কথা হবে।

বিকেলে শিনে ডাকাতের দাওয়ায় গিয়ে দেখা করলেন চারজন। সবচেয়ে বয়স্ক লোকটি হাত জোড় করে বলেন, “আমার নাম গোবিন্দ ঘোষ। এই প্রৌঢ় লোকটি জীবন বিশ্বাস। আর জোয়ান দু’জন বলাই শিকদার আর সুবোধ মণ্ডল। আমরা হুতোমখালি গ্রামে থাকি।

আপনারা বসুন। তারপর বলুন কী সমস্যা,” বলেন শিনে ডাকাত।

তাঁরা মাটির দাওয়ায় বসলেন। গোবিন্দ ঘোষ বলতে থাকেন, “আমরা চারজনে এসেছি৷ গ্রামের লোকেরাই পাঠিয়েছে আমাদের। কাউকে একা পাঠানোর সাহস তারা পেল না। গ্রামের বাইরে বেরোলেই ঘাপটি মেরে আছে বিপদ।

শিবু বলল, আপনারা কোনো ভূতুড়ে ব্যাপারে কথা বলতে এসেছেন। কিন্তু গ্রামেগঞ্জে তো গাছে গাছে ভূত থাকে। এটা তো খুব সাধারণ ব্যাপার। দূরের ওই বেলগাছটা দেখছেন, ওখানে থাকেন একজন ব্রহ্মদত্যি। সাঁঝবেলা গাছের তলায় গেলে সুগন্ধ পাবেন। কিন্তু ভূতের ভয়ে আপনারা ডাকাতের ডেরায় চলে এলেন?”

আজ্ঞে, আমরা গরিব চাষিরা ডাকাতকে ভয় পাই না। আমাদের কী রয়েছে, যেটা ডাকাত লুঠ করবে? তাছাড়া আপনি তো ভালো ডাকাত। শুনেছি আপনার ভয়ে জমিদার আর মহাজনরা কাঁপে।

তাই আপনাকে গ্রামের সবাই শ্রদ্ধা করে। আমরা শুনেছি আপনার অলৌকিক শক্তি আছে। তাই বড়ো আশা নিয়ে আপনার কাছে এসছি।

ঠিক আছে। বলে যান।

আমাদের হুতোমখালি, পলাশপুকুর আর কোঁড়াইল এই তিনটে গ্রামের মাঝখানে রয়েছে দেদারবিল। বিলের জল বর্ষাকালে এত বেড়ে যায়, এই গ্রামগুলির একটি থেকে অন্যটিতে যাতায়াতের অন্য পথ চলে যায় জলের তলায়। নৌকো করে দেদারবিল পার হওয়া ছাড়া কোনো উপায় থাকে না।

কিন্তু এই দেদারবিলেই বাসা বেঁধেছে এক অশরীরী প্রেতাত্মা। তিন গ্রামের লোক তাকে বিলপেত্নি বলে চেনে।

শিনে ডাকাত ও বিলপেত্নি

বহু বছর ধরে বিলের জল এবং আশেপাশের জঙ্গলে ঘুরে বেড়ায় সে। একের পর এক মানুষ প্রাণ হারিয়েছে তার হাতে। শুধু তিনটে গ্রাম না, প্রতিবেশী অন্য সব গ্রামেও ভয় ছড়িয়ে গিয়েছে।

কীভাবে?

গ্রামের লোকেরা বলে, বিলপেত্নি এক পরমা সুন্দরী যুবতীর রূপ ধরে ঘুরে বেড়ায়৷ কখনও জঙ্গলে দেখা যায় তাকে। কখনও বা বিলের জলে সাঁতার কাটে।

এরকমও শোনা গেছে, কোনো মাঝি জ্যোৎস্না রাতে একা নৌকো চালাচ্ছে দেদারবিলে। তখন রূপসী এক মেয়ে জল থেকে নৌকোয় উঠে পড়ল। তার কথাবার্তা এবং রূপে মুগ্ধ হয়ে যায় মাঝি৷ সেই মেয়ে পেত্নি এক সময় মাঝিকে মেরে ফেলে।

সাধারণত পুরুষরাই বিলপেত্নির শিকার হয়। অনেকে বলে, সে নাকি সব সময়ে মানুষকে প্রাণে মেরে ফেলে না। কখনও কখনও মানুষকে প্রথমে আকর্ষণ করে, তারপর ভয় দেখিয়ে ছেড়ে দেয়। তখন পাগল হয়ে যায় সেই মানুষ।

আমাদের গ্রামেরই মদন নামের একটা ছেলে গত বছর পাগল হয়ে গিয়েছিল। সবাই বলে, ও নাকি দুপুরবেলা পড়েছিল বিলপেত্নির খপ্পরে। একা একা জঙ্গলে গেছিল, তারপর থেকেই উন্মাদ হয়ে রাস্তার পাশে একা বসে কী যেন সব বিড়বিড় করে।

একটু চুপ থেকে শিনে ডাকাত বলেন, “তাহলে এটা অনেক দিনের সমস্যা। আপনাদের গ্রামে বা কাছাকাছি কোনো ওঝা নেই? সে কিছু করতে পারছে না?

জীবন বিশ্বাস তখন বললেন, আমাদের গ্রামে একজন ওঝা রয়েছে। সাপের বিষ তুলতে খুবই দক্ষ সে। কিন্তু ভূতপেত্নি তাড়াতে চায় না।

পলাশপুকুর গ্রামে একজন তান্ত্রিক ছিল। হারাধন তান্ত্রিক। কয়েক বছর আগে তাকে অনুরোধ করেছিলাম আমরা সবাই মিলে। যাতে সে বিলপেত্নিকে তাড়িয়ে দেয়। প্রথমে সে রাজি হচ্ছিল না। তারপর জোরাজুরি করায় গ্রাম ছেড়ে পালিয়ে যায়।

পরে জানা গেছে, সে ছিল ভন্ড। বুজরুকি দেখিয়ে এর থেকে লাউ, ওর থেকে চাল-ডাল, তার থেকে গোরুর দুধ এসব আদায় করত।

অনেক তান্ত্রিক এবং গুনিনের কাছে আমরা গেছি। কেউ বিলপেত্নির কাছে যেতে রাজি হয়নি৷ আপনিই হলেন শেষ ভরসা। শুনেছি আপনি ভূত, পিশাচ, দৈত্য, দানব কাউকে ভয় পান না।

হ্যাঁ এটা ঠিক, আমি কাউকে ভয় পাই না, বলেন শিনে ডাকাত, “ভয় জিনিসটা আমার রক্তেই নেই। আপনাদের সাহায্য করতেও রাজি আমি। একবার বিলপেত্নিকে নিজের চোখে দেখতে চাই।

এর জন্য আমাকে কয়েকদিন যেতে হবে আপনাদের গ্রামে। কয়েকদিন থাকতেও হতে পারে। আপনারা জানেন নিশ্চয়ই, জমিদারেরা আমার চরম শত্রু। তারা যদি কোনোভাবে জানতে পারে আমি আপনাদের গ্রামে গিয়েছি, তারা কিন্তু আপনাদের অত্যাচার করবে।

আমার টিকিও ওরা ছুঁতে পারবে না। কিন্তু আপনারা বিপদে পড়তে পারেন।

গোবিন্দ ঘোষ এবার মাথা চুলকাতে লাগলেন। সত্যিই এটা বড়ো সমস্যা। যুবক সুবোধ মণ্ডল এবার বলে ওঠে, জমিদারের লাঠির ভয়ে আমরা সারা জীবন বাঁচতে পারব না। আপনাকে নিয়ে যাব আমরা। তাতে যা হওয়ার হবে।

শিনে ডাকাত বলেন, ঠিক আছে। কিছু একটা উপায় ভেবে বের করছি। রাতটা আপনারা এখানে থাকুন। আগামীকাল সকালে আমি আর শিবু যাব আপনাদের সঙ্গে।

পরের দিন খুব ভোরে কালীমন্দিরে প্রণাম করলেন শিনে ডাকাত। তারপর বেরিয়ে পড়লেন। সঙ্গে শিবু ডাকাত যাচ্ছে। আর রয়েছেন চারজন গ্রামবাসী। যাঁরা সাহায্য চাইতে এসেছিলেন।

জঙ্গল পেরোতেই সূর্য মাথার ওপরে চলে গেল। সামনে একটা নদী। শিবু ডাকাত সঙ্গে পুঁটুলি করে এনেছিল চিঁড়ে আর আম। নদীর জলে চিঁড়ে ভিজিয়ে আম দিয়ে খেলেন ছ’জন।

বৃদ্ধ দু’জনের হাঁটতে খুব কষ্ট হচ্ছে। তবুও চলছেন। শিনে ডাকাত জিজ্ঞেস করেন, “কত দূরে আপনাদের গ্রাম?

জীবন বিশ্বাস উত্তর দেন, “এখনও দশ-বারোটা গ্রাম পেরোতে হবে। তারপর দেদারবিল। বিল পেরিয়ে আমাদের গ্রাম হুতোমখালি।

শিনে ডাকাত বলেন, “একটা কথা মাথায় রাখবেন। গ্রামে ঢুকে বলবেন, শিনে ডাকাতের ডেরা আপনারা খুঁজে পাননি। জঙ্গলের মধ্যে ঘুরছিলেন, তখন একজন তান্ত্রিক বাবার সঙ্গে আপনাদের দেখা হয়। তিনি এক শিষ্যকে নিয়ে আপনাদের গ্রামে চলেছেন। এখন থেকে আমার নাম ভোলানন্দ ঠাকুর৷ আর শিবুর নাম করালীদাস। মনে থাকবে?

সবাই একযোগে বললেন, “হ্যাঁ, মনে থাকবে।

শিবুর দিকে তাকিয়ে শিনে ডাকাত বলেন, “এবার থেকে তুই আমাকে বাবা বলে ডাকবি, আর আমি তোকে করালী বলে ডাকব। ঠিক আছে?

ঠিক আছে, বাবা।

{ আরো পড়ুন – নিশি রাতে বৃদ্ধের কুটিরে

একটা গোরুর গাড়ি আসতে দেখে শিনে ডাকাত তাকে থামালেন। বৃদ্ধ দু’জনকে তুলে দিলেন। বাকিরা যাবেন হেঁটেই।

চার-পাঁচটা গ্রাম পেরোনোর পর বৃষ্টি নামল। একটা চণ্ডীমণ্ডপে দাঁড়াতে হল সবাইকে। গোরুর গাড়ি রাখা হল গাছের তলায়। বৃষ্টি থামলে আবার পথ চলা। অবশেষে পলাশপুকুর এল।

দেদারবিলের পাশে কয়েকজন মাঝি একসঙ্গে বসেছিলেন। গোবিন্দ ঘোষ বলেন, “এখানে কোনো মাঝি একা থাকে না।

তাঁদের নিয়ে এক মাঝি নৌকোয় ওঠেন। হুতোমখালি পৌঁছতে বিকেল হয়ে গেল।

গোবিন্দ ঘোষ নিজের বাড়িতেই দু’জনের থাকার ব্যবস্থা করলেন। দূর থেকে তান্ত্রিক বাবা এসেছেন, খবর ছড়িয়ে পড়ল সারা গ্রামে৷ লোকজন ভিড় করতে থাকে সন্ধেবেলা। গোবিন্দ সবাইকে বলেন, “এখন বাবা খুব ক্লান্ত৷ আমিও পরিশ্রান্ত। কাল তিনি সবার সঙ্গে দেখা করবেন।”

মুষলধারে বৃষ্টি হওয়াতে আরও সুবিধে হল৷ আর কেউ দেখা করতে আসে না।

গোবিন্দের স্ত্রী অনন্যাদেবী সবাইকে খেতে দিলেন। ভাত, ডাত, তরকারি৷ খাওয়ার পর গোবিন্দ নিজে হুঁকো সেজে দেন শিনে ডাকাতকে৷

হুঁকো টানটে টানতে শিনে ডাকাত বলেন, “বৃষ্টি থেমেছে বোধ হয় বাইরে।

গোবিন্দ বলেন, “হ্যাঁ, বাবা। এখন বৃষ্টি হচ্ছে না।

চলুন একটু বাইরে গিয়ে দেখি। চল করালী।

শিনে ডাকাত বেরোলেন বাড়ির বাইরে৷ আকাশে মেঘ নেই৷ বরং চাঁদের আলো দেখা দিয়েছে।

আজ কি পূর্ণিমা?” জিজ্ঞেস করেন তিনি।

হ্যাঁ, বাবা। আজ পূর্ণিমা,” গোবিন্দ উত্তর দেন।

বাঃ! ভেজা গাছের পাতায় উজ্জ্বল চাঁদের আলো কেমন চকচক করছে। স্বর্গীয় পরিবেশ। আমি একটু বিলের ওদিকে ঘুরে আসি।”

এখন যাবেন?” চমকে ওঠেন গোবিন্দ।

হ্যাঁ, এখন যাব আর একাই যাব। করালী থাকবে আপনার বাড়িতে”, শিনে ডাকাত বলেন।

শিবু বলে, “আমি চলি না আপনার সঙ্গে।

যা বলছি সেটাই কর,” শিনে ডাকাত ধমক দেন।

ঠিক আছে,” মুখ কাঁচুমাচু করে ভেতরে ঢুকে যায় শিবু। গোবিন্দও তাকে অনুসরণ করেন।

শিনে ডাকাত আজ লাঠি নেননি। হেঁটেই চলে যান গ্রামের রাস্তা দিয়ে। এখন লোক নেই৷ একে যখন তখন বৃষ্টি নামছে। তার ওপর বিলপেত্নির ভয়৷ লোকজন অনেক আগে ঘুমিয়ে পড়ে। ভোরে উঠে কাজকর্ম শুরু করতে হয়।

চলে এলেন বিলের ধারে। পূর্ণিমার জ্যোৎস্নায় কেমন অপার্থিব হয়ে উঠেছে জায়গাটা। শিনে ডাকাত ভাবেন, এমন সৌন্দর্য চিরকালের জন্য থেকে গেলে কত ভালো হত। তিনি বিলের ঘাটে বসলেন। এখন অশুভ পেত্নিকে নিয়ে ভাবতে ইচ্ছে করছে না।

প্রকৃতির মায়াবী দৃশ্য উপভোগ করছেন, এই সময়ে মৃদু নারীকণ্ঠের গান শুনতে পেলেন। অনেক দূর থেকে ভেসে আসছে। কেউ গাইছে খুব উদাসী গলায়। সুমধুর কণ্ঠ। এই মাতাল করা পরিবেশের সঙ্গে খুব মানিয়ে যায়।

সব কিছুর সাজুয্যে মুগ্ধ হন শিনে ডাকাত। ভাবেন, এই গান যেন শেষ না হয়। জ্যোৎস্না যেন ফুরিয়ে না যায়। সূর্য যেন আর না ওঠে। এখানেই তিনি অনন্তকাল পাথরের মূর্তির মতো বসে থাকবেন।

গানের আওয়াজ কাছে আসছে ক্রমশ। আশ্চর্য সম্মোহনী শক্তি ওই গলার স্বরে। শিনে ডাকাতের মনে হল, পাথরের মূর্তি হয়ে বসে থাকা কষ্টকর হয়ে উঠছে। যেতে হবে জঙ্গলের দিকে, এমন সুরেলা কণ্ঠের অধিকারিনীকে না দেখলেই নয়৷

তিনি উঠে পড়লেন। মন্ত্রমুগ্ধের মতো চলছেন গানের আওয়াজ লক্ষ করে। যেন হুঁশ নেই আর৷ বিলের পাশ দিয়ে হেঁটে জঙ্গলে ঢোকেন। এই তো গান অনেক কাছ থেকে শোনা যাচ্ছে।

ধীর গতিতে এগোচ্ছেন শিনে ডাকাত। আর কিছুটা চলার পর গান বন্ধ হয়ে যায়৷ ঝিঁঝির ডাক ছাড়া আর কোনো শব্দ নেই। শিনে ডাকাত ঝোপ পেরিয়ে কাউকে দেখতে পান না।

আবার গান শুরু হয়েছে বিলের দিক থেকে। শিনে ডাকাত যেন থমকে যান। স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে গান শুনতে থাকেন। হাঁটার কোনো ইচ্ছে আর নেই৷ চোখে ঘুম জড়িয়ে আসছে।

তখনই শিনে ডাকাত দেখেন, বিলের কাছাকাছি জঙ্গলে ঘুরে বেড়াচ্ছে কে যেন। ফোঁটা ফোঁটা জল পড়ছে গাছ থেকে, চাঁদের আলোয় সেগুলো চকচকিয়ে কেমন অপার্থিব হয়ে উঠেছে৷ তার মধ্যে দেখা যায়, দূরে এক অস্পষ্ট ছায়ামূর্তি।

একটু পরে দেখা যায় সামনে কিছুই নেই। গানও বন্ধ। সজাগ হয়ে যান শিনে ডাকাত। ঠিক করেন, তাঁকে বিলের ধারে ফিরতেই হবে। এখানে থাকলে চলবে না।

বিলের দিকে চলছেন৷ আবার পেছনে জঙ্গলের মধ্যে গান শুরু হয়। আর সুমধুর হাসির শব্দ। কোনো যুবতী মেয়ের উদার হাসি। সবকিছু ভুলিয়ে দেওয়া কোমল হাসি।

শিনে ডাকাত একবার থমকে দাঁড়ান। পেছনে তাকাবেন না ঠিক করেন। চলতে থাকেন ফের। পৌঁছলেন বিলের পাশে। বিলের জল ঝাপটা মারেন নিজের মুখমণ্ডলে।

ঝমঝমিয়ে শুরু হয় বৃষ্টি। শিনে ডাকাত বুঝলেন, বিলের পাশে আর থাকা যাবে না এখন। তাকালেন এদিক ওদিক। পাশেই একটা বড়ো গাছ। তার নিচে গিয়ে দাঁড়ালেন।

অমনি সেই গাছের ডাল থেকে মাথা নিচের দিকে করে দোল খেতে থাকে বিকট এক মহিলা। সারা গা ক্ষতবিক্ষত। মুখে রক্ত মাখা। চোখ দুটো জ্বলছে। বড়ো বড়ো ছুঁচোলো দাঁত।

শিনে ডাকাতের মুখের সামনে দাঁত খিঁচিয়ে বলতে থাকে, “আমাকে পছন্দ হল না তোর? আমার রূপ-যৌবনকে তুই অসম্মান করলি? আজ তোকে ছাড়ব না। কোথায় পালাবি?”

শিনে ডাকাত দেখলেন, শুনলেন। কিছুই বললেন না। তিনি ভয় পাননি। সেটা প্রকাশ করলেন না। হাসলেনও না। চুপ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকেন। যেন কিছুই হয়নি।

পেত্নির গলা বড়ো হতে থাকে সাপের মতো। শিনে ডাকাতকে পেঁচিয়ে ধরে চারদিক থেকে। কিন্তু স্পর্শ করে না। যেন ভেতরে বন্দি করতে চায়৷

কিন্তু যাকে খোদ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বন্দি করতে পারেনি, তাকে এক অশরীরী কীই বা করবে?

গাছের মগডাল থেকে পুরুষ কণ্ঠে অট্টহাসির আওয়াজ শোনা যায়। বিলপেত্নি ওপরে তাকিয়ে দেখে, সেখানে বসে আছেন শিনে ডাকাত। বৃষ্টিতে ভিজছেন। পেত্নি আবার নিচে তাকায়। তার গলার প্যাঁচের ভেতরেও শিনে ডাকাত রয়েছেন।

এই সময়ে বাইরের বৃষ্টি থেকে গাছের তলায় এসে দাঁড়ান আরেক শিনে ডাকাত। যেন অনেকক্ষণ ভিজে পরিশ্রান্ত হয়ে গেছেন। গাছের শেকড়ে বসে পড়েন।

তিনজন শিনে ডাকাতকে বারবার দেখতে থাকে বিলপেত্নি। হঠাৎ করে অদৃশ্য হয়ে যায়।

তিনজনের মুখভঙ্গি তিন রকম। একজন দাঁড়িয়ে আছেন শান্ত। একজন গাছের তলায় বিরক্ত মুখে বসে। আরেকজন গাছের ওপরে বসে মজায় হেসে যাচ্ছেন।

একটু পরে দেখা গেল চারজনই আর নেই৷ না আছে বিলপেত্নি। না আছেন শিনে ডাকাত। বিলের ধারে জঙ্গলে মানুষ এবং ভূত দু’পক্ষই অদৃশ্য। কেবল বৃষ্টি আর বৃষ্টি।

অনেকক্ষণ পর বৃষ্টি থামল। তখন মাঝরাত। আশেপাশের গ্রামগুলোয় একেবারে নিঝুম। আগুন জ্বলার চিহ্ন নেই কোথাও। এমনিতে সূর্য ডুবে গেলে এই চত্বরে কেউ আসে না। মেঘে ঢাকা আকাশ। তাই ঘুটঘুটে অন্ধকার।

বিলের ঘাটে আবার দেখা গেল শিনে ডাকাত বসে রয়েছেন। বিলপেত্নি ঘামটি মেরে নিশ্চয়ই অপেক্ষা করছে। তবে সামনে আসছে না।

কিছুটা সময় আগেই কত পদ্মফুল ভাসছিল বিলের জলে। এখন সব বেপাত্তা। কেবল নিকস কালো টলটলে জল।

শিনে ডাকাতের শরীর খুব মজবুত৷ অনেকক্ষণ বৃষ্টি ভিজলেও সর্দিজ্বর হয় না। এখন ভেজার মধ্যেই বসে আছেন। শুকনো জায়গা তো নেই।

বিলের মাঝখানে সাদা মতো কী একটা ভেসে উঠছে। কাপড়ও নয়, মানুষও নয়। কেমন যেন ধোঁয়া ধোঁয়া আর বুদ্বুদ। উঠে যেন একটা অবয়ব নেওয়ার চেষ্টা করে। পুরো অবয়ব নিতে পারছে না।

ওই অদ্ভুত জিনিসটা এগিয়ে আসে ক্রমশ ঘাটের দিকে। ঘাট স্পর্শ করে না। কাছেই ঘুরপাক খায়। ফেটে যায় বিকট শব্দ করে। শিনে ডাকাতের গায়ে অনেকটা জল এসে পড়ে।

{ আরো পড়ুন – দরজার ওপাশে

ওই লাফিয়ে ওঠা জলের সঙ্গেই এক বিকট নারীমূর্তি এসে ঝাঁপিয়ে পড়ল শিনে ডাকাতের ওপর। কিন্তু আর তো ওখানে শিনে ডাকাত নেই। একটা কালো পাথরের মূর্তি রয়েছে৷ প্রবল আক্রোশে বিলপেত্নি ওই পাথরের গায়ে দমাদ্দম মারতে থাকে।

শিনে ডাকাত ও বিলপেত্নি

পাথরের মূর্তি তখন বালি হয়ে ঝরে পরে কাদার ওপর। বিলপেত্নির খেয়াল নেই। কাদার মধ্যেই হাত চালিয়ে যাচ্ছে। তার বীভৎস শরীরে বালিকাদা লেগে ভয়ংকর লাগে আরও।

কাদা আঁচড়াতে আঁচড়াতে এক সময় বিলপেত্নির হুঁশ ফেরে। উঠে দাঁড়ায়৷ ব্যর্থতার ক্রোধে চিৎকার করে ওঠে। আগের মতো সুরেলা গলার স্বর আর নেই৷ বিকট গর্জন। শব্দে বিল এলাকা থরথর করে কেঁপে ওঠে।

কয়েকবার গর্জনের পর বিলপেত্নি বসে পড়ল কাদার ওপর। কাঁদতে লাগল অঝোরে। কান্নার শব্দ চারদিকে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে৷ আশেপাশের পশুপাখিরাও ভয় পেয়ে গেছে বোধ হয়৷

শিনে ডাকাত এসে পেত্নির সামনে দাঁড়ান। বিলপেত্নি দেখে। কিছু বলে না। কাঁদতেই থাকে। তারপর থেমে যায়৷ চুপচাপ বসে থাকে।

শিনে ডাকাত বলেন, “এই জায়গা ছেড়ে চলে যাও। শান্তিতে থাকতে দাও মানুষকে।

দেবো না শান্তিতে থাকতে,” চিৎকার করে ওঠে পেত্নি, “আমাকে শান্তি পেতে দেয়নি। সবাই শয়তান।

তোমাকে যেতেই হবে এখান থেকে।

যদি না যাই?

তাহলে এই বিলটাই আর তোমার থাকবে না।

বিলের দিকে তাকিয়ে দেখে পেত্নি। কোথাও একটুও জল নেই৷ কোনো ঘাস, কোনো গাছপালা নেই। শুকনো মাটি খটখট করছে।

বিলপেত্নি উঠে সেখানে যায়। ডুবল না তো। বিলের ওপরে শুকনো জায়গায় হেঁটেচলে বেরানো যাচ্ছে দিব্বি।

আকাশের দিকে তাকায় পেত্নি৷ এখনও কালো মেঘ। চারদিকে সবকিছু ভেজা। জল আর কাদায় থকথক করছে। শুধু এখানে জলের চিহ্নমাত্র নেই।

শুয়ে পড়ে বিলপেত্নি আঁকড়ে ধরলে চায় ওই জায়গা। শক্ত মাটিতে সাঁতার কাটার চেষ্টা করে। পারে না।

ছুটে এসে শিনে ডাকাতের গায়ের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়তে চায় বিলপেত্নি। আবার গিয়ে পড়ে কাদার ওপর। শিনে ডাকাতের শরীর ভেদ করে সে বেরিয়ে গেছে। তাঁর যেন কোনো কঠিন দেহই নেই। একটা কেবল অভিক্ষেপ।

সেই অভিক্ষেপ বলে ওঠে, “তাহলে কি যাবে এখান থেকে?

চলে যাব। এই দেদারবিল ছেড়ে, এই জঙ্গল ছেড়ে চিরদিনের মতো চলে যাব।

মানুষ কীভাবে বুঝবে তুমি চলে যাচ্ছ?

আপনিই বলুন। আমাকে কী প্রমাণ দিতে হবে?

যাওয়ার সময় তুমি হুতোমখালি গ্রামের ওপর দিয়ে চিৎকার করতে করতে চলে যাবে। আর কখনও এমুখো হবে না। আবার যদি কেউ তোমাকে এই বিলের ধারেকাছে দেখেছে, আমিও তাহলে আবার আসব।

আমি চলে যাচ্ছি। চলে যাচ্ছি এখনই। তার আগে বিলের জলে হাত বোলাতে চাই শেষবার। আপনি দয়া করে বিল আগের অবস্থায় ফিরিয়ে দিন।

জল আগের মতোই আছে। তাকিয়ে দেখো।

বিলপেত্নি দেখে আগের মতোই কালো জল কী সুন্দর নড়ে উঠছে। ঘাট দিয়ে নেমে গেল সে। জলে পা ডোবাল৷ হাতে জল নিয়ে ছেটাতে লাগল এদিক ওদিক। তারপর অদৃশ্য হয়ে গেল।

তখনই আকাশ জুড়ে শোনা যায় নারীকণ্ঠের ভয়ংকর আর্তনাদ। চারপাশের সব গ্রামে লোকজনের ঘুম ভেঙে গেল শব্দে। গ্রামবাসীরা ভয় পেয়ে দেবদেবীর নাম বিড়বিড় করতে লাগল। হুতোমখালির ওপর দিয়ে চিৎকারের আওয়াজ মিলিয়ে যায় অনেক দূরে।

শিনে ডাকাত নিশ্চিন্ত মনে গিয়ে বিলের ধারে বসলেন। মেঘ সরে যাচ্ছে চাঁদের নিচ থেকে৷ জ্যোৎস্না ছড়িয়ে পড়ছে সর্বত্র। মনের সুখে এবার প্রকৃতির লীলা দেখা যাবে।

ভোর হয়। আলো ফোটে পুবদিকে। গোবিন্দ ঘোষ অনেক লোকজন নিয়ে আসেন বিলের ঘাটে৷ সঙ্গে রয়েছে শিবুও। সবাই দেখেন, শিনে ডাকাত বসে আছেন বিলের ধারে।

লোকজনকে দেখে তিনি বলেন, “বিলপেত্নি চলে গেছে বিল ছেড়ে। তিন গ্রামের লোকেরা আজ মনের সুখে আনন্দ করুন।

সবাই হুল্লোড় করতে থাকে। শিনে ডাকাত তাদের সঙ্গে গ্রামে চলে যান। আজ রাতটা এখানে থেকে পরের দিন ফিরে যাবেন বজ্রবনে।

 

 

{ আরো পড়ুন – লালবাগ কেল্লা

 

( শিনে ডাকাত ও বিলপেত্নি গল্পটি আপনাদের কেমন লাগলো তা কমেন্ট করে অবশ্যই জানাবেন।

পরবর্তী গল্প পড়ার আমন্ত্রণ জানালাম। ধন্যবাদ।)

শিনে ডাকাত ও বিলপেত্নি

” সমাপ্ত”