কালো বিড়ালের আতঙ্ক – ভূতের গল্প

কালো বিড়ালের আতঙ্ক

 

সন্ধ্যার সময় বাজার করে ফেরার সময় দেখলাম এলাকার কয়েকজন পাতি মাস্তান জটলা পাকিয়ে একটা বিড়ালকে মা*রধর করবার চেষ্টা করছে।

বিড়ালটা প্রাণে বাঁচার জন্য চার হাত-পা সমানে ছোড়াছুড়ি করলেও তাদের শক্তির কাছে পরাস্ত হয়ে গিয়ে দাত খিঁচিয়ে অদ্ভুত একটা গোঙানি দিচ্ছে।

একটা অবলা প্রাণীকে এইভাবে টর্চার করার দৃশ্যটা আমার কাছে বড্ড অমানবিক লাগলো। হাতে থাকা ব্যাগটা রেখে দৌঁড়ে গেলাম সেদিকে।

এগিয়ে গিয়ে একজনকে উদ্দেশ্য করে বললাম, -‘ অবলা প্রাণীটাকে ওভাবে মারধর করার মানে কী? কী করেছে বিড়ালটা?’

ওদের ভিতর থেকে বয়োজেষ্ঠ্য একজন কাঁধ ঝুকিয়ে তাকিয়ে বললো, -‘তাতে তোমার কি হে? নিজের চরকায় তেল দাও না।’

লোকটার উপর ভীষণরকম রাগ হলো। যে বয়সে নামাজ কালাম পড়বে,সেই বয়সে এসে নিজে তো পাপ করছেই সাথে কয়েকজন সাঙ্গপাঙ্গও জুটেয়েছে।

ভ্রু কুচকে রূঢ কণ্ঠে বললাম, -‘ এই বয়সে এসে কোথায় নামাজ কালাম পড়বেন,তা না করে একটা অবলা জানোয়ারকে ধরে মারতে যাচ্ছেন? কি অপরাধ করেছে বিড়ালটা?’

লোকটা এবার বিদ্রুপের একটা হাসি দিয়ে বললো, -‘এইযে মানবতার ফেরিওয়ালা,আমাদের জ্ঞান না দিয়ে যে কাজে এসেছিস সেই কাজটা কর না গিয়ে। আমাদের কাজে নাক গলাতে আসলে শেষমেশ নাকটাই হারাবি। বুঝলি?’

লোকটার উপর তিক্ততা জমে গেলো কথাগুলো শুনে। লোকটা এই অঞ্চলের ভারপ্রাপ্ত মেয়রের ডান হাত। তাই বলে কাঁধের উপর মেয়রের হাত আছে দেখে যা ইচ্ছা তাই করবে! দেশ থেকে কি আইন কানুন সব উঠে গেলো? এইভাবে একটা অবলা জানোয়ারকে মারার কোনো অধিকার নেই ওদের।

আমিও খানিকটা শক্ত গলায় বললাম, -‘আরে ভাই, মানছি আপনাদের ক্ষমতা আছে। তাই বলে একটা অবলা প্রাণীকে এইভাবে মারবেন সবাই মিলে?মারার জন্য কি আর কিছু পাননি?কী অপরাধ করেছে বিড়ালটা ?’

দানব আকৃতির লোকটা এবার বিশ্রী একটা গালি দিয়ে বললো, -‘ তখন থেকে একটাই কথা; কি করেছে ওটা,কি করেছে। কী না করেছে ওটা? ওটা বিড়াল না,একটা অপয়া। শয়তানের ভাই।

দেখ দেখ,চোখগুলো দেখলেই কেমন যানি ভয়ে গা সেঁদিয়ে যাচ্ছে। ওর জন্য আজকে আমাদের বড় ভাই মরতে মরতে বেঁচে গিয়েছে।

ওর দিকে তাকালেই সেই দিনটা খারাপ যায় আমাদের।

ওমন বিদ্ঘুটে নিকষ কালো বিড়াল বাপের জন্মে দেখিনি! পুরো শরীরটা যেন আলকাতরার ভিতরে চুবানোর পর তুলে ছেড়ে দিছে কেউ। অন্ধকারে সামনে পড়লে যে কেউ ভয়ে আতকে উঠবে। আর একটু গাঢ় অন্ধকারের মাঝে তো কেউ দেখতেই পাবেনা হতচ্ছাড়াটাকে।’

লোকটার কথা শুনে বিড়ালটার দিকে তাকালাম আমি। বিড়ালটা আসলেও দেখতে একটু বিদ্ঘুটে টাইপের। নিকষ

কালো গায়ের রং। শরীরে কালো বৈ অন্য কোনো রঙের ছিটেফোঁটা নেই।

এমনকি চোখের মনি গুলো পর্যন্ত অন্ধকারে মোড়ানো। বিড়ালটা আমার দিকে কালো কালো চোখ জোড়া দিয়ে অসহায়ের দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।

চোখের করুন চাহনি দিয়ে বুঝাতে চায়ছে, ‘দয়া করে আমাকে এদের হাত থেকে বাঁচাও। আমি নিরাপরাধ,আমার কোনো দোষ নেই। ওরা আমাকে মেরে ফেলবে।’

ভাই বলে হয়তো মেয়রকেই সম্বোধন করছে লোকটা। দুপুরের দিকে লোকমুখে শুনেছিলাম গাড়ির ব্রেক ফেল করে এক্সিডেন্ট করেছে এলাকার মেয়র।

শীতল গলায় বললাম, -‘আচ্ছা শোনেন, আপনাদের ভাই এক্সিডেন্ট করেছেন তার গাড়ির ব্রেক ফেল করে। আপনারা যদি এতোই শাস্তি দিতে উদগ্রীব হন,তাহলে গাড়িটার ভাঙচুর করেন,নয়তো পুড়িয়ে দেন। এখানে এই অবলা প্রাণীটার কী দোষ? তাকে এইভাবে মারধোর করবেন কোন ভিত্তিতে ?’

-‘দোষ আছে দেখেই বলছি। বিড়াল পথ কাটলে বিপদের আশংকা থাকে। আর এই ভূতুড়ে বিড়ালটা পথ কাটলে তো বিপদ নিশ্চিত। আজকে সকালে আমাদের ভাই বাড়ি থেকে বার হওয়ার সময় এই অপয়া বিড়ালটা রাস্তা কেটেছিলো। আর সেইজন্যই ভাইয়ের এক্সিডেন্ট হয়েছে।

এই তোরা হা করে কি দেখছিস,জলদি পি*টা, পি*টিয়ে শেষ করে দে হতচ্ছাড়াটাকে।

লোকটার বলা শেষ দুটো বাক্য যেন আমার ভিতরের পুরুষত্বটাকে নাড়া দিলো। এক লাফে গিয়ে বিড়ালটা হাত থেকে কেড়ে নিয়ে ঝোপের দিকে ছুঁড়ে মারলাম।

কালো বিড়ালের আতঙ্ক

এবার দানব আকৃতির লোকটা ক্ষুব্ধ হয়ে বললো, -‘তোর এত বড় সাহস, আমাদের কাজে বাঁধা দিস।তখন থেকে ভালোভাবে কথা বলছি দেখে গায়ে লাগছে না।

এই এটাকে আগে শেষ করতো,তারপর ওটাকে দেখছি। তোরা দুজনে গিয়ে ওটাকে ধরে আন।

দুটোকেই মেরে এইখানে পুঁতে রেখে রেখে দিবো।

কথাগুলো শেষ না করতেই সামনে দাঁড়িয়ে থাকা দুজন লোক হাতে থাকা লাঠিগুলা নিয়ে রুদ্ধশ্বাসে আমার দিকে তেড়ে এলো।

আমি কোনকিছু বুঝবার আগেই সপাটে নেমে আসলো মাথার উপরে।

অসহ্য এক তীব্র যন্ত্রনায় চেচিয়ে উঠে মাথায় হাত দিয়ে মাটিতে বসে পড়লাম আমি।

হাত জোড়া রক্তে ভিজে গিয়েছে বুঝতে পারছি। স্নায়ু গুলো ক্রমশই অবশ হয়ে আসছে। হাত-পা থরথরানি দিয়ে কাঁপছে। চোখজোড়াও নিদ্রা যাওয়ার জন্য ইতিমধ্যে মস্তিষ্কের সাথে যুদ্ধ শুরু করে দিয়েছে।

একটা আর্তনাদ করে মাটির উপরে শুয়ে পড়লাম। আধা নিমজ্জিত চোখ জোড়া দিয়ে দেখলাম বাকি দুজন বিড়ালটাকে ধরে এনেছে আবার।

বিড়ালটা পূর্বের ন্যায় আবার দাঁত খেঁচিয়ে গোঙানি দিচ্ছে বাঁচবার জন্য।

একজন রশি দিয়ে বিড়ালটার চার হাত-পা বেঁধে আমার সামনে ফেলে দিলো। তারপর বয়োজেষ্ঠ্য লোকটা পৈশাচিক হাসি দিয়ে বললো, -‘ এইযে পশুদরদের ফেরিওয়ালা,এইবার কে রক্ষা করবে পাঁজি বিড়ালটাকে? এই নে দেখ।

বলেই চারজন একসাথে হাতের লাঠি দিয়ে বিড়ালটার মাথা বরাবর স্ব জোরে আঘাত করে বসলো।

বিড়ালটা আঘাত খেয়ে বাচ্চা শিশুর মত চার হাত-পা ছড়িয়ে আর্তনাদ করে উঠে মূহুর্তে আবার নিস্তব্ধ হয়ে গেলো!

মূর্ছা যাওয়ার আগ মূহুর্ত পর্যন্ত বিড়ালটার চোখের দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলাম আমি।

বিড়াটাও ছলছল দৃষ্টি নিয়ে আমার চোখের দিকে তাকিয়েই দুনিয়ার মায়া ত্যাগ করলো।

অসহ্য যন্ত্রনা আর অবলা প্রাণীটাকে বাঁচাতে না পারার তীব্র কষ্টে চোখ জোড়া অশ্রুতে ভরে উঠলো আমার। পাহাড় সমান ঘৃণা নিয়ে ধিরেধিরে আমার চোখ দুটোও বুঁজে আসলো।

চোখ খুলতেই দেখলাম মাথার উপর সিলিং ফ্যানটা চক্রাকারে ঘুরছে। চোখের দৃষ্টি নাড়াতেই মাথায় অসম্ভব রকমের ব্যাথা অনুভূত হলো।

আমার স্ত্রী শিয়রে দাঁড়িয়ে আছে।

তার মুখের অভিব্যক্তিতে দুশ্চিন্তা আর ভয় দুই-ই মিশে আছে।

ধড়মড়িয়ে আমাকে উঠতে দেখে সুমি বলে উঠলো, -‘এখনি উঠো না প্লীজ,তোমার মাথায় প্রচন্ড আঘাত লেগেছে।

ডাক্তার বলেছে তোমাকে রেস্ট করার জন্য।’

সুমিকে অসহায়ের দৃষ্টিতে হাতটা চেপে ধরতে দেখে নিজেকে সামলিয়ে নিলাম।

তারপর বললাম, -‘আমি এখানে কীভাবে আসলাম?’

কেবিনের ভিতরে অজ্ঞাত এক ভদ্রলোক এসে বললো, -‘আমি আপনাকে নিয়ে এসেছি। গতকাল রাতে বাসায় ফেরার সময় দেখি আপনি জ্ঞানশূন্য অবস্থায় রাস্তার এক পাশে পড়ে আছেন।

মাথা ফেটে গিয়ে রক্তে একবারে যাচ্ছেতাই অবস্থা! তাড়াহুড়ো করে আমিই তারপর আপনাকে হাসপাতালে নিয়ে এসে ভর্তি করিয়ে দেই। ‘

সুমি হাতটা চেপে ধরে বললো, -‘জানিনা সঠিক সময়ে তোমাকে হাসপাতালে না নিয়ে আসলে কি হতো? ভাইয়া আপনার ঋণ পরিশোধের অযোগ্য আমি।’

ভদ্রলোক মৃদু হেসে বললো, -‘মানুষ মানুষেরই জন্য। আচ্ছা আমি এখন যাই তাহলে। অন্য আরেক সময় এসে দেখে যাবো।’

আমি হকচকিয়ে বলে উঠলাম, -‘আচ্ছা আপনি ওখানে আর কাউকে দেখতে পান।নি? মানে ওখানে আমার পাশে একটা বিড়ালও ছিলো,ওটাকে দেখতে পান।নি?’

ভদ্রলোক কিছুক্ষণ চুপ থেকে তারপর বললো, -‘কোই না তো,আমি শুধু আপনাকেই দেখেছিলাম। আর দেখলেও হয়তো ওতটা মালুমে আনিনি। আপনাকে হাসপাতালে আনার তাড়াহুড়োতে হয়তো অন্যকিছু দেখবার সময় হয়ে ওঠেনি আর। ডাক্তার বলেছে আপনার মাথায় চোট লেগেছে।

অযথা চিন্তা করলে নিজে তো কষ্ট পাবেনই,সাথে আপনার পাশের মানুষটারও দুশ্চিন্তা আর কষ্ট দুটোই বাড়বে। ওসব চিন্তা ঝেড়ে ফেলে দিয়ে একটু ঘুমানোর চেষ্টা করুন। ব্রেইনকে একটু রিফ্রেশ হতে দিন।

আর আমি এখন যাচ্ছি,পরে একসময় এসে আবার দেখে যাবো।’

ভদ্রলোক উত্তরের আশা না করে বেরিয়ে গেলো কেবিন ছেড়ে।

আমি সুমির দিকে তাকিয়ে দেখলাম তার চোখ দুটো টলমল করছে। আর কোনো প্রশ্ন না করে চুপচাপ হাত দুটো ধরে চোখ বন্ধ করে শুয়ে রইলাম।

আজ দু সপ্তাহ পর হাসপাতাল থেকে রিলিজ দিয়েছে আমাকে।

এখন অনেকটাই সুস্থ আমি,তবে মাথার আঘাতটা এখনো পুরোপুরি সেরে ওঠেনি।

এখনো মাথায় ব্যান্ডেজ বাঁধা।

এই কয়দিনে আমি যতবারই একাকি থেকেছি সেদিনের সেই করুন ছলছল চোখজোড়া আমার চোখের সামনে ভেসে উঠেছে বারবার। আঁখিদুটো আমার দিকে করুন দৃষ্টিতে তাকিয়ে বারবার বাঁচার জন্য আর্তনাদ করে ডেকেছিলো আমায়। আমি বাঁচাতে পারিনি অবলা প্রাণীটাকে। বড্ড খারাপ লাগছে বিড়ালটার জন্য।

রাতে ঘুমের ভিতরে একরকম অস্বস্তি অনুভব হওয়াতে হঠাৎ করে ঘুমটা ভেঙে গেলো আমার। তন্দ্রাচ্ছন্ন ঘোর কাটিয়ে উঠতেই মনে হলো রুমের ভিতরের পরিবেশটা কেমন জানি ভারি হয়ে উঠেছে।

ড্রিম লাইটের ঘোলাটে আলোতে জানালার দিকে চোখ পড়তেই তন্দ্রাচ্ছন্ন ভাবটা কেটে গেলো তারপর।

চোখ জোড়া মুছে জানালার দিকে তাকাতেই মনে হলো একজোড়া জলন্ত চোখ শীতল দৃষ্টিতে আমার দিকে অপলকভাবে তাকিয়ে আছে।

চোখের দৃষ্টি খানিকটা ক্ষীণ করতেই নিজের মনে বলে উঠলাম, -‘তুই বেঁচে আছিস! আমি জানতাম তোর কিছু হবেনা। একদিনের ক্ষনিকের পরিচয়ে যাকে এতটা আপন করে ফেলেছি, সে এত সহজে আমাকে ছেড়ে চলে যেতে পারেনা।’

জানালার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা চার পায়ে প্রাণীটা অদ্ভুত একটা শব্দে ডেকে উঠলো। মেউ মেউ করে।

আওয়াজটা কানে আসতেই সরু একটা হাসি ফুটে উঠলো আমার ঠোঁটে। জানালার গ্রিল ভেদ করে অবয়বটা ভিতরে প্রবেশ করতেই, আমিও হিতাহিত জ্ঞান ভুলে জানালার দিকে পা বাড়িয়ে এগিয়ে গেলাম তার দিকে।

মেয়রের ৬৫তম জন্মদিন আজ। জন্মদিন উপলক্ষে মেয়রের গেস্ট হাউজে বড়সড় পার্টির আয়োজন করা হয়ছে। শহরের নাম করা সকল ব্যক্তিবর্গ এসেছেন সেই পার্টিতে। লাল-সবুজ ফেয়ারি লাইট দিয়ে সাজানো হয়েছে পুরো গেস্ট হাউজ।

মেয়ের তাঁর জন্মদিন উপলক্ষে কোনকিছুর খামতি রাখেন নি। তার জন্মদিনের পার্টিতে।

এক কর্ণারে থাক থাক করে সাজানো আছে দেশি বিদেশি নানান পদের পানীয় সমাহার। সেই সাথে মনোরঞ্জনের জন্য আছে রাত পরীদের মনকাড়া নৃত্যের আয়োজন। আজকের এই রাতে কারোও খেতে মানা নেই। যার যত ইচ্ছে মন ভরে রঙিন পানি গাণ্ডে পিণ্ডে গিলছে আর মনোরঞ্জন লুফে নিচ্ছে।

গেস্ট হাউজের এক কর্ণারে দাঁড়িয়ে আছে, মেয়রের ডান হাত রমিজ সাথে তার চ্যালাপেলার দল।

রমিজ নিজে রঙিন পানির গ্লাস হাতে নিয়ে ওদেরকে উদ্দ্যেশ্য করে এলোমেলো একটা ছন্দ বলে উঠলো, -“আজকে কোনো নেই মানা, পথ হারাতে।

রঙিন পানি খেয়ে হবো দিশেহারা,বাড়ির পথের ঠিকানা রইবে নাকো কারো জানা।”

অখাদ্য ছন্দ বলার পর পিঠ চাপড়ে বললো, -‘খা যার যত ইচ্ছা খা। একবারে গলা পর্যন্ত খা সবাই।’

রমিজের পাশে থাকা সবার কনিষ্ঠ, রতন বোলে উঠলো, -‘বড় ভাই এইগুলার ভিতরে সবচায়তে দামি কোনটা? সেইটা খাবো।’

রমিজ ফ্যাসফ্যাস করে হেসে টলমলানো গলায় বললো, -‘এই কে আছিস,ছোকরাটাকে এক গ্লাস রেড ওয়াইন দেতো। জীবনে শুধু নাম শুনেছিস,আজ আমার বদৌলতে নিজের পেট পর্যন্ত চলে যাবে বুঝলি। এই হলো রমিজের পাওয়ার। কী? ‘

ছেলেটা অস্ফুটে কণ্ঠে বলে, -‘পাওয়ার।’

-‘হ্যাঁ। সবকিছু পাওয়ার। যার পাওয়ার আছে তার সবকিছু আছে বুঝলি সবাই?’

সবাই এক বাক্যে রমিজের কথার উত্তরে বোলে উঠে, -‘হ্যাঁ বড় ভাই।’

রমিজ এবার খুশিতে গদগদ হয়ে বলে, -‘এই ওয়েটার, একজন নয় সবাইকে একটা করে রেড ওয়াইনের বোতল দে।’

রমিজ সবাইকে একটা করে বোতল দিতে বলে সামনে এগিয়ে যায়।

লাল ড্রেস পরে রাত পরীর দল নৃত্য করছে।

রমিজের খুব ইচ্ছা করছে তাঁদেরকে ছুয়ে দেখবার। অনেকদিন হলো মেয়েদের শরীরের ঘ্রাণ নেওয়া হয়ে ওঠেনি তার।

কিন্তু মেয়র আর পার্টিতে আসা ব্যক্তিবর্গের সামনে হাত দেওয়াটা ঠিক হবেনা। এতে উভয়ের ইমেজের ক্ষতি হতে পারে। এসব ভেবে নিজেকে দমিয়ে নেই সে। তারপর আবার রঙিন পানি গলায় ঢালতে শুরু করে।

রেড ওয়াইন খেয়ে পা টলমল করছে রতনের,জীবনে প্রথমবারের মত এত দামি পানি পেটে পড়েছে কি না।

পাশে থাকা সজিবকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠলো রতন, -‘এই, বাথরুমটা কোন দিকে রে?’

সজিবেরও একই অবস্থা,হুশ জ্ঞান সব আজ রঙিন পানির গ্লাসে ডুবিয়ে দিয়েছে সে।

মাতলামো স্বরে বলে উঠলো, -‘ধুর সালা, আমি ক্যামনে কমু। মেয়র কি আমার বাপ লাগে,যে তার ঘরের খবর রাখবো আমি।

যা গিয়ে নিজে খুঁজে নে।

সালা লুজার। যা খেতে পারিসনা তা গোগ্রাসে গিলতে যাস কেন?’

রতনও কয়েকটা মিডিল ক্লাস গালি দিয়ে টলতে টলতে গেস্ট হাউজের বাহিরে চলে আসে।

চোখের সামনে সবকিছু ধোঁয়াশা লাগছে এখন। তারউপর আবার জোনাকি পোকার ন্যায় জ্বলতে থাকা ফেয়ারি লাইটের রঙিন আলোতে চোখ ধাঁধিয়ে আসছে তার। ফ্রি-তে পেয়ে একদম আকণ্ঠ পান করেছে সে।

বাহিরের ঠান্ডা বাতাস লাগতেই শরীরটা গুলিয়ে উঠলো। হাঁটু গেড়ে ওখানেই মুখ ভরে বমি করলো কয়েক দফা। আর হাঁটতে ইচ্ছা করছেনা রতনের।

তবুও মদের নেশা তাকে পেয়ে বসেছে। এত দামি দামি ব্রান্ডের পানি সে বাপের জন্মেও দেখেনি,পান করা তো দূরকা বাত। আজকের রাতটা চলে গেলেই আবার একটা বছর অপেক্ষা করতে হবে।

তাই আজকের রাতটা সে মিস করতে চায় না।

টলমল পায়ে ভর দিয়ে উঠে আবার হাঁটতে লাগে রতন।

গেস্ট হাউজে ঢুকবার সময় ওর চোখে পড়লো বাথরুমটা। ভাবলো চোখে মুখে পানি দিলে হয়তো ঘুমঘুম ভাবটা একটু কমে যাবে। তখন আরও বেশি করে খেতে পারবে সে।

দেওয়াল হাতড়িয়ে এক পা এক পা করে বাথরুমের দিকে এগিয়ে গেলো রতন। বাথরুমের ভিতরে এসেও আরেকবার বমি করলো সে। তারপর ট্যাব ছেড়ে ঠান্ডা পানি মুখে মারতে খানিকটা স্বস্তিবোধ করলো।

টিস্যু ছিঁড়ে মুখ মুছে বার হতে যাবে,ঠিক তখনি সামনে থাকা আয়নার ভিতরে একজোড়া চোখ দেখে থমকে দাঁড়ালো রতন!

চোখ কচলে আবার আয়নার দিকে তাকাতে দেখলো সে ব্যতীত আর কেউ নেই।

নিজেই নিজেকে বিশ্রী ভাষায় একটা গালি দিয়ে গালে হাল্কা থাপ্পড় মেরে বললো, -‘হুঁশে আয় রতন। তোর এখনো অনেককিছু করার বাকি।’

কথাটা বলে পাশ ফিরতেই আবার মনে হলো আয়নার ওপাশ হতে সত্যিই একজোড়া তীক্ষ্ণ দৃষ্টি তাকে দেখছে!

আবার ঘুরে দাঁড়ালো রতন। এবার সামনের হাত দুটোতে ভর দিয়ে খানিকটা ঝুঁকে আয়নার দিকে তাকালো সে।

তারপর বোকার মত হেসে বললো, -‘না আর খাওয়া যাবেনা। বরং গিয়ে দু তিনটা বোতল শার্টের ভিতর লুকিয়ে বাড়িতে নিয়ে যেতে হবে। হ্যাঁ এটাই ভালো হবে।’

কথাগুলো বলে ঘাড় ঘুরাতেই কাঁধের উপর একটা ভারি বাতাস অনুভব করলো সে।

ভয়ে আতকে উঠে বললো, -‘কোন শু** বাচ্চারে,লুকিয়ে লুকিয়ে কেন নাটক করছিস। সাহস থাকলে সামনে আয়। দেখি বুকের দম কতটুকু।’

কথাটা বলে শার্টের নিচে থাকা ধারালো চাকুটা বার করে শক্ত হাতে আঁকড়ে ধরে একটা ঘুরানি দিলো সে। কিন্তু পরক্ষণেই মনে হলো, সে হাওয়ার মাঝে হাত ঘুরাচ্ছে। এইখানে সে ছাড়া আরে কেউ নেই।

বুঝতে পারলো এইসবই তার মনের ভ্রম। গলা পর্যন্ত খাওয়ার কারণে এমন উল্টা পাল্টা লাগছে তার। বড্ড অস্বস্তি লাগছে এখন।

সিদ্ধান্ত নিলো বাথরুম থেকে বেরিয়ে সোজা বাড়ি যাবে সে।

কালো বিড়ালের আতঙ্ক

‘অতি লোভে তাঁতি নষ্ট’ করার মত বোকামি করতে চায় না সে।

যেমন কথা তেমন কাজ। বাথরুম থেকে বেরিয়ে সোজা পার্কিং-এ চলে গেলো রতন।

রমিজ ভাইয়ের গাড়ির চাবি তার কাছেই আছে। গাড়ি দিয়ে গেলে দ্রুত পৌঁছানো যাবে। পরেরটা পরে সামলে নেবে সে।

দ্রুত পায়ে গাড়ির দিকে যাওয়ার সময় রতনের মনে হলো কেউ তার নাম ধরে ডাক দিলো পিছন থেকে।

ঘুরে দাঁড়িয়ে বললো, -‘সজিব। তুই এইখানে কি করছিস?’

সজিব কাছে এসে শান্ত গলায় বললো, -‘আজ বহুত গিলে ফেলেছি রে।

বিশ্বাস কর বাপের জন্মেও এমন খাইনি কখনো। পায়ে হেঁটে বাড়ি যাওয়া একবারে অসম্ভব। চল আমাকে গাড়ি করে নামিয়ে দিয়ে আসবি।’

রতন একটু হেসে বললো, -‘আমিও চলেই যাচ্ছিলাম। রমিজ ভাই তো এইখানেই আজ সারারাত কাটিয়ে দেবে। আর কুদ্দুস সেও তো কম মা*বাজ নয়। দেখবি একজনকে ধরে দিব্যি রাত পার করে দিবে।

তারপর দুজনেই একসাথে হেসে উঠে বলে।

-‘চল তাহলে।’

কথাগুলো বলার পর দুজনে গাড়িতে উঠে পড়ে।

গাড়িতে চাবি দিয়ে লুকিং গ্লাসটা ঠিক করতে গিয়ে হকচকিয়ে উঠে রতন।

পাশের সিটে সজিব বসে আছে,অথচ গ্লাসে তাকে দেখা যাচ্ছেনা!

চমকে উঠে এক পলকে আয়না আবার তারপর পাশের সিটের দিকে তাকায় সে।

কিন্তু না,পাশের সিটে সজিব বসে থাকলেও গাড়ির মিররে সজিবের শরীরটা সম্পূর্ণ অদৃশ্য! শরীরের পরিবর্তে সোজা তার পিছনে থাকা সিট কাভারটা দেখা যাচ্ছে! চোখ কচলে আবার আয়নার দিকে তাকায় রতন,আবারও একই দৃশ্য!

ভয়ে শিহরিত হয়ে কেপে উঠে তার পুরো শরীর।

তারপর বিস্ফারিত চোখে সজিবের দিকে তাকাতেই সজিব সামনে তাকিয়ে বলে, -‘গাড়ি স্টার্ট দে রতন।’

কথাটা শুনতেই ভয়ে আতকে উঠে রতন।

সজিবের গলা সে ভালোমতো চেনে।

এই গলার স্বর সজিবের নয়। কেউ যেন অনেক দূর হতে ঘ্যাড়ঘ্যাড়ে কণ্ঠে কথাগুলো বলছে,আর সজিব সেই কথার তালে ঠোঁট নাড়াচ্ছে মাত্র।

কাঁপা কাঁপা গলায় রতন বলে ওঠে, -‘ সজিব,কি হয়েছে তোর! এমনভাবে কথা বলছিস কেন?’

রতনের কথা শুনে সজিব এবার ঘাড় ঘুরিয়ে রতনের দিকে তাকাতেই রতন ছিটকে সরে গিয়ে সিট থেকে দরজার গায়ে পড়ে।

সজিবের চোখের মনি দুটো আর স্বাভাবিক নেই। কালো মনির পরিবর্তে একজোড়া হলদেটে জলজলে চোখাল মনি ফুটে উঠেছে।

আতঙ্কিত গলায় বলে উঠে রতন, -‘একি! তোর চোখ গুলো ওমন দেখাচ্ছে কেন?’

সজিব মিশ্র একটা হাসি দিয়ে বোলে উঠে, – কেমন দেখাচ্ছে রে? বিড়ালের চোখের মত তাই না?’

-‘হ্যাঁ। কিন্তু একটু আগেও তো ঠিক ছিলো।’

সজিব এবার হো হো করে হেসে বলে ওঠে, -‘ঠিকি ধরেছিস তুই। এই চোখ দুটো বিড়ালেরই চোখ।’

কথাটা শেষ হতেই দেখলো সজিবের রক্ত মাংসের শরীরটা ধিরে ধিরে দুমড়ে মুচড়ে বাঁকা হয়ে যাচ্ছে।

এমন ভয়ানক দৃশ্য দেখে রতনের কোক ভয়ে পানিশূন্য হয়ে গেলো একমূহুর্তে। মেরুদন্ড বেয়ে সমস্ত ভয় যেন নিংড়ে রক্তের শিরায় শিরায় পৌঁছে যাচ্ছে।

রতন দেখলো হাড় মাংসের মানুষটা দুমড়ে মু্চড়ে গিয়ে একটা বিড়ালের আকৃতি নিয়েছে।

কালো মিশমিশে একটা বিড়াল!

রতনের চোখ যেন আর এসব নিতে পারলো না। অসহ্য এক যন্ত্রনা আর তীব্র ভয় নিয়ে গাড়ির দরজা খুলে নেমে পালাতে গেলো সে।

কিন্তু ভয়ের তীব্রতা তাকে পঙ্গু বানিয়ে দিয়েছে। গাড়ি থেকে নামতেই ধপ করে নিচে পড়ে গেলো সে। মুখ দিয়ে চিৎকার দিয়ে লোকজনকে জানিয়ে দিতে চাইলো,কিন্তু একি পায়ের সাথে সাথে তার বাকশক্তিও যেন হারিয়ে গিয়েছে।

শত চেষ্টার পরও মুখ থেকে একটা শব্দও উচ্চারিত হলো না। তারপর বাঁচার শেষ চেষ্টা করতে বুকে ভর দিয়ে পালাতে চাইলো রতন।

ভয়ার্ত চোখে দেখলো বিড়ালটা গাড়ি থেকে নেমে তার দিকে এগিয়ে আসছে সন্তপর্ণে।

ঠিক যেমটা শিকারী তার শিকারকে ধরবার জন্য এগিয়ে আসে। বিড়ালের চোখ দুটো জলজল করছে আগুনের শিখার মত।

রতনের চোখের সামনে একমূহুর্তের জন্য কিছুদিন আগে ঘটানো একটা পাপ কর্ম ভেসে উঠলো।

স্থির চোখে দেখলো,সে নিজে সহ আরও তিনজন একটা বিড়ালকে বেঁধে মাটিতে ফেলে রেখেছে।

বিড়ালটা হাত-পা ছুড়ে বাঁচার জন্য আর্তনাদ করছে। আর তারা চারজন পৈশাচিক হাসি নিয়ে বিড়াটার দিকে এগিয়ে আসছে।

রতনের আর কিছু বুঝতে বাকি রইলো না।

সে হাউমাউ করে কেঁদে ফেলে নিজের প্রাণ ভিক্ষা চাইতে লাগলো বিড়ালটার কাছে।

কিন্তু বিড়ালটা তার আকুতি অনুনয়ের তোয়াক্কা না করে এক লাফে রতনের শরীরের উপর পড়ে ধারালো নখের আঁচড়ে ছিন্নভিন্ন করে দিলো রতনের দেহটা।

সুচালো স্ব দন্ত দিয়ে একের পর এক কামড় বসিয়ে শরীর থেকে খুবলে খুবলে মাংস আলাদা করতে লাগলো। ভয়ানক এক আর্তনাদে কেঁপে উঠলো গেস্ট হাউজের পার্কিং লট।

 

{ আরো পড়ুন – চিৎকার

( কালো বিড়ালের আতঙ্ক গল্পটি আপনাদের কেমন লাগলো তা কমেন্ট করে অবশ্যই জানাবেন। পরবর্তী পর্বের জন্য আমাদের সাথেই থাকুন । ধন্যবাদ।)