সবুজ ডায়েরীর আত্মকথা

সবুজ ডায়েরীর আত্মকথা

 

টিউশনি করে রাতের বেলা হেঁটে হেঁটে বাসায় ফিরছিলাম। হঠাৎ পথের পাশে পড়ে থাকা একটা সবুজ রঙের ডায়েরীর উপর নজর পড়লো। ভাবছিলাম তুলবো কিনা। এভাবে পড়ে থাকা কারো জিনিস ধরা তো ঠিক না। তারপরও কি মনে করে ডায়রীটা তুলে নিলাম। বাসায় গিয়ে ফ্রেশ হয়ে ডায়রীটা খুললাম। প্রথম পাতায় একটা মেয়ের নাম লিখা।

ভাবলাম একটু পড়েই দেখি না, পড়ার পর না হয় শেষ পাতায় যে ঠিকানাটা দেয়া আছে সেখানে যোগাযোগ করা যাবে। পড়তে শুরু করলাম প্রথম পাতা থেকে,

আজকে আমাদের বিয়ে হয়েছে। বিয়ের প্রথম রাতেই আমরা চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় যাচ্ছি। গাড়ির পেছনের সিট দুটোতে আমি, আর কিছুক্ষণ পূর্বে কবুল বলা আমার স্বামী একসাথে বসা। বিয়ের আগে উনার সাথে আমার একবারই দেখা হয়েছিলো, যখন উনি আমাকে দেখতে এসেছিলেন। দুজনে গাড়িতে বসে আছি চুপচাপ। আমার ইচ্ছে হলো অনুভূতি দিয়েই শুরু করি বিবাহিত জীবন।

তাই ঘুমের অভিনয় করে উনার কাঁধে মাথা রাখলাম। উনিও কাছে এসে পাশাপাশি বসলেন। এই প্রথম কোনো পুরুষের কাঁধে মাথা রাখলাম। লজ্জায়, ভয়ে, আনন্দে প্রায় দুই ঘণ্টা এভাবে উনার কাঁধে শুয়ে ছিলাম। উনার মাঝে তখন কি চলছিল, কে জানে।

আজকে ফজরের আযানের সময় উনি আমার মুখে পানির ছিটা দিয়ে জাগিয়ে দিয়েছে। জিজ্ঞেস করলাম, এমনেই তো জাগাতে পারতেন, পানির ছিটা দেয়া লাগে! উনি মার্কা মারা এক হাসি দিয়ে বললেন, এক গল্পে পড়েছিলাম প্রেমিক প্রেমিকাকে পানির ছিটা দিয়ে জাগাচ্ছে।

উনার সরলতা দেখে প্রচুর হাসি পাচ্ছিল, উনি লজ্জা পাবেন বলে হাসি চাপিয়ে রাখলাম।

আজকে রান্নায় ভুলে যে লবণ বেশি দিয়ে ফেলেছি টের পাইনি। উনি খাওয়ার সময় কিচ্ছু বললেননা। পরে যখন আমি খেলাম তখন বুঝতে পারি। জিজ্ঞেস করলাম, লবণ বেশি হয়েছে বললেননা কেনো? উনি মুচকি হেসে উত্তর দিলেন, প্রতিদিন তো আর এইরকম হয় না, আজকে হয়তো ভুলে করেছো তাই চুপচাপ খেয়ে নিয়েছি। আমি বললাম, আরে বাহ্! আপনার মাথায় বুদ্ধিও আছে দেখছি।

আজকে অসুস্থ লাগছে। কিন্তু এতগুলো কাপড় সকালে ভিজিয়েছিলাম, এখন কিভাবে যে ধুবো। সহজ সরল মানুষটা কিভাবে যেনো বুঝে গেলো ব্যাপারটা। আছতে আছতে গিয়ে কাপড় সব ধুয়ে ফেলছিলেন। বাথরুমে গিয়ে দেখি অর্ধেকের মত ধুয়ে ফেলেছেন।

আজকে দুজনে মিলে ঘরে জামাতে নামায পড়লাম। পিছনে দাঁড়িয়ে যখন উনার সুরেলা কণ্ঠে কোরআন তেলাওয়াত শুনছিলাম, মনে এক প্রশান্তি বয়ে যাচ্ছিল। দুআয় আমার জন্য কেঁদে কেঁদে অনেক কিছু চাইছিলেন। বুঝলাম আমার জীবনে কি কি দরকার তা আমার চেয়ে উনিই বেশি জানে।

আজকে আমার শাশুড়ি আম্মা গ্রাম থেকে এসেছেন। মা আর ছেলে মিলে গ্রাম্য ভাষায় কথা বলছে আর হাসাহাসি করছে। একটু আগে উনি নিজ হাতে মাকে ভাত খাইয়ে দিচ্ছিলেন। দৃশ্যটা দেখতে অনেক ভালো লাগছিলো। কিছুক্ষণ পর মা আমাকে কাছে ডেকে বললেন, আমার পোলাডা সহজ সরল, ওরে একটু দেইখ্যা রাইখ্যো।

জীবনে এইরকম দিন আসবে কখনো ভবি নি। কলিং বেল বাজতেই দরজা খুলে উনার দিকে তাকাতেই ভয়ে আমার পুরো শরীর কাঁপতে থাকে। উনার জামা ছেঁড়া, ডান হাতে অনেক বড় ব্যান্ডেজ। জিজ্ঞেস করলাম, কিভাবে হলো আপনার এই অবস্থা? উনি বললেন, আর বলো না, তোমাকে একটা উপহার দেয়ার জন্য কিছু টাকা জমিয়েছিলাম।

টাকাগুলো নিয়ে বের হয়েছি, আর ছিনতাইকারী ধরলো। আমি টাকাগুলো দিতে চাচ্ছিলাম না দেখে ডান হাতটায় ছুরি দিয়ে আঘাত করে টাকাগুলো নিয়ে নিয়েছে। আমি বললাম, আপনি এত বোকা কেনো। ওরা টাকা চাচ্ছিল দিয়ে দিতেন, বাঁধা দিচ্ছিলেন কেনো। আল্লাহ্ না করুক যদি ছুরি দিয়ে অন্য কোথাও আঘাত করতো।

আজকে দুআয় আল্লাহর কাছে অনেক কাঁদলাম। আল্লাহ্ তুমি আমার সহজ সরল স্বামীটাকে সব সময় হেফাজতে রেখো।

রান্না করছিলাম। কথা নাই, বার্তা নাই, হঠাৎ করে উনি পেছন থেকে এসে জড়িয়ে ধরলেন। বললাম, আরে করছেন টা কি! তরকারি পুড়ে যাবে, ছাড়ুন। উনি বললেন,

ছাড়বোনা, আগে বলো আমাকে ভালোবাসো। আমি বললাম, আমি আপনাকে ভালোবাসি, এবার তো ছাড়ুন। উনি আমাকে ছেড়ে দিলেন। ছাড়া পেয়ে বললাম, আপনিও না মাঝে মাঝে কি করেন! দেখছেন রান্না করছি, ঘামে পুরো শরীর ভেজা আর আপনি কিনা! উনি বললেন, আমি তো গল্পে পড়েছিলাম বউকে পিছন দিক দিয়ে জড়িয়ে ধরলে তারা খুশি হয়। আমি খিলখিল করে হেসে বললাম, আরে আমার সিদা জামাই একটু তো চালাক হোন, বুদ্ধি খাটান।

মনে মনে অবশ্য ব্যাপারটা ভালই লেগেছিলো।

প্রতিদিনের মত আজকেও উনি কুরআনুল কারীমের কথা আমাকে শোনাচ্ছেন। উনি যখন আল্লাহর কথা বলেন তখন আল্লাহকে খুব কাছে মনে হয়। বিয়ের আগে কত গুনাহ করতাম, কত নামায ছেড়ে দিতাম। কিন্তু আল্লাহ্ আমাকে এইরকম স্বামী দিয়েছে, যার ভালোবাসায় এখন ইসলামের বিধানগুলো পালন করা আমার জন্য সহজ হয়ে গেছে।

আমি ডায়েরি লিখি দেখে উনিও কয়েকদিন ধরে ডায়েরি লেখা শুরু করেছেন। অনেকদিন চেষ্টা করেছি উনার ডায়েরীটা পড়ার জন্য, যে উনি কি লিখে। কিন্তু মানুষটা সহজ সরল হলে কি হবে, অফিসে যাওয়ার সময় ঠিকই ডায়েরীটা ড্রয়েরে রেখে তালা দিয়ে চাবি নিয়ে যান। অপেক্ষায় আছি কবে উনার ডায়েরীটা পড়তে পারবো, পড়ে জানতে পারবো উনার চোখে আমি কেমন।

এতক্ষণ এক ধ্যানে ডায়েরি পড়ছিলাম। হঠাৎ দুষ্ট বুদ্ধি মাথায় খেলা করলো। ডায়েরীর শেষ পাতার ঠিকানায় দেয়া মোবাইল নাম্বারে কল দিলাম। একটা মেয়েলি কণ্ঠ হ্যালো বললো। বুঝলাম উনি এই ডায়েরীর লেখিকা। আমি বললাম,

আপনার হাজব্যান্ডকে একটু দেয়া যাবে?

জ্বি দিচ্ছি।

এরপর ফোনে উনার স্বামী বললেন,

কে বলছিলেন?

পথের পাশে একটা ডায়েরী পেলাম। ঠিকানায় এই নম্বরটা ছিলো।

সত্যি বলছেন। ডায়রীটা খুঁজে পেয়েছেন! অসংখ্য ধন্যবাদ। আপনি জানেন না সারাদিন ডায়রীটার জন্য আমার স্ত্রী কতটা মন খারাপ করেছিলো। আপনি আপনার ঠিকানাটা বলুন, আমি আসছি নেয়ার জন্য।

ডায়রীটা ফেরত দিবো ঠিকই, কিন্তু আমার একটা চাওয়া আছে আপনার কাছে।

অবশ্যই, আপনি কি চান বলুন?

আপনার ডায়রীটা।

মানে?

যদি আপনার নিজের ডায়রীটা একদিনের জন্য আমাকে দেন তাহলেই আপনার স্ত্রীর ডায়রীটা ফেরত দেবো।

 

লেখক: এনামুল হাসান এনাম

 

{ আরো পড়ুন – অভিশপ্ত দোলনা

( সবুজ ডায়েরীর আত্মকথা গল্পটি আপনাদের কেমন লাগলো তা কমেন্ট করে অবশ্যই জানাবেন। পরবর্তী পর্বের জন্য আমাদের সাথেই থাকুন । ধন্যবাদ।)