মৃত্যুর জঙ্গল – ভূতের গল্প

মৃত্যুর জঙ্গল

রাত আনুমানিক দশটা।গ্রামে রাত দশটা মানে অনেক রাত।চারিদিক শুনশান, নিস্তব্ধ।পূর্ণিমার আলোতে এই নিঝুম রাতে শান বাঁধানো পুকুর ঘাটে আড্ডা দিচ্ছে নিলয়,মৃন্ময়, সৌরভ, কাব্য আর রোহান।ছোট বেলা থেকেই বন্ধুত্ব ওদের।আড্ডার মূল বিষয় বস্তু হচ্ছে জঙ্গলে ট্র্যকিং নিয়ে।

তবে তার আগে সবার পরিচয় জেনে নেওয়া যাক।

মৃন্ময় এর পুরো নাম আরিয়ান মৃন্ময়।মৃন্ময় এর বাবা গ্রামের স্কুল শিক্ষক এবং মা গৃহিণী।মৃন্ময়ের একটি ছোট বোন আছে।নাম তৃষা তানজিম ইচ্ছে।দশম শ্রেণীতে পড়ে ও।মৃন্ময় ঢাকায় একটা বেসরকারি কম্পানিতে চাকরি করে।বেতন অবশ্য ভালই পায় সে।

তবে মৃন্ময় একজন প্রকৃতিপ্রেমী মানুষ।পাহাড় ,সমুদ্র,জঙ্গল ওকে খুব টানে।তাই প্রায়ই ও ছুটে যায় প্রকৃতির কাছে।তবে এবার অবশ্য একা যাবে না ও।

প্রাণপ্রিয় বন্ধুদের ও সাথে নিয়ে যাবে।এই কারণেই অফিস থেকে ছুটি পেতেই সময় নষ্ট না করে চলে এসেছে ও।

মৃত্যুর জঙ্গল

কাব্য এর পুরো নাম নেহাল মাহমুদ কাব্য।কাব্যর বাবার মুদি দোকান আছে এবং মা গৃহিণী।কাব্যরা দুই ভাই।কাব্যর বড় ভাই ঢাকায় চাকরি করে।কাব্য ও ঢাকায় পড়াশোনা শেষ করে এখন ফটোগ্রাফির কাজ করে।

ফটোগ্রাফি ওর নেশা।এই ফটোগ্রাফির জন্য ও চল্লিশ হাজার টাকার বেতনের ভালো চাকরিটাও ছেড়ে দিয়েছে।মৃন্ময় যখন ওকে প্রথমে জঙ্গল ট্র্যকিং এর কথা বলে ও এক কথায় রাজি হয়ে যায়।

ওর রাজি হওয়ায় পিছনে অবশ্য একটা কারণ ও আছে।কাব্য ভাবে ও ওর ক্যামেরা দিয়ে পুরো ট্রিপের ওপর শর্ট ডকুমেন্টরি বানাবে।

নিলয় আহমেদ মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান।ওর নিজের উপার্জনের ওপরই ওর পরিবার নির্ভরশীল।বেশ ভালো একটা কম্পানিতে চাকরি করে ও।তবে ওর মা ওর বিয়ের জন্য উঠেপড়ে লেগেছে।

মার ইচ্ছেতেই নিলয় শেষমেষ রাজি হয়েছে বিয়েতে। আর দু-মাস পড়েই ওর বিয়ে।তবে বিয়ে অনেকটা ঘরোয়া ভাবেই করতে চায় নিলয়।

সৌরভ আর রোহান ওরা দুইজন আপন ভাই।সৌরভ রোহানের থেকে এক বছরের ছোট হলেও ওরা দুজন এক সাথেই স্কুলে ভর্তি হয়।তাই ওরা দুজন একই ব্যাচের সুডেন্ট হয়ে যায়।

ওরা দুই ভাই আপাদত গ্রামেই থাকে।পড়াশোনা শেষ করে ওরা বিজনেস শুরু করে।ছোটবেলা থেকেই দুই ভাইয়েরইচ্ছা ছিল ব্যবসা করার।

আলোচনার এক পর্যায়ে সৌরভ বলল,

কবে যেতে চাচ্ছিস তোরা?

সৌরভের কথা শুনে মৃন্ময় বলে উঠলো,

পরসু রওনা দিলে ভালো হয়।যেহেতু সবার ছুটিও বেশিদিন নেই।

মৃন্ময় এর কথা শুনে রোহান বলে উঠল,

এত অল্প সময়ে সব কিছু ম্যানেজ করব কিভাবে?

মৃন্ময় বলল,

ও নিয়ে তোদের ভাবতে হবে না।ওসব আমি আর কাব্য সামলে নিব।তবে আমাদের সাথে আরও দুজন যাবে।আগামীকাল ওরা আমাদের গ্রামে আসবে।

আরও দুজন কে কে যাবে আমাদের সাথে? নিলয় জিজ্ঞেস করল মৃন্ময়কে।

নিলয়ের প্রশ্নের জবাবে মৃন্ময় লাজুক হয়ে বলল,

আমার গার্লফ্রেন্ড মেহের আর ওর বান্ধবী জান্নাত।

মৃন্ময়ের লজ্জা পাওয়া দেখে সৌরভ বলে ওঠল,

প্রেম করার সময় তো লজ্জা পাও নি মামা তবে এখন কেন লজ্জা পাচ্ছ? তুমি তো দেখি মিয়া তলে তলে টেম্পু চালাও।তো কবে থেকে শুরু করলা এসব?

সৌরভের কথায় বেচারা মৃন্ময় আরেক দফা লজ্জা পেল। কিছুক্ষণ পর বলল,

আরে বেশিদিন হইনি। সবে ছয় মাস হলো। একই অফিসে চাকরি করি আমরা ,সেই হিসেবে কলিগ বলতে পারিস আমাদের।

মৃন্ময়ের কথা শেষ হতেই সৌরভ দুঃখিত স্বরে বলে উঠলো,

তোরই কপাল বুঝলি। আমরা তো মনে হয় সারাজীবন সিঙ্গেল ই থাকব।

আরে ব্যাটা আমরা কেন বলছিস? নিলয়কে নিচ্ছিস কেন আমাদের সাথে? ওর তো মাস দুয়েক পরেই বিয়ে। ঐ সৌরভ আগেই বলে দিলাম জান্নাত কিন্তু আমার।ওর দিকে চোখও দিবি না কইলাম। কাব্য ও সৌরভ উভয়কেই শাসিয়ে বলে ওঠল রোহান।

কইলেই হইল জান্নাত তোর।ছোট ভাইয়ের হবু বউয়ের দিকে নজর দিতে লজ্জা করল না তোর।এখনও সময় আছে ভালো হইয়া যা। গর্জে করে ওঠল সৌরভ।

জান্নাত কে নিয়ে সৌরভ ও রোহান এর মধ্যে কথা কাটাকাটি শুরু হলো। এইটা অবশ্য ওদের নিত্য দিনের কাজ। পিঠাপিঠি হওয়ার দরুণ দুজনের সব সময় ঝগড়া লেগেই থাকে। তবে ওদের মধ্যে মিল ও রয়েছে অনেক।

অবশেষে ওদের ঝগড়া কমল মৃন্ময়ের ধমকে।মৃন্ময় ওদের ধমক দিয়ে বলল,

জান্নাত কারো নয় বুঝলি।ওর দিকে কেউ নজরও দিবি না। ও আমার গার্লফ্রেন্ড এর বান্ধবী।ওর কিছু হইলে আমার গার্লফ্রেন্ড আমারে ছাইড়া চইল্যা যাইবো। অনেক কষ্টে একটা মেয়ে পটাইসি।এইটারে ভাগাইছ না। তাই সাবধান।”

সবই তো বুঝলাম।কিন্তু যাবিটা কই? জায়গা কি ঠিক করেছিস তুই?” গম্ভীর স্বরে বলে ওঠল নিলয়।

চিন্তা করিস না।জায়গা আমি ঠিক করেই রেখেছি। মৃন্ময় বলল।

কোথায়? বাকি সবাই এক সাথে বলল।

ঐটা সারপ্রাইজ।পরসু জানতে পারবি তোরা।এখন চল ঘুমাতে যাই।কাল সকালে তাড়াতাড়ি ঘুম থেকে উঠতে হবে আবার।ওরা প্রথমবার আসছে এখানে। মৃন্ময় বলল।

হুম চল।সত্যিই অনেক রাত হয়ে গেছে। কাব্য বলল।

কাব্যর কথা শুনে সবার খেয়াল হলো সত্যিই অনেক রাত হয়ে গেছে।ওদের মধ্যে সৌরভ একটু ভিতু।ও বলল,

চল এতক্ষণ বাহিরে থাকা ঠিক নয়।কবরস্থান কাছে। তাড়াতাড়ি চল। তেনারা চলে আসবেন।

চুপ।এতো ভিতু একজন কেমনে যে আমার ভাই হলো তা আল্লাহ্ই ভালো জানেন।

সৌরভকে নিয়ে হাসাহাসি করতে করতে ওরা সবাই বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দিল।

পরের দিন সকাল বেলা ফোনের রিংটোনে ঘুম ভেঙ্গে গেল মৃন্ময়ের।গতকাল অনেক রাত অবধি আড্ডা দেওয়ার ফলে রাতে ঘুমাতে অনেক দেরি হয়েছে।ফলস্বরূপ আজ ভোরে ঘুম থেকে আর ওঠতে পারে নি ও। বিরক্তিভরে চোখ বন্ধ করেই কল রিসিভ করল ও,

হ্যালো মৃন্ময় আমি আর জান্নাত ঢাকা থেকে রওনা দিয়েছি।

মেহের এর কথা শুনে ট্র্যকিং এর কথা এতোক্ষণে মনে পড়ল মৃন্ময়ের।ওতো বেমালুম সব ভুলে বসে ছিল।

কি ব্যাপার কথা বলছ না কেন?

মেহের এর কথা শুনে ভাবনার রাজ্যে বিচরণ করা আর হলো না মৃন্ময়ের। মেহেরকে বলল,

ওকে চলে আসো।পৌছানোর একটু আগে আমাকে কল করো। আমি বাস স্ট্যান্ড এ গিয়ে তোমাদের নিয়ে আসব।

ওকে।রাখছি তাহলে এখন।

ওকে।সাবধানে এসো।আল্লাহ্ হাফেজ।

আল্লাহ্ হাফেজ।

মৃন্ময় কথা বলা শেষ করে দেখল অনেক বেলা হয়ে গেছে ।ঘড়িতে এগারোটা বাজে তখন।অনিচ্ছা স্বত্তেও ওঠে ফ্রেশ হতে গেল ও।

মৃন্ময়দের গ্রামের নাম ললিতাবাড়ি।শেরপুর টাউন থেকে একটু দূরেই।মেহেররা আসার এক ঘণ্টা আগেই মৃন্ময় আর নিলয় ওদের আনতে বাস স্ট্যান্ড চলে গেল।

বেশ কিছু ক্ষন পর মেহেরদের গাড়ি এসে পৌছালো স্ট্যান্ড এ।বাস থেকে নামল মেহের ও জান্নাত।ওদের বাস থেকে নামতে দেখে ওদের দিকে এগিয়ে গেল মৃন্ময় ও নিলয়।

মৃত্যুর জঙ্গল

তোমাদের আসতে কোন কষ্ট হয়নি তো মেহের?

আরে না। আমরা তো বেশ মজা করতে করতেই এসেছি।

তাহলে তো ভালই।তবে চলো এখন গ্রামের দিকে যাওয়া যাক।

তোমাদের গ্রামে যেতে কি আবার হাঁটতে হবে নাকি?

আরে ভাবি হাঁটতে হবে কেন?এখান থেকে সোজা অটোতে চলে যাবেন।তারপর অবশ্য একটু হাঁটতে হবে।”

নিলয় এর কথা শুনে মেহের ও জান্নাত দুজনেই বেশ অবাক। মেহের অবশ্য লজ্জা পাচ্ছে। মৃন্ময় মেহের ও জান্নাত এর সাথে নিলয় এর পরিচয় করিয়ে দিল।তারপর অটো করে রওনা দিলো গ্রামের উদ্দেশ্যে।মৃন্ময় বাড়িতে এসে ওর বাবা, মা আর ওর বোনের সাথে অফিসের কলিগ বলে পরিচয় করে দিল ওদের।

তোমরা এখন বিশ্রাম করো।বিকালে তোমাদের পুরো গ্রাম ঘুরে দেখাব।ইচ্ছে যা তো ওদের ঘরটা দেখে দিয়ে আয়।

আপনারা আমার সাথে আসুন।

মেহের ও জান্নাত ইচ্ছের পিছন পিছন ওদের ঘরে চলে গেল।আপাদত কিছুক্ষন বিশ্রাম নেওয়া দযকার ওদের।তবে তার আগে ফ্রেশ হওয়ার দরকার।তাই মেহের ইচ্ছে কে বলল,

ইচ্ছে আমরা একটু ফ্রেশ হতে চাচ্ছিলাম।তোমাদের বাথরুমটা কোন দিকে?

ইচ্ছে ওদের দেখিয়ে দিয়ে বলল,

আপনাদের যা লাগে বলবেন।আপনারা বিশ্রাম করুন।বিকালে ভাইয়া আপনাদের গ্রামটা ঘুরে দেখাবে।

ইচ্ছে চলে যাওয়ার পর মেহের ও জান্নাত ফ্রেশ হয়ে বিশ্রাম নিলো।বিকাল বেলা মৃন্ময় এলো ওদের রুমে।

কি ব্যাপার তোমারা এখনও তৈরি হও নি?

হুম। আমরা তো রেডি।

তাহলে চলো।

কোথায় যাব?

প্রথমে আমার বাকি বন্ধুদের সাথে পরিচয় করে দিব তোমাদের। তারপর গ্রাম ঘুরে দেখাব।

ঠিক আছে চলো।

মৃন্ময়দের বাড়ি থেকে কিছুটা দূরে একটি খোলা মাঠ আছে।বিকেল বেলা গ্রামের সব ছেলেরা আড্ডা দেয় এখানে।মৃন্ময় মেহের দের নিয়ে সেখানে যায়।সবাই আগে থেকেই ওদের জন্য অপেক্ষা করছিল।মৃন্ময়রা যাওয়ার পর রোহান বলল,

কিরে ভাবির সাথে পরিচয় করে দিবি না আমাদের?

মৃন্ময় রোহান এর কথা শুনে হেসে ওদের সবার সাথে মেহের ও জান্নাত এর পরিচয় করে দিল।পরিচয় পর্ব শেষ করে নিলয় বলল,

এবার বল কাল যাব কখন?

সকাল সকাল বের হবো। মৃন্ময় বলল।

কিভাবে যাবি। কাব্য জিজ্ঞেস করল।

প্রথমে বাসে করে শ্রীবরদীর বাবলা কোনায় যাব।তারপর সেখান থেকে টেম্পুতে করে যাব রাজার পাহাড় বাবলাকোনায়।

বাবলাকোনায় কেন যাবি? তুই যে বললি জঙ্গলে যাবি।

জঙ্গলেই তো যাব। বাবলাকোনায় আন্ধাঘেরা জঙ্গলে।

নামটা কেমন অদ্ভুত। কেমন যেন ভুতুরে টাইপ।আমার তো এখনই ভয় লাগছে। জঙ্গলে ট্র্যকিং করার দরকার নেই। আমরা বরং অন্য কোন জায়গায় যাই।

তুই চুপ থাক। ভিতুর ডিম। মৃন্ময় তুই ওর কথায় কান দিস না।

সৌরভকে নিয়ে হাসাহাসি করতে করতে ওরা সবাই ওঠে চলে গেল মেহের আর জান্নাতকে গ্রাম ঘুরিয়ে দেখাতে।

ছোট নদী টেউফা। এ নদীর শান্ত শীতল স্রোতধারা এক টানা বয়ে চলেছে। নদীর এপার কূল ঘেঁসে নানা কারুকার্যে সজ্জিত উপজাতি বাবলাকোনা এলাকা।এ গ্রাম যেন যোগ করেছে নতুন মাত্রা।

গভির মমতা আর ভালোবাসায় ভরা উপজাতিদের বর্ণিল জীবনধারা। নদীর ওপারে সবুজ বন বৃক্ষে আচ্ছাদিত হয়ে আছে আন্ধাঘেরা জঙ্গল।জঙ্গলের মাঝে রয়েছে ছোট-বড় অসংখ্য পাহাড়।তবে এদের মধ্য সবচেয়ে বড় পাহাড়ের নাম টিলা রাজার পাহাড়।এ পাহাড়ের নাম করণ নিয়ে একটি পুরনো গল্প আছে।

প্রাচীন কালে কোন এক রাজার বাসস্থান ছিল এখানে।সেই অনুযায়ী এই পাহাড়ের নাম দেওয়া হয় রাজার পাহাড়।তবে প্রাচীন রাজার কোন চিহ্ন এখানে নেই।তবে এই জঙ্গলে উপজাতিদের আনাগোনা খুব কম দেখা যায়।

এর কারণও অবশ্য আছে।ওদের ধারণা এই আন্ধাঘেরা জঙ্গল একটি অভিশপ্ত জঙ্গল।এই জঙ্গলে যেই একবার যাই সে আর ফেরত আসে না।

বর্ষাকালে টেউফা নদীর জোয়ারে কানায় কানায় ভরে ওঠে।তবে দিনের শেষে ভাটা পড়ে।এ নদীর পানির গতি কখনও কমে না।

নদীর এপারের জঙ্গলে করো আনাগোনা না থাকায় জঙ্গলটি আরও ভুতুরে দেখায়।দূর থেকে দেখলেই কেমন গা ছমছম করে।এছাড়াও রাতের বেলা কিছু অদ্ভুত শব্দ শুনতে পাওয়া যায় এ বন থেকে।তাই বাবলাকোনার উপজাতিরা পারত পক্ষে রাতের বেলা কম বের হয়।ওদের ধারণা রাতের বেলা বের হলেই জঙ্গলের ঐ অশরীরী ওদের ডেকে নিয়ে যাবে ঐ মৃত্যুর জঙ্গলে।

 

লেখিক: আফরোজ

 

 

{ আরো পড়ুন –দেখা হবে জান্নাতে

( মৃত্যুর জঙ্গল গল্পটি আপনাদের কেমন লাগলো তা কমেন্ট করে অবশ্যই জানাবেন। পরবর্তী পর্বের জন্য আমাদের সাথেই থাকুন । ধন্যবাদ।)