চিৎকার – ভয়ানক আত্মার ডাক

চিৎকার-

লেখা: রায়হান_মাসুদ

 

সুমন,আমি শোভনদা বলছি। শোভন বাড়ৈ মোবাইলটা কানে নিয়ে বলল।

দাদা,আসসালামু আলাইকুম, দাদা,হঠাৎ কি মনে করে? দাদা,আমার কি কোনো দোষ হল?

সুমন,তুই একটু আমার সাথে দেখা কর।

ওপাশ থেকে প্রচন্ড ভয়ে সুমন বলল,”দাদা,আমি কি করেছি দাদা? আমি কি ভুলে আপনাকে রাগিয়ে দিয়েছি? দাদা,আমাকে মাফ করে দিন,দাদা। আর করব না।যাই করে থাকি দাদা,মাফ করে দিন।

শোভন অধৈর্য হয়ে বলল,”আহ,সুমন! আমার একটু দরকার আসে তোকে। কিছু জানার আছে।তবে যে কথা নিয়ে আলোচনা করতে তোকে ডাকছি,সেটা যাতে ভুলেও কেউ না জানে। বুঝেছিস? তাহলে কোনো ভয় নেই।

সুমন এখনো কাপছে সেটা তার গলা শুনেই বোঝা যাচ্ছে।তাও একটু স্বস্তি নিয়ে বলল,”আচ্ছা দাদা,রুমে আসব আপনার। সিগারেট কিনে আনব?

শোভন বলল,”না ক্যান্টিনে আয়।লোক যেখানে বেশি সেখানে। আর কিছু আনতে হবে না। চলে আয়।

সুমন এই শহরেই থাকে। ভার্সিটি হলে থাকে না। ভাগ্যগুনে স্থানীয় ছেলে হয়ে স্থানীয় বেশ নামকরা ভার্সিটিতেই চান্স পেয়েছে। হলে তাই থাকতে দেয় নি বাবা মা।

কি জানি ওসব খবরের কাগজে ছাইপাশ লেখে।হলে নাকি খু”ন খারাপি হয়,মারপিট হয়,মাদকের আড্ডা বসে।মাঝে মাঝে পুলিশ রে’ইড করে।রাজনৈতিক কোন্দলের মাঝে নিরীহ ছেলেরা পড়ে যায়।দরকার নেই ছেলেকে রতটা সামাজিক বানানো,মিশতে হবে না হলের কারো সাথে।আড্ডার দরকার নেই।

তবে সুমনের বাবা মার সে ইচ্ছা অতটা পূর্ণতা পায় না। এবারের ছাত্র সংসদের যে গ্রুপটা সেটার সভাপতি হয়েছে শোভন বাড়ৈ।আজ থেকে ১৫ বছর আগে সে এই ভার্সিটিতে ভর্তি হয়েছিল। ভার্সিটিটাকে সে এতটাই ভালবেসে ফেলেছে,যে এটাকে সে আর ছেড়ে যায় নি,ভবিষ্যতেও ছাড়ার সম্ভাবনা খুব কমই দেখা যায়।

শোভন যেমন ভার্সিটিটাকে ভালবাসে,ভার্সিটিটা যেন ততটাই ভয় পায় শোভনকে।ভার্সিটির শরীর থাকলে হয়ত শোভনের পদচারনার সময় থরথরিয়ে কাপত,অজ্ঞান হয়ে যেত আতংকে।

১৫ বছর আগে অনেক কষ্টে,ভর্তি পরীক্ষায় টুকলিফাইং করে এই ভার্সিটিতে ভর্তি হয় সে। এসে সিলেবাস দেখে বুঝে যায়,এই জিনিসকে আকড়ে ধরে জীবনে প্রতিষ্ঠিত হওয়া তার ধাতে নেই।

তাই তার মত ছাত্ররা যা করে সে তাই করল,জীবনে প্রতিষ্ঠিত হবার লক্ষ্যে মেধাবী তকমা গায়ে লাগিয়ে ছাত্র রাজনীতিতে যোগ দেয়।

পড়াশুনা করে যারা ভার্সিটি থেকে বের হয়ে ভালভাল জায়গায় যাবে,সে কিছুই না করে তাদের চেয়ে অনেক উপরের পোস্টে উঠে সাংবাদিক দের সামনে মিঠুন চক্রবর্তী সাজবে। কাড়িকাড়ি টাকা হবে,আর হবে সম্মান,সাথে ভয়… জনমানুষ এর ভয়।

জীবনের প্রথম খুনটা সে করে ঠিক ১৪ বছর আগে। অর্থাৎ মাত্র সেকেন্ড ইয়ারে উঠে। মাত্র নির্বাচন শেষে তৎকালীন সরকার বিরোধী দলে রূপান্তরিত হয়েছে,আর শুরু হল ক্যাম্পাস দখলের লড়াই।

দুইদলের স্বাস্থ্যবান কর্মীদের হাতে দেশী বিদেশী অস্ত্র তুলে দেওয়া হল উপরের মহল এর ইশারায়। ঝেটিয়ে,র’ক্ত দিয়ে ধুয়ে মুছে ক্যাম্পাস দখল করার জন্য।

আগের সরকারের ছাত্র সংগঠনের এক দুর্ধর্ষ নেতা ছিল রুস্তম। ভয়ংকর ক্যাডার। আগের সরকারের হয়ে বেশ চা’দাবাজি,খু’নোখু’নি তে নামডাক ছড়িয়েছিল। একনামে সবাই চিনত।

সে হাতে পিস্তল নিয়ে চার্জ করছিল বর্তমার সরকারের ছাত্র সংগঠনকে।

বর্তমান সরকারের ছাত্রসংগঠনে পিস্তল ছিল উপরের দিকের কিছু নেতার হাতে। ছোট ছোট কর্মীদের হাতে লাঠি,দা ইত্যাদি তুলে দেওয়া হয়েছিল,আরো ছোট কর্মীদের সম্বল ইট পাটকেল।

তাও মারামারি করতেই হবে।ক্যাম্পাস দখল করা উপরের নির্দেশ। পুলিশ আশেপাশে দাঁড়ানো ছিল।যাতে মা’রামা’রিটা রাস্তায় না যায়।এটাই তাদের দায়ুত্ব।হাতে সরকারি বন্দুক নিয়ে তারা মা’রামা’রি টা দেখছিল।

এমন অবস্থায় কিছু গুলির শব্দের পর হঠাৎ ভয়াবহ একটা চিৎকার শোনা গেল।সবাই ভাবল,গুলি কারো গায়ে লেগেছে কিনা। কিন্তু চিৎকারটা থামল না,বেড়েই চলল।আস্তে আস্তে ভয়ংকর আতংকের চিৎকার হয়ে গেল সেটা।

সেই কুখ্যাত ক্যাডার রুস্তম,যার নামে দেশের বিভিন্ন জেলার থানায় এমন কোনো অপরাধ নেই,যার জন্য মামলা নেই,সেই রুস্তম ডানহাতহীন অবস্থায় পড়ে রয়েছে। কাটা হাতটা এখনো পিস্তল ধরা।অমানবিক ভাবে কাপছে।

একটু পর চিৎকার থেমে গেল।কারণ মাথাটাই আলাদা হয়ে গেল। কি হল কি হল,সাংবাদিক আসার আগেই সরকারের লোকেরা রামদা হাতে দাঁড়ানো সেকেন্ড ইয়ারের ছাত্র শোভনকে ঘিরে আড়াল করে দিল।কেউ যাতে ওর ছবি না তুলতে পারে।

রুস্তম ম’রার পর ওই দলের ছাত্রসংগঠনকে এই ভার্সিটিতে কখনওই শ্লোগান দেবার সাহস করতে দেখা যায় নি।

সেই থেকে শোভন এই দলের বড় একটা ক্যাডার হয়ে গেল।শুধু ছাত্র রাজনীতিতে না,সরকার যেকারো উপর রুষ্ট হলে,তাকে গায়েব করে দেবার অতি গোপনীয় স্কোয়াডেও জায়গা দেওয়া হল তাকে।

র’ক্তলালসা অত্যাধিক হওয়ায় শিগগিরি দলের বেশ প্রয়োজনীয় অস্ত্র হয়ে ওঠে সে।এভাবে ১৫ বছর কেটে যায়।

ভার্সিটির ছাত্র সংসদের বাঘা বাঘা মেধাবী ত্রিশোর্ধ ছাত্রনেতারা অবশেষে চল্লিশে ঠেকে।চুলে পাক ধরে,বাধ্য হয়ে সরকারকে ছাটাই করতে হয় তাদের।

এদিকে শোভনের স্বপ্নও বড় রাজনীতিবিদ হওয়া,সারাজীবন ক্যাডার হয়ে থাকলে জীবনে প্রতিষ্ঠিত হওয়া যায় না।শোভন তাই আপাতত এই ছাত্র সংসদের ভারপ্রাপ্ত নেতা হয়।ভবিষ্যৎ এর জন্য প্রাক্টিস আর কি।

সে আসার পর হোস্টেল কি,লোকাল কি,প্রত্যেক বর্ষের প্রত্যেক ছাত্রের তার সাথে দেখা করা ছিল ফরজে আইন। কিভাবে কিভাবে চলতে হবে সেকথাগুলো বলে নোট করিয়ে ছেড়েছিল।

কোনদিন কে সিগারেট এনে দেবে,কোনদিন কে বাজার করে দেবে,কোনদিন কে জামাকাপড় ধুয়ে ইস্ত্রী করে দেবে,ইত্যাদি সবকিছু।কেউ টু শব্দও করে নি।চেনে তারা শোভন বাড়ৈ কে।

সুমন আহমেদ তাই এখনো থতমত খেয়ে আছে। নোট অনুযায়ী, আজ তো শোভনদায়ের সাথে তার কোনো কাজ নেই। তাহলে তাকে তলব করল কেন? এছাড়া রুমে না ডেকে ক্যান্টিনেই বা কেন?

সুমন ক্যান্টিনে গেল। কোথায় শোভনদা? আশেপাশে চেয়ে খুজল সে। হঠাৎ ওই কোণা থেকে কে একজন হাত নেড়ে বলল,”সুমন এদিকে আয়”

পরিচিত পেশাদার খু’নির হিংস্র শীতল কন্ঠটা না হলে সুমন বুঝতেই পারত না এটা শোভন বাড়ৈ।মাত্র ২/৩ মাস আগে না ওকে দেখল সে? একয়দিনের ভিতর কি হল চেহারার?চোখের আশেপাশে এত কালি পড়েছে,যে দূর থেকে মনে হয় এটা শূন্য কোটর।গাল এতটাই ঢুকে গেছে ভিতরে,মনে হয় সাদা একটা কঙ্কাল।

সুমন ভয়ে ভয়ে এগোল। শোভন খুবই নরম ভাষায় বলল,”কষ্ট দিলাম,নারে ভাই? আয় আয়,বোস এখানে। চেয়ারটা টেনে কাছে বোস।

সুমন আতংকিত হয়ে পড়ল। এই লোক এভাবে কেন বলছে।এ তো সাধারণত মানুষের সাথে এমন ব্যবহার করে যেটা নরমাললি কসাইরা কুকুর তাড়ানোর সময় করে। এত নরম হয়ে কি বলছে।সুমন এখনো বুঝছে না সে কি বিপদে আছে না কি।

সুমন কাছে গেল।বসল। শোভন চেয়ারটা আরো কাছে আনল।তারপর ফিসফিসিয়ে বলল,”তোর বাবা পাগলের ডাক্তার না,ভাই?”

সুমন থতমত খেয়ে বলল,”হ্যা দাদা। সাইকিয়াট্রিস্ট। দাদা,বাবা কি আপনার সাথে খারাপ ব্যবহার করেছে কোনভাবে? মাফ করে দেন দাদা…

শোভন অধৈর্য হয়ে আরো ফিসফিসিয়ে বলল,”আরে না না,শোন না, শোন না… তোর বাবাকে ধর আমি যদি গিয়ে দেখাই,তবে কি সে আমার পরিচয়টা গোপন রাখতে পারবে?

সরকারি কাউকে না জানালেই হবে। সরকারি কেউ জানলে আমার ক্যারিয়ার এ কলঙ্ক লাগবে।

সুমন বলল,”দাদা,ডাক্তাররা তো রোগীর কথা গোপন রাখতে বাধ্য থাকে…

শোভন বলে,”উহু উহু,এসব ব্যাপার না। সাংবাদিকরা ইদানীং ছোক ছোক করে।রোগী সেজে চেম্বারে কান পেতে বসে থাকে। তাই সরকার ডাক্তারদের বলেছে,বইয়ের যেসব নির্দেশ অনুযায়ী ডাক্তার রোগীর কথা বলতে বাধ্য থাকে,সেটা যেন রিপোর্ট আকারে পুলিশে পেশ করে।

পরে আমরা সাধারণত পুলিশকে চাপ দিয়ে রিপোর্ট টা নষ্ট করি।

সুমন বুঝল,এই হারামজাদা নির্ঘাত কাউকে খু’ন করেছে। কিন্তু খু’নের পর ভীষণ নাড়া খেয়েছে। সে তারা বাবাকে মাঝে মাঝে বলতে শুনেছে,দুনিয়ার সবচেয়ে দুর্ধর্ষ লোকটাও কখনো মা’রাত্মক ভয় পায়।

সুমন বলল,”দাদা,তো আপনার ভয় পাওয়ার কারণ কি?

শোভন বলল,”আরে বোকা ছেলে,আমি তাকে যা বলব,সেগুলো সে রিপোর্ট করলে সরকার জিনিসটা ধামাচাপা দেবে আমি জানি।কিন্তু রিপোর্ট টা সরকারি লোকেরা পড়ে। আমার ঝামেলা এখানেই। ডাক্তারকে আমি যা বলব,সেগুলো সে অবশ্যই রিপোর্ট করবে।

কিন্তু রিপোর্ট টা যদি সরকারি কেউ পড়ে,রাজনীতিতে আমার ক্যারিয়ারটা শুরুতেই শেষ হয়ে যাবে। মানসিক ভারসাম্যহীন, কুসংস্কারাচ্ছন্ন কাউকে সরকার তার দিলের গুরুত্বপূর্ণ পদ দেবে না।”

সুমন এখনো বুঝছে না সে কি বলবে।

শোভন হঠাৎ গলাটা এতটাই ফিসফিসানিতে নামাল যে সুমনের মনে হল একটা সাপ কথা বলছে,”তোর বাবাকে আজ বল না ভাই।আমি তার চেম্বারে যাব। সে যেন আমি যা বলি তা কাউকে রিপোর্ট না করে। কোনোভাবে যদি কোনো সাংবাদিক ঘটনা জেনে ঝামেলা করতে চায়, আমি তাকে দেখে নেব।তোর বাবার ভয় নেই।”

সুমন কিছু বলল না।এই কথাটা তাকে কেন বলা হচ্ছে এর কারণও সে বুঝছে না। শোভন তো ডাইরেক্ট তার বাবাকে গিয়েই কথাটা বলতে পারত।এই বুদ্ধিটা তার মাথায় কেন এল না। লোকটা যে মারাত্মক সমস্যায় আছে বোঝা যাচ্ছে।

হঠাৎ শোভন বাড়ৈ পকেট থেকে একটা জপমালা টাইপ কিছু বের করল। তারপর দ্রুত কিছু জপতে লাগল। থু থু ছিটল মুখ থেকে। সুমন স্পষ্ট শুনল শোভন কি পড়ছে,,, “আল্লাহু আকবর, হরে কৃষ্ণ,হোলি ফাদার,জিসাস,ভার্জিন মেরি,ভগবান বুদ্ধ,সাহায্য কর…সাহায্য কর।”

আস্তে আস্তে ক্যান্টিন ফাকা হয়ে যেতে লাগল।ভয়ংকর আতংক গ্রাস করল শোভনকে।খরগোশের মত আশেপাশে তাকাতে লাগল সে।

“সুমন,আমাকে একটু বাইরে দিয়ে আয় তো।তাড়াতাড়ি, ওই যে লোকগুলো যাচ্ছে ওদের সাথে। একা যেন না হই আমি।,হ্যা?”

সুমন তাজ্জব হয়ে শোভনের হাত ধরে উঠাল।অত্যন্ত দুর্বল শোভন সুমনের হাত আকড়ে ধরল। ওরা বাইরে যাচ্ছে।

বাইরে আধার নামল। সন্ধ্যা হবে হবে,তবে সন্ধ্যাটা অতিরিক্ত অন্ধকার। আকাশে কাল মেঘ জমছে।

শোভন বলল,”আমাকে রুম পর্যন্ত দিয়ে আয় সোনা ভাই।

সুমন যন্ত্রের মত তাই করল। শোভনের রুমে এসে সে অবাক। আগে এই বিশাল রুমটায় রাজার মত একটা বিছানায়,একা ঘুমাত শোভন। আশেপাশে দামি ফ্লাটবাড়ির মত আসবাব ছিল। এখন আসবাবগুলো সরিয়ে ফেলা হয়েছে। প্রায় ৫/৬ টা খাট রুমে। এমনকি শোভনের বিশাল বিছানায়ও আলাদা পার্টিশন বালিশের।মানে এই বেডে শোভনকে মাঝে রেখে,দুইপাশে দুইজন শোয়।

তবে এখন রুমে কেউ নেই। শোভন আতংকিত হয়ে পড়ল। “কই গেল সব? শু’য়োরগুলোকে কতবার বলেছি,আমি রুমে এসে যেন একা না হই… ওহ শিট…হে ভগবান,ঈশ্বর,আল্লাহ,গড…যে যেখানে থাকো,গালি দিয়ে যে পাপটা করলাম,এর শাস্তি হিসেবে ওকে আজ পাঠিও না। আমি একটু ঘুমাতে চাই।একটু ঘুমাতে দাও…প্লিজ।”

সুমন এবার প্রচন্ড ভয় পাচ্ছে। ভয়ংকর এক লোকের সাথে সে দাঁড়ানো,সেটাই ভয়ের কথা,লোকটার মাথা বিগড়েছে, এটা তো আরো ভয়ের কথা….

হঠাৎ শোভন পেট চেপে ধরল। বলল,”উফফ,তোর অপেক্ষা করতে গিয়ে ক্যান্টিনে দুটো পুরি খেয়েছিলাম।পেটে মোচড় দিল। আমি বাথরুমে যাব।আমার সাথে একটু আয়,ভাই। প্লিজ।”

সুমন হতচকিত হয়ে শোভনের সাথে গেল। শোভন বাথরুমে ঢুকে একটা টয়লেটের দুরজা খুলল। তারপর বসল। কিন্তু সুমনকে আরো আতংকিত আর বাকরুদ্ধ করতে দরজাটা সে আটকাল না। সুমন কিছু বলার আগেই সে বলল,”দরজা আটকালে এই জায়গাটায় একা হয়ে যাব রে ভাই। সরি,ভাই।”

তবে সুমন যথেষ্ট দেখে ফেলেছে। শোভন কিছু বলার আগেই সে বাথরুম থেকে বের হয়ে গেল। শোভন আর্তনাদ করে উঠল,”না না….নাআআআআআআআ”

রুমটায় শোভন একা। সাথে সাথে রুমের মাঝে একটা মেয়ে দাড়াল। মেয়েটার সারা শরীরে গরিলার মত পশম। মুখটা বাঁদরের মত। চুল গুলো সোনালী। এটা যে মেয়ে বোঝা যাচ্ছে,তার দেহের গঠন দেখে। নখ,দাত ধারাল,আর বড়।

তবে বিকট পৈশাচিক চেহারাটা শোভনকে আতংকিত করে না। মেয়েটার সারা শরীরের বাদামী পশমগুলো লাল র’ক্তে মাখাটা,মুখের বিকট রূপটা লাল র’ক্তে ঢাকা। র’ক্তগুলো সেদিনের সেই র’ক্ত,যেগুলো ছিটকে লেগেছিল ওই পিশাচিনীর মুখ সহ সারা শরীরে….

পিশাচিনীর ভয়াবহ রূপটা ভীতিকর না আপাতত,তবে বিকট চেহারার জিনিসটার মুখ খুচকানো। প্রবল আতংকে মানুষের মুখ যেমন কুচকায়,ঠিক তেমন।

জিনিসটা কাপতে লাগল। থরথর করে কাপতে লাগল। তারপর তারস্বরে চিৎকার করল। পৈশাচিক সেই চিৎকার।  ভয়ংকর সেই চিৎকার। চিৎকারের সাথে অপার্থিব পৈশাচিক স্বরের একটা মিনতি,”আমায় একটু ঘুমাতে দাও,দোহাই লাগে,দোহাই লাগে…তোমার পায়ে পড়ি।”

শোভন অজ্ঞান হয়ে যায়। চিৎকারটা চলতেই থাকে।

সেরাতে শোভনের জ্ঞান আর ফিরল না। ভীত সন্ত্রস্ত নতুন জুনিয়র রুমমেটগুলো অজ্ঞান শোভনকে ঘিরে থাকল সারারাত।মাঝে মাঝে শোভনের ঘুম ভেঙে যাচ্ছিল।সে তীব্র ভয়ে আশেপাশে তাকাল,বলল,”তোরা আমার সোনা ভাই।আমাকে একা রেখে যাবি না কোথাও। কথা দে….”

পরের দিন। সুমনের বাবার চেম্বারে শোভন বসা। বাইরে তার কিছু পরিচিত কর্মীরা। ভিতরে ডাক্তারের কাছে এসেছে।একা সে হবে না,তাই ওরা ভিতরে আসে নি।

ডাক্তার বলল,”আপনি একটু বসুন।আমি একটু ফ্রেশ হয়ে আসি।”

শোভন তীব্র আতংকে চিল্লিয়ে উঠল,”না না,আমাকে একা রুমে রাখবেন না।না না.. প্লিজ না।।।”

ডাক্তার অবাক হয়ে রোগীর দিকে তাকালেন। একটা আস্ত শয়তান এই রোগী।শুধু ডাক্তার না,সারাদেশ জানে,সরকারের পোষা খুনি,কত মায়ের কোল যে খালি করেছে রাজনৈতিক খুনের নামে ইয়ত্তা নেই।কয়েকমাস আগেও টিভিতে এক রিপোর্ট এ জোরে জোরে শ্লোগান দিতে দেখেছিল একে ডাক্তার। চোখে সানগ্লাস ছিল।অন্যরকম এটিচিউড।আর এই কয়দিনের ব্যবধানে কি অবস্থা হয়ে এসেছে। যাই হয়ে থাকুক,ডাক্তার আশা করছে,জিনিসটা যেন একে অনেক কষ্ট দেয়।

ডাক্তার বললেন,”তো শুরু করেন।”

শোভন বলল,”কথাটা মনে আছে তো? রিপোর্ট আপনি কাউকে শেয়ার করবেন না। আমি খু’ন করেছি।স্বীকার করব। আপনি শেয়ার করলে সরকারই এটা ধামাচাপা দেবে। তবে রিপোর্ট এর বর্ণনায় যদি ঘুণাক্ষরেও তারা ভাবে আমি পাগল।আমার ক্যারিয়ার শেষ….”

ডাক্তার বলল,”বুঝলাম।তো সমস্যাটা কি?”

শোভন বলল,”বদর মিয়াকে চেনেন? শ্রমিক নেতা? সরকারের এক নেতার গার্মেন্টস এ কাজ করে এমন এক মেয়েকে নেতার ছেলে আর তার বন্ধুরা মিলে বলাৎ’কার করে খু’ন করল।এর প্রতিবাদে,সিসিটিভি ফুটেজ,আর কিসব প্রমাণ নিয়ে আন্দোলনে নামল। সুষ্ঠু বিচার করতে।এর সাথে অনেক শ্রমিক যুক্ত হল। এই আন্দোলনকে ইস্যু করে বিরোধী দল সরকার পতনের একটা চেষ্টা করার প্লান করল।

যদিও হাস্যকর প্লান। কিন্তু সরকার কোনো রিস্ক নিতে চাইল না। আন্দোলন এ বিরোধী দল যোগ দেবার আগেই আন্দোলন শেষ করতে সিদ্ধান্ত নেওয়া হল বদর মিয়াকে সরিয়ে দেওয়ার। কাজটার দায়িত্ব দেওয়া হল আমাকে।

ঘটনার দিন রাতে বদর মিয়ার বাসার কাছে গিয়া দেখি বদর মিয়ার বউয়ের বাচ্চা হবার টাইম হয়েছে। বদর মিয়া ভ্যান খুজতে আশেপাশে দৌড়াচ্ছে আমি সবার অলক্ষ্যে বদর মিয়ার মুখ চেপে ওকে দূরের একটা বিলে নিয়ে গেলাম।

তারপর ওইখানে বসে আমি কোপাতে লাগলাম ওকে। কুপি’য়ে কু’পিয়ে দেহটাকে দলাপাকানো ন্যাকড়ার মত করার আগ পর্যন্ত থামলাম না।

কাজ শেষে হাফিয়ে উঠে সামনে তাকালাম।

দেখলাম,একটা ভয়ংকর জিনিস।মেয়েদের গঠন।সারা শরীরে বাদামী লোম,বড় ধারাল দাত,নখ,বিকট চেহারা,দাঁড়িয়ে আছে।আমার দিকে তাকিয়ে।এতক্ষণ কোপানোর সময় র’ক্ত ছিটকে আশেপাশে যাচ্ছিল।সেই র’ক্ত ছিটে ওটার সারা শরীর লাল করে দিয়েছে।

সবচেয়ে আশ্চর্যের কথা কি জানেন। ওই বীভৎস মুখটা কিন্তু আমাকে ভয় দেখানোর চেষ্টা করল না।উলটা ওটার চোখে আমি আতংক দেখলাম। তারপর ওঠা শুরু করল চিৎকার।উফফফ কি বীভৎস চিৎকার।অপার্থিব,অলৌকিক, র’ক্ত হিম করা আর্তনাদ।

স্যার,গত তিনমাস ধরে আমি যদি কখনো একা হই,তাহলেই ওটা ওরকম রূপ নিয়ে আমার কাছে আসে। আর চেচায়। উফফফ কি বীভৎস সেই চিৎকার।  স্যার,এই চিৎকার যাতে না শুনতে হয়,সব ধর্মের ফকিরদের কাছ থেকে তাবিজ এনেছি,মন্ত্র দোয়া শিখে  জপতেছি। মুখ দিয়ে খারাপ কথা বলি না,খারাপ কাজ করি না,খারাপ কিছু খাই না। দল থেকে সাময়িক ছুটি নিয়েছি। কিন্তু একা হলেই ওটা আসে স্যার। আর চিৎকার করে। চিৎকার করে বলে,”আমাকে ঘুমাতে দাও।

চিৎকার

আমি এর অর্থ জানি না। শুধু জানি,এই চিৎকার বন্ধ না হলে,ওই জিনিসটা আমার কাছে আসা বন্ধ না করলে আমি ম’রে যাব। ইসসস…কেউ একটা গু’লি করে আমাকে শেষ করে দিত!আত্ম’হ’ত্যা করতে তো একা ঘর লাগে,সবার সামনে পারা যায় না। একা ঘর হলেই তো ওটা আসে,আর চিৎকার করে কেউ আমাকে মে’রে ফেলত,আমি মুক্তি চাই!উফফফ,কি বীভৎস চিৎকার…. ”

শোভন ডাক্তারের টেবিলে মুখ গুজে কাদতে লাগল। ডাক্তার বাকরুদ্ধ হয়ে থাকল।

অনেক অনেক দূরে,যেখানে কোনো মানুষ থাকে না,এমন একটা শহরের কোনো এক ট্যাক্সিতে একটা বীভৎস চেহারার লোমশ একটা শরীর বসা,মেয়েদের গঠন,অর্থাৎ এটা মেয়ে, এবং বেশি বয়সও না। মুখ ভরা ধারাল দাতের সারি।কিন্তু মুখটা নির্জীব। পাশে বসে জিনিসটাকে ধরে রাখা একটু বয়স্ক,কিন্তু ওটার মতই বীভৎস কিছু একটা বলল,”ভাই,একটু তাড়াতাড়ি গাড়িটা চালান।আমার মেয়ে গত ৩ মাস ধরে ঘুমাতে পারে না। কোনো ডাক্তারে কাজ হয় না। শেষ চেষ্টা হিসেবে একজনই বাকি আছে। তাড়াতাড়ি করেন ভাই।”

একই রকম ধারাল দাতওয়ালা বীভৎস কিছু একটা গাড়ির ড্রাইভিং সিটে বসে বলল,”এইতো আপা,এখনি পৌছে যাব।”

ট্যাক্সি একটা হাসপাতালের সামনে দাড়াল। হাসপাতালে যারা হেটে বেড়াচ্ছে,সবাই একই রকম লোমশ,ধারাল দাতওয়ালা বীভৎস চেহারা বিশিষ্ট।

ডাক্তারের অফিসে গেল মা আর মেয়ে।ডাক্তার তার হলুদ শ্বাপদের মত চোখ দুটো দিয়ে তাদের দিকে তাকাল। বলল,”কি সমস্যা?”

মেয়েটা মিনমিন করে বলল,”স্যার,বললে বিশ্বাস করবেন না। কেউই করে না। যাকে বলি,সে ভাবে গাঁজাখুরি গল্প।কিন্তু স্যার,সত্যি বলছি,মানুষ আছে স্যার,ভয়ংকর… বীভৎস…ওরা আছে,স্যার। ”

ডাক্তার তার ধারাল দাতের সারি বের করে স্মিত হেসে বাচ্চাদের সামলানোর মত করে বলল,”হ্যা,মানুষ আছে। তুমি যা বললে সব ঠিক। কিন্তু সমস্যাটা কি মামণি।”

মেয়েটা বলল,”স্যার,আমি ঘুমালে স্বপ্নের ভিতর মানুষের দুনিয়ায় যেতে পারি স্যার। অনেকবার যেতাম। তখনো ওরকম ভয়াবহতা বুঝতাম না। মানুষ এর সাথে অত দেখা হত না। স্বপ্নে বড় গাছ,বিরান মরুভূমি, হাইওয়ে,বিলে হাটতাম। মানুষের জগতের জায়গা….”

”কিন্তু সেদিন সেদিন ”কেদে দিল মেয়েটা।”আমি রাতে স্বপ্নের ভিতর মানুষের দুনিয়ার এক বিলে হাটছিলাম। হঠাৎ,আমি ওটাকে দেখলাম। বীভৎস কদাকার এক মুখ, হাতে ধারাল লম্বা চকচকে একটা রা’মদা,ওটা নিজের প্রজাতির একজনকে কোপাচ্ছিল। তার শরীরের লাল র’ক্ত আমার সারা শরীরে ছিটকে উঠেছিল। বীভৎস জিনিসটা কোপাচ্ছিল,আর হাসছিল,স্যার ওটা হাসছিল উফফফ কি ভয়ংকর।

আমি সৃষ্টিকর্তাকে ডাকছিলাম ঘুমটা যেন ভাঙে আমার।স্বপ্নটা যেন ভাঙে কিন্তু ভাংল না। ওটা আমার দিকে ফিরে তাকাল। কি বীভৎস র’ক্তাক্ত মুখ।নিজের প্রজাতির জীবের রক্তে রাঙানো পিশাচ ।

আমি চিৎকার করলাম স্যার,জীবনে এত জোরে চিৎকার করি নি।অবশেষে আমার ঘুম ভাঙল।

কিন্তু স্যার,সেই আমার শেষ ঘুম।আমি গত তিনমাস ধরে ঘুমাতে পারি না। ঘুমালেই দেখি,ওই পিশাচটার সাথে আমি একা এক রুমে,আমার সারা শরীরে র’ক্ত… পিশাচটা আমার দিকে তাকায়,ওর ভয়াবহ চেহারাটা দেখে আমি চিৎকার করি।আমার চিৎকার আমার স্বপ্নেই থেকে যায়, বাস্তবে কেউ শোনে না। আমি ঘুমাতে চাই একটু স্বপ্নহীনভাবে ঘুমাতে চাই। যেই ঘুমে আমি চিৎকার করব না”

 

চিৎকার

” সমাপ্ত”

 

{ আরো পড়ুন – সাইলেন্ট

( চিৎকার গল্পটি আপনাদের কেমন লাগলো তা কমেন্ট করে অবশ্যই জানাবেন। পরবর্তী পর্বের জন্য আমাদের সাথেই থাকুন । ধন্যবাদ।)