সাইলেন্ট
আমি কথা বলার শক্তি হারিয়ে ফেলি একটা অনাকাঙ্ক্ষিত দূর্ঘটনায়। ঐ একটা ঘটনা আমার জীবনটাকে সম্পুর্ন এলোমেলো করে দেয়। আমি আমার স্বাভাবিক জীবন এবং পরিবার থেকে অনেক দূরে চলে যাই।
সময় টা ছিলো ২০১৮ সাল। সিলেটের শাহজালাল মাজারে গিয়েছিলাম এই প্রথম বার। বাসে করে যেতে প্রায় রাত ১২ টা বেজে গেলো। তাই মাজারের কাছেই একটা হোটেলে উঠলাম।
ফ্রেশ হয়ে রাতের খাবার খাওয়ার জন্য বের হলাম। ক্ষিধায় পেটে হাতি দৌড়াচ্ছে কিন্তু তেমন কোনো হোটেল খোলা পেলাম না এতো রাতে। একটা হোটেল খোলা পেলাম তারা সব হিসাব কিতাব করে এখন-ই হোটেল বন্ধ করবে।
আমি গিয়ে বললাম ” ভাই কিছু খাবার হবে। আমি অনেক দূর থেকে এসেছি। আসতে আসতে রাত হয়ে গেলো। আশেপাশে কোনো দোকানও খোলা নেই…!
কাউন্টারে বসে থাকা লোকটা বললো ” আমরাও তো হোটেল বন্ধ করে ফেলেছি। এখন তেমন কিছু নেই তবে আমি বাসায় নিয়ে যাওয়ার জন্য কিছু খাবার রেখে দিয়েছিলাম, আপনি চাইলে সেটা নিতে পারেন। কিন্তু দাম ডাবল দিতে হবে…!
আমি বললাম ” দাম নিয়ে চিন্তা নেই। আমি ডাবল-ই দিচ্ছি আপনাকে। খাবার টা প্যাক করে দেন…!
লোকটা উঠে গিয়ে ভিতরে গেলো এবং কিছুক্ষণ পর এসে একটা পার্সেল ধরিয়ে দিলো আমার হাতে। আমি দাম চুকিয়ে পার্সেল টা নিয়ে আবার হোটেলে চলে আসলাম।
আমার রুমটা চারতলায়। লিফ্ট না থাকায় সিঁড়ি বেয়ে উঠছি মোবাইল চাপতে চাপতে। হঠাৎ মনে হলো আমার পিছনেও কেউ আসছে আমার সাথে। তাড়াতাড়ি পিছনে তাকিয়ে দেখলাম কেউ নেই।
মনের ভুল ভেবে যখন-ই সামনে তাকিয়ে আবার হাঁটা দিবো তখনই সিঁড়ির ওপর হন্তদন্ত হয়ে একটা পাগল টাইপের লোক এসে বললো ” খাবার দে….”
আমি একটু ভয় পেয়ে অপ্রস্তুত হয়ে গেলাম। নিজেকে সামলে খেয়াল করলাম লোকটার চুল বড় বড় জট বাঁধা। মনে হয় ২০ বছর ধরে গোসল করে না।
চেহারায় লোহার মতো ঝংকার ধরে গেছে। হাত পায়ের নখগুলো বড় হয়ে বেঁকে গিয়েছে। আর জামা কাপড়ের অবস্থা না-ই বললাম।
আমাকে এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে পাগলটা মাথা চুলকাতে চুলকাতে বললো ” খাবার দে……!
আমি বললাম ” আমি-ই অনেক কষ্টে খাবার জোগাড় করেছি। আপনাকে দিয়ে দিলে আমি খাবো কি…!
পাগলটা শুধু একটা কথা-ই রিপিট করছে বারবার ” খাবার দে…!
আমি তাকে পাশ কাটিয়েও যেতে পারছি না সে সিঁড়িতে এমন ভাবে দাঁড়িয়ে আছে। আশেপাশে তাকিয়ে কাউকে দেখতেও পাচ্ছি না। একটু রেগে তার দিকে খাবারের পার্সেলটা এগিয়ে দিলাম। সে সাথে সাথে সেটা নিয়ে সেখানে বসেই খাওয়া শুরু করে দিলো।
আমি কিছু না বলে বিরক্তি নিয়ে কোনোরকম তাকে পাশ কাটিয়ে আবার সিঁড়ি দিয়ে উঠতে লাগলাম। সে দুইটা কাশি দিলো পিছন থেকে। আমি আবার তাকালাম তার দিকে।
এবার সে তার ময়লা দাঁতগুলো বের করে অদ্ভুত একটা হাসি দিলো। তারপর একটা আঙুল মুখে দিয়ে মুখ চেপে বললো ” সাইলেন্ট……!
আমি এবার ভয় পেয়ে তাড়াতাড়ি সিঁড়ি বেয়ে উঠতে লাগলাম। কি মনে করে যেনো আবার পিছনে তাকালাম। এবার দেখলাম সেখানে কেউ নেই। আরে পাগলটা গেলো কোথায়।
এতো অল্প সময়ে সে এখান থেকে যেতে পারে না। তাহলে কি সে অন্য কিছু ছিলো। ভাবতেই গলা শুকিয়ে গেলো। তাড়াতাড়ি করে রুমে এসে ঢকঢক করে বোতল থেকে পানি খেয়ে নিলাম।
ভয়ে আমার ক্ষিধে হাওয়া হয়ে গিয়েছে। সিলেট আসতে না আসতেই এ কেমন বিপদে পড়লাম।
এসব ভাবতে ভাবতে কখন ঘুমিয়ে গিয়েছি বলতে পারবো না।
আমার নাম গালিব আবরার। আমার বাড়ি ফরিদপুর জেলার মধুখালি থানায়। অনার্স ফাইনাল ইয়ারের পরীক্ষা শেষ করে দুই বন্ধু সজীব এবং ইউসুফের সাথে সিলেট ঘুরতে আসার প্ল্যান করেছিলাম।
কিন্তু স্বাভাবিক ভাবে এই হারামি গুলা হঠাৎ করেই প্ল্যান ক্যানসেল করে দেয়। সজীবকে তার গার্লফ্রেন্ড অনুমতি দেয় নি আর ইউসুফের নাকি ডাইরিয়া হইছে। আর আমি এমন একটা ছেলে যে অনেক জিদ্দি। যেটা বলবো সেটা করেই ছাড়বো।
বলেছিলাম সিলেট আসবো তাই একা হলেও আমি আসবোই। আর এই জন্যই একাই চলে এসেছি। আমার সখগুলো আমি কারো জন্য ভেস্তে যেতে দেই না কখনো ।
হঠাৎ ঘুমের মাঝে মনে হলো আমার মাথায় কেউ হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। আমি তাড়াতাড়ি করে উঠে বসলাম। মোবাইলের দিকে তাকিয়ে দেখলাম রাত ৩:৫৬ বাজে।
আমি চোখ ডলতে ডলতে আবার শুয়ে পড়তে যাবো তখন-ই মোবাইলে টুং করে একটা মেসেজ আসার শব্দ হলো। আমি একটু অবাক হলাম কারণ আমার মোবাইল সবসময় সাইলেন্ট করে রাখি। মেসেজ বা কল আসলে শব্দ হওয়ার কথা না।
আমি মোবাইলটা হাতে নিয়ে দেখলাম অচেনা একটা নাম্বার থেকে মেসেজ এসেছে। মোবাইল তো সাইলেন্ট করা তাহলে শব্দ হলো কিভাবে। ভাবতে ভাবতে মেসেজটা ওপেন করে দেখলাম সেখানে একটা শব্দ লেখা সাইলেন্ট…….!
আমি একটু ঘাবড়ে গিয়ে ফোন টা বন্ধ করে দিলাম। কি হচ্ছে এগুলো। চোখে মুখে পানি দেয়ার জন্য তাড়াতাড়ি উঠে ওয়াশরুমে চলে গেলাম। ভালো করে চোখে পানি দিলাম।
তারপর আয়নার দিকে তাকিয়ে দেখলাম আমার কপালে একটা কালো দাগ। সেটাতে অনেক ঘষেও দাগ টা উঠাতে পারলাম না। এই দাগ তো আগে ছিলো না তাহলে এটা কিভাবে হলো।
কেমন যেনো সব কিছু অদ্ভুত লাগছে। ওয়াশরুম থেকে বের হয়ে খাটে এসে আবার শুয়ে পড়লাম।
এদিকে আমরা দেখতে পাই গালিব ওয়াশরুম থেকে বের হওয়ার পর আয়নায় কিছু রক্তের ছেটা এসে পড়লো। সেই রক্তের ছেটা দিয়ে কেউ যেনো আঙুল দিয়ে কচকচ শব্দ করে লিখে দিলো ” সাইলেন্ট ”
চোখ লেগে এসেছে প্রায় তখন-ই আবার মোবাইলে টুং করে মেসেজ আসলো। এবার আমি আরো বেশি ভয় পেয়ে গেলাম।
একটু আগে আমি তো মোবাইল বন্ধ করে দিয়েছিলাম। তাহলে মেসেজ আসলো কিভাবে।
আমি কাঁপা কাঁপা হাতে মোবাইল টা হাতে নিয়ে দেখলাম মোবাইলে একটা ভিডিও চলছে। সেখানে একটা লাল রঙের প্রজাপতি উড়ছে। এটা কিভাবে হতে পারে। মোবাইলটা হাতে নিয়ে তাড়াতাড়ি ভিডিও টা বন্ধ করে কেটে দিলাম। দেখলাম একটা মেসেজ শো করে আছে ওপরে। আরে এটা তো সজীবের মেসেজ।
আমি মেসেজ টা ওপেন করে দেখলাম সজীব লিখেছে আমি আগামীকাল সিলেট আসছি দোস্ত। গার্লফ্রেন্ড অনুমতি দিয়েছে। তুই যেই হোটেলে উঠেছিস সেটার নাম আমাকে টেক্সট করে দিস। আমি আগামীকাল আসছি…!
আমি কোনো রিপ্লাই করলাম না। আমার মাথায় তখন অন্য চিন্তা। বন্ধ মোবাইল খুললো কিভাবে। আর ঐ প্রজাপতির ভিডিও-ই বা আসলো কোথা থেকে।
আমার মোবাইলে ঐরকম কোনো ভিডিও ছিলো না কখনও। মোবাইল সাইলেন্ট থাকার পরও মেসেজের শব্দ হয় কিভাবে। কিছুই মাথায় ঢুকছে না। এবার মোবাইল সাইলেন্ট কেটে দিয়ে জেনারেল মুডে দিয়ে আবার ঘুমিয়ে গেলাম।
এক ঘুমে সকাল হয়ে গেলো। জানালার পর্দা ভেদ করে সূর্যের আলো এসে আমার চোখে পড়ছে।
ঘুম থেকে উঠে ফ্রেশ হয়ে বেড়িয়ে পড়লাম রুম থেকে। রাতের ঘটনাগুলো প্রায় ভুলেই গেলাম। হোটেলে গিয়ে নাস্তা সেড়ে নিলাম। হোটেলে আমার পিছনের টেবিল থেকে একটা মেয়ের কন্ঠ ভেসে আসলো।
সে হয়তো কারো সাথে ফোনে কথা বলছে ” ঐ বাড়িতে আমি আর কখনও ফিরে যাবো না।
আমাকে আমার মতো ছেড়ে দাও তোমরা। কখনও তোমাদের সামনে মেয়ের পরিচয় নিয়ে দাঁড়াবো না…!
এই বলে মেয়েটা ফোন কেটে ফুঁপিয়ে কান্না করতে লাগলো। আমি পিছনে তাকিয়ে দেখলাম শ্যাম বর্ণের একটা মেয়ে গোলাপি রঙের থ্রি পিছ পড়ে বসে আছে। সাথে একটা ব্যাগ।
বুঝাই যাচ্ছে বাড়ি থেকে পালিয়ে এসেছে। মেয়েটা শ্যাম বর্ণের হলেও চেহারায় অদ্ভুত একটা মায়া আছে। প্রথম দেখাতেই যে কোনো ছেলে ঘায়েল হয়ে যাবে।
সরাসরি কথা বলতে গেলে হয়তো আমাকে চোর বাটপার ভাবতে পারে তাই অন্য একটা আইডিয়া আসলো মাথায়।
আমি ফোন টা বের করে এমনি কানে দিয়ে মেয়েটাকে শুনিয়ে শুনিয়ে বলতে লাগলাম ” তুমি কি ভেবেছিলে বাবা। আমি তোমার কথামতো ঐ দাঁত উচা পেত্নিটাকে বিয়ে করে নিবো।
আমারও একটা পছন্দ অপছন্দ আছে। সেটা তুমি একবারও জানতে চাও নি আমার কাছে। তাই আমি তোমাকে কিছু না বলেই বাড়ি থেকে চলে আসছি পালিয়ে। আমাকে খোঁজার চেষ্টা করো না। আমি আমার মতো থাকতে….
তখন-ই আমার ফোনের রিং বেজে উঠলো। আমি একটু ইতস্তত বোধ করে দেখলাম সজীব ফোন করেছে।
মেয়েটার দিকে তাকিয়ে দেখলাম রাগান্বিত দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আমি বলদের মতো দাঁত বের করে দিয়ে ফোন টা রিসিভ করে বললাম ” হা*লারপুত ফোন দেয়ার আর সময় পেলি না। কি একটা কাঁচা শরম পেলাম মেয়েটার কাছে…!
ওপাশ থেকে সজীব বললো ” মেয়েটা মানে। ঐখানে গিয়ে কাউকে পটিয়ে ফেলছোস নাকি মামা। করছোস কি। আমি আইতাছি। হোটেলের নামটা তাড়াতাড়ি টেক্সট কর।
আমি বললাম ” তোর জন্য পটাতে পারলাম কই। সব জায়গায় ঘাবলা করোস তুই। ফোন রাখ……!
এই বলে ফোন রেখে হোটেলের নাম ওকে টেক্সট করে দিলাম। পিছনে তাকিয়ে দেখি মেয়েটা নেই।
আরে এখানেই তো ছিলো। গেলো কোথায়। আশেপাশে তাকিয়ে খুঁজে দেখলাম কোথাও নেই। ধূর হারিয়ে ফেললাম নাকি।
তাড়াতাড়ি হোটেল থেকে বের হয়ে রাস্তার এপাশ ওপাশ দেখতে লাগলাম। কিন্তু মেয়েটাকে আর কোথাও খুঁজে পেলাম না। মনটাই খারাপ হয়ে গেলো।
আস্তে আস্তে হেঁটে শাহজালাল মাজারে প্রবেশ করলাম। কবুতর গুলোর জন্য দানা নিয়ে এসেছিলাম আসার সময়। সেগুলো কবুতরকে খাইয়ে পুকুরের দিকে চলে গেলাম।
বড় বড় মাগুর মাছ দেখে ভালোই লাগলো। চারপাশে আরো অনেক মানুষ। সবাই যে যার মতো ঘুরাফেরা করছে। হঠাৎ খেয়াল করলাম পুকুরের পানি তে আমার প্রতিচ্ছবির পাশে আরেকটা অচেনা মুখ দেখা যাচ্ছে। সে একদম আমার পাশেই দাঁড়িয়ে আছে।
কিন্তু পাশে তাকিয়ে কাউকেই দেখতে পেলাম না। আবার পুকুরের পানির দিকে তাকালে শুধু আমার প্রতিচ্ছবি-ই দেখতে পেলাম। মনের ভুল ভেবে সেখান থেকে হাঁটতে হাঁটতে শাহজালাল (রহঃ) এর কবর দেখার জন্য ওপরে গেলাম।
কবরের কাছে গিয়ে দেখলাম অনেক মানুষ সেখানে আসা যাওয়া করছে। সেখানে মহিলাদের যাওয়া নিষেধ ছিলো। আমি গিয়ে দাঁড়াতেই কবরের অন্য পাশ থেকে একটা লোক আমার দিকে তাকিয়ে অদ্ভুত একটা হাসি দিয়ে এক আঙুল দিয়ে মুখ চেপে ধরলো।
মানে সে আমাকে চুপ করতে বললো। কিন্তু আমি তো কোনো কথা বলছি না তাহলে চুপ হবো কিভাবে। তখন-ই মনে পড়লো রাতের সেই পাগলের কথা। সে-ও ঠিক এভাবেই মুখে আঙুল দিয়ে বলেছিলো ” সাইলেন্ট
আমি একটু ভয় পেয়ে গেলাম এবং তাড়াতাড়ি করে সেখান থেকে চলে আসলাম। নিচে আসতেই হঠাৎ আমার চোখ গেলো আবার সেই মেয়েটার ওপর। দূরে এক জায়গায় সে বসে আছে।
আমার মন তো খুশিতে নেচে উঠলো। এবার আর তাকে হারানো যাবে না। তার দিকে এগিয়ে যেতে লাগলাম তখন-ই হঠাৎ কোথা থেকে যেনো সেই রাতের পাগল টা আমার সামনে লাফিয়ে পড়লো।
{ আরো পড়ুন – দ্য ডার্ক লেগ
( সাইলেন্ট গল্পটি আপনাদের কেমন লাগলো তা কমেন্ট করে অবশ্যই জানাবেন। পরবর্তী পর্বের জন্য আমাদের সাথেই থাকুন । ধন্যবাদ।)
Leave a Reply