দেখা হবে জান্নাতে

দেখা হবে জান্নাতে

বিয়ের আর মাত্র দুই দিন বাকি।যেখানে অন্যান্য মেয়েরা পার্লার, শপিং নিয়ে ব্যস্ত মালিহা সেখানে গভির ভাবে চিন্তাচ্ছন্ন।কি অপেক্ষা করছে মালিহার জন্য?সে উত্তির্ন হতে পারবে তার ইমানি পরীক্ষায়।

বাবা মায়ের প্রথম সন্তান মালিহা।যেন এক সদ্য প্রস্ফুটিত গোলাপ। আধুনিকতার তীব্র ছোয়ায় বড় হলেও একটা সময় ফিরে আসে মহান রবের ছায়াতলে।নিজেকে পুরোপুরিভাবে পরিবর্তন করলেও পরিবার কে পরিবর্তন করতে ব্যর্থ হয়েছে বারবার।

কারন আল্লাহ তো বলেছেন হেদায়েত তো আল্লাহর হাতে, তিনি না চাইলে হেদায়েত পাওয়া অসম্ভব।

তাইতো মালিহা আজ এতো চিন্তিতো।তার বিয়ে হতে যাচ্ছে এক ধনীর দুলালের সাথে।যাকে পেয়ে পরিবারের সবাই আনন্দে দিশেহারা।তারা এতোটাই দিশেহারা যে মাহিলার মতামতটা নিতেও ভুলে গেছে।

অনেক চেষ্টা করেও মালিহা ব্যর্থ হয়েছে বিয়েটা আটকাতে।সে যেনে শুনে এমন কাউকে কিভাবে

জীবনসঙ্গী হিসেবে মেনে নিবে যার কাছে ইসলামের আদেশ নিষেধ গুলো কেবল ই গল্প মাত্র।আধুনিকতার তীব্র আকর্ষণ যাকে গভীর ভাবে নেশা ধরিয়ে দিয়েছে।

নাহ, মালিহা আর চিন্তা করতে পারছে না।মাথাটা যেন অবশ হয়ে আসছে। এভাবেই কেটে দুই টা দিন। সকাল থেকেই সবাই ব্যস্ত আছে বিয়ের নানার কাজে। অনিচ্ছে সত্ত্বেও সেজেগুজে স্টেজ এ বসতে হলো মালিহা কে। অনেক অনুরোধ করে শুধু মাথা টা ঢেকে নিলো।

বর বেশে আবরার এসে পাশে বসলো।মালিহা একটি বার ও চোখ তুলে তাকালো না আবরারের দিকে।

চাপা কষ্টে যেন বুকটা দুমড়ে মুচড়ে যাচ্ছে।মনে হচ্ছে এক জলন্ত অগ্নিকুণ্ডে বসে আছে মালিহা।যে মালিহা চেষ্টা করতো কেউ যেন তার হাতটার সৌন্দর্য ও উপভোগ করতে না পারে।

আর আজ! কেউ যেন বুকের মাঝে ছুড়ি দিয়ে তীব্র ভাবে আঘাত করেই চলছে।যার রক্তক্ষরণ এর রাক্ষী শুধুমাত্র একজন ই।যার কাছে হাজারো বার তওবা করেই যাচ্ছে মালিহা।

“হে আরশের অধিপতি, রহমানুর রহিম, আল্লাহ রাব্বুল আলামীন, ক্ষমা করো তোমার এই অধম বান্দিকে।আমি আজ ব্যর্থ হয়ে গেলাম তোমার আদেশ পালনে। হেরে গেলাম পরিবারের কাছে।

হে অন্তর্জামি, তুমি তো জানো আমার অন্তরের খবর।আমি যে নিরুপায়।হাশরের মাঠে আজকের দিনটার জন্য তুমি আমাকে পাকড়াও করোনা মালিক।জান্নামের কঠিন আগুন যে আমি সয্য করতে পারবো না আল্লাহ!”

মনে মনে একনাগাড়ে বলে যাচ্ছিলো মালিহা।জাহান্নামের কথা স্মরণ হতেই নিজেকে আর কন্ট্রোল করতে না পেরে ডুকরে কেঁদে উঠলো মালিহা।

হটাৎ এমন কান্নার শব্দ পেয়ে আবরার তাকিয়ে পরলো তার হবু স্ত্রীর দিকে।

জাহান্নামের কথা স্মরণ হতেই নিজেকে আর কন্ট্রোল করতে না পেরে ডুকরে কেঁদে উঠলো মালিহা।

হটাৎ এমন কান্নার শব্দ পেয়ে আবরার তাকিয়ে পরলো তার হবু স্ত্রীর দিকে।আবরার খুব অবাক হয়ে হবু স্ত্রীকে জিজ্ঞেস করলো কোনো সমস্যা?

মালিহা কোনোরকম ভাবে নিজেকে কন্ট্রোল করে কোনো কথা না বলে শুধুমাত্র ইশারায় না সূচক উত্তর দিলো।এর মধ্যেই বিয়ের সব কার্যক্রম সম্পন্ন হলো।

বেলা প্রায় ১ টা বেজে গেছে। খুব অস্বস্তি লাগছে মালিহার।সামনে তাকিয়ে দেখলো কয়েকজন ক্যামেরা ম্যান তাদের দিকে এগিয়ে আসছে। মালিহার আর বুঝতে বাকি রইলো না যে বর কনের ছবি তোলার জন্য ই তাদের আগমন।

মুহুর্তের মধ্যেই মালিহার বুকের ধুপধাপ শব্দ যেন কোনো হাতুড়ি পেটাকেও হার মানাবে।সে যেন চিন্তা ভাবনা করতেই ভুলে গেলো।শুধু বিরবির করে বলতে লাগলো,

“O my Lord, my dear Allah, please help me.help me,help me.”

সুদূর থেকে বাতাসের সাথে ভেসে আসছে সুমিষ্ট আজানের ধ্বনি।মালিহা কোনো কিছু না ভেবেই উঠে দাড়ালো।কাউকে কিছু না বলেই হাটতে শুরু করলে আবরার জিজ্ঞেস করলো

আবরারঃকোথায় যাচ্ছেন?

মালিহাঃসালাত আদায় করে আসছি ইংশা আল্লাহ।

আবরার কে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই বাতাসের গতিতে হেটে চলছে তার রুমের দিকে।সবাই একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে মালিহার পানে।তাতে কি! কাউকে তোয়াক্কা করার সময় বা ইচ্ছে কোনোটাই যে নেই তার।

সে এখন ব্যস্ত, খুব ই ব্যস্ত।মনের কথা গুলো যে খুলে বলতে হবে একজন কে।অনুভূতি গুলো যে বাধ মানছে না আর।

রুমে ঢুকেই দরজা টা বন্ধ করে দিলো মালিহা।

ভারি লেহেঙ্গাটা চেঞ্জ করেই তাড়াতাড়ি ওয়াশরুমে ঢুকলো মালিহা।

মালিহার চলে যাওয়াতে খুব অবাক হলো সবাই।

আবরারের বাসার সবাই আবরারের দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো,

আবরারের বড় বোন জিজ্ঞেস করলো,

সাবিহাঃ কিরে আবরার, তোর বউ কোথায় গেলো?

আবরারঃ বললো তো নামাজে যাচ্ছে।(কিছু টা বিরক্তি ভাব নিয়ে।)

সাবিহাঃসময় কি চলে যাচ্ছিলো? এত্ত তাড়ার কি আছে বুঝলাম না। কোথায় এখন ছবি টবি তুলবো তা না? কেমন মেন্টালিটির মেয়ে কে জানে।

আবরারঃদেখ এবার তোরা ই বুঝে দেখ।আম্মি যে এই মেয়েটাকে কি দেখে পছন্দ করলো কে জানে।সারাক্ষণ কেবল জোকারের মতোই নিচের দিকে তাকিয়ে ছিলো। আম্মিকে যে এখন কি বলতে ইচ্ছে করছে।

জীবন টা মনে হয় বরবাদ হয়ে গেলো। এতো করে বললাম, রিয়া খুব স্মার্ট,সুন্দরী,শিক্ষিতা। কে শোনে কার কথা। অত স্মার্ট মেয়ে নাকি ভালো না। এখন তো দেখাই যাচ্ছে এই ক্ষ্যাত টা কতো ভালো!

সাবিহাঃকাম অন আবরার। তুই ওকে ট্রেনিং দিয়ে তোর মতো করে তুলবি।

আবরারঃপ্লিজ আপি তুই থাম। ভাল্লগছে না এসব। যেখানে ছিলি সেখানেই যা। একটু একা থাকতে দে আমাকে।

সাবিহাঃহি যাচ্ছি,(মুখে ভ্যাংচি কেটে)।তোর সাথে এতো প্যাচাল পাড়ার ও সময় নেই আমার।

সবার মাঝে যখন হট্টগোল বিরাজ করছে তখন মালিহার আব্বু আম্মু তাদের মাঝে এসে তাদের কে শান্ত করার উদ্দেশ্যে বিভিন্ন কথা বলাবলি শুরু করলো।

মালিহার মাঃ আপনারা কিছু মনে কইরেন না। আসোলে মালিহা তো ভারি ড্রেস খুব কম ই পড়ে তাই এতো ভারি লেহেঙ্গায় হয়ত ও আনইজি ফিল করছিলো,এজন্যই হয়ত এভাবে চলে গেছে।(হাসতে হাসতে বলছিলো কথাগুলো)

মালিহার আব্বুঃএকটু পরেই চলে আসবে।

আবরারঃ তিনি নাকি নামাজে গেছেন।(কিছুটা ব্যাংগো করে)

মালিহার আম্মুঃ ও হ্যা, আজান হইছে তো। আর বইলেন না মেয়েটা আমার সব কাজেই খুব সিনসিয়ার। সবকিছুই সময় মতো করার চেষ্টা করে।কিন্তু কি সমস্যা একটাই ও আসোলে ভুলে যায় কোন কাজটার গুরুত্ব কতো বেশি।এই যে যেমন এখন ও ভুলে গেলো।

আজকের এই দিনটা কি প্রতিদিন আসবে। কি আর বলবো। যাইহোক আপনারা আনন্দ করেন। ও একটু পরেই চলে আসবে।

ওয়াশরুম থেকে বের হয়েই জায়নামাজ বিছিয়ে সালাতে দাঁড়িয়ে গেলো।এর মাঝেই কেউ হয়ত দরজায় নক করেছে।সে দিকে মালিহার কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই।সালাত আদায় শেষ করে গভীর সিজদায় লুটিয়ে পরলো।

“মাবুদ গো দেখো তোমার পাপী বান্দী কিভাবে বাচ্চাদের মতো কেঁদে কেঁদে আবদার করছে।একটি বার তাকাও মালিক। তুমি তো জানোই তুমি ছাড়া আমার কেউ নেই।কার কাছে সাহায্য চাইবো বলো?

আল্লাহ তুমি না বান্দার চোখের পানি পছন্দ করো, দেখো আল্লাহ আমার চোখের পানির সাক্ষী তো তোমার জমিন,তোমার বাতাস, সবকিছুই।

আল্লাহ তুমিইতো বলেছে কেউ যেনো কোনো ভিখারি কে খালি হাতে না ফিরায়,ও মালিক তবুও কেউ যদি ভিখারিকে ফিরিয়ে দেয় এতে কিন্তু সে খুব একটা নিরাশ হয় না কারন তার হাত পাতার মতো আরো অনেক জায়গা আছে।একজনে না দিলে ও সে আরেক জনের আশায় থাকে।

হায় রহিম আমি থাকবো কার আশায় বলো? আমার যে হাত পাতার আর কোনো জায়গা নেই।তুমি তো একা ই আমার মালিক।

তাই তুমি আমাকে নিরাশ কইরো না রহমান।তুমি আমাকে সাহায্য করো রাব্বুল আলামীন। সব কিছু কে সহজ করে দাও। আমার ইমানী তেজ কে আরো বাড়িয়ে দাও আরশের অধিপতি।

আমার ইমান কে এতোটা মজবুত করো যতোটা মজবুত হলে সব বাধা পেরিয়ে আমি পৌঁছে যাবো জান্নাতের আঙিনায়।আমি যে তোমার সাথে সঠিক ভাবে কথাও বলতে পারিনা রাব্বুল আলামীন। বুঝাতে পারিনা অন্তরের অব্যক্ত অনুভূতি।

কিন্তু তুমি তো অন্তর্যামী।বুঝে নাও তোমার পাপী বান্দীর অন্তরের কথাগুলো।”

মালিহার চোখের পানি যেন কোনো বাধ মানছে না। অনেক ক্ষন ধরেই অঝোরে কেদেই চলছে আর প্রকাশ করার চেষ্টা করছে তার অব্যক্ত অনুভূতি।

কয়েক বার ই দরজায় নক করে কোনো সারাশব্দ না করলেও মালিহার বাসার কেউ চিন্তা করছে না কারন তারা জানে মালিহা দীর্ঘসময় নিয়ে সালাত আদায় করে।

সিজদা থেকে উঠে মালিহা ড্রেসিং টেবিলের সামনে গিয়ে দাড়ালো। নিজেকে মনে হচ্ছে নিজেই চিনতে পারছে না।

চোখ জোড়া যেন রক্তিম বর্ন ধারন করেছে।ঠোঁটে মুখে এক অদম্যতার ভাব।ড্রেস চেঞ্জ করার জন্য পাশ ফিরে লেহেঙ্গা টা হাতে নিলো মালিহা। লেহেঙ্গা টা হাতে নিতেই কেউ যেন ভিতর থেকে প্রতিবাদ করে উঠলো।

ছুড়ে ফেলে দিলো লেহেঙ্গা টা। মালিহা যেনো রুদ্ধশ্বাসী হয়ে যাচ্ছে।যুদ্ধক্ষেত্রে তরবারী হাতে রুদ্ধশ্বাসে ছুটে চলতে অগ্র পথে।হাতে নিলো তার প্রিয় কুচকুচে কালো জিলবাব টা।

নিজেকে এমন মুডে জিলবাবে আবদ্ধ করছে যেন সে পরিধান করছে কোনো যুদ্ধের পোশাক।জিলবাব পরা শেষ করে আয়নাতে সে নিজেকে

পরিলক্ষন করছে খুটিয়ে খুটিয়ে।ওহহো এখনো তো সে পুরোপুরিভাবে তৈরি নয়।তাড়াতাড়ি হাতমোজা পা মোজা গুলো পরে নিলো। হ্যা এবার মালিহা প্রস্তুত। প্রস্তুত তার অগ্রগামী যাত্রা।

এখন কেমন যেনো হালকা লাগছে নিজের কাছে।এতোক্ষণ যেন কোনো একটা ঘোরের মধ্যে ছিলো সে।আর তো সময় নেই তাড়াতাড়ি বাইরে যেতে হবে তাকে। তার জন্য যে আরো অনেক কিছু অপেক্ষা করছে। পাড়ি দিতে হবে দীর্ঘ পথ। দরজার কাছে যেতেই মনে পড়লো,

মালিহাঃইরে গুরুত্বপূর্ণ কাজটাই তো করা হয়নি।(জিভে কামড় দিয়ে)সেই কবে থেকে প্লান করে রেখেছি আর আজকেই ভুলে যেতে হলো এমন একটা বিষয়।

 

লেখিকাঃরহিমা খানম।

 

{ আরো পড়ুন –ভূতুড়ে বাংলো

( দেখা হবে জান্নাতে গল্পটি আপনাদের কেমন লাগলো তা কমেন্ট করে অবশ্যই জানাবেন। পরবর্তী পর্বের জন্য আমাদের সাথেই থাকুন । ধন্যবাদ।)