মৃগতৃষ্ণা

মৃগতৃষ্ণা

পঙ্খির স্বামী আজ দ্বিতীয় বার করে মারা গেল। তাও আবার একই স্বামী। ব্যাপার টা হাস্যকর শোনালেও এমনই কিছু অনাসৃষ্টি ঘটনা ঘটেছে ওর সাথে। প্রথমে মারা যায় যেদিন পঙ্খি বিবাহের বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছিল লোকটার সাথে। বিয়ের রাতেই এক এক্সিডেন্টে তার গাড়ি নদীতে ডুবে যায়। অনেক খুঁজে লা,শটাও পাওয়া যায় নি সেদিন। সবাই তাকে মৃ,তই মেনে নিয়েছিল।

কিন্তু পাঁচ মাস পর গত দুই দিন পূর্বেই হঠাৎই কোথাথেকে যেন আচমকা প্রকট হয় সে। আর আজ সকালেই বাড়ির বাগানে তার মৃ,তদেহ পাওয়া যায়। গত রাতে কেউ তাকে রহস্যজনক নৃশংস ভাবে হ,ত্যা করে রেখে গেছে।

চেয়ারম্যান সামছুল মজুমদারের বাড়িতে মানুষের যেন ঢল নেমেছে। আপন গ্রাম ছাড়িয়ে আশেপাশের অন্যান্য গ্রাম থেকেও উৎসুক জনতার বৃহত্তর ভীড় জমেছে এই ঘটনার চক্ষুসাক্ষী হেতু। বিশাল উঠোনের মধ্যভাগে লাশ রাখা আছে।তপ্ত রোদের প্রখরতাকে তাচ্ছিল্য করে মানুষ উপচে পড়ছে সামছুল মজুমদারের ছোট পুত্র নাঈম মজুমদারের মৃ,ত লাশ দেখার আগ্রহে।

চেয়ারম্যান সাহেব অনেক সম্মানীয় একজন ব্যাক্তিত্ব। অত্র এলাকায় তার একটা প্রতাপ আর দাপট আছে।মানুষ একনামে তাকে মানে গোনে।তাই তিনি চেয়েও এই লোকজনকে কিছু বলতে পারছেনা। এতে তার ব্যাক্তিত্বের ওপর বিরুপ প্রভাব ফেলতে পারে।লেখিকা-মেহরুৃা নূর।

পঙ্খির শাশুড়ী ছেলের শিঁওরে বসে মাটিতে হাত চাপড়াতে চাপড়াতে বিলাপ করে যাচ্ছে। তার সঙ্গ দিচ্ছে পঙ্খির দাদী শাশুড়ী। এতদিন পর ছেলেকে ফিরে পেয়েও আবার হারালেন তিনি। তার ক্ষতটা উপলব্ধি করার ক্ষমতা কারোর মাঝে নেই।

বাতাবরণ তমসাচ্ছন বিষাদভারাতুর ভারী হয়ে আছে। সবার চোখে এক অব্যক্ত অভিশঙ্কা আর সন্দেহের অস্পষ্ট ছায়া। বেশির ভাগ সন্দিহান দৃষ্টির লক্ষ্য আপাতত পঙ্খি। সাথে অন্য আরেক মানবের ওপরও এই অদৃশ্য সন্দেহের তীক্ষ্ণ তীরের বান চলছে। যে বর্তমানে উঠোনের এককোনায় চেয়ারে বিরাজমান আছে।

মৃগতৃষ্ণা

বারান্দার এক কোনে মাটিতে খুটির সাথে মাথা ঠেকিয়ে বসে আছে পঙ্খি। অনুভূতি গুলো আপাতত এলোমেলো তার। সামনে মৃত অবস্থায় পরে থাকা স্বামী নামক ব্যাক্তিটার জন্য তার যে খুব একটা শোক হচ্ছে তেমন কিছুই না। কারণ এই লোকটার প্রতি তার কোন অনুভূতিই নেই। যদিও এর যথাযথ কারণও আছে। তবে যতযাই হোক। কোন ব্যাক্তির এভাবে মৃত্যু কখনোই কেউ কামনা করে না। পঙ্খিও তার ব্যাতিক্রম না।

কোন মায়ের সন্তান এভাবে মারা গেলে কতটা খারাপ লাগে সেটা একটু হলেও বুঝতে পারছে পঙ্খি। শাশুড়ী জাহানারা কে এভাবে আহাজারি করতে দেখে তার খুব খারাপ লাগছে। সে যতোই জাহানারার কাছে পঙ্খি চক্ষুশূল হোক না কেন। পঙ্খির মনে তার জন্য কোন ক্ষোভ নেই।

ছেলে হারা মায়ের কাছে এসব কিছুই না। যদিও আজ পূর্বের ন্যায় তেমন পঙ্খিকে কোন দোষারোপ করছেন না তিনি। তবে পঙ্খির দাদাী শাশুড়ী খোদেজা দমে নেই। আহাজারির নামে সে শুধুমাত্র পঙ্খিকেই দোষারোপ করে যাচ্ছে। অপয়া,মুখপুড়ি, কাল নাগিনীসহ অনুরূপ যত কটুকাটব্য আছে তার বাণী শুনিয়ে যাচ্ছে।

তারমতে পঙ্খির মতো অপয়া মেয়েকে বউ করে আনায় তার নাতীর এই অকাল মৃত্যু হয়েছে। তার সাথে সায় দিচ্ছে আশেপাশের সব জ্ঞানী গুনীজনরা।

পঙ্খি বরাবরের মতোই নির্বিকার হয়ে বসে রইলো। যেন তার মাঝে ভালো খারাপ লাগার কোন উৎসই নেই। মাঝে মধ্যে তার চিল্লিয়ে বলতে ইচ্ছে করে। কেন? কেন বিনা কারণে প্রতিবার দোষের আঙুল ওর ওপরই উঠে? সেকি বলেছিল তাকে এবাড়ির বউ করে আনতে?

বরং সেতো বিয়েই করতে চেয়েছিল না। তাহলে তাকে কেন দোষারোপ করা হয়? কেউ কি ইচ্ছে করে বিধবা হতে চায়? তাহলে কেন ওকেই বারবার কাঠগড়ায় দাঁড় করানো হয়? মন চাইলেও সে মুখ ফুটে কিছুই বলতে পারে না। শুধু নীরব পাথর হয়ে বসে থাকে সে।সবসময় সে এমন ছিলনা। সে ছিল প্রকৃতির অনুরূপ নিসর্গশোভা। ১৭ বসন্ত পার করা এই জীবনে নিজের অস্তিত্ব খুঁজছে পঙ্খি।

জীবন অংক মেলাতে ব্যার্থ হচ্ছে বারংবার। চোখের সামনে ভাসছে তার অতিবাহিত জীবনীগ্রন্থের পৃষ্ঠাসমূহ। এইটুকু জীবনকালে কতকিছুই না ঘটলো ওর সাথে। লেখিকা-মেহরুমা নূর।

লোকে বলে মানুষের জীবন কাহিনি তার জন্ম থেকেই আরম্ভ হয়। পঙ্খির জীবন শুরু হয় সিরাজগঞ্জ জেলার, উল্লাপাড়া থানার ফুলপুর গ্রামে। ২০০৪ সনের ফাল্গুন মাসের কোন এক রাতে পৃথিবীর আলো দেখে পঙ্খি। জন্মের সাথে যেন ভাগ্যরেখায় হারানোর বরদান নিয়ে আসে পঙ্খি।

চার ভাইয়ের পর পঙ্খির জন্ম হয়। তবে একমাত্র মেয়ে হওয়ার দরুন তেমন কোন বিশেষ আদর আহ্লাদ বা তেমন কিছুই সে পায়নি। বরং গরীবের সংসারে আরেকটা বাড়তি খাওয়ার মুখ ছাড়া আর কিছুই না। তারওপর আবার মেয়ে। আর মেয়ে হওয়া মানেই যেন মা বাবার জন্য বিশাল বড়ো একটা বোঝা। তবুও সবকিছু ঠিক ঠাকই চলছিল দিনক্ষণ। কিন্তু সেই ঠিক থাকাটাও বেশিদিন গড়ায় না।

পঙ্খির তিন বছর বয়সের সময় ওর মা কোন এক অজ্ঞাত অসুখে আক্রান্ত হয়ে পৃথিবীর আলো ত্যাগ করেন। ছোট্ট পঙ্খি মাতৃহীন হয়ে যায়। শান্তনা স্বরূপ তখন দাদাী এগিয়ে আসেন। পঙ্খি বড়ো হতে থাকে দাদাীর কাছে। তবে এবার দাদীকেও হারানোর পালা আসে।

দশ বছরে পদার্পণ করতেই পঙ্খির দাদী পরলোক গমন করে। পঙ্খির একমাত্র আদরের সম্পর্কটাও শেষ হয়ে যায়।লেখিকা-মেহরুমা নূর। এরপর আর কি। পঙ্খি কোনরকমে আদর আহ্লাদের ছাউনি ছাড়াই বড়ো হতে থাকে।

বড়ো ভাইয়েরা যার যার মতো বিয়ে করে আলাদা আলাদা সংসার গড়ে নেয়। অসুস্থ বাবা আর পঙ্খি এদের কাছে শুধুই বোঝা। আর ওদের লালনপালনের বিনিময়ে পঙ্খিকে গাধার মতো ভাই ভাবির সংসারে খাটতে হয়। এতো খাটাখাটুনি করে ভাইদের মন যুগিয়ে পঙ্খি ওর পড়াশোনা টা চালিয়ে যায়। দাখিল মাদ্রাসা থেকে এসএসসি পাস করে একটি সরকারি মহিলা কলেজে ভর্তি হয়ে কোনরকমে পড়াশোনা করতে থাকে সে।

গ্রামের বাড়ি মেয়ে ষোল পেরুলেই যেন সবার চোখে পড়ে যায়। মনে হয় বিয়ে না হলে বুঝি আর গতি হবে না। তবে পঙ্খির এইদিক থেকে একটা সুবিধা আছে। পঙ্খির বিয়ে নিয়ে তার ভাই ভাবিদের কোনো মাথাব্যথা নেই। কারণ একেতো ওকে দিয়ে বাড়ির সব কাজ ফ্রী ফ্রী করাচ্ছে।

আর তারচেয়ে বড়ো কথা বিয়ে দিতে হলে টাকার দরকার হয়। আজকাল লাখ লাখ টাকার যৌতুক ছাড়া কোন বিয়ে হয়না। সে যতই মেয়ে সুন্দর বা সুশীল হোক। টাকা ছাড়া বিয়ে নেই। যে যত টাকা দিতে পারবে তার মেয়ের তত ভালো বিয়ে হবে। বাংলাদেশে এই যৌতুকের কুপ্রথা একটা মহামারী ভাইরাসের মতো ছড়িয়ে পড়েছে। আর উত্তর অঞ্চলে এটার প্রথা সবচেয়ে বেশি।

এই কুপ্রথা কারণেই এখন মানুষ মেয়ে হওয়া দেখে ভয় করে। গরীব ব্যাক্তি ভিটা মাটি বিক্রি করে মেয়ের বিয়ে দিতে হয়। এই অভিশাপের কারণেই মেয়েরা আজ বোঝা। আর পঙ্খির ভাইদের ওর জন্য এতো টাকা খরচ করার কোন ইচ্ছে নেই।

তাইতো তারা এসব বিষয়ে মাথা ঘামায় না। এতে করে পঙ্খির অবশ্য সুবিধাই হয়। সে এখুনি বিয়ে করতে চায়না। পড়ালেখা করে বড়ো কিছু হওয়ার আশা তার।

পঙ্খি কি জানতো বাকি সবকিছুর মতোই তার এই আশাও বিলীন হতে চলেছে। এক দুপুরে কলেজ থেকে ফিরতেই সে জানতে পারে ভাইয়েরা ওর বিয়ে ঠিক করেছে। চেয়ারম্যান সামছুল মজুমদারের ছেলে নাইম মজুমদারের সাথে। পঙ্খির মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়ে। সে অনেক কান্নাকাটি করে ভাই আর বাবার কাছে আকুতি মিনতি করে বিয়ে না দেয়ার জন্য।

কিন্তু ভাইয়েরা মানে না। তারা তাদের সিদ্ধান্তে অটল। আর অসুস্থ বাবাও কিছু বলে না। এখন যে তাকে ছেলেদের ওপরই ভরসা করতে হয়। অতঃপর পঙ্খি আবারও হেরে যায়। তবে একটা কথা সে ভেবে পায়না। চেয়ারম্যান এর মতো এতো উচ্চ পরিবার তাদের মতো গরীব পরিবারে কেন আত্মীয়তা করতে চায়? আর তার ছেলেই বা কবে দেখলো পঙ্খিকে?

পঙ্খি যে গ্রামের সেরা সুন্দরী এমন কিছুও না। বাকি সব সাধারণ মেয়েদের মতোই একজন সে। তাহলে কি এমন দেখলো তারা? আর ওর ভাইয়ারাই বা হঠাৎ এমন বিয়ের জন্য উঠে পড়ে লাগলো কেন? এতো এতো প্রশ্নের কোন জবাবই পায়না পঙ্খি।তবে এসবের মাঝে যে কোন না কোন অজানা ব্যাপার আছে সেটার আভাস কিছুটা হলেও পাচ্ছে পঙ্খি।

অতঃপর হার মেনে তাকে বিয়ের পিড়ীতে বসতে হয়।

মৃগতৃষ্ণা

এটুকু কি কম ছিল? পঙ্খির ভাগ্যে আরও দূর্দশা নেমে আসে বিয়ের দিনই। বিয়ের সব কার্যক্রম শেষে যখন বাপের বাড়ি ছেড়ে বিদায় নিয়ে আসে তখন গাড়িতে তার স্বামী নাঈম মজুমদার পাশেই বসেছিল।পঙ্খি তখনও তার মুখদর্শন করেনি। কালা না ধলা কিছুই জানে না।

কিন্তু মাঝরাস্তা আসতেই হঠাৎ তার স্বামী নাইম মজুমদার গাড়ি থামিয়ে নেমে পড়ে। পঙ্খি তখন কি বলবে বুঝতে না পেরে পূর্বের ন্যায় ঘোমটার আড়ালে চুপচাপ বসে রয়। নাইম গাড়ির ড্রাইভারকে বাড়ি চলে যেতে বলে। ড্রাইভারও তার কথামতো একা পঙ্খিকে নিয়েই বাড়ি পৌঁছায়। শশুর বাড়ি পৌঁছে সব রিতীমালা শেষে পঙ্খিকে বাসর ঘরে আনা হয়।

সবার কথামতো পঙ্খি ফুলের বাসরে বসে রয় তার স্বামীর অপেক্ষায়। তবে সে আসে না। আসে তার মৃত্যুর খবর। শোনা যায় তার গাড়ি নাকি এক্সিডেন্ট করে নদীতে ডুবে গেছে। পঙ্খির ঠিক ওইমুহূর্তে কেমন অনুভূতি হয়েছিল তা সে নিজেও জানে না।

যে লোকটাকে এপর্যন্ত দেখলই না। তার জন্য যে খুব একটা শোক হয়েছে তেমন না।কারণ তার প্রতি কোন অনুভূতি জন্মই নেইনি। তবে ওর জীবনের এই অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার জন্য থমকে গিয়েছিল সে।

পঙ্খির জীবন সেদিন থেকে বদলে যায়।লেখিকা-মেহরুমা নূর। সে এই বাড়িতে নাঈম মজুমদারের বিধবা হয়ে দিনযাপন করতে থাকে। সামছুল মজুমদারের কাছে বংশের মান মর্যাদা হলো সর্বোপরি। পঙ্খি এখন তার বাড়ির বউ। এবাবড়ির সম্মান।

তাই সম্মান রক্ষার্থে পঙ্খিকে সে ছেলের বিধবা হিসেবে এবাড়িতেই রেখে দেয়। পঙ্খিও এই নিয়ে কোন প্রকার মতভেদ করে না। কারণ তার যাওয়ার যে আর কোন জাইগা নেই। ওর ভাইয়েদের কাছে বোঝা হয়ে ফিরে যাওয়ার চেয়ে এইখানে পড়ে থাকাই শ্রেয় মনে করে। যদিও এখানেও যে শান্তিতে থাকে তা নয়। শাশুড়ী জাহানারা আর দাদী শাশুড়ী খোদেজার কাছে দিনরাত কটুবাক্য শুনতে হয় তাকে। তাদের অনুযায়ী পঙ্খির অশুভ কদমের কারণেই তাদের ছেলের মৃত্যু হয়েছে।

এসব ছাড়াও এবাড়িতে আরও অনেক কিছু আছে।তবপ পঙ্খি এসবকিছু প্রশমিত করে যায়। তার যে আর কোন উপায় নেই। সামছুল মজুমদারের কাছে অনেক অনুরোধ করে পড়ালেখা টা কোনরকমে বহাল রাখে সে। তবে শুধু পরিক্ষার সময়ই কলেজে যাওয়ার অনুমতি আছে। পড়ালেখা সব বাড়িতে থেকেই করতে হবে। দরকার হলে গৃহশিক্ষক রেখে দিবে।

এটাই সামছুল মজুমদারের শর্ত। কারণ যুবতী বিধবা নারীকে বাড়ির বাইরে থাকার রিস্ক নিতে চাইনা তিনি। তারমতে এতে বংশের মান যেতে পারে। তথাপি পঙ্খি তাতেও রাজি।সে পড়ালেখার সুযোগ পাচ্ছে এইবা কম কিসে।

সে সব শর্তই মেনে নেয়। সেদিন থেকে এই মজুমদার বাড়ির বিশাল আঙ্গিনাই হয়ে যায় পঙ্খির সীমিত দুনিয়া। ব্যাস এভাবেই চলতে থাকে তার বেরঙ জীবন।

পরন্তু পঙ্খি জানতোও না তার জীবনে আবারও নতুন মোড় আসতে চলেছে। যা ওর থমকে থাকা জীবন টাকে তীব্র পবনে এলোমেলো করে দিবে। কালবৈশাখী ঝড়ের মতো উড়িয়ে নিয়ে যাবে তাকে।

দিনটা ছিল শুক্রবার। জৈষ্ঠ মাসের মাঝামাঝি সময়। পঙ্খির বিধবা হিসেবে জীবনযাপনের দুমাস অতিবাহিত হয়েছে তখন। সারাবাড়ি জুড়ে চলছে উৎসব মুখোর পরিবেশ। চেয়ারম্যান বাড়ির প্রায় সদস্য সহ বাড়িতে থাকা প্রত্যেক টা কাজের লোকগুলোও নানান কাজে অত্যাধিক ব্যাস্ত। বাড়ি সাজানো সহ বাহারি খাবারের সুবাসে মাতোয়ারা হয়ে উঠছে চারপাশ। হবে নাই বা কেন! আজ যে বিগত চৌদ্দ বছর পর এবাড়ির ছেলে বিদেশ থেকে আসছে। সামছুল মজুমদারের কনিষ্ঠ ভ্রাতা জহির মজুমদারের একমাত্র ছেলে “ইন্ধন মজুমদার” বিদেশের পড়াশোনা শেষ করে আজ দেশে ফিরছে। তার আগমনের খুশিতেই এতো তোড়জোড় চলছে।

সূর্যালোকের ক্রোধ যেন আজ সর্বোচ্চ মাত্রায়।লেখিকা-মেহরুমা নূর। তীব্র রোদের দাবদাহে ধরণী ঝলসে যাওয়ার দশা। প্রখর রোদের তেজে জনমানবের বেহাল জীবদ্দশা। ছাদে পা দিতেই পায়ের তালুতে গরম ছাদের ছেঁকা পেতেই লাফিয়ে উঠলো পঙ্খি। খালি পায়ে এখানে আসাটা মোটেও বুদ্ধিমানের কাজ হয়নি। এতো রোদে কাপড় চোপড়ের রঙ জ্বলে যেতে ভেবে কাপড় চোপড় নিতে এসেছিল সে। যদিও তার কাপড়ে জ্বলে যাওয়ার মতো কোনো রঙই নেই। তারতো কাপড়ে কোন রঙের ছোঁয়া নেই। তবে পরিবারের বাকি সদস্যদের কাপড় চোপড় আছে।

সেগুলোই নিতে এসেছিল। তবে মনে হয় না এতো গরম ছাদে পাড়া দিতে পারবে সে। অগত্যা ফিরে এলো সে।নিচে এসে দেখলো সবাই কাজে ব্যাস্ত।জহির মজুমদারের স্ত্রী রাবেয়া আজ মহা ব্যাস্ত। এতদিন পর তার ছেলে ফিরে আসছে এই মহাখুশি তার চোখে মুখে উপচে পড়ছে। রাবেয়া বেগমকে দেখে মুচকি হাসলো পঙ্খি। এতদিন ছেলের শোকে তাকে অনেকবার কাঁদতে দেখেছে পঙ্খি। ছেলেকে তিনি মাত্রাতিরিক্ত ভালোবাসেন। পঙ্খি ভাবলো তারও কিছু করা উচিত। এভাবে হাত গুটিয়ে বসে থাকাটা অশোভনীয় দেখায়। তথাপি সে চাচী শাশুড়ী রাবেয়ার সম্মুখে এসে বললো।

চাচী মা আমি কোন সাহায্য করবো? আপনি একা একা কত কি করবেন? আমাকে বলুন কি করতে হবে?

নাড়ু বানানোর জন্য নারকেল কোরাচ্ছিল রাবেয়া।তার ছেলের খুব পছন্দ এটা। পঙ্খির কথায় নারিকেল কোরানো থামিয়ে হাতের উল্টোপিঠ দিয়ে ঘমার্ত কপাল টা মুছে নিলো রাবেয়া। স্বস্তিময় হাসির রেখা টেনে পঙ্খির উদ্দেশ্যে কিছু বলতে গিয়েও আটকে গেলেন তিনি । তার আগেই পঙ্খির দাদী শাশুড়ীর আগমন ঘটলো। এক হাতে তজবি আরেক হাতে লাঠি ভর দিয়ে খুটখুট করে এগিয়ে এসে থমথমে গলায় বলল উঠলো।

তোমাক না কতবার কছি, কোনো শুভ কামের মইদ্যে আইসপ্যা না? তাও আছ্যাও কিহামে? একবার এক কথা কলি কানে যায় না? এহেনে শুভ কাম হইতাছে। বিধবার কুনু কাম নাই এহেনে। আইজকা আমার নাতী আইসপো। এহন কি তুমি আমার এই নাতীর ওপরও তোমার অশুভ ছায়া ফালাইব্যার চাও? একটোরে খাইয়া মন ভরে নাই? হরো যাও এহেন থে।(সিরাজগঞ্জের আঞ্চলিক ভাষা)

কথাগুলো বলে আবারও খুটখুট করে বাহিরের দিকে চলে গেল খোদেজা। পঙ্খির মলিন মুখ দেখে রাবেয়া মুচকি হেঁসে বললো।

আম্মার কথায় গোসা হইরো না। তুমি তো জানোই সে একটু এমনই।

পঙ্খি বরাবরই অন্তর্মুখী ধরনের মেয়ে। নিজের ভালো লাগা, মন্দ লাগা সহজে কারোর সামনে জাহির করেনা। আসলে ছোট থেকে নিজের ভালো মন্দ বলার মতো কাউকে পায়ইনি সে। তাইতো নিজের মনোভাব সর্বদা নিজের ভেতরেই চেপে রাখতে অভ্যস্ত সে। তথাপি নিজের অভ্যাস অনুযায়ী পঙ্খি জোরপূর্বক নিজের মলিনতা দূর করার চেষ্টা করে, ঠোঁটে মিছে হাসির রেখা টেনে বললো।

আরে না না আমার এখন এসবের অভ্যাস হয়ে গেছে। আপনি চিন্তা করেন না।

আইচ্ছা তুমি আমার সাহায্য করতে চাইছিলা না? তাইলে যাও ওই তিন তলার কোনার রুম থেকে ঝুল ঝাড়া ঝাড়ু নিয়ে ইন্ধনের রুমডা একটু পরিস্কার করোগা। মেলা দিন বন্ধ থাকায় ময়লা জমে গেছে।

পঙ্খি বিনাবাক্য ব্যয় করে সঙ্গে সঙ্গে মাথা নেড়ে বললো।

ঠিক আছে চাচী মা আমি এখুনি করছি।

পঙ্খি সানন্দে আবারও সিড়ি বেয়ে উঠে গেল। এবাড়ির কিছু সংখ্যক সদস্যদের ভেতর রাবেয়াও একজন যে পঙ্খিকে সর্বদা স্নেহ করে। কখনো দুরাচারণ করে না। পঙ্খির মনে তারজন্য যথেষ্ট শ্রদ্ধা আর মায়া কাজ করে।

তখন নিচে ফট করে হ্যাঁ তো বলে দিয়েছে পঙ্খি। তবে এখানে এসে যেন নিজের সিদ্ধান্তের ওপর খেদ হচ্ছে তার। তিন তলার এই কোনার জায়গা টায় আসতে তার প্রচুর ভয় হয়। এইখানে একটা তালাবদ্ধ রুম আছে। যেখান থেকে কেমন অদ্ভুত আওয়াজ শোনা যায়। পঙ্খি প্রথম যেদিন এদিকে আসে তখন প্রচুর ভয় পেয়ে গিয়েছিল। জানতে চেয়েছিল এই রুমে কি আছে?

তবে কেউই তার কথার স্পষ্টস্বরুপ জবাব দেয়নি। শুধু বলেছে এই রুমে নাকি কোন অশুভ শক্তিকে তন্ত্র মন্ত্র দ্বারা আটকে রাখা হয়েছে। আর পঙ্খিকে এদিকে আসতে মানা করেছে। পঙ্খিও সেই অনুযায়ী এদিকে আর কখনোই আসেনি। আজ আবার এসে পড়েছে ও। রাবেয়ার কথা ফেলতেও পারবে না। তাই নিজের ভয়কে একটু দমিয়ে নিয়ে স্টোর রুমে ঢুকলো পঙ্খি।

ভীরু পায়ে দ্রুত ঝাড়ুটা খুঁজতে লাগলো সে। পুরান আলমারির পাশে দেখতে পেল ঝাড়ু। এগিয়ে গিয়ে ঝাড়ুটা হাতে নিতেই পাশের রুম থেকে অদ্ভুত ভাবে কারোর কান্নার আওয়াজ শুনতে পেল সে।ভয়ে চমকিয়ে উঠলো পঙ্খি। ভয়ে হাত পা কাঁপতে লাগলো তার। সে কোনরকমে ঝাড়ুটা নিয়েই দৌড়ে বেড়িয়ে এলো। এক দৌড়ে দোতলায় নেমে এসে থামলো সে। দেয়ালে ভর দিয়ে হাঁপাতে লাগলো। এতটুকু সময় ঘেমে নেয়ে উঠেছে পঙ্খি।

বুকে হাত দিয়ে জোরে জোরে নিঃশ্বাস নিতে লাগলো সে।

আচমকা কানের কাছে কারোর উচ্চস্বরে “‘ভাউউউ… শুনতে পেল। পূর্বের ভয় কেটে ওঠার আগেই এমন শব্দে আতঙ্কিত হয়ে ছিটকে লাফিয়ে উঠলো পঙ্খি। পেছনে ঘুরে তাকাতেই দেখলো পঙ্খির ননদ ছায়া খিলখিল করে হাসছে। পঙ্খিকে এভাবে বোকা বানিয়ে সে ভীষণ মজা পেয়েছে। বেচারি পঙ্খি একটু স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো। একটু দম নিয়ে সে বললো।

ছায়া!! এমন কেউ করে? জানো আরেকটু হলে আমাট দম বেড়িয়ে যেত।

ছায়া নিজের হাসি নিয়ন্ত্রণে এনে বললো।

সরি সরি ভাবি। আসলে তোমাকে উপর থেকে আসতে দেখে ভাবলাম একটু মজা নেওয়া যাক। তবে যে এতটা ভীতু তা জানতাম না। তা তুমি কোথাথেকে এমন ভয় পেয়ে আসছ?

আসলে চাচী মা বললো উপরের ওই কোনার রুম থেকে ঝুল ঝাড়ু উনার ছেলের রুমটা পরিস্কার করে দিতে। কিন্তু ঝাড়ু আনার সময় ওই বন্ধ রুম কেমন যেন আওয়াজ আসছিলো। মনে হচ্ছিল যেন কেউ কাদছে। আচ্ছা ওই রুমে কি আছে?

জানি না ভাবি। আর জানার ইচ্ছেও নেই। একদিন ভুল করে ওই রুমের দরজা খোলার চেষ্টা করেছিলাম। ব্যাস সেদিনই বাবার কাছে যে ধমক খেয়েছিলাম তা আজ পর্যন্ত ভুলিনি। তাই আর ওদিকে যাওয়ার সাহস করিনি। আর তুমিও ওদিকে যেওনা প্লিজ। আব্বা জানলে রাগ করবে।

কতদিন হলো এই রুম বন্ধ?

এইতো তোমার বিয়ের কয়েকদিন আগে থেকেই।

ব্যাপার টা কেমন রহস্যজনক মনে হলেও আপাতত সেটাতে মাথা ঘামালো না পঙ্খি। রাবেয়ার দেওয়া কাজে মনোনিবেশ করলো। ছায়ার সাথে ইন্ধনের কক্ষে প্রবেশ করলো। কক্ষে প্রবেশ করে চারপাশে চোখ বুলিয়ে পঙ্খি বলে উঠলো।

রুম তো পরিস্কারই আছে। আমি আর কি পরিস্কার করবো?

ছায়া বিছানার উপর পা ঝুলিয়ে বসে বলে উঠলো।

আরে থাকবে না? চাচী রোজই রুমের সাফ সাফাই করে। ইন্ধন ভাইয়া পরিচ্ছন্নতার ব্যাপারে প্রচুর কড়া। অপরিচ্ছন্নতা তার একদমই অপছন্দ। তাইতো চাচী কদিন পর পরই রুমের সবকিছু পরিস্কার করে। যাতে রুম সবসময় নতুনের মতো থাকে। ইন্ধন ভাইয়া ফিরে এসে যেন কোন ত্রুটি না পান।

পঙ্খি তবুও কোনায় কোনায় জমা কিছু মাকড়সার বাসা পরিস্কার করতে করতে বললো।

চাচী মা অনেক ভালোবাসেন তাকে তাইনা? না মানে সব মা বাবাই তাদের ছেলেমেয়েদের ভালোবাসে। তবে চাচীমার মতো কাউকে দেখিনি।

হ্যাঁ, সে আর বলতে। ভাইয়া যখন বিদেশে গেল আমি তখন ছোট। রোজ চাচীকে কেঁদে কেটে গঙ্গা বানাতে দেখেছি। একটাই তো ছেলে। ভালোবাসবে নাইবা কেন? আর ভাইয়াও তো মা বলতে পাগল।

তাহলে উনি উনার মাকে রেখে গেলেন কেন? আই মিন দেশে থেকেও তো পড়ালেখা করা যায়।

ভাইয়া যেতে চায়নি। চাচা তাকে জোর করে পাঠিয়েছে।

কেন?

কি জানি এই ছোট বালিকাকে কি কেউ কিছু বলে নাকি? শুধু জানি ভাইয়ার ইচ্ছার বিরুদ্ধে জোর করেই তাকে বিদেশে পাঠানো হয়েছিল। আর একারণে ভাইয়া এখনো চাচার ওপর নারাজ। বিদেশে যাওয়ার পর তার সাথে একবারের জন্যও কথা বলেনি। শুধু চাচীর সাথেই কথা বলে।

দুজনের কথপোকথনের মাঝেই সাফাই ক্রিয়া শেষ হয়ে গেল। কাজ শেষে দরজা লাগিয়ে ওরা বেড়িয়ে এলো।

ঘর পরিস্কারের কাজ করে শরীর নোংরা হয়ে গেছে। পঙ্খি তাই গোসলে ঢুকলো।লেখিকা-মেহরুমা নূর। গোসল শেষে চুলে গামছা পেঁচিয়ে ভেজা কাপড় নেড়ে দিতে আবারও ছাদে এলো। এবার আর জুতো পড়ে আসার কথা ভুললো না সে।

বালতি নিচে রেখে একটা করে কাপড় তুলে দুই হাতে ঝাড়া দিয়ে তারে নেড়ে দিচ্ছে। পঙ্খির চুলগুলো অনেক ঘন আর দীর্ঘ। গামছার নিচ দিয়েই চুলের অনেকাংশ বেড় হয়ে আছে। সেই চুলের পানি গড়িয়ে পঙ্খির পিঠ যাচ্ছে। পানি গড়িয়ে সাদা কামিজ ভিজে পিঠে লেগে ধরছে। পঙ্খির অজান্তে এক জোরা ধারালো চোখের দৃষ্টি এই দৃশ্য অবলোকন করে যাচ্ছে।

মৃগতৃষ্ণা

কামুক নজরে তার কামনার তীব্র আকাঙ্খা জেগে উঠছে। বুকে তার হাহাকার চলছে। কু নজর গেড়ে আছে পঙ্খিতে। কাপড় নাড়তে নাড়তেই পঙ্খির কেমন আভাস হলো কেউ যেন আশেপাশে আছে। পঙ্খি ছাদের দরজার দিকে তাকাতেই একটা ছায়া সরে যেতে দেখলো। অন্তর্দেশ কেঁপে উঠল পঙ্খির। তবে কি কেউ তাকে লুকিয়ে দেখছিলো? কিন্তু কে হতে পারে? এবাড়িতে এমন কে আছে? পঙ্খি গায়ের ওড়নাটা মাথাসহ ভালো করে পেঁচিয়ে নিলো।বালতি হাতে নিয়ে দ্রুত নেমে এলো ছাঁদ থেকে।

তড়িঘড়ি করে করিডরে আসতেই হঠাৎ কারোর সাথে থাক্কা লেগে গেল। পঙ্খি মাথা তুলে দেখলো তার জা (ভাসুরের বউ) কনিকা। পঙ্খির সাথে ধাক্কা লাগায় সে মৃদু সুরে আর্তনাদ করে উঠলো। পঙ্খি ব্যতিব্যস্ত হয়ে অপরাধী সুরে বললো।

দুঃখিত ভাবি আমি খেয়াল করিনি। আপনার কি খুব বেশি লেগেছে?

পঙ্খি কনিকার হাত ধরে দেখতে চাইলো কোথাও লেগেছে কিনা। কনিকার হাত ধরতেই সে যেন আরও ব্যাথায় কুঁকড়ে উঠলো। পঙ্খি খেয়াল করলো কনিকার হাতে কেমন কালো জখম হয়ে আছে। পঙ্খি কপাল কুঁচকে বললো।

ভাবি কি হয়েছে আপনার হাতে? এতো জখম হলো কিভাবে?

কনিকা ঝট করে নিজের হাত টান দিয়ে পেছনে লুকিয়ে ফেললো।চেহারায় ব্যাথার প্রতিচ্ছবি সরিয়ে জোরপূর্বক হাসার চেষ্টা করে বললো।

ক কই কি? কিছুই নাতো।

কিছু না মানে? আমি স্পষ্ট দেখলাম আপনার হাতে জখমের দাগ। কিসে জখম হলো এভাবে?

আ আরে তেমন কিছুই না। বাসায় কতো কাজ থাকে। হয়তো কোন সময় কোথাও লেগে গেছে। ওসব কিছু না।

কনিকার ভাষ্য কেমন বিশ্বাসযোগ্য হচ্ছে না পঙ্খির কাছে। আজ প্রথম না। এর আগেও কয়েকবার কনিকার শরীরে এমন আঘাতের চিহ্ন দেখেছে ও। কিন্তু কনিকাকে জিজ্ঞেস করলে সবসময় এড়িয়ে যায়। তার চোখে মুখে কেমন একটা ভয়ের ছাপ ভেসে ওঠে।

ভাইয়া ভাবিকে কোনরকম শারীরিক নির্যাতন করে? পঙ্খি আবারও কিছু বলবে তখনই সামনে থেকে পঙ্খির ভাসুর জুবায়েদ পাঞ্জাবির হাতা গোটাতে গোটাতে ওদের দিকে এগিয়ে এসে হাসিমুখে বললো।

কি ব্যাপার? দুই জা মিলে কিসের এতো আলাপচারিতা হচ্ছে? তা আমাকেউ একটু বলো।

পঙ্খি নির্দ্বিধায় বলে উঠলো।

ভাইয়া ভাবির হাতে ব্যাথা পেয়েছে। সেটাই বলছিলাম। কিন্তু ভাবি বলছেই না কিভাবে ব্যাথা পেল।

পঙ্খির কথা শুনে জুবায়েদ স্ত্রীর পানে তাকিয়ে ব্যতিব্যস্ত হয়ে বললো।

কি বলো? কই? কখন, কোথায় ব্যাথা পেলে? তোমাকে নিয়ে আর পারিনা। কে বলেছে এতো কাজ করতে তোমায়। বাড়িতে কি কাজের লোকের অভাব আছে? সারাদিন কোথাও না কোথাও ব্যাথা লাগাতেই থাকো। চলো চলো রুমে গিয়ে তোমাকে মলম লাগিয়ে দেই। আর আজকের দিনে আর কোন কাজ করবে না তুমি। চুপচাপ রুমে আরাম করবে। ভাগ্যিস পঙ্খি আমাকে বললো। নাহলে তো আমি জানতেই পারতাম না।

কথাগুলো বলতে বলতে জুবায়েদ কনিকার কাঁধ জড়িয়ে ধরে তাকে রুমের দিকে নিয়ে গেল। পঙ্খির নিজের ধারণার ওপর খেদ হলো। মনে মনে ভাবছে, ধুর আমিও কি না কি ভাবছি। ভাইয়া তো ভাবিকে কতো ভালোবাসে। তার প্রতি কতো যত্নশীল। আমিই বোধহয় একটু বেশিই ভাবছি।

নিজেদের রুমে এসে দরজা লাগিয়ে দিলো জুবায়েদ। দরজার লাগানোর শব্দেই ভয়ে আত্মা কেঁপে উঠল কনিকার। সে জানে তার সাথে এখন কি হতে চলেছে।

জুবায়েদের হাস্যজ্বল মুখটা মুহূর্তের ব্যবধানেই বদলে গেল। চোখ মুখে নেমে এলো কঠোরতা। চোয়াল শক্ত করে কনিকার হাতের ক্ষতস্থান টায় সজোরে চেপে ধরলো। সদ্য আঘাত প্রাপ্ত স্থানে পুনরায় ব্যাথা পেয়ে মুষড়ে উঠলো কনিকা। আর্তনাদ করার প্রচেষ্টা করতে চাইলে তাতেও বিপত্তি করলো জুবায়েদ। কনিকার মুখের ওপর ঝুঁকে বললো।

হুঁশ হুঁশ.. আওয়াজ করবি না। কি করতে চাইছিলি তুই? সবাইকে নিজের ক্ষত দেখিয়ে কি বোঝাতে চাইছিস? আমাকে সবার সামনে ভিলেন বানাতে চাইছিস?

কনিকা খোলা হাতটা দিয়ে নিজের মুখ চেপে ধরে কান্না আটকে নিয়ে ব্যাথাতুর কন্ঠে বললো।

আ আমি কিছু দেখাতে চাইনি। সত্যি বলছি। পঙ্খি হঠাৎ দেখে ফেলেছে। কিন্তু আমি ওকে কিছু বলিনি।

না বলাটাই তোর জন্য মঙ্গলকর। নাহলে এবাড়ির বউয়ের যে মর্যাদা পাস সেটাও হারাবি। মনে রাখবি তোকে আমার বউ করে এবাড়িতে রাখছি এটা তোর বাপ দাদার সৌভাগ্য। শুধু মাত্র বাবার মান সম্মানের কথা ভেবে তোকে রেখে দিয়েছি।

নাহলে তোর মাঝে আছেটা কি? না রুপ, না যৌবন। তুই তো বিছানায়ও আমাকে সুখ দিতে পারিস না।একবার নিজেকে দেখ,আর আমাকে দেখ। আমার মতো সুদর্শন যুবকের সাথে তোকে কোন দিক দিয়ে মানায়?কি দেখে যে বাবা তোকে আমার গলায় ঝুলিয়ে দিয়েছে। যত্তসব।

তিরস্কারপূর্ণ বাণী ঝেড়ে কনিকাকে ঝটকা মেরে বেড়িয়ে গেল জুবায়েদ। অবহেলিত কনিকা পড়ে রইলো ওভাবেই।

দিবাভাগ গড়িয়ে প্রদোষকাল নেমেছে ধরনীতে।লেকিকা-মেহরুমা নূর। মাগরিবের নামাজ আদায় করে বিছানায় বসে আছে পঙ্খি। দাদী শাশুড়ির কথা অনুযায়ী নিচে আর যায়নি সে। কি দরকার আবারও কথা শোনার।

তারচেয়ে বরং পড়াশোনায় মনোযোগ দেওয়া যাক। ইংরেজি বইটা খুলে বসলো সে। পাঁচ মিনিট অতিবাহিত হতেই হঠাৎ নিচ থেকে হৈচৈ এর স্বরধ্বনি এলো। পঙ্খি বুঝতে পারলো নিশ্চয় আজকের সেই কাঙ্ক্ষিত ব্যাক্তির আগমন ঘটেছে। কৌতুহল বশত পঙ্খি উঠে দাঁড়িয়ে দরজার কাছে এসে দরজা হালকা খুলে নিচে উঁকি দিলো। দূর থেকে কিছুটা দেখতে পেল।

রাবেয়া চাচী ছেলেকে ধরে কেঁদে যাচ্ছেন। উল্টো দাঁড়িয়ে থাকায় ইন্ধনের চেহারা দেখা যাচ্ছে না। সে মায়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। মা ছেলের মমতাময় মুহূর্ত দেখে পঙ্খি স্মিথ হাসলো। নিজের মাতৃহীন দূর্ভাগ্যের কথা হঠাৎই মনে পড়ে গেল তার। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে দরজার কাছ থেকে সরে এসে আবারও নিজের কাজে মনোযোগ দিলো সে। ঘন্টাখানিক পর হঠাৎ বিদ্যুৎ চলে গেল।

পঙ্খি তড়িঘড়ি করে অন্ধকারে হাতড়ে দিয়াশলাই খুঁজতে লাগলো। অন্ধকারে প্রচুর ঘাবড়ে যায় পঙ্খি। আর গ্রামের বিদ্যুতের কোন ভরসা নেই। একবার গেলে আর সহজে আসার নাম নেয় না। তাই পঙ্খি সবসময় নিজের কক্ষে একটা হারিকেন আর দিয়াশলাই রাখে।

যাতে বিদ্যুৎ গেলে সাথে সাথে কাজে লাগাতে পারে। হাতড়িয়ে টেবিলের ড্রয়ার থেকে দিয়াশলাই বের করে বুঝতে পারলো এর মাঝে কাঠি শেষ হয়ে গেছে। এখন দিয়াশলাই আনতে আবার রান্নাঘরে যেতে হবে। কিন্তু এই অন্ধকারে যাবে কিভাবে ও? আর এই অন্ধকারে বসে থাকাও ওর পক্ষে সম্ভব না। একটা বাটন ওয়ালা পুরান ফোন অবশ্য ওর কাছে আছে। শুধু দরকারী কথা বলার জন্য যেটা ওকে সামছুল মজুমদার দিয়েছে। সেটার টর্চও নষ্ট।

অগত্যা মনে সাহস যুগিয়ে হারিকেন টা হাতে নিয়ে দেয়াল হাতড়িয়ে ধীরে ধীরে বাইরে বেড়িয়ে এলো পঙ্খি। আন্দাজ অনুযায়ী ধীরে ধীরে সাবধানে পা ফেলে রান্নাঘরের দিকে এগুলো সে। অন্ধকারে তার ভীষণ ভয় করছে। দ্রুত হারিকেন টা জ্বলাতে পারলেই নিস্তার। রান্নাঘরে পা রাখতেই কারোর সাথে টক্কর লাগলো পঙ্খির। পঙ্খি আরও ঘাবড়ে গিয়ে ভয়ার্ত কন্ঠে বললো।

কে? কে এখানে??

পঙ্খির কথার প্রতিত্তোরে কোন জবাব এলো না।তবে সামনের ব্যাক্তি তখন ঘর্ষণের শব্দ করে দিয়াশলাই এর কাঠি জ্বালিয়ে উঠলো। জ্বলন্ত কাঠিটা পঙ্খির মুখের সামনাসামনি ধরলো সে। কাঠির আগুনের হলুদ আলোয় জ্বলজ্বল হয়ে উঠলো পঙ্খির ভীতু মুখখানা।

পঙ্খিও দেখতে পেল সামনের ব্যাক্তির মুখাবয়ব। অপরিচিত কোন যুবককে দেখতে পেল সে। তবে কি ইনিই সেই ইন্ধন? লোকটা কেমন অদ্ভুত দৃষ্টিতে ওর পানে তাকিয়ে আছে। হঠাৎই সে বলে উঠলো।

 

 

{ আরো পড়ুন – এক মুঠো রোদ

( মৃগতৃষ্ণা গল্পটি আপনাদের কেমন লাগলো তা কমেন্ট করে অবশ্যই জানাবেন। পরবর্তী পর্বের জন্য আমাদের সাথেই থাকুন । ধন্যবাদ।)