এক মুঠো রোদ
বিয়ের প্রথম রাতে সে আমার কাছে একা আসেনি। সাথে আরো একজন নিয়ে এসেছিলো।
প্রথমে ভেবেছিলাম বন্ধু হবে হয়তো, তাই পরিচয় করাতে নিয়ে এসেছে।
কিন্তু সে আমায় ভুল প্রমান করে নিজে থেকেই বলে ওঠে,
“আজ তোমার সাথে আমি নয়, সে বাসর করবে, খুশি করে দাও ওকে”
নিজের স্বামীর মুখে এমন কথা শুনে পায়ের নিচ থেকে মাটি সরে গিয়েছিলো। কানকে একদমই বিশ্বাস করতে পারিনি। বুকের ভেতরটা ধুকধুক শুরু করেছিলো। এক মূহুর্তের জন্য ফ্রিজ হয়ে গেছিলাম।
মনে অনেক আসা নিয়ে তার বাড়িতে পা রেখেছিলাম। যদি এই জীবনে একটু সুখের দেখা পাই। আমার বয়স যখন ১২ বছর, তখন মায়ের পরকিয়ার জের ধরে বাবা মায়ের থেকে আলাদা হয়ে যায়।
বাবা অনেক চেয়েছিলো আমায় তার কাছে নিয়ে যেতে। কিন্তু মা আমায় কিছুতেই বাবার কাছে যেতে দেয়নি।
আমিও মাকে ছেড়ে যেতে চাইনি। মায়ের সাথেই রয়ে গেছিলাম।
বাবার সাথে ডিভোর্সের ২ সপ্তাহ পর মা আবার নতুন করে সংসার সাজায়। আমার মায়ের সেই স্বামীকে আমি একটুও পছন্দ করতাম না। ওনাকে বাবা বলে না ডাকায় মা একদিন আমায় খুব মেরেছিলো।
খুব কষ্ট পেয়েছিলাম সেদিন। একদিন জানতে পারি এই সেই লোক, যার জন্য আমাদের সাজানো গোছানো সংসারটা তছনছ হয়ে গিয়েছিলো।
বাবা মাকে কোনো মিথ্যে অপবাদ দেয়নি। সত্যিই মা পরকিয়ায় জড়িয়েছিলো।
মায়ের প্রতি মনের মধ্যে প্রচুর ঘৃণা জন্মাতে থাকে।
মা সেই লোকটার জন্য এতটাই পাগল ছিলো যে লোকটা মাকে যা বলতো মা তাই করতো।
শত কষ্ট বুকে চেপে বাবার জন্য অনেক অপেক্ষা করতাম, এই বুঝি বাবা এসে আমাকে এই জাহান্নাম থেকে বের করে নিয়ে যাবে।
কিন্তু বাবা আর কখনোই ফিরে আসেনি। এখনো জানি না আমার বাবা কোথায় আছে কেমন আছে।
ওই লোকটার কথায় মা আমার পড়াশোনা বন্ধ করে দেয়। নিজের মা আমার সাথে সৎমায়ের মত ব্যবহার শুরু করে। ঘরের যাবতীয় সব কাজ আমায় দিয়ে করাতো। পান থেকে চুন খসলেই খুব মারতো।
খুব অত্যাচার হতো আমার ওপর।
একদিন মাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে কান্না করে বলেছিলাম
মা, কেনো তোমরা আমার সাথে এমন করছো? আমি তো তোমারই মেয়ে। কেনো আমায় এত কষ্ট দিচ্ছো? আমি যে আর পারছিনা মা।
মা আমায় একটা তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বলে, আমি নাকি তার নিজের মেয়ে নই। বাবার শারীরিক সমস্যার কারনে মা গর্ভধারণ করতে পারেনি। তাই তারা আমায় দত্তক নেয়।
সত্যি বলতে আমার পুরো দুনিয়াটা এমনিতেই ওলট পালট ছিলো, মায়ের এমন কথায় আমার একটুও কষ্ট হয়নি, শুধু একটু অবাক হয়েছিলাম।
নিজের মেয়ের সাথে কি কেউ এমন করতে পারে?
বাবা আমায় খুব ভালোবাসতো, তাই বাবার কাছে আমায় দেয়নি। বাবার সুখ নাকি মায়ের পছন্দ না, তাই বাবার থেকে আমায় কেড়ে নেয়।
খুব একা হয়ে গিয়েছিলাম।
আমার বয়স যখন ১৬, শারীরিক দিক দিকে তখন আমাকে অনেকটা বড় লাগতো।
এমনি একরাতে রান্নাঘরেই ঘুমাচ্ছিলাম, মাঝরাতে কারো হাতের ছোয়ায় ঘুম ভেঙে যায়। চোখ মেলে দেখি ওই লোকটার হাতে আমার ওড়না, আর লোকটা আমার দিকে কুকুরের মতো করে তাকিয়ে লালা ফেলছে।
ভয়ে রান্নাঘরের এক কোনায় চলে যাই।
সেও ধীরেধীরে আমার কাছে এসে বসে।
তার মতলব বুঝতে পেরে জোরে চিৎকার দিয়ে উঠি।
কোথায় থেকে যেনো মা দৌড়ে আসে।
আমাদের এমন অবস্থায় দেখে মা ভীষণ রেগে যায়।
মাকে দেখে লোকটা আমার ওড়না আমার মুখের ওপর ছুড়ে মেরে চলে যায়।
সেই রাতে মা আমায় খুব মারে।
মা ওই লোকটাকে ভীষণ ভালোবাসতো, তাই হয়তো তার রাগ আমার ওপর দিয়ে ওঠায়।
মায়ের মার খেয়ে ২দিন ভীষণ জ্বর ছিলো, হাটতে পারছিলাম না। তবুও ঘরে প্রতিটা কাজ আমায় করতে হয়েছে।
মায়ের ওই স্বামীর ভয়ে মা আমাকে বাড়ি থেকে তাড়ানোর উপায় খুজতে থাকে। আমার বিয়ে ঠিক করা হয়।
যার সাথে আমার বিয়ে ঠিক করা হয় তাকে আমি বিয়ের আগ পর্যন্ত দেখিনি, চিনিও না।
শুনেছিলাম আমার বর মায়ের ওই স্বামীর সাথে কিসের যেনো ব্যবসা করে। সেই সুত্রে মা তাকে চিনে।
ওই জাহান্নাম থেকে বের হয়ে নিজের স্বামীর বাড়ি এসে একটা সস্থির নিশ্বাস ফেলি।
এবার যদি জীবনে একটু সুখের দেখা পাই।
স্বামীর বাড়ি এসে জানতে পারি ওনার পরিবারে কেউ নেই। উনি একাই এই বাড়িতে থাকেন।
মনে মনে খুব লোভ হয়েছিলো, ওনার শুন্য মনে শুধু আমারই জায়গা হবে। ওনার সব ভালোবাসা জুড়ে শুধু আমিই থাকবো।
খুব আসা ভরসা নিয়ে বাসর ঘরে বউ সেজে ওনার জন্য অপেক্ষা করছিলাম। এই বুঝি উনি এসে আমার ঘোমটা তুলবেন, আর আমি লজ্জায় লাল হয়ে যাবো। তখন উনি আমার লজ্জা ভাঙাবেন।
আমার সব স্বপ্ন মাটি করে উনি বাসর ঘরে অন্য লোক নিয়ে এসে তার সাথেই আমায় রাত কাটাতে বলেন।
খুবই ভয় পেয়ে যাই। এক জাহান্নাম থেকে বের হয়ে বুঝি আরেক জাহান্নামে প্রবেশ করলাম।
উনি আমাকে কিছু কাপড় হাতে ধরিয়ে দিয়ে তৈরী হতে বলে রুমের বাহিরে চলে যান।
ধরেই নিয়েছিলাম আমার জীবনটা শেষ।
স্বামী হয়ে কি করে নিজের বিয়ে করা বউকে অন্যের হাতে তুলে দিতে পারে? কি করে আমার সব স্বপ্ন এভাবে চুরমার করে দিতে পারে?
সেও বুঝি মায়ের সেই স্বামীর মতো?
চোখ দিয়ে অঝোরে পানি ঝরছিলো।
চিৎকার করে বাবাকে ডাকতে ইচ্ছে করছিলো। বাবার সাথে থাকলে হয়তো আজ আমার এমন অবস্থা হতো না।
কিছুক্ষণ আগেও যেই ঘরটাকে আমার দিন বদলে যাওয়ার কারন হবে ভেবেছিলাম, এখন মনে হচ্ছে সত্যিই সেই ঘরটা আমার দিন বদলে যাওয়ার কারন হবে। তবে নতুন করে নয়, পুরোনো কষ্টে ঘি ঢালার মতো করে।
বুকটা চিরে কান্না করতে থাকি।
হঠ্যাৎই আমার স্বামীর সাথে আসা লোকটা আবার রুমে প্রবেশ করে।
রুমে ঢুকে লোকটা আমায় ধমক দেয়, কেনো আমি এখনো বিয়ের কাপড় চেইন্জ করিনি।
ঝাপিয়ে পড়ে ওনার পা দুটো ধরে কান্না করতে থাকি।
কিন্তু লোকটা আমার চুলের মুঠি ধরে আমায় দাড় করায়।
নিচ থেকে ওপর পর্যন্ত একবার চোখ বুলিয়ে নেয়।
এত সুন্দর কেনোরে তুই? শুনলাম তুই নাকি এখনো ভার্জিন, একদম কচি মা….. আহ, কত মজা হবে আজ রাতে। তোর জীবটা রঙিন করে দেবো আমি। কাপড় খোল।
মুখ দিয়ে কোনো কথা বের হচ্ছিলো না আমার, শুধু ওনার দিকে হাত জোড় করে কেঁদেই যাচ্ছিলাম। কিন্তু ওই লোকটার একটুও মন গলেনি।
আমায় ধাক্কা দিয়ে বিছানায় ফেলে দিয়ে আচল টেনে কাপড় খোলার চেষ্টা করে।
মনে মনে ভেবেই নিয়েছি, এই জীবনটা আর রাখবো না।
লোকটাকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে টেবিল থেকে ফল কাটার ছুরিটা হাতে নেই।
নিজের গলায় ছুরি ধরে নিজেকে শেষ করে দেওয়ার হুমকি দিতে থাকি।
লোকটাও বেশ ভয় পেয়ে যায়।
লোকটা নরম গলায় কথা বলতে বলতে ধীরেধীরে আমার কাছে এসে দাড়ায়।
তার উদ্দেশ্য ছিলো এক ঝাটকায় আমার হাত থেকে ছুরিটা নিয়ে নিবে।
আমার কিছুটা সামনে এসে লোকটা এক লাফ দিয়ে ছুরিটা ধরার চেষ্টা করে।
ছুরিটা ওনার দিকে তাক করে ধরি, লাফ দেওয়ার ফলে লোকটা এসে সোজা ছুরির ওপর পড়ে।
মুখে হাত দিয়ে ফ্লোরে বসে পড়ে সে।
ভালো করে খেয়াল করে দেখি ছুরিটা ওনার বাম চোখে ঢুকে গেছে।
চোখ দিয়ে ওঝোরে রক্ত বের হতে থাকে।
মূহুর্তেই লোকটা জ্ঞান হারায়।
ভীষণ ভয় পেয়ে যাই। দরজার বাহির থেকে আমার স্বামী নামক লোকটা জোরে জোরে বলতে থাকে।
জলদি কর, এখনো আমিও ছুয়ে দেখিনি। তাড়াতাড়ি আয়।
এই মানুষ নামক নরপশুর হাত থেকে বাচার জন্য জানালার থাই গ্লাস খুলে রুম থেকে বেরিয়ে পড়ি। জানালায় কোনো গ্রিল না থাকায় বের হতে আমার কোনো সমস্যা হয়নি।
রুম থেকে বের হয়ে দৌড়াতে থাকি। অন্ধকারে চোখ বন্ধ করেই দৌড়াতে থাকি। জানি না কতক্ষণ দৌড়াই, একটা সময় জ্ঞান হারিয়ে পড়ে যাই।
যখন জ্ঞান ফিরে, তখন নিজেকে বিছানায় আবিষ্কার করি।
পাশেই একটা বয়স্ক মহিলা বসে আছে।
কি হয়েছে মা তোমার? কোথায় থেকে এসেছো?
আমি এখানে কি করে এলাম?
সকালে নামাজের ওজু করতে বের হয়ে দেখি তুমি আমার কলপাড়ে পড়ে আছো। তাই তোমায় তুলে এখানে নিয়ে এলাম। কে তুমি মা?
ওই ভদ্র মহিলাকে সব কিছু খুলে বলি।
উনি একটা দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে আমার দিকে করুণাময় দৃষ্টিতে তাকান।
ওই পশুটার ভাগ্যে বুঝি তুমিই পড়লে? জানো সে কে?
কে?
এই এলাকার নাম করা পতিতা ব্যবসায়ী। আর তুমি কিনা তাকেই বিয়ে করলে?
বিয়ের আগে আমি কিছুই জানতাম না।
এখন সে যদি জানতে পারে যে তুমি এখনো এই এলাকায় আছো, তোমায় সে খুজে বের করবেই।
এখন আমি কি করবো দাদু?
আজ সারাদিন তুমি এখানেই লুকিয়ে থাকো। রাতের আধারে এই এলাকা ছেড়ে পালিয়ে যাবে।
কোথায় যাবো আমি? আমার যে কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই।
বাঁচতে চাইলে তোমাকে যেতেই হবে। তুমি অন্য কোনো শহরে চলে যাও।
দাদু, পৃথিবীটা বড়ই নিষ্ঠুর। তার চেয়েও নিষ্ঠুর এই পৃথিবীর মানুষগুলো। ওরা আমায় বাঁচতে দেবে না।
দেখো মেয়ে, তুমি এখনো ছোট। জীবনের মানেটা তুমি এখনো জানো না। তোমাকে বাঁচতে হবে।
ঠিক আছে, আজ রাতেই আমি অন্য কোথাও চলে যাবো।
রাতের আধারেই বেরিয়ে পড়ি এক অচেনা গন্তব্যের উদ্দেশ্যে।
ওই ভদ্র মহিলা আমায় একটা বোরকা দেয়, এবং সাথে কিছু টাকাও দেয়। যেনো খুদা লাগলে কিছু খেতে পারি।
অন্ধকারে হাটতে হাটতে স্টেশন পর্যন্ত চলে আসি।
কিন্তু তখনো আমি জানতাম না আমি কোথায় যাবো। দূরপাল্লার কোনো একটা বাসে উঠে যাবো। যা হওয়ার হবে…
টিকেট নেওয়ার জন্য কাউন্টারে গিয়ে দেখি আমার স্বামী নামক সেই মানুষটা ভেতরে একটা লোকের সাথে কথা বলছে।
ওনাকে দেখেই কাউন্টার থেকে বের হয়ে বড় রাস্তা ধরে দৌড় দেই।
উনিও আমার পেছন পেছন দৌড়াতে থাকে।
তখনই মনে পড়ে আমার মুখটা বোরকা দিয়ে ঢাকা ছিলো। উনি আমাকে চিনতে পারতেন না। ইসস, কেনো আমি বোকার মতো দৌড় দিলাম।
মনে ভয় নিয়ে এলোপাথাড়ি দৌড়াতে থাকি।
নিজের জীবনের প্রতি মায়াটাই উঠে গিয়েছিলো।
কি নিয়ে বাঁচবো? কাকে নিয়ে বাঁচবো? কার ভরসায় বাঁচবো? আমার বেঁচে থাকার কোনো কারনই খুজে পেলাম না।
রাস্তার পাশ ছেড়ে রাস্তার মাঝ দিয়ে দৌড়ানো শুরু করি। তার হাতে ধরা পড়লে হয়তো বেঁচে থেকেও আমাকে মরে যেতে হবে। এরচেয়ে ভালো সহজ মৃত্যুটাই হোক।
একটা গাড়ি এসে স্বজোরে আমায় আঘাত করে। ছিটকে গিয়ে রাস্তার সাইটে পড়ি।
জ্ঞান হারানোর আগে দেখতে পাই আমার স্বামী নামক লোকটাও আমার পাশে পড়ে আছে।
আমার পিছু নিতে গিয়ে সেও আমার সাথে এক্সিডেন্ট করে। পুরো রাস্তা রক্তে সেঁতসেঁতে হয়ে যায়।
এরপর আমার আর কিছুই মনে নেই।
জ্ঞান ফেরার পর আপনাকে দেখতে পাই।
সামনে থেকে সানু বেগম একটা দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে মেয়েটার দিকে তাকিয়ে আছে।
এমন পোড়া কপাল নিয়েও বুঝি মানুষ জন্মায়?
আন্টি, আপনাকে একটা কথা বলি?
হ্যা বলো।
আমি কি করে এখানে এলাম?
আমার ছেলে তোমায় নিয়ে এখানে ভর্তি করিয়ে দেয়। সেদিন সে কাজ শেষে বাসায় ফিরে আসার সময় তোমায় রাস্তায় পড়ে থাকতে দেখে। বাসায় এসে এই ব্যাপারে আমায় বলেছিলো। ২ মাস তুমি আইসিইউতে ছিলে। কেউ তোমার খোজ নিতে আসেনি। আজ তোমার জ্ঞান ফিরলে হাসপাতাল কাউন্টার থেকে তারা আমার ছেলেকে ফোন দেয়। ও আসতে পারনি, তাই আমিই তোমাকে দেখতে এলাম।
আর ওই লোকটা?
কে?
আমার সাথে যে এক্সিডেন্ট করেছিলো।
সে ওখানেই মারা গেছে।
আলহামদুলিল্লাহ…। আল্লাহ তার বিচার করেছেন।
তোমার নাম কি মা?
মিষ্টি।
বাহ, নামটাও তোমার মত মিষ্টি। চলো আমার সাথে।
কোথায়?
আমার বাসায়।
বাসায় কেনো?
বাসায় আমার মেয়েকে একা রেখে এসেছি। দেরি হলে চিল্লাচিল্লি করবে। আর তোমার তো কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই। আমার সাথেই চলো।
আপনাদের সাথে?
ভয় পেও না, সব পরিবার খারাপ হয় না।
সেটা নয়।
এত কথা না বলে ওঠো।
হাসপাতালের সব ঝামেলা শেষ করে মিষ্টিকে সাথে নিয়েই সানু বেগম বাসায় ফেরেন। মিষ্টি অনেকটা অবাক হয়, কোথায় যাবে সে? কি করবে? কোথায় থাকবে? মনের মধ্যে অনেক কিছুই ঘুরপাক খাচ্ছে। এই ভদ্র মহিলা তার সাথে করে নিজের ঘরে নিয়ে এলো। কিন্তু এরপরের গন্তব্য কোথায়?
এই মেয়ে, দাড়িয়ে আছো কেনো? ভেতরে আসো।
জ্বি আন্টি।
ভেতর থেকে মিষ্টির বয়সি একটা মেয়ে বেরিয়ে আসে।
ওমা, কে গো মা উনি?
তোর ভাইয়া বলেছিলো যে, সেই মেয়ে।
ও আচ্ছা, ওনাকে আনতে গিয়েছিলে?
হুম।
হাই, এসো এসো, ভিতরে এসো।
তোমায় বলেছিলাম না আমার একটা মেয়ে আছে, এই হলো আমার মেয়ে রিয়া।(সানু বেগম)
নতুন মানুষের সামনে পড়ে মিষ্টির কথাই বন্ধ হয়ে যায়। বেশ অবাক হয়ে মানুষগুলোকে যাচাই করছে সে। মানুষগুলোর কথাবার্তা কত সুন্দর, কতটা নম্র।
রিয়া মিষ্টির হাত ধরে মিষ্টিকে নিজের রুমে নিয়ে যায়।
কিছুটা লজ্জা লাগলেও নিজেকে রিয়ার সাথে মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করে যায় সে।
তোমার নাম কি গো?(রিয়া)
মিষ্টি।
কত্ত সুন্দর নাম তোমার। আর আমার নাম হলো রিয়া।
তোমার নামটাও খুব সুন্দর।
তাই?
হুম
এসো ফ্রেস হয়ে নাও, ভাইয়া খাবার আনতে গেছে, একটু পরই চলে আসবে। আমরা একসাথেই খাবো।
আমারতো কাপড় নেই।
ওমা, কি বলো? এই আলমারিতে যা আছে সব আমারই। তোমার যেটা পছন্দ হয় এখান থেকে নিয়ে পড়ে নাও।
কি হলো? লজ্জা পেও না, যাও গোসল করে নাও।
মিষ্টি একটা গামছা হাতে নিয়ে বাথরুমে চলে যায়।
গোসল শেষে রিয়ার দেওয়া তোয়ালেটা পড়ে রিয়ার বিছানায় বসে আছে সে।
রিয়ার ব্যবহার করা আলমারিতে হাত দিতে কেমন যেনো লাগছে। মেয়েটা নিজের হাতে একটা কাপড় বের করে দিলে হয়তো পড়া যেত। কোথায় যে গেলো মেয়েটা, ডাকাও যাচ্ছে না।
হঠ্যাৎই একটা ছেলে দরজা খুলে রিয়ার রুমে প্রবেশ করে।
আচমকা চোখের সামনে একটা পুরুষ মানুষ দেখতে পেয়ে মিষ্টি ঘাবড়ে যায়।
পরনে একটা তোয়ালে ছাড়া আর কিছুই নেই। বেসামাল হয়ে নিজেকে আড়াল করার চেষ্টা করে মিষ্টি।
ছেলেটাও মিষ্টিকে এমন অবস্থায় দেখে আবার বেরিয়ে পড়ে।
একটু পর রিয়া রুমে প্রবেশ করে দেখে মিষ্টি খাটের এক কোনায় গুটি মেরে বসে আছে।
কি গো? তুমি দেখি তোয়ালে পড়ে বসে আছে। কাপড় পড়বে না?
আসলে, আপনার আলমারিতে হাত দিতে আমার কেমন যেনো লাগছে। আপনার জন্যই বসে ছিলাম।
হায় খোদা, কি মেয়েরে বাবা। বলে গেলাম যেটা মন চায় নিয়ে পড়ে নাও, অথচ এখনো সে লজ্জা পাচ্ছে। এদিকে এসো।
রিয়ার ডাকে মিষ্টি আলমারির সামনে যায়। নিজে পছন্দ করে একটা কাপড় নিয়ে মিষ্টি পড়তে শুরু করে।
উনি কে ছিলো?
কে?
একটু আগে এসেছিলো।
ওওও, আমার ভাইয়া। ওর নাম মামুন। আমিই ওকে পাঠিয়েছিলাম তোমাকে খাবার খেতে ডাকতে। আমিতো ভাবলাম তুমি তৈরী হয়ে বসে আছো। কে জানতো এতক্ষণ তোয়ালে পড়ে বসে থাকবে। বেচারা লজ্জা পেয়ে চলে গেছে।
আমারই দোষ।
ধুর, চলো তো। আজ আমরা কিছুই রান্না করিনি। বাহির থেকে খাবার নিয়ে আসছে ভাইয়া। এসো খাবে।
আপনারা রান্না করেন না?
করি তো। শুধু শুক্রবারে করি না। শুক্রবারে ভাইয়ার ছুটি, তাই আমরা এই দিনে বাহিরে গিয়ে খেয়ে আসি। আজ তো তুমি আছো, তাই আজ সব ঘরেই নিয়ে এলাম।
আমার জন্য আজ আপনারা বাহিরে যেতে পারলেন না।
এমা, এমন নয়, তুমিতো অনেক ক্লান্ত। তাই ভাইয়াই বললো আজ ঘরে খেতে। পরের সপ্তাহে তোমায় নিয়ে যাবো বাহিরে।
ততদিন কি আমি থাকবো?
কেনো থাকবে না? মা বললো তোমাকে আমাদের সাথে রেখে দিবে।
কি বলছেন?
চলো তো, মা আর ভাইয়া তোমার জন্য অপেক্ষা করছে।
আচ্ছা চলেন।
খাবার টেবিলের সামনে গিয়ে মিষ্টি দাড়িয়ে আছে।
আরে, দাড়িয়ে আছেন কেনো? বসুন(মামুন)
আমার টেবিলে খাওয়ার অভ্যাস নেই। মাটিতে বসেই খেতাম।
মা, চলো আজ আমরা ফ্লোরে বসে খাই।(রিয়া)
তোর মাথা খারাপ হয়েছে?(মামুন)
সমস্যা কি? এতদিন তো টেবিলেই খেয়েছিস। আজ নাহয় ফ্লোরে বসেই খেয়ে দেখ না।
তুই খা, আমি খাবো না।
মা, ওকে বলো না।
হ্যা রে মামুন, আয় আজ আমরা নিচে বসেই খাই।(সানু বেগম)
মা তুমিও? ধুর, ভাল্লাগে না।
রিয়া দেরি না করে নিচে জাগয়া করে সব খাবার নিচে নামিয়ে নেয়।
একটু দুরে দাড়িয়ে মিষ্টি অবাক চোখে তাদের দিকে তাকিয়ে আছে। কোনো কথা বলবে তারও সাহস করে উঠতে পারছে না।
তার জন্য আজ সবাই নিচে বসে খাবার খাচ্ছে।
মিষ্টি রিয়ার পাশে বসেই খাবার খাচ্ছে। জীবনে প্রথম কতসব নতুন নতুন খাবার সে চোখের সামনে দেখছে।
অদ্ভুত বিষয় হলো খাবারগুলো নামও সে কখনো শুনেনি। মায়ের কাছে যখন ছিলো, কাচা মরিচ বা পেয়াজ বা মাঝে মাঝে কপালে একটু তরকারি জুটলে সেগুলো দিয়েই খেতো। যখন বাবা মায়ের সাথে একসঙ্গে ছিলো, তখনও এমন খাবার খাওয়ার সৌভাগ্য হয়নি।
এই মেয়ে খাচ্ছো না কেনো? (সানু বেগম)
কেমন কেমন যেনো এগুলো।(মিষ্টি)
ওমা, আগে খাওনি?(রিয়া)
না।
হায় আল্লাহ, কষ্ট করে খেয়ে নাও। এখন তো আর কিছু নেইও।
না না, সমস্যা নেই। আমি খেয়ে নেবো।
মা, উনি কোথায় যাবে কিছু জানে?(মামুন)
মামুনের এমন কথা শুনে মিষ্টির বুকের মধ্যে একটা মোচড় দিয়ে ওঠে।
সত্যিই তো, সে এখন কোথায় যাবে? এই পৃথিবীতে তো তার আর আপন বলতে কেউ নেই যে তার কাছে গিয়ে আশ্রয় নিবে।
কথাটা ভাবতেই চোখদুটি ছলছল করে ওঠে মিষ্টির।
কোথায় যাবে সে? তার তো কোথায়ও যাওয়ার জায়গা নেই। আর এই মূহুর্তে মেয়েটা বাহিরে বের হলেও ওর বিপদ হবে, কি করবে সে? এখনো তো সে ছোট।(সানু বেগম)
তাহলে কি করবে মা?
সেটাই তো ভাবছি। এই মেয়ে, আমাদের সাথে থাকবে?
সানু বেগমের কথা শুনে মিষ্টি নিজের জবাব হারিয়ে ফেলে। কি উত্তর দেবে?
আন্টি, আপনারা আমার যেই উপকার করেছেন তার জন্য আমি আপনাদের কাছে ঋণী। আমি আর আপনাদের বোঝা বাড়াতে চাই না। কোথায়ও গিয়ে একটা কাজ আর আশ্রয় খুজে নেবো।
তুমিতো বাহিরের দুনিয়াটা দেখলেই, কতটা কঠিন এই দুনিয়া। তুমি পারবে না বাহিরে গিয়ে থাকতে।
কি আর করবো বলুন। কোথাও গিয়ে কাজ করে নিজের পেট চালিয়ে নেবো।
তোমার কাজ লাগবে?
হুম।
আমি তোমাকে কাজ দিবো, করবে?
সত্যি?
হুম।
করবো আমি।
ঠিক আছে।
কি কাজ আন্টি?
সেটা পরে বলবো, এখন খেয়ে রিয়ার রুমে গিয়ে বিশ্রাম নাও।
খাবার শেষে মিষ্টি গিয়ে রিয়ার বিছানায় শুয়ে পড়ে।
একটু পর রিয়া নিজের রুমে আসে। রিয়াকে দেখে মিষ্টি উঠে বসে।
আরে, উঠছো কেনো? বিশ্রাম করো।
না এমনিই উঠলাম। আপনার খাওয়া শেষ?
হুম শেষ, আর হ্যা, তুমি আমায় আপনি আপনি বলো কেনো? আমি কি তোমার বড়? আমায় রিয়া বলেই ডাকবে।
আপনি মনে হয় আমার বড়।
তোমার বয়স কত?
১৭ বছর।
আমি তো ১৬, তুমিই আমার বড়। আমায় নাম ধরেই ডাকবে।
আচ্ছা।
আমার বন্ধু হবে?
কি লাভ? আমিতো চলে যাবো।
কোথায় যাবে?
আন্টি বললো না আমায় কাজ দিবে।
আম্মু কোথায় কাজ পাবে? সে এমনি এমনি বললো।
কি বলছো এসব?
ওত ভেবো না তো। আমার সাথেই থাকো।
মিষ্টি নিচের দিকে মাথা নামিয়ে কি যেনো ভাবতে থাকে।
আচ্ছা, তুমি এত কম কথা বলো কেনো?
আমার লাইফে কথা বলার মতো কোনো মানুষ ছিলো না, তাই কথা বলারও অভ্যাস নেই।
আমি একটু বেশি কথা কথা বলি, আমার সাথে থাকলে ঠিক হয়ে যাবা।
রিয়ার কথায় মিষ্টি মুচকি মুচকি হাসতে থাকে।
ওম্মা, তুমি হাসতেও জানো? হাসলে কত সুন্দর লাগে তোমায়।
তাই?
হ্যা।
আচ্ছা, তোমাদের পরিবারে আর কেউ নেই? তোমার বাবা কোথায়?
না, আমার বাবা মা পরিবারের অমতে বিয়ে করেছিলেন। তাই পরিবারের কেউই তাদের মেনে নেয়নি। বাবা মা আলাদাই থাকতেন। এইতো ৫ বছর আগেই বাবা মারা গেছেন। এরপর ভাইয়াই আমাদের সংসারের হাল ধরে। আমি, ভাইয়া আর মা মিলেই আমাদের সুখের সংসার।
ও আচ্ছা, তোমার ভাই আমার জীবন বাঁচিয়েছে, তাকে একটা ধন্যবাদও দেওয়া হয়নি।
ধন্যবাদ দিতে গেলে বকা শুনবে।
কেনো?
তোমায় ওভাবে রাস্তায় পড়ে থাকতে দেখে সে তোমার সাহায্য করেছে। ওটা তার দায়িত্ব ছিলো।
তাই?
আমি জানি না। মাকে বলতে শুনলাম, মুখস্থ করে তোমায় শুনিয়ে দিলাম।
বললে যে আমায় বকবে।
এমনি বললাম, ভাইয়ার সাথে কথা বলবে?
না না।
ওমা, লজ্জা পাচ্ছো কেনো?
লজ্জা না, উনি কি না কি মনে করেন। বাদ দাও।
ঠিক তখনই মামুন রিয়ার রুমে প্রবেশ করে।
মামুনকে সামনে দেখে মিষ্টি একটু নড়েচড়ে বসে। পুরুষমানুষ দেখলে শরীরটা কেমন যেনো ঘিনঘিন করে, আবার এটাও প্রমান হলো সব মানুষ এক না। বিড়বিড় করতে করতে মিষ্টি মামুনকে একটা সালাম দেয়।
ওয়ালাইকুম আসসালাম, বসেন বসেন। মায়ের সামনে তো কিছুই জিজ্ঞেস করতে পারলাম না। এখন আপনার শরীর কেমন আছে?
জ্বি আলহামদুলিল্লাহ ভালো।
হাটা চলা করতে সমস্যা হয়?
জ্বি না। আমি এখন পুরোপুরি সুস্থ।
যাক ভালো কথা। বিশ্রাম করুন। আর কিছু লাগলে রিয়া অথবা মাকে বলিয়েন।
আচ্ছা।
ওনার খেয়াল রাখিস(রিয়াকে উদ্দেশ্য করে)
বলেই মামুন আবার হাটা দেয়।
শুনুন….
মিষ্টির ডাকে মামুন পেছন ফিরে তাকায়।
বলুন।
ধন্যবাদ।
একটা মুচকি হাসি দিয়ে মামুন বেরিয়ে যায়।
আমার ভাই একটু রাগি স্বভাবের মানুষ, কিন্তু ওর মনটা খুব ভালো।(রিয়া)
শুধু তোমার ভাই না, তোমাদের সবার মনই খুব ভালো। আমায় চেনো না জানো না, তবুও আশ্রয় দিয়েছো আমায়। তুমি আমায় নিজের কাছে রেখেছো।
আমার একটা ভালো গুন আছে, আমি মানুষের চেহারা পড়তে পারি। তোমায় প্রথম দেখেই বুঝেছি তুমি কেমন। তোমায় আমার খুব ভালো লেগেছে। আমার তো ইচ্ছে করছে তোমায় এই বাড়িতেই রেখে দেই।
তুমি বলেছো এটাই অনেক। তবে আমি জানি না আমার পরের গন্তব্য কোথায়।
বেশি চিন্তা করলে অসুখ করবে, বিশ্রাম নাও।
আর বেশি কথা না বাড়িয়ে মিষ্টি শুয়ে পড়ে।
দিনটা খুব ভালোভাবেই কেটে যায় মিষ্টির।
রাতে ঘুমানোর আগে সানু বেগম মিষ্টিকে ডেকে পাঠায়।
আন্টি আমায় ডেকেছেন?
হ্যা।
জ্বি বলুন।
তোমার কাজের ব্যাপারে কথা বলতে ডেকেছিলাম।
মিষ্টি বেশ খুশি মনে আগ্রহ নিয়ে সানু বেগমের কথায় মনোযোগ দেয়।
জ্বি বলুন।
ঘরের কি কাজ জানো?
রান্না করা, কাপড় কাচা, ঘর গুছানো, এবং ঘরের যাবতীয় সব কাজ জানি।
মাশা-আল্লাহ। কিন্তু তোমায় এত কাজ করতে হবে না। সারাদিন তো আমি বাসায় একা থাকি। শুধু আমার পাশেপাশে থেকো। আর আমার টুকটাক কাজে সাহায্য করলেই হবে।
আচ্ছা আন্টি।
তোমায় কত বেতন দিতে হবে?
কিছু লাগবে না, টাকা দিয়ে আমি কি করবো? শুধু খাবার আর আপনার ঘরের এক কোনায় পড়ে থাকতে দিলেই হবে।
পাগলি মেয়ে। টাকা লাগবে না কেনো? আর ঘরের এক কোনায় থাকতে হবে কেনো? তুমি রিয়ার সাথেই থাকবে।
টাকা দিয়ে আমি কি করবো? এমনি কিছু প্রয়োজন পড়লে আপনাকে বলবো।।
আচ্ছা, নাস্তা বানাতে পারো?
জ্বি আন্টি।
আচ্ছা, সকালে নাস্তা তুমি বানাবে। কাল আমরা তোমার হাতের নাস্তা খাবো।
ঠিক আছে।
মিষ্টি খুশিতে কেঁপে ওঠে। এই বুঝি তার মাথা গোজার জায়গা হয়ে গেলো।
{ আরো পড়ুন – চন্দ্রাবতী
( এক মুঠো রোদ গল্পটি আপনাদের কেমন লাগলো তা কমেন্ট করে অবশ্যই জানাবেন। পরবর্তী পর্বের জন্য আমাদের সাথেই থাকুন । ধন্যবাদ।)
Leave a Reply