মুকুন্দপুরের অভিশপ্ত পিশাচ

প্রথম পর্ব

মুকুন্দপুরের অভিশপ্ত পিশাচ-

মুকুন্দপুর গ্রামটি বেশ বর্ধিষ্ণু গ্রাম.. গ্রামে প্রায় ছয় সাতশো পরিবারের বাস.. গ্রামের বেশিরভাগ মানুষ কৃষিজীবি হলেও. কিছু মানুষ ছোটো বা মাঝারি শিল্প কর্মের মধ্যে দিয়ে নিজেদের জীবিকা নির্বাহ করে | স্কুল. স্বাস্থকেন্দ্র. পোস্টঅফিস. সবকিছুরই আছে গ্রামে.. সেখানের বেশিরভাগ মানুষ অশিক্ষিত হলেও তারা কুসংস্কারছন্ন নয়.সবকিছুই তারা বাস্তব বুদ্ধি দিয়ে বিবেচনা করতে জানে.. মোট কথা হলো গ্রামের মানুষগুলো সহজ সরল হলেও তারা বাস্তব বুদ্ধি সম্পন্ন।

গ্রামের পশ্চিমপ্রান্তে ফাঁকা মাঠের একপাশে বহু পুরানো একটি শিবমন্দির আছে. মন্দিরটি বহু পুরানো এই ধারণা সবার আছে. কিন্তু কতো পুরানো সেই ধারণাটা গ্রামের প্রবীণ থেকে প্রবীণতম মানুষেরও নেই  কারও মতে এটা দুশো বছর পুরানো  কারও মতে পাঁচশো বছর  আবার কারও কারও মতে হাজার বা দুহাজার বছর পুরানো মন্দিরটি .. মন্দির যতই পুরানো হোকনা কেনো আজও তার ঐতিহ্য মানুষকে সমান আকৃষ্ট করে।

প্রত্যেক শিবরাত্রির দিন মন্দির প্রাঙ্গনে বিরাট মেলা বসে. গ্রামের মেয়েরা দলবেঁধে মন্দিরে গিয়ে শিবের মাথায় দুধ অর্পণ করে আসে. শুধু মুকুন্দপুরই নয়. আশপাশের বেশ কয়েকটি গ্রাম থেকেও বহু মানুষ এই মেলায় ঘুরতে আসে।

এইভাবেই বছরের পর বছর চলে আসছে এখানের মানুষের বৈচিত্রপূর্ণ জীবন।

গ্রামেরই একপাশে মনোহর বাঁড়ুজ্জের বাড়ী  তেজারতি কারবার করে সে বেশ দু পয়সা করেছে . তিনি অত্যান্ত সজ্জন এবং দয়ালু মানুষ  গ্রামের কারও কোনো সমস্যার কথা জানতে পারলে তিনি নিজে গিয়ে সেই সমস্যার সমাধান করে আসেন . কার টাকার অসুবিধা কার মেয়ের বিয়ে কার সংসারে অভাব  মনোহর বাবু সবারই পাশে দাঁড়ান তার কাছে কেও কোনো প্রয়োজনে এলে কেও খালি হাতে ফেরেনা।

এজন্য সারা গ্রামের মানুষ তাকে দেবতার মতো সন্মান করে.তার মুখের উপর কেও কথা বলেনা কিন্তু এতকিছু থাকার সত্বেও তার সংসারে সুখ ছিলোনা কারণ তিনি নিঃসন্তান ছিলেন. মনোহর বাবুর মতো তার স্ত্রী কেও গ্রামের সকলে ভালোবাসতো তার সবার প্রতি স্নেহ এবং মিষ্টি ব্যবহারের জন্য গ্রামের অল্প বয়সী মেয়ে বউরা প্রত্যেকদিন মনোহর বাবুর স্ত্রী অন্নপূর্ণা র কাছে এসে গল্প গুজব করে সময় কাটাতো এতে তার মন পরিপূর্ণ হয়ে যেত সন্ধ্যায় সবাইকে বাটি করে মুড়ি মুড়কি খেতে দিতো সেগুলো খেয়ে যে যার বাড়ী ফিরে যেত।

গ্রামের একেবারে শেষ প্রান্তে মাঠের প্রায় মাঝখানে স্মশান আছে. স্মশানটি বেশ বড়ো মুকুন্দপুর গ্রাম ছাড়াও পাশের আরও দু তিনটি গ্রামের লোক এই স্মশানে মরা পোড়াতে আসে. স্মশানের পাশেই একটি বিশাল অশ্বত্ব গাছ আছে সেই গাছের গায়েই ঝুপড়ি বানিয়ে একজন তান্ত্রিক মতো লোক থাকে রুক্ষ স্বভাব এবং বিশ্রী মুখের ভাষার জন্য কেওই তার কাছে ঘেঁষতো না. শুধু মাঝে মাঝে গ্রামের দু একজন অশিক্ষিত চাষাভুসো মানুষ তার কাছে টুকটাক মাদুলি জলপড়া আনতে আসতো তাদের ছেলেপুলের জ্বর টর হলে

এছাড়া কেও তার কাছে আসতো না গ্রামের বেশিরভাগ মানুষ এই সব আজগুবি কুসংস্কার বিশ্বাস করতো না তাদের বা তাদের পরিবারের কারও শরীর খারাপ করলে তারা ডাক্তারখানা বা হাসপাতালেই নিয়ে যেত. এই সব মাদুলি. জলপড়া তারা বিশ্বাস করতো না।

এইরকম করেই গ্রামের মানুষগুলির জীবন বেশ সুখে স্বাচ্ছন্দে কেটে যাচ্ছিলো. এইসময় সেখানে হঠাৎই এক ভয়ানক সমস্যার সৃষ্টি হলো. পর পর দু বছর বর্ষায় ভালোকরে বৃষ্টি না হওয়ায় গ্রামের সর্বত্রই চাষ বাস এবং পানীয় জলের সমস্যা হচ্ছিলো.

এবারের বৈশাখ মাসের মাঝামাঝি সেই অসুবিধা চরমে পৌছালো. চাষবাস তো দূরের কথা.খাবার জলটুকুও পাওয়া দুস্কর হয়ে পড়লো. গ্রামে পানীয় জলের জন্য যেসব পুকুর ছিলো সেগুলো আগেই শুকিয়েছে. গ্রামের স্কুলের পাশে সরকার থেকে করা একটা কুয়ো ছিলো. পুকুর শুকিয়ে যাওয়ার পর গ্রামের লোকেরা এতদিন এই কুয়ো থেকেই প্রয়োজনীয় জল নিচ্ছিলো।

কিন্তু এই প্রচন্ড গরমে কুয়োটাও প্রায় শুকিয়ে আসায় গ্রামের লোক প্রচন্ড জলকষ্টে পড়লো. এই অবস্থায় গ্রামের লোকেরা তাদের একমাত্র ভরসা মনোহর বাবুর কাছে ছুটে গেলো. মনোহর বাবু তাদের কথা শুনে পরেরদিনই দুজনকে সঙ্গে নিয়ে কুয়ো খননের মিস্ত্রির সন্ধানে বেরিয়ে গেলেন।

সারাদিন তারা দু তিনটি গ্রাম ঘুরে কুয়ো খননের জন্য প্রয়োজনীয় লোকজন সঙ্গে নিয়ে সন্ধ্যায় গ্রামে ফিরে এলেন. রাতটুকু মনোহর বাবুর দেউড়িতে কাটিয়ে ভোর হতেই তারা কাজ আরম্ভ করে দিলো. কুয়ো খননের জায়গা আগে থেকেই ঠিক করা ছিলো. গ্রামের পশ্চিম প্রান্তে যে পুরানো শিব মন্দিরটি আছে তার একটু তফাতেই কুয়ো খননের কাজ চলছে. মনোহর বাবু সারাদিন নিজে দাঁড়িয়ে থেকে তাদের কাজ তদারক করতে লাগলেন. |

সারাদিন কাজ চললো. সন্ধ্যার কিছু পূর্বে কাজ একটু বাকি থাকতেই তারা কাজ বন্ধ করলো. আগামীকাল ঘন্টা দুয়েকে খনন করলেই কাজ সম্পন্ন হবে. তারা উপরে ওঠার তোড়জোড় করতে লাগলো. এই সময় হটাৎই একজনের দৃষ্টি পড়ে মাটির নিচ থেকে কি একটা ধাতু একটু বেরিয়ে আছে. একজন মজুর কোদাল দিয়ে সেখানের একটু মাটির খুঁড়তেই একটা ছোটো তামার ঘটিজাতীয় পাত্র বেরিয়ে এলো।

পাত্রটির মুখটা একটা ঢাকনা দিয়ে বন্ধ করা. সবচেয়ে আশ্চর্য হলো ঢাকনাটি একটি ধাতুনির্মিত চেন জাতীয় বস্তু দিয়ে বাঁধা আছে. | মজুরটি সেটা তুলে মনোহর বাবুর হাতে দিলো. তিনি হাতে নিয়ে সেটা ভালোকরে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখলেন।

কিন্তু কি জিনিস সেটা বুঝতে পারলেন না. তারপর পাত্রটির মুখের এবং গায়ের লেগে থাকা মাটি জল দিয়ে ধুয়ে পরিষ্কার করতে লাগলেন. ভালোকরে ধুয়ে পরিষ্কার করার পর দেখাগেল ঘটিটির গায়ে এবং ঢাকনায় অস্পষ্ট ভাষায় কি সব লেখা খোদাই করা আছে. অনেক চেষ্টা করেও কি লেখা আছে তা পড়া গেলোনা।

মনোহর বাবু বাড়ী এসে ঘটিতে জড়ানো চেনটা খুলে ঢাকনাটা খোলার চেষ্টা করতে লাগলেন. বেশ কিছুক্ষন চেষ্টার পর ঢাকনাটি খোলা গেলো. ঢাকনা খোলার পর প্রথমে ভিতরে কিছুই দেখা গেলোনা।

মনোহর বাবু ভিতরে হাত ঢুকিয়ে দেখলেন ভিতরের মাটি শক্ত হয়ে আছে. তখন তিনি জল দিয়ে ভিতরের মাটি পরিষ্কার করার কাজে লেগে পড়লেন প্রথমে তিনি শক্ত মাটি কিছুক্ষন জল দিয়ে ভিজিয়ে রাখলেন. তারপর অল্প অল্প করে ধুতে লাগলেন।

প্রায় ঘন্টা দেড়েকের চেষ্টার পর কি একটা ধাতুর মূর্তির মতো জিনিস ঘটির ভিতর চকচক করতে দেখা গেলো. আরও কিছুক্ষন জল দিয়ে মাটি ধোয়ার পর ছোটো মূর্তিটা আলগা হয়ে মনোহর বাবুর হাতে চলে এলো. এই সময় আচমকাই বাড়ীর পিছনের জঙ্গলে প্রচন্ড জোরে ঝোড়ো বাতাস বইতে লাগলো।

আজকে সারাদিন আকাশ পরিষ্কার ছিলো. মেঘের কোনো লক্ষণই ছিলোনা. কিন্তু হটাৎই এখন সারা আকাশ জুড়ে কালো মেঘ চেয়ে গেলো. তারসাথে ঘূর্ণিঝড়. সেই ঝড়ে প্রচন্ড ধুলো উড়তে লাগলো। সেই ধুলোর ঝড় এতো সাংঘাতিক যে এক হাত দূরের জিনিসও দেখা যাচ্ছিলো না. তখন সবাইমিলে মনোহর বাবুর বাড়ীর দিকে দৌড়োতে লাগলো. বাড়ীর ভিতর এসে ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধকরে বসে রইলো সবাই।

ঘরে বসেই সবাই শুনতে লাগলো বাইরের ঝড়ের ভীষণ তান্ডব. এমন ভীষণ ঝড় এর আগে কেও দেখেনি. বাড়ীর পিছনের বাগানে গাছের ডালগুলি মড়মড় করে ভেঙে পড়তে লাগলো।

এই ঝড়ের গর্জন শুনলে ভয়ে বুক কেঁপে ওঠে মনে হয় যেনো কোনো বিশাল দানব প্রচন্ড আক্রোশে ভয়ানক তান্ডব করছে. ভয়ে আর কারও চোখে ঘুম এলোনা. সবাই সারারাত দরজা বন্ধ করে জেগে রাত কাটাতে লাগলো. আর মনে মনে ভগবানকে ডাকতে লাগলো।

ভোরবেলার দিকে ঝড়ের গর্জন আস্তে আস্তে কমতে লাগলো তারপর হঠাৎই যেমন ঝড় শুরু হয়েছিলো তেমনই সেটা বন্ধ হয়েগেলো ঝড় বন্ধ হয়ে গেলে সবাই মনে একটু স্বস্তি পেলো সারারাত জেগে থেকে সকলেই ক্লান্ত ছিলো তাই সবাই ঘুমিয়ে পড়লো।

সকালে বাড়ীর বাইরে থেকে অনেকের ডাকাডাকি তে মনোহর বাবু বাড়ীর বাইরে এলেন. বাইরে আসতেই সবাই মিলে তাকে ঘিরে ধরে চেঁচামেচি করতে লাগলো. মনোহর বাবু সবাইকে শান্ত হতে বললো. যেকোনো একজনকে বলতে বললো কি ব্যাপার. তখন ভীড় থেকে শ্যামাপদ এগিয়ে এসে যা বললো তার সারমর্ম এই ” রায় পাড়ার সুধীর রায় গতকাল দুপুরে পাশের গ্রামে গিয়েছিলো একটা অন্নপ্রাশনের নিমন্ত্রনে. সাথে অবশ্য তার স্ত্রী এবং দুই ছেলেও গিয়েছিলো।

দুপুরে একসাথে খাওয়া দাওয়ার পর সে স্ত্রী ছেলেদের আগে বাড়ী পাঠিয়ে ওই বাড়ীর কর্তার সাথে একটু গল্পগুজব করতে বসে যায়. স্ত্রী কে জানিয়ে দেয় একটু বেলা পড়লে সে বাড়ী ফিরবে. এদিকে একমনে একথা সেকথা বলতে বলতে কখন যে সময় পেড়িয়ে গেছে সেটা সে বুঝতেই পারেনি. যখন খেয়াল হলো তখন প্রায় সন্ধ্যা হবো হবো করছে. তখন তাড়াতাড়ি সেখান থেকে বিদায় নিয়ে সুধীর বাড়ীর উদ্দেশ্যে রওনা দেয়।

পাশের গ্রাম থেকে একটু এসেই একটা মাঠমতো পড়ে. তারপর একটা মাঝারি মতো জঙ্গল পেড়িয়ে তারপর এই গ্রামের সীমানা.| সন্ধ্যার সময় বের হলেও রাত্রি আটটার মধ্যে বাড়ী ফিরে আসার কথা. কিন্তু দশটা বাজার পরেও সুধীর বাড়ী না আসায় তার বাড়ীর লোক একটু চিন্তায় পড়ে গেলো. পরে ভাবলো ঝড়ের জন্য হয়তো সে অন্নপ্রাশন বাড়ীতেই রয়ে গেছে. কাল সকালেই ফিরে আসবে।

ভোরবেলা চাঁপা বাগদির ঘুমভেঙ্গে ধড়পড় করে বাইরে এসে দাঁড়াতে চাঁপা হাঁপাতে হাঁপাতে জঙ্গলের দিকে ইশারা করে তার পিছনে পিছনে আসতে বললো. সবাই তার পিছন পিছন জঙ্গলের রাস্তায় কিছুটা গিয়ে যা দেখলো তাতে সবার বুক ভয়ে আতঙ্কে কেঁপে উঠলো “. মনোহর বাবু বললো. ” কি দেখলো সবাই “.. তখন শ্যামাপদ বললো ” আপনি চলুন বাঁড়ুজ্জে মশাই. গিয়ে নিজের চোখেই দেখবেন”।

তখন সবার সাথে মনোহর বাবু জঙ্গলের দিকে চলতে লাগলেন বেশ খানিকটা আসার পর রাস্তার পাশে একটা ঝাঁকড়া নিম গাছের নিচে বসে সুধীরের স্ত্রী এবং ছেলেদের বুক চাপড়ে কাঁদতে দেখলেন আরও খানিকটা এগিয়ে তাদের কাছে এসে মনোহর বাবু যা দেখলেন. তাতে তার এই দিনের বেলাতেও আতঙ্কে বুক কেঁপে উঠলো।

তিনি দেখলেন মাটিতে সুধীর মরে পরে আছে. আর তার মুন্ডুটা কেও যেনো প্রবল আক্রোশে পিছনের দিকে ঘুরিয়ে দিয়েছে. আর তার চোখ মুখ এতটাই বীভৎস হয়ে গেছে. যেনো মনে হয় মৃত্যুর সময় ভয়ঙ্কর কোনো বিভীষিকা দেখে সে প্রচন্ড ভয় পেয়েছে. সেই দৃশ্য দেখে সেখানে উপস্থিত সকলেই আতঙ্কিত হলো।

অনেকে বলতে লাগলো সুধীর কোনো ডাকাতের পাল্লায় পড়েছিল তাই তার এই অবস্থা হয়েছে. কিন্ত এ গ্রামের সকলেই জানে যে এটা কোনোমতেই সম্ভব নয়. কারণ এখানে কেও কস্মিনকালেও চোর ডাকাতের উপদ্রবের কথা শোনেনি. আর যেভাবে মুন্ডু ঘুরিয়ে দিয়েছে সেটা দেখে মনে হচ্ছে এটা সাধারণ মানুষের পক্ষে কোনোমতেই সম্ভব নয়..

যাইহোক তখনকার মতো সবাই নানা রকম মতামত করতে করতে যে যার বাড়ীতে ফিরে গেলো. আগেই বলেছি গ্রামের লোকেরা কুসংস্কারছন্ন নয়. তাই তাদের মনে ভূত প্রেত বা ওই জাতীয় কোনো অপদেবতার কাজ বলে কোনো সন্দেহ এখনো দানা বাঁধেনি।

দুপুরের দিকে মনোহর বাবু ও গ্রামের বেশ কয়েকজন লোক মিলে সুধীরের দেহটাকে শ্মশানে নিয়ে গিয়ে দাহ করে এলো. দাহ করার সময় সকলের দৃষ্টি চিতার দিকে ছিলো. নাহলে দেখতে পেতো একটা ঝাঁকড়া গাছের আড়ালে দাঁড়িয়ে শ্মশানে থাকা সেই তান্ত্রিকটি বিস্ফারিত চোখে চিতার দিকে তাকিয়ে ভয়ে ঠকঠক করে কাঁপছে।

মৃতদেহ সৎকার করে সকলেই সন্ধ্যার মধ্যে যে যার বাড়ী ফিরে এলো. সবাই এই মৃত্যুটাকে স্বাভাবিক ভাবে নিলেও একটা খটকা সকলের মনেই রয়ে গেলো. কারণ সুধীর সন্ধ্যার আগেই অন্নপ্রাশন বাড়ী থেকে বেরিয়ে পড়েছিল. আর গতকাল সারারাত সেখানে ঝড় হওয়া তো দূরের কথা. সামান্য বাতাস পর্যন্ত হয়নি।

গ্রামের লোকেরা এই মর্মান্তিক ঘটনাটা হয়তো ভুলেই যেত. কিন্তু তার পরেরদিন সকালের ঘটনায় গ্রামের লোকের মনে এক অজানা আতঙ্কের বাসা বাঁধতে আরম্ভ করলো।

গ্রামের একপাশে কমলা নামের প্রায় বছর পঞ্চান্নর এক প্রৌঢ়া বাস করতো. প্রায় বছর পঁচিশ আগে তার স্বামী মারা যায়. একমাত্র ছেলেও বছর দশেক আগে নিউমোনিয়া হয়ে মারা যায়. তাই এই বয়সে সে এগ্রাম সেগ্রাম ঘুরে ঘুরে ভিক্ষা করে নিজের পেট চালায়. গতকালও সে ভিক্ষায় বেরিয়েছিল. সারারাত সে বাড়ী ফেরেনি. তার খোঁজ নেবার মতো কেও ছিলোনা. তাই রাতে সে বাড়ী না ফিরলেও কেও তার খোঁজ খবর নেয়নি।

আজ ভোরবেলা গ্রামেরই দুজন চাষী মাঠে যাবার সময় জঙ্গলের শেষেই মাঠের পাশে একটা গাছের নিচে প্রৌঢ়া ভিখারিনীর মৃতদেহটি দেখতে পায়. সেই একই রকম মৃত্যু. সেই বীভৎস মর্মান্তিক ভাবে মুন্ডু পিছনদিকে ঘোরানো. আর ভয়ে বীভৎস হয়ে যাওয়া চোখ মুখ।

এই দ্বিতীয় মৃত্যুর পর গ্রামের লোকেদের মনে ভীষণ আতঙ্কের সৃষ্টি হলো. যারা এতদিন ভূত অপদেবতা অন্ধ কুসংস্কার বলে মনে করে আসছিলো. আজ তারাও মনে প্রাণে এগুলোকে বিশ্বাস করতে লাগলো. গ্রামের লোকেরা উদ্যোগী হয়ে বিকালের মধ্যে কমলার মৃতদেহ সৎকার করে যে যার বাড়ী ফিরে এলো. যারা বাড়ীর বাইরে কাজের জন্য বেরিয়েছিল. সন্ধ্যার মধ্যেই তারা ঘরে ফিরে এলো. সূর্য ডোবার পরেই যে যার ঘরের দরজা বন্ধ করে দিলো. এতবড়ো গ্রামটা সন্ধ্যার পর যেনো নিঝুম শ্মশানে পরিণত হলো।

এতো সাবধানতার পরেও কিন্তু সকলের অলক্ষে সেই অজ্ঞাত অশরীরী তার কাজ হাসিল করে গেলো ক্রমশ।

 

দ্বিতীয় পর্ব

এবারে তার শিকার চক্কোত্তি পাড়ার ভুবন. রাত্রি প্রায় সাড়ে এগারোটা বারোটা নাগাদ সে প্রকৃতির ডাকে বাইরে আসে. সাথে তার স্ত্রী ও লণ্ঠন হাতে এগিয়ে আসে. ভুবন একটা বাঁশঝাড়ের পিছনে চলে যায়।

একটু তফাতে তার স্ত্রী লণ্ঠন হাতে দাঁড়িয়ে থাকে. আচমকাই একটা খসখস শব্দে তার স্ত্রী সজাগ হয়ে যায়. সে খেয়াল করে এতক্ষন চারপাশে বাতাস বইলেও এখন হঠাৎই বাতাস বন্ধ হয়ে যায়. মনে মনে সে বিপদ আঁচ করে স্বামীকে ডাকার জন্য এগিয়ে যেতে গিয়েই থমকে দাঁড়িয়ে পরে।

তার থেকে বাঁশঝাড়টা মাত্র আট দশ হাত দূরে ছিলো. লণ্ঠনের আবছা আলোয় এতক্ষন সেটা পরিষ্কার দেখা যাচ্ছিলো. | কিন্তু এখন মনে হচ্ছে বাঁশঝাড় আর তার মধ্যে এক গাঢ় অন্ধকারের দেওয়াল তৈরী হয়ে গেছে. সেই অন্ধকার এতোই গাঢ় যে লণ্ঠনের আলো সেই অন্ধকারে ধাক্কা খেয়ে সেখানেই থেমে আছে. আরও আশ্চ্যর্যের বিষয় হলো।

এতক্ষন যে ঝিঁ ঝিঁ পোকারা ডাকছিলো সেই ঝিঁ ঝিঁ র ডাক ও স্তব্ধ হয়ে গেছে. আচমকাই তার নাকে আসে এক বিকট পচা গন্ধ সেই গন্ধ এতটাই উৎকট যে সে প্রায় বমি করে ফেলেছিলো. হঠাৎ ই সে শুনতে পেলো বাঁশঝাড়ের দিক থেকে ধস্তাধস্তির মতো একরকম শব্দ।

সে পিছন ফিরে চেঁচিয়ে লোকজন ডাকার উপক্রম করতেই শুনতে পেলো তার স্বামীর এক মর্মভেদী আর্তনাদ. যেন সে মৃত্যুযন্ত্রণায় ছটপট করছে. আর তার পরেই চোখের সামনে এক ভয়ঙ্কর জিনিস দেখতে পেলো সে. দেখলো এতক্ষন যে একটা অন্ধকারের প্রাচীর তৈরী হয়েছিলো সেটা আরও গাঢ় হয়ে জমাট বাঁধতে বাধঁতে এক বিশাল দানবাকৃতি শরীরে পরিণত হলো।

আর তারপর সেই বিশাল কালো শরীরটা ধীরে ধীরে আকাশের দিকে উঠতে উঠতে মিলিয়ে গেলো. এই দৃশ্য দেখে ভুবনের স্ত্রী অজ্ঞান হয়ে পরে যায়. জ্ঞান হবার পর চেঁচামেচি করে আশপাশের বাড়ী থেকে লোক ডেকে নিয়ে বাড়ীর পিছনে বাঁশঝাড়ের কাছে গিয়ে দেখে তার স্বামী মৃত অবস্থায় পরে আছে. সেই একই অপমৃত্যু।

এরপর গ্রামের লোকেরা মনোহর বাবুর কাছে গেলো এর একটা সমাধান করার জন্য মনোহর বাবু সবার উদ্দেশ্যে বললেন ” দেখুন আমাদের গ্রামে যে ভয়ানক বিপদ নেমে এসেছে এর সমাধান আমাদেরই করতে হবে. এটা মনুষ্যজনিত কোনো বিপদ হলে আমি নিজে শহরে গিয়ে সেখানের থানার পুলিশের সাথে কথা বলে এর একটা সমাধান করার চেষ্টা করতাম।

কিন্তু দুঃখের কথা হলো এখানে যে বিপদটা ঘটে চলেছে সেটা ভয়ানক কোনো অপদেবতার কাজ. কাজেই পুলিশ আমাদের কথা বিশ্বাস করবে না. তাই আমাদেরই চিন্তাভাবনা করে এই ভয়ানক বিপদ থেকে রক্ষা পাবার একটা রাস্তা বের করতে হবে।

সেদিনই একটু বেলা বাড়লে মনোহর বাবু এবং গ্রামের আরও কয়েকজন মাতব্বর গোছের লোককে সঙ্গে নিয়ে শ্মশানে থাকা তান্ত্রিকটির কাছে গেলো. তান্ত্রিক কে কিছু বলার আগে সে নিজেই বললো ” তোমরা যে আমার কাছে আসবে সেটা আমি জানতাম. কিন্ত আমি তোমাদের কতটা সাহায্য করতে পারবো সেটা এখন বলতে পারবো না. কারণ প্রথম দিন সুধীরের মৃতদেহ সৎকার করার জন্য এখানে আনার পর তার মৃতদেহর বৈশিষ্ট দেখেই আমি বুঝেছিলাম এটা কোনো সাধারণ মৃত্যু নয়. এই মৃত্যুর পিছনে ভয়ঙ্কর শক্তিশালী কোনো এক অপদেবতার হাত আছে.

দেখো আমি সামান্য তন্ত্র মন্ত্রের অধিকারী. আর আমার ক্ষমতাও সামান্য. আর সেই অপদেবতা টি কে এবং তার ক্ষমতাই বা কতো সেই সম্বন্ধে আমার এখনও কোনো ধারণা নেই।

তবে আগামীকাল সকালের আগেই তোমাদের জানাতে পারবো যে সেই অপদেবতা টি কে. কি করে এখানে এলো. আর কেনই বা এখানের মানুষদের এইরকম নির্মমভাবে হত্যা করছে.| তোমরা শুধু আমার প্রয়োজনীয় এই উপকরণগুলো এনে দাও. আর একটা জিনিস মনে রাখবে. আজকে সন্ধ্যার পরে গ্রামের কেও যেনো বাড়ীর বাইরে না বের হয়. এমনকি প্রাকৃতিক প্রয়োজনেও যেনো না বের হয়।

কারণ আজ রাত্রি দ্বিপ্রহরে আমি প্রেত সাধনায় বসবো. এবং সেই পক্রিয়ায় আমি সকল অপদেবতা কে জাগ্রত করবো. তবেই জানতে পারবো এই অপদেবতা টি কে. এবং কি তার উদ্দেশ্য।

তোমরা আর দেরি না করে আমার উপকরণের এই জিনিসগুলো এনে দাও.”. সেই মতো মনোহর বাবু তন্ত্রিকের প্রয়োজনীয় উপকরণগুলো শ্মশানে দিয়ে তারাতারি নিজের বাড়ী ফিরে এলেন. সন্ধ্যা হতেই যে যার ঘরে দরজা বন্ধ করে আতঙ্কিত মনে সকালের জন্য অপেক্ষা করতে লাগলো।

রাত্রি নটা বাজতেই তান্ত্রিক প্রয়োজনীয় সামগ্রী নিয়ে ধুনি জ্বেলে যজ্ঞের আয়োজন করতে লাগলো. একটি ছোটো মাটির পুতুল তৈরী করে তাতে সিঁদুরের টিপ লাগিয়ে গলায় জবার মালা পরিয়ে যজ্ঞস্থানের পাশে রাখলো।

সবকিছু প্রস্তুতি সম্পন্ন করার পর সে নিজের দেহবন্ধন করে যজ্ঞে বসলো। প্রায় তিন ঘন্টা মন্ত্রোচ্চারণের পর দুটি শোলমাছ এবং একটি মরা দাঁড়কাক যজ্ঞের আগুনে আহুতি দিলো. সঙ্গে সঙ্গে আগুন থেকে এক উৎকট গন্ধ চারিদিকে ছড়িয়ে পড়লো. কিন্ত সেই গন্ধকেও ছাপিয়ে গেলো অন্য একটি গন্ধ. একটা পচা উৎকট গন্ধে চারপাশের পরিবেশ ভরে গেলো।

পচাগলা শবদেহ দাহ করলে যেমন গন্ধ বের হয়. এই গন্ধটা ঠিক তেমন. আচমকাই সে খেয়াল করলো ইতিমধ্যেই তার চারপাশে এক গাঢ় অন্ধকারের প্রাচীর তৈরী হয়েছে. সেই অন্ধকারের প্রাচীর এতটাই দুর্ভেদ্য যে চোখের দৃষ্টি বার বার সেই অন্ধকারে ধাক্কা খেয়ে ফিরে ফিরে আসছে. তারপর দেখলো সেই অন্ধকারের প্রাচীর টা ধীরে ধীরে একটা বিশাল শারীরিক অবয়বে পরিণত হলো।

এই অন্ধকারেও দেখাগেলো তার আগুনের মতো গনগনে দুটো চোখ. বাতাসে ভেসে ভেসে সেই অশরীরী তান্ত্রিকের সামনে এসে দাঁড়ালো।

প্রথমে দু হাত দিয়ে যজ্ঞের সব উপকরণ ছুঁড়ে ফেলে লণ্ডভণ্ড করে দিলো. তারপর ভয়ঙ্কর দৃষ্টিতে তান্ত্রিকের দিকে তাকিয়ে রইলো।তার ভয়ঙ্কর রূপ দেখে তান্ত্রিকের ভয়ে প্রাণ উড়ে গেলো।

তার সাথে এটাও বুঝতে পারলো এই অশরীরীর ক্ষমতা তার সাধনার ক্ষমতার থেকে অনেক বেশী।তান্ত্রিক যজ্ঞ ছেড়ে উঠে গ্রামের দিকে দৌড়োতে লাগলো. কিন্তু তাকে বেশিদূর দৌড়াতে হলো না. ভয়ে দৌড়াতে দৌড়াতে সে পা মুচকে একটি বিশাল বটগাছের নিচে পরে গেলো. পা মুচকে যাওয়ার যন্ত্রনায় সে মাটিতে পরে কাতরাতে লাগলো।

সেই অবস্থাতেই তান্ত্রিক দেখতে পেলো সেই বীভৎস অশরীরীটি হাওয়ায় ভাসতে ভাসতে ঠিক তার উপরে এসে দাঁড়ালো. আচমকাই সে বিশাল শব্দে হেসে উঠলো. সেই হাসি শুনে তান্ত্রিকের বুক কেঁপে উঠলো. সে ভয়ে চোখ বন্ধ করে দিলো. চোখ বন্ধ করার আগের মুহূর্তে সে দেখলো একটি বিশাল মোটা গাছের ডাল ভেঙ্গে সবেগে তার দিকে নেমে আসছে।

পরেরদিন সূর্যের আলো ফোটার সাথে সাথেই মনোহর বাবু গ্রামের কয়েকজন লোককে সঙ্গে নিয়ে শ্মশানে তান্ত্রিকের উদ্দেশ্যে রওনা দিলেন. কিন্তু তাদের বেশিদূর যেতে হলোনা। জঙ্গলের রাস্তায় কিছুটা এগিয়েই তারা দেখতে পেলো. বিশাল একটি গাছের ডাল চাপা পরে তান্ত্রিক মৃত অবস্থায় পরে আছে। তার মুখ এতো ভয়ঙ্কর ভাবে থেঁতলানো যে দেখলে বুক কেঁপে ওঠে।

গ্রামবাসীদের তান্ত্রিকের প্রতি অনেকটাই ভরসা ছিলো যে তিনি হয়তো ওই অশরীরীর উপদ্রব থেকে তাদের রক্ষা করবে. স্বভাবতই এই দৃশ্য দেখে তারা আশাহত হলো. আর তার সাথে তাদের মনে আরও বেশী আতঙ্কের সৃষ্টি হলো।তবে কি ওই অশরীরী প্রতিদিনই গ্রামের মানুষদের এভাবেই হত্যা করবে.? এটাই কি তবে গ্রামের মানুষদের পরিণতি.?

মনোহর বাবু বিকালে গ্রামের সকল পুরুষদের ডেকে এর সমাধানের রাস্তা বের করার জন্য আলোচনা করতে লাগলেন. আলোচনায় ঠিক হলো প্রত্যেক রাতে পালাক্রমে গ্রামের পঞ্চাশজন যুবক সারারাত গ্রামে টহল দিয়ে গ্রাম পাহারা দেবে।

সেদিন থেকেই গ্রামে পাহারার বন্দোবস্ত করে দিলেন মনোহর বাবু।

রাত্রি আটটার মধ্যে পাহারার দায়িত্বে থাকা সকলে গ্রামের চণ্ডীমণ্ডপে এসে একত্রিত হলো. তারা নিজেরা ঠিক করলো একেবারে গ্রামের মধ্যস্থলে দশজন থেকে পাহারা দেবে. বাকি চল্লিশজন চারভাগে বিভক্ত হয়ে গ্রামের চারদিকে ঘুরে ঘুরে পাহারা দেবে।

তাদের সকলের হাতে একটিকরে মোটা লাঠি এবং একটিকরে টর্চ থাকবে. কেও কেও আবার সাথে করে চোরা. বল্লম. রামদা. ইত্যাদি নিয়ে নিলো. | নিজেরা ঠিক করে নিলো যে কেও কিছু দেখতে পেলে লাঠি ঠুকে ও জোরে জোরে বাঁশি বাজিয়ে সবাইকে একত্রিত করবে. তার জন্য প্রত্যেক দলে দু তিনটি করে বাঁশি নিয়ে নিলো সবাই. মোটকথা সেই অশরীরীর হাত থেকে নিজেদের গ্রামবাসীদের বাঁচাতে বদ্ধপরিকর তারা।

কিন্তু এতো সাবধানের পরেও সেই অশরীরী তার নিষ্ঠুর হিত্যাকান্ড করে গেলো. গ্রামেরই একপাশে সিধুর বাড়ী।

সে একটা ছোটোখাটো সিঁধেল চোর. গত কয়েকদিন অজানা অশরীরীর ভয়ে সে রাত্রে চুরি করতে বের হয়নি. কিন্তু চুরি করতে না বেড়োলে তার পেট চলবে না। আজকে গ্রামে পাহারা বসায় সে সাহস করে চুরি করতে বেড়িয়েছিল বাজারেরই পাশে একটি মুদিখানার দোকানে সিঁদ কেটে চুরি করে সে যখন বাড়ী ফিরছিলো।

তখন সে শুনতে পেলো সামনের দিকথেকে পাহারার লোকেরা লাঠি ঠুকতে ঠুকতে এদিকেই এগিয়ে আসছে. তাই সে সোজা রাস্তা ছেড়ে জঙ্গলের ঘুরপথের রাস্তা ধরলো. এই রাস্তাটা কিছুটা জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে এগিয়ে আবার গ্রামের রাস্তায় গিয়ে উঠেছে. | জঙ্গলের রাস্তা ধরে কিছুটা যাবার পরআচমকাই তার গা টা কেমন ছমছম করে উঠলো।

সে ভয় পেয়ে একটু তারাতারি পা চালাতে লাগলো. হঠাৎই সে দেখলো তার সামনে আর কোনো রাস্তা নেই. এক গাঢ় অন্ধকারের প্রাচীর তার রাস্তা আগলে দাঁড়িয়ে আছে. কিন্তু সে নিজে ভালোকরেই জানে যে রাস্তা এখানেই ছিলো. এখন যেনো কোনো এক মন্ত্রবলে সেটা অদৃশ্য হয়ে গেছে গাঢ় অন্ধকারের অন্তরালে।

সে দাঁড়িয়ে এইসব ভাবছিলো. আচমকাই তার নাকে এসে লাগলো এক উৎকট দুর্গন্ধ. ভয়ে তার বুকের রক্ত হিম হয়ে গেলো. এই লক্ষণগুলো কিসের সেটা সে ভালোকরেই জানতো. গ্রামের আগের মৃত্যুগুলোর বর্ণনা সে শুনেছে. আগের মৃত্যুগুলোর সময় এই লক্ষণগুলো সেখানেও ছিলো। সে সব জিনিসপত্র ফেলে পিছনদিকে ঘুরে পালাবার চেষ্টা করলো. কিন্তু কোথায় রাস্তা.! একপা এগোতেই সেই দুর্ভেদ্য অন্ধকারের প্রাচীরে গিয়ে ধাক্কা খেলো সে।

যেদিকেই যেতে চায় সেদিকেই একই রকম অন্ধকারের দেওয়াল. সে গলা ফাটিয়ে চিৎকার করতে লাগলো. কিন্তু তার সেই চিৎকার অন্ধকারের দেওয়ালে ধাক্কা খেয়ে বার বার ফিরে আসতে লাগলো. সেই পচা গন্ধটা এখন আরও বেশী উৎকট হয়ে উঠেছে সে নিঃশাস পর্যন্ত নিতে পারছে না। আর তার সাথে আরও একটা জিনিস খেয়াল করলো সে. অন্ধকারের দেওয়াল গুলো চারপাশ থেকে তার আরও কাছে সরে এসে একটা দমবদ্ধকর অস্বস্তির সৃষ্টি করেছে।

তার মধ্যে সেই এবার তার একদম মাথার উপর টের পেলো. এই সময় আচমকাই সে বুঝতে পারলো তার মাথা এবং ঘাড় শক্ত কোনকিছুতে চেপে ধরেছে. সে প্রানপনে সেই শক্ত বাঁধন থেকে নিজেকে মুক্ত করার চেষ্টা করতে লাগলো. কিন্তু পারলোনা. এই সময় সে নিজের ঘাড়ের কাছে একটা মট্ করে আওয়াজ এবং তীব্র যন্ত্রনা অনুভব করলো. তার মৃত্যুযন্ত্রণার শেষ চিৎকার ধীরে ধীরে মিলিয়ে গেলো।

 

{ আরো পড়ুন – অভিশপ্ত কবরস্থান – ভয়ানক অভিশপ্ত কবরস্থানের গল্প!

 

তৃতীয় পর্ব

গ্রামেরই এক বৃদ্ধ রাধারমণ সামন্ত বহুদিন যাবৎ শহরে বসবাস করে. তার তিন ছেলে. সবাই শহরে ব্যবসা করে. তাদের মা বেশ কয়েকবছর হলো গত হয়েছে বাবা এখন একা মানুষ।

তাই একরকম জোর করেই ছেলেরা বাবাকে নিয়ে শহরে নিজেদের কাছে এনে রেখে দেয়. শুধু বছরে দু একবার পূজা পার্বনে সবাই গ্রামের বাড়ীতে এসে দিনকয়েক থেকে আবার শহরে ফিরে যায়। সেই রাধারমণ বাবু গ্রামের বাড়ীতে বেড়াতে এসেছেন. এসেই পাড়া প্রতিবেশীদের মুখে গ্রামের আতঙ্কের কথা শুনে তিনি বেশ অবাক হয়ে গেলেন।

সেদিনই বিকালে মনোহর বাবু এলেন তার সাথে দেখা করতে. দুজনেই দুজনকে যথেষ্ট শ্রদ্ধা সম্ব্রম করেন. কুশলবাক্য বিনিময়ের পরে মনোহর বাবু রাধারমণ বাবু কে বললেন ” আপনি বোধহয় এখানের ঘটনা সব শুনেছেন. আপনি শহরে থাকেন. আপনার অনেক জানাশোনা আছে. আপনি কিছু একটা উপায় বের করুন দাদা. নাহলে এই গোটা গ্রামটা শ্মশানে পরিণত হবে. রোজ একজনের সর্বনাশ করছে শয়তান টা. ভয়ে গ্রামের লোকেরা রাতে ঘুমাতে পর্যন্ত পারছে না।

আতঙ্কে রাত কাটাতে হচ্ছে প্রতিটি মানুষকে. এই গ্রামে আমরা সাতপুরুষ বাস করছি. এখানের মাটি আমাদের মা তুল্য. সারাজীবন আমি চেষ্টা করে এসেছি গ্রামের লোকেদের দুঃখ দূর করে তাদের মুখে হাসি ফোটাবার. আজ তাদের এই পরিণতিতে আমি খুব মর্মাহত ” এই পর্যন্ত বলে মনোহর বাবু ধূতির কোঁচায় চোখ মুছতে লাগলেন।

রাধারমণ বাবু সমস্ত কথা মন দিয়ে শুনলেন. তারপর একটু অন্যমনস্ক হয়ে কি একটা ভেবে বললেন ” এপর্যন্ত আপনি গ্রামবাসীদের সাথে পরামর্শ করে কিছু সিদ্ধান্ত নিয়েছেন. “?মনোহর বাবু বললেন ” আমাদের গ্রামের পাশেই শ্মশানে যে তান্ত্রিক ছিলো তাকে বলেছিলাম কিছু একটা বন্দোবস্ত করতে।

কিন্তু ওই রাতেই সেই শয়তানের হাতে সে প্রাণ হারায়. তারপর থেকে গ্রামবাসীরা আরও অসহায় হয়ে পরে. | রাধারমণ বাবু একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন ” একজন তান্ত্রিককে যে নৃশংস ভাবে মারতে পারে. নিঃসন্দেহে তার ক্ষমতা অনেক বেশী. তবে আমার কাছে একটা রাস্তা আছে. আপনি যদি রাজী থাকেন তাহলে সেটা করতে পারি ।

মুকুন্দপুরের অভিশপ্ত পিশাচ

মনোহর বাবু রাধারমণ বাবুর হাত দুটি ধরে বললেন ” আপনি যা করতে বলবেন. যেখানে যেতে বলবেন আমি সবকিছু করতে রাজী আছি. এই অসহায় গ্রামের মানুষগুলির জীবনে আবার সুখ শান্তি ফিরিয়ে আনার জন্য আমি সবকিছু করতে রাজী আছি. আপনি শুধু বলুন আমাকে কি করতে হবে ।

তখন রাধারমণ বাবু বললেন ” কামাক্ষায় আমার এক জানাশোনা তান্ত্রিক আছে. নাম আচার্য তারকানন্দ. তন্ত্রসাধনায় সে অসীম ক্ষমতার অধিকারী হয়েছেন. আমার ছেলেরই এক ব্যবসায়ী অংশীদারের মাধ্যমে তার সাথে আমাদের পরিচয় হয়. একবার আমাদের পারিবারিক ব্যবসায় ভীষণ সঙ্কট দেখাদেয়।

তখন ব্যবসা প্রায় বন্ধ হতে বসেছিলো. সেই সময় সুনীলবাবু নামের সেই ভদ্রলোকের কাছে এই তারকানন্দের কথা জানতে পারি আমরা. ছুটে যাই তার কাছে. কিন্তু সেই সময় তিনি পাহাড়ের এক গুহার মধ্যে গভীর তন্ত্র সাধনায় মগ্ন ছিলেন. তিনদিন ধর্না দিয়ে বসে থাকার পর তেনার সাথে সাক্ষাৎ হয়।

শুনেছিলাম তিনি বড়ো বেশী কারও সাথে কথা বলেন না. কিন্তু কেনো জানিনা আমাদের সাথে ভালোভাবেই কথা বললেন.এবং মন দিয়ে আমাদের সব সমস্যার কথা শুনলেন. আমাদের সাথে কলকাতা আসতেও রাজী হয়ে গেলেন। তিনি যেদিন আমাদের বাড়ী এলেন. সেদিন রাতেই এক যজ্ঞের আয়োজন করেছিলেন. রাত্রি বারোটা নাগাদ তিনি যজ্ঞে বসলেন তারপর আমাদের সবাইকে নিশ্চিন্ত মনে ঘুমিয়ে পড়তে বললেন।

পরেরদিন ভোরের আলো ফোটার সাথে সাথেই আমরা তার কাছে গেলাম. আমাদের দেখে তিনি বললেন ” আমি তোমাদের জন্যই অপেক্ষা করছিলাম।

আমরা হাত জোর করে তার পায়ের কাছে বসলাম. তারপর তিনি বললেন ” তোমরা আমাকে ঠিক সময়মতো ডেকেছিলে তাই এ যাত্রায় অনেক বড়ো ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা পেলে. আর্থিক ক্ষতি তো হতোই. তার সাথে এই পরিবারের একজনের প্রাণ সংশয়ও ছিলো. যে এই সর্বনাশ করার চেষ্টা করেছিলো।

সেও একজন তান্ত্রিকের সাহায্যেই এই কাজ করেছিলো। তবে এখন আর ভয়ের কিছু নেই. আমি সব বন্দোবস্ত করে দিয়েছি. আর ভবিষ্যতেও কেও যেনো এই পরিবারের কোনো ক্ষতি না করতে পারে তার ব্যবস্থাও আমি করেছি ।

এই বলে তিনি উঠে পড়লেন এবং যাবার জন্য পা বাড়ালেন. আমাদের শত অনুরোধেও তিনি এতটুকু জলস্পর্শও করলেন না. শুধু যাবার সময় আমাকে ডেকে বললেন ” আমি কখনো কারও বাড়ী যাইনা. কিন্তু তোমার বাড়ী কেনো এসেছি জানো. “? আমি মাথা নেড়ে বললাম “না “. তিনি বললেন ” তুমি যেদিন আমার কাছে এসেছিলে তখন তোমাকে দেখে আমার মন প্রসন্ন হয়ে যায়. কারণ তোমার মুখে একটা পবিত্রতা আছে. তাই আমি তোমার সাথে আসতে রাজী হয়েছিলাম. ভবিষ্যতে যদি কখনো আমাকে প্রয়োজন হয় তাহলে নির্দ্বিধায় আমার কাছে চলে আসবে. প্রয়োজন ছাড়াও আমার কাছে মাঝে মাঝে গেলে আমি খুশিই হবো ।

আমি তখন হাত জোর করে আমতা আমতা করে বললাম ” কিছু মনে করবেন না. আসলে আমি ঠিক বুঝতে পারলাম না যে আপনি কি করে বুঝলেন যে আমাদের বিপদ কেটে গেছে । তিনি তখন একটু মুচকি হেসে বলেছিলেন ” আজকের পর থেকেই তুমি সেটা নিজেই বুঝতে পারবে “.. এই বলে তিনি ধীরে ধীরে বাড়ীর বাইরে বেরিয়ে দূরের রাস্তায় অদৃশ্য হয়ে গেলো।

আশ্চর্য ব্যাপার লক্ষ করলাম. সেদিন থেকেই সবকিছু ঠিক হয়ে যেতে লাগলো. ব্যবসায় আবার ছন্দ ফিরে এলো. দিন দশেক যেতে না যেতেই সব আবার আগের মতো হয়ে গেলো।তারপর থেকেই তারকানন্দের প্রতি আমাদের সবার গভীর ভক্তি শ্রদ্ধার সঞ্চার হলো. তারপরে আমি বেশ কয়েকবার কামাক্ষায় গিয়ে তার সাথে দেখা করে এসেছি. এবং এটাও বুঝেছি আমি যাওয়াতে তিনি সত্যিই প্রসন্ন হয়েছেন।

এই পর্যন্ত বলে রাধারমণ বাবু থামলেন.. তারপর মনোহর বাবুকে বললেন ” আপনি কবে কামাক্ষার উদ্দ্যেশ্যে রওনা দিতে চান “?. তখন মনোহর বাবু বললেন ” এখানের যেরকম ভয়ানক পরিস্তিতি তাতে দেরী করা একদম উচিৎ হবেনা. কাল সকালেই চলুন।

পরেরদিন ভোরেই দুজনে রওনা দিলো. তখনকার দিনে গাড়ী ঘোড়ার রাস্তা অতটা উন্নত ছিলো না. তাই তাদের গন্তব্যস্থলে পৌঁছাতে প্রায় দেড়দিন সময় লাগলো. | সেখানে গিয়ে রাধারমণ বাবুর সৌজন্যে তারকানন্দের সাথে সাক্ষাতের কোনো অসুবিধা হলো না. | তিনি তখন সাধনায় মগ্ন ছিলেন. শিষ্য বলে দিলো তিনি সন্ধ্যার পর সাক্ষাৎ করবেন।

দুজনে সারাদিন এদিক ওদিক ঘোরাফেরার পর সন্ধ্যায় তারকানন্দের ডেরায় গিয়ে হাজির হলো. | তিনি দুজনকে ভিতরে আসতে বললেন. পাশেই দুটি আসন পাতা ছিলো সেখানে বসতে বললেন. দুজনেই তখন ভিতরে গিয়ে তাকে প্রণাম করে পাশে বসলো. | তিনি তখন রাধারমণ বাবুর কাছে মনোহর বাবুর পরিচয় জানতে চাইলেন. তখন রাধারমণ বাবু গুরুদেবের কাছে মনোহর বাবুর পরিচয় করিয়ে দিলেন।

তারকানন্দ এক দৃষ্টিতে অনেক্ষন মনোহর বাবুর মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে বললেন ” তোমার মুখ দেখে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে সম্প্রতি তুমি এক সঙ্কটময় সময়ের মধ্যে আছো. তোমার মুখের প্রতিটা রেখায় সেই ভয় আর যন্ত্রনা ফুটে রয়েছে. আর সেই সঙ্কট থেকে মুক্তি পাবার জন্যই তুমি আমার কাছে এসেছো “. তারকানন্দের মুখে এই কথাগুলি শুনে মনোহর বাবুর চোখদুটি অশ্রুসিক্ত হয়ে উঠলো. তিনি ভেজা গলায় হাতজোড় করে বললেন ” আপনি যে শুধু পরম জ্ঞানী তাই নয়. আপনার মনটাও কোমলের মতো নরম. আপনি আমাদের এই চরম বিপদ থেকে রক্ষা করুন “. এই পর্যন্ত বলে সে অঝোরে কাঁদতে লাগলো।

তখন তারকানন্দ কোমল স্পর্শে তার মাথায় হাত দিয়ে বললেন ” এটা মায়ের স্থান. মা তার সন্তানদের সকল বিপদ থেকে রক্ষা করে. আমাকে সব কথা বলো. আমি আমার সাধ্যমতো চেষ্টা করবো এই বিপদ থেকে সকলকে রক্ষা করার ।

মনোহর বাবু হাতজোড় করে প্রথম দিন থেকে এখনো পর্যন্ত যা যা হয়েছে সবিস্তারে বলতে লাগলো. | তারকানন্দ মনদিয়ে সব কথা শুনতে লাগলেন. কথাগুলো শুনতে শুনতে তিনি শঙ্কিত এবং চিন্তামগ্ন হয়ে পড়লেন. | তারপর তিনি একটু ব্যস্ত হয়ে বললেন ” প্রথমে আমি তোমার কোথায় ভয়ের কিছুই বুঝতে পারিনি. কিন্তু শেষের দিকে সেই অশরীরীর আবির্ভাব. পচা দুর্গন্ধ. এবং মৃত্যুর ধরণ দেখে আমি শুধু অবাকই হয়নি. যথেষ্ট কৌতূহলও হয়েছি.. আমি প্রায় তিন কুড়িবছর তন্ত্রসাধনা করছি।

আমার এই দীর্ঘ জীবনে অভিজ্ঞতাও কিছু কম নয়. কিন্তু এখনও এমন কোনো অপশক্তি আমার গোচরে আসেনি. যায় আবির্ভাব. লক্ষণ এই ধরণের. তবে এটুকু বুঝতে পারছি. এই অশরীরী যথেষ্ট ক্ষমতার অধিকারী. সাধারণ কোনো অপশক্তি হলে তোমাদের শ্মশানের তান্ত্রিককে ওইরকম নৃশংস ভাবে হত্যা করতে পারতো না. | যাইহোক তোমরা অনেক দূরথেকে এসেছো. আজ রাতটা বিশ্রাম করেনাও. কাল ভোরে রওনা দেবে. আর আমিও তোমাদের সাথে যাবো।

মনোহর বাবুদের বিদায় দিয়ে তারকানন্দ গভীর চিন্তামগ্ন হলেন. এই অশরীরীর আবির্ভাব. হত্যালীলা. তিনি কোথায় যেনো পড়েছিলেন বা শুনেছিলেন.কিন্তু কোথায় সেটা এখন মনে করতে পারছেন না. মনে পড়লে হয়তো সেই অশরীরীর ক্ষমতা সম্বন্ধে অবগত হওয়া যেত. প্রকৃতির নিয়মে সব অপশক্তিরই বিনাশ অনিবার্য. সুতরাং সেই অশরীরীরসামনে গেলেই বোঝা যাবে তার ক্ষমতা কতটা. আর তার দুর্বলতার রহস্য. তিনি আর বেশী চিন্তা না করে তার আরাধ্যা দেবীকে প্রণাম করে শয্যা গ্রহণ করলেন।

পরেরদিন খুব ভোরে তিনজন রওনা দিলেন. রাস্তায় তারকানন্দ তার জীবনের নানা আশ্চর্য অভিজ্ঞতার কথা বলতে লাগলেন. সেসব শুনে মনোহর বাবু এবং রাধারমণ বাবুর মন তার প্রতি শ্রদ্ধায় ভোরে উঠলো. সারাদিন যাত্রার পর প্রায় সন্ধ্যা নাগাদ গ্রামে প্রবেশ করলেন।

গ্রামেরমাটিতে পা দিতেই তারকানন্দ হঠাৎ থমকে দাঁড়িয়ে পড়লেন. এবং চোখ বন্ধ করে কিছু একটা উপলব্দি করতে লাগলেন. তারপর দুশ্চিন্তাগ্রস্ত মুখে সেখানেই দাঁড়িয়ে রইলেন. | তাকে চিন্তামগ্ন হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে পাশে থাকা মনোহর বাবু বললেন ” বাবাঠাকুর. গ্রামের মাটিতে পা দিয়েই আপনি থমকে দাঁড়িয়ে পরে এমন চিন্তামগ্ন হয়ে রইলেন. আপনি কি কিছু বুঝতে পেরেছেন “?

সেই কথার কোনো উত্তর না দিয়ে তিনি আরও কিছুক্ষন চোখ বন্ধ করে মনে মনে কিছু বোঝার চেষ্টা করতে লাগলেন. তারপর মুখ তুলে মনোহর বাবুর দিকে তাকিয়ে ধীরে ধীরে বললেন ” এই মুকুন্দপুর গ্রামে যে বিভীষিকার আবির্ভাব হয়েছে এটা কোনো সাধারণ অপদেবতা নয়. এই অশরীরী শত শত বছরধরে নিজের সাথে বয়ে বেড়াচ্ছে এক ভয়ানক অভিশাপ।

তবে এই অভিশাপ কোনো মুনি ঋষি. বা কোনো সিদ্ধপুরুষের থেকে পাওয়া কোনো সাধারণ অভিশাপ নয়. এ অভিশাপ কোনো নারী কর্তৃক প্রদত্ত অভিশাপ. | আমরা সবাই নারীশক্তির ক্ষমতার কথা জানি. | মহিষাসুরের অত্যাচারে যখন দেবকূল বিপর্যয়ের মুখে পড়েছিল. তখন মা মহামায়া দুর্গতিনাশিনী রূপে দেবকূল রক্ষা করেছিলেন।

ত্রিভুবনের অধীশ্বর দেবাদিদেব মহাদেব স্বয়ং দেবী পার্বতীর কালী রূপ থেকে জগৎ সংসারকে রক্ষা করতে তার চরণতলে শায়িত হয়েছিলেন. | সতী তার মৃত স্বামীকে যমরাজের কাছথেকে ছিনিয়ে এনেছিলেন. | এছাড়াও আমাদের সবার জীবনে ভগবানের আশীর্বাদ প্রদত্ত যে মা এর আশীর্বাদ থাকে সেই মা ও তো এক নারীর রূপ।

সুতরাং আমাদের এই জগৎ সংসারে নারীশক্তির আশীর্বাদ যতটা কল্যাণময়. তেমনই অভিশাপও ততটাই সর্বনাশী হয়. | এখনও সন্ধ্যা হতে বেশ কিছুক্ষন দেরী আছে. তোমরা গ্রামে গিয়ে গ্রামের মানুষদের অভয় দাও. তাদের বলো যে সেই অশরীরী গ্রামের মধ্যে ঢুকে আর কারও অনিষ্ট করতে পারবে না. তার মধ্যে আমি আমার কয়েকটা কাজ সম্পন্ন করে. তারপর গ্রাম বন্ধন করে আসছি. এই বন্ধনে শুধুমাত্র আমার উচ্চারিত মন্ত্রই থাকবেনা. তারসাথে থাকবে মা কামাক্ষার আশীর্বাদ।

যে আশীর্বাদ ভেদ করা পৃথিবীর কোনো অশরীরী শক্তির দ্বারাই সম্ভব নয়. | তোমরা আর দেরী কোরোনা তাড়াতাড়ি গ্রামে চলে যাও. আমি কাজ সম্পন্ন করে যত শীঘ্র সম্ভব আসছি. এই বলে তিনি সেখানেই বসে তার ঝোলা থেকে কিছু উপকরণ বের করে কাজে লেগে পড়লেন।মনোহর বাবু আর রাধারমণ বাবু আর দেরী না করে দ্রুত পায়ে গ্রাম অভিমুখে ফিরে চললেন।

 

মুকুন্দপুরের অভিশপ্ত পিশাচ

চতুর্থ পর্ব

গ্রামে ফিরে গ্রামের অবস্থা দেখে তারা অবাক হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন. এই দুদিনে গ্রামের অবস্থা যেনো আরও শোচনীয় হয়ে গেছে. অনেকেই গ্রাম ছেড়ে বিভিন্ন আত্মীয় স্বজনদের বাড়ী চলে গেছে. গত দুদিনে আরও দুজন গ্রামবাসীর মৃত্যু হয়েছে. মনোহর বাবুদের দেখে গ্রামবাসীরা তাদের দিকে এগিয়ে এসে জিজ্ঞাসু মুখে তাকিয়ে রইলেন।

তখন মনোহর বাবু সবাইকে অভয় দিয়ে বললেন ” তোমাদের আর সেই অশরীরীকে ভয় পেতে হবেনা. ভগবান আমাদের সহায় হয়েছেন. তাই আমাদের এই বিপদের দিনে একজনকে পাঠিয়েছেন আমাদের এই বিপদ থেকে উদ্ধার করার জন্য.আমাদের সাথে সেই তান্ত্রিকঠাকুর এসেছেন. তিনি নিজে সবাইকে অভয় দিয়েছেন. আর ইতিমধ্যে তিনি তার কর্মও শুরু করে দিয়েছেন ।

মনোহর বাবুর মুখে এই অভয় শুনে সবাই যেনো একটু স্বস্তি পেলো. নিরেট অন্ধকারের মধ্যে যেনো আশার আলো দেখতে পেলো সবাই. | গ্রামবাসীদের সাথে কথা বলার পর মনোহর বাবু নিজের বাড়ী না গিয়ে রাধারমণ বাবুকে সঙ্গে নিয়ে মৃত দুজনের পরিবারের সাথে দেখা করতে গেলেন।

এবারের মৃত্যু দুটি পাশাপাশি দুটি বাড়ীতে হয়েছে.| গ্রামেরই একটু অদূরে কয়েকটি কায়স্থ পরিবারের বাস. তাদেরই মধ্যে দুটি পরিবারে হয়েছে মৃত্যু দুটি. মনোহর বাবু দুটি পরিবারকে যথা সম্ভব সান্তনা ও আশ্বাস দিয়ে নিজের বাড়ীর দিকে রওনা দিলেন।

ইতিমধ্যে তারকানন্দ তার ক্রিয়া সম্পন্ন করে মনোহর বাবুর বাড়ী চলে এসেছেন. তার পিছন পিছন জনাকয়েক কৌতূহলি গ্রামবাসীও উঠানের একপাশে দাঁড়িয়ে নিজেদের মধ্যে কথা বলাবলি করছে. মনোহর বাবু গ্রামবাসীদের বিদায় দিয়ে তান্ত্রিককে সঙ্গে নিয়ে ঘরের মধ্যে ঢুকলেন. বৈঠকখানায় তিনটি চেয়ার নিয়ে তিনজনে বসলেন।

তারকানন্দ কথা বলা শুরু করার আগেই দেখলেন মনোহর বাবুর স্ত্রী তিনটি রেকাবিতে লুচি. আলুর তরকারি হাতে নিয়ে বৈঠকখানায় প্রবেশ করলেন.খাবারগুলো টেবিলে রেখে একটু তফাতে গিয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন।

মনোহর বাবু খাবারের একটি রেকাবি নিয়ে তারকানন্দের দিকে এগিয়ে এগিয়ে দিলেন. তাই দেখে তারকানন্দ বিনীত সুরে বললেন ” ক্ষমা করো. কিন্তু আমারতো এসব খাবার চলে না. তাছাড়া আমি মিতভোজী.| তারপর মনোহর বাবুর স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে বললেন ” মা আমার না খাওয়া নিয়ে মনে কোনো কষ্ট পেয়োনা. আমি রাত্রে খাবো. তখন নাহয় দুটো চাল আলু ফুটিয়ে দিও. আর যদি সম্ভব হয় তাহলে সাথে একটু দুধ দিও”. তারপর মনোহর বাবু এবং রাধারমণ বাবুর দিকে তাকিয়ে বললেন ” তোমরা বরং খেয়েনাও তারপর ভিতরের কোনো ঘরে গিয়ে কথা বলাযাবে.। একথা মনে হওয়ার বাবু এবং রাধারমন বাবু দুজনেই প্রতিবাদ করে বললেন।

আপনি বাড়ির অতিথি আপনি না খেয়ে আছেন আমরা কি করে খাই। আমরা বরং সবাই রাত্রে একসঙ্গেই খাব। তারকানন্দ বার কয়েক তাদের খেয়ে নেওয়ার জন্য বললেন। কিন্তু তাতে কোনো ফল হলো না দেখে তিনি বললেন আচ্ছা ঠিক আছে তোমরা যখন রাতে একসাথে খাবে বলছ তাহলে তাই হবে। এবারে মনোহর বাবু বললেন “আপনি ভিতরের ঘরে যাবার কথা বলেছিলেন কেন”? বৈঠকখানায় কথা বলতে কি কোন সমস্যা আছে? এই পর্যন্ত বলে মনোহর বাবু জিজ্ঞাস মুখে তারকানন্দের দিকে তাকালেন।

এই প্রশ্নে তারকানন্দের মুখটা গম্ভীর হয়ে গেল। তিনি গম্ভীর হয়ে বললেন”আমি যখন এই গ্রামে প্রথম পা দিয়েছিলাম তখন তোমাদের একটা কথা বলেছিলাম সেটা হল”এই গ্রামে যে অশরীরীর আবির্ভাব হয়েছে সে শুধু ভয়ানক শক্তিশালীই নয়। সে একটা প্রাচীন অভিশাপও বয়ে বেড়াচ্ছে। আর এই অভিশাপএর জন্যই সে এতটা শক্তিশালী ও ভয়ঙ্কর হয়ে উঠেছে।”. আমি যখন এই কথাটা বলেছিলাম তখন আমি শতভাগ নিশ্চিত ছিলাম না। কিছু কিছু লক্ষণ দেখে সেটা আন্দাজ করেছিলাম মাত্র। কিন্তু সে আন্দাজ যে অমূলক ছিল না তার প্রমাণ আমি তারপরেই পেয়েছি”।

রাধারমন বাবু কৌতুহলী মুখে প্রশ্ন করলেন “সেটা কি করে বুঝলেন আপনি আমাদের খুলে বলুন”। তারকানন্দ আবার বলতে আরম্ভ করলেন” তোমাদের গ্রামের দিকে পাঠিয়ে আমি গ্রামের চারপাশে প্রদক্ষিণ করে গ্রাম বন্ধন করছিলাম। প্রথমে কোন সমস্যা হয়নি।কিন্তু যখনই গ্রামের দক্ষিণ পশ্চিম প্রান্তে গিয়ে সেখানের মাটিতে মন্ত্রপূতঃসরিষা ছড়াছিলাম। তখন আমার মনে হল কেউ যেন প্রচন্ড আক্রোশে আমার কার্যকলাপ গভীরভাবে নিরীক্ষণ করছে তার হিংস্র দৃষ্টি দিয়ে।

তখন সন্ধ্যা হতে আর বেশী দেরী নেই। তার উপর গ্রামের বেশ অনেকটাই অংশ তখনো বাকি আছে বন্ধন করতে। তাই আমি সেই ক্ষণিকের অনুভূতিটা কাটিয়ে নিয়ে দ্রুত পায়ে এগিয়ে যেতে লাগলাম। কিন্তু মন সেখানেই পড়ে রইল আমার মন বলতে লাগলো এই গ্রামের উপর মৃত্যু-যজ্ঞ চালানো সেই বিভীষিকার কেন্দ্রস্থল এখানেই আশেপাশে কোথাও আছে। তাই দ্রুত পায়ে বাকি গ্রাম টুকু বন্ধন করার পর আমি সেই জায়গায় আবার গিয়ে হাজির হলাম।

আর তখনই দেখলাম যেন একটা জমাট বাঁধা অন্ধকার এর অবয়ব সেই জায়গা দিয়ে আমার বেঁধে দেওয়া সীমারেখা অতিক্রম করার চেষ্টা করছে।আমি সেটার কাছাকাছি যেতেই সেই অন্ধকারের অবয়বটা বাতাসে ভর করে আমার দিকে এগিয়ে আসতে লাগলো। কিন্তু বেশি দূর এগোতে পারল না আমার কাছাকাছি আসতেই আমার গাত্রবন্ধন এর পবিত্রতায় ছিটকে কিছুটা পিছিয়ে গেল। তখনই কয়েক মুহূর্তের জন্য তার অন্ধকারের অবয়বের ভিতরটা আমি দেখেছিলাম “।

এই পর্যন্ত বলে তারকানন্দ চুপ করলেন। মনোহর বাবু এবং রাধারমন বাবু দুজনেই জিজ্ঞাসু চোখে তার দিকে তাকিয়ে রইলেন। তারপর তারকানন্দ ধীরে ধীরে মাথা তুলে আরো গম্ভীর গলায় বলতে আরম্ভ করলেন ” আমরা যারা তন্ত্র সাধনায় সিদ্ধিলাভ করেছি আমরা সাধারন দৃষ্টিশক্তির বাইরেও অনেক কিছু দেখতে পাই। তেমনি সাধারণ অনুভূতির থেকেও অনেক বেশি অনুভব করতে পারি।সেই অন্তরের দৃষ্টি দিয়ে দেখলাম সেই অশরীরীর শরীরের ভিতরের সব অংশ দাউ দাউ করে জ্বলছে। আর তার থেকেই এক উৎকট পোড়া গন্ধ সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ছে “।

এই শেষের কথাটি শুনে মনোহর বাবু যেন চুমকে উঠলেন। তিনি উত্তেজিত হয়ে বললেন ” আগের মৃত্যুগুলোর বর্ণনা থেকেও এই পোড়া গন্ধের কথা অনেকেই উল্লেখ করেছে”।

একথার প্রত্যুত্তরে তারকানন্দ কি একটা বলতে যাচ্ছিলেন কিন্তু আচমকাই দরজার দিকে তাকিয়ে তিনি চুপ করে গেলেন । মনোহর বাবু দরজার দিকে তাকিয়ে দেখলেন শম্ভুচরণ দরজার কাছে দাঁড়িয়ে আছে । তাকে দেখে মনোহর বাবু বেশ আশ্চর্য হলেন।তবুও স্বাভাবিক ভঙ্গিতেই তাকে ভিতরে আসতে বললেন। আজকে বৈকালেই মনোহর বাবু এর বাড়িতে গিয়েছিলেন।

কারণ গতকাল রাতে এই শম্ভুচরণ এর দাদা শ্যামচরণ এর মৃত্যু হয়েছে সেই অশরীরীর হাতে । সে কথা শুনেই এদের বাড়ি গিয়েছিলেন সান্তনা দেবার জন্য।

শম্ভুচরণ চেয়ারে বসার পর সবাই তার মুখের দিকে তাকালেন। দেখলেন তার মুখে দুঃখ ও শোকের ছাপ স্পষ্ট। এবং তার সাথে একটা আতঙ্কের ছাপও ফুটে আছে।

তার এই অবস্থা দেখে সকলেই তার দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন।শম্ভু চরণ ধীরে ধীরে মাথা তুলে তাকাল তার দুচোখ তখনও অশ্রুসিক্ত হয়ে আছে চোখ মুছে সে বলতে আরম্ভ করলো ” গতকাল রাতে দাদার মৃত্যুর সময় আমি দাদার সাথেই ছিলাম। আমি নিজের চোখে সব কিছু দেখেছি, কিন্তু ভয়ে কাউকে কিছু বলতে পারিনি, কিন্তু আজ তান্ত্রিকঠাকুর কে দেখে আমি মনে বল পেয়েছি , তাই গতকাল রাতে আমি যা দেখেছি সেটা বলার জন্য এখানে এসেছি “।

এই পর্যন্ত বলে সে আমার মাথা নিচু করে অঝোরে ধারায় কাঁদতে লাগলো।

এবার তারকানন্দ শম্ভুচরণ এর উদ্দেশ্যে বললেন ,”আমি তোমার কষ্ট বুঝতে পারছি বাবা, নিজের পরিবারের কাউকে হারানোর যন্ত্রণা চেয়ে বড় আর কিছু হয় না। আমি এ গ্রামে এসেছি যাতে সেই অশরীরীর হাত থেকে এই গ্রামের মানুষদের রক্ষা করা যায়। এ গ্রামের মানুষের জীবনে যাতে আগের মত সুখ ফিরে আসে, এখানের বিনিদ্র মানুষেরা যাতে শান্তিতে ঘুমাতে পারে। কিন্তু তার জন্য আমার এই গ্রামের মানুষের সাহায্যের প্রয়োজন। গতকাল রাতে তুমি কি কি দেখেছো সব আমাকে বল, কারণ যার বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য আমি এখানে এসেছি, তার ক্ষমতা সম্বন্ধে আমাকে অবগত হতে হবে “। এই পর্যন্ত বলে তিনি চুপ করলেন।

এবারে শম্ভুচরণ তান্ত্রিক এর দিকে তাকিয়ে গত রাতে ঘটে যাওয়া ভয়ানক ঘটনার বর্ণনা দিতে লাগলো। তার মুখে বলা ঘটনাটি ঠিক এইরকম ” গত কয়েকদিন ঘটে যাওয়া ভয়ানক ঘটনায় গ্রামের সকলের মতো আমরাও আতঙ্কিত ছিলাম ।তাই সন্ধ্যার পূর্বেই বাইরের সব কাজ সম্পন্ন করে বাড়ি ফিরে এসেছিলাম। সন্ধ্যা নামতেই দরজা জানালা বন্ধ করে রাতের খাওয়া-দাওয়া সম্পন্ন করে সবাই বিছানায় গেলাম, কিন্তু আতঙ্কে কারো চোখে সহজে ঘুম এলো না, এমন সময় হঠাৎই রাত্রি প্রায় বারোটা নাগাদ পাশের গোয়াল ঘর থেকে বেশ একটা হুটোপাটির শব্দ হতে লাগলো।

আমরা বাড়ির সকলেই একটু সচকিত হয়ে গেলাম ,প্রথমে বেশি গুরুত্ব না দিলেও যতই সময় যেতে লাগল মিনিট ততোই হুটোপাটির শব্দ বাড়তে লাগল। গোয়াল ঘর আমাদের বাড়ির লাগোয়া সেখানে আর গায়ে সব মিলিয়ে প্রায় নয়টি টি গরু ছিল। সুতরাং সকলের মনেই যথেষ্ট উদ্বেগ হতে লাগলো। গোয়াল ঘরের আওয়াজ টা আরো বেড়ে যাওয়াতে দাদা লন্ঠন নিয়ে ঘর থেকে বের হতে উদ্যত হল। বাড়ির আর সকলেই তাকে বাধা দিলেও তাদের বোঝাবার জন্য দাদা বলল গরুগুলো তো অন্য কোনো কারনেও হুটোপাটি করতে পারে। আর গোয়ালঘরটা তো বাড়ির লাগোয়া।

সুতরাং আমাকে বাড়ির বাইরে তো কোথাও যেতে হচ্ছে না?। তাই তোমরা অযথা ভয় পেয়ো না আমি গিয়ে দেখেই চলে আসব এই বলে দাদা এগিয়ে গেল তখন আমি দাদা কে থামিয়ে বললাম ” সেই রকম যদি হয় তাহলে আমিও তোমার সঙ্গে যাবো। বিপদ যদি হয় তাহলে দুজনেরই হবে। সেই কথায় দাদা আমাকে অনেক নিষেধ করল সাথে না যাবার জন্য, কিন্তু আমার এবং বাড়ির লোকেদের আপত্তিতে আমাকে সঙ্গে নিয়ে যেতে বাধ্য হল। বাড়ির বাইরে বেরিয়ে আমরা দুজনেই সচকিত ভাবেই গোয়াল ঘরের দিকে যেতে লাগলাম। প্রথমে কিছুই বোঝা গেল না, গোয়াল ঘরের কাছেও গিয়ে অস্বাভাবিক কিছু চোখে পড়লো না।

তবুও দাদা লন্ঠন নিয়ে গোয়াল ঘরের ভিতরে গেল, তখনো গোয়াল ঘরের ভিতর থেকে হুটোপাটির শব্দ আসছিল। দাদা গোয়ালে ঢোকার পর আচমকাই চারপাশের পরিবেশ বদলে যেতে লাগলো। যেন মনে হল একটা অন্ধকারের প্রাচীর এসে আমার আর গোয়ালের মধ্যে বাধার সৃষ্টি করেছে। তার সাথে উৎকট পচা মাংস পোড়ার গন্ধ ।এই লক্ষণগুলি আমার পরিচিত, আগের মৃত্যুগুলোর পূর্বেও এই লক্ষণ গুলি ছিল।

সুতরাং আমার বুঝতে বাকি রইল না যে সেই অশরীরীর আবির্ভাব হয়েছে। মুহুর্তের মধ্যে আমি ভয়ে কাঠ হয়ে গেলাম। তারপর দেখলাম সেই জমাট বাঁধা অন্ধকার টা আস্তে আস্তে একটা প্রাণীর অবয়বের রূপ নিচ্ছে, তারপর সেটা গোয়াল ঘরে প্রবেশ করল। গোয়ালের গরু গুলির হুটোপাটির শব্দ আগের থেকে অনেক বেড়ে উঠলো।মনে হলো তারা আপ্রাণ চেষ্টা করছে দড়ি ছেড়ার। আচমকাই দাদার তীব্র কন্ঠে আর্তনাদ শুনতে পেলাম, মনে হল সে চরম যন্ত্রণায় আর্ত চিৎকার করছে। কিন্তু সেই চিৎকার অত্যন্ত অল্প শোনা যাচ্ছে, কিন্তু আমার থেকে গোয়ালঘর এর দূরত্ব মাত্র আট দশ হাত হবে ।

এত কাছ থেকে যদি কেউ চিৎকার করে তাহলে সেই চিৎকার যথেষ্ট জোরে শোনাযাবে।আচমকাই আমার চারপাশে পরিবেশ দেখে আমি চমকে উঠলাম। এতক্ষন বাইরে টা অন্ধকার ছিল ঠিকই ,কিন্তু এখন মনে হচ্ছে গোয়ালের কাছের অন্ধকার টা অনেক বেশি। যেন একটা অন্ধকারে প্রাচীর দিয়ে গোয়াল ঘর থেকে আমাকে আলাদা করা হয়েছে।তারপর দেখলাম সেই জমাট বাঁধা অন্ধকার টা একটা শরীরী অবয়বে রূপান্তরিত হচ্ছে।

আমি একটা দেওয়ালের আড়ালে সরে গিয়ে দম বন্ধ করে সেই দৃশ্য দেখতে লাগলাম। ধীরে ধীরে সেই অবয়বটা একটা বিশাল শরীরে রূপান্তরিত হয়ে গেল। এবং তার দুপাশে ফুটে উঠল দুটি ডানা। সেই ডানার উপর ভর করে সে প্রায় একশ হাত উপরে উঠে তারপর ধীরে ধীরে বাতাসে ভেসে এগিয়ে যেতে লাগল।হঠাৎই আমার ভয়টা এক মুহূর্তে কেটে গেল। মুহুর্তের মধ্যে আমি আমার কর্ম স্থির করলাম।

আমি নিঃশব্দে একটু দ্রুত পা চালিয়ে সেই অশরীরীকে অনুসরণ করতে লাগলাম। দাদা যে নেই সেটা আমার আর বুঝতে বাকি ছিল না, সেই কষ্ট মনে চেপে রেখেই আমি দ্রুত পা চালিয়ে তাকে অনুসরণ করতে লাগলাম

যদি তার ডেরার সন্ধান পাওয়া যায় সেই উদ্দেশ্যে।এভাবে বেশ কিছুক্ষন চলার পর আমি গ্রামের দক্ষিণ পশ্চিম প্রান্তের শেষে জঙ্গল এর কাছে উপস্থিত হলাম। সেই অশরীরীকেও দেখলাম জঙ্গলের গাছের উপর দিয়ে ধীরে ধীরে উড়ে চলেছে। আমিও জঙ্গলে প্রবেশ করলাম। বিশ্বাস করুন তখন আমার মনে ভয় এর পরিবর্তে জেদ চেপে রয়েছে।

জঙ্গলের পথে বেশ কিছুক্ষণ চলার পর দেখলাম সেই অশরীরী নিচে নামছে। ততক্ষণে আমি জঙ্গলের প্রায় মাঝখানে থাকা ভাঙ্গা রাজবাড়ির কাছে পৌঁছে গেছি। সেই অশরীরীকে নিচে নামতে দেখে আমি তাড়াতাড়ি একটা মোটা গাছের পিছনে লুকিয়ে পড়লাম। তারপর দেখলাম সে শরীরটা ছোট করে প্রায় একটা বাদুরের সাইজের করে ফেলল।

তারপর ভাঙ্গা দেয়ালের পাশ দিয়ে ঢুকে রাজবাড়ির উত্তর দিকের একটা ঘরে প্রবেশ করল। এই পর্যন্ত আমি স্বচক্ষে দেখেছি এরপর সেই ভাঙার আজবাড়িতে ঢোকার সাহস আমি পাইনি তাই আমি ফিরে আসি “। এ পর্যন্ত বলে শম্ভুচরণ চুপ করলো।

 

(পরবর্তী পর্ব পড়তে এখানে ক্লিক করুন । ধন্যবাদ।)